ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — প্রথম পর্ব

স্বপনকুমার ঠাকুরের জন্ম ১৯৬৫ সালে, পূর্ব-বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানার বুঁইচি গ্রামে। পেশায় স্কুলশিক্ষক। কৌলাল অনলাইন ও কৌলাল পত্রিকার সম্পাদক। রাঢ়বঙ্গের আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে নিয়মিত লেখালিখি করেন। রয়েছে একাধিক উল্লেখযোগ্য বই। বর্তমান কথোপকথনটি আবর্তিত হয়েছে তাঁর সম্পাদিত ‘বঙ্গে রামপূজা ও রামায়ণ সংস্কৃতি’ বইটিকে(প্রকাশসাল ২০২২) কেন্দ্র করে। কথোপকথনে স্বপনকুমারের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ প্রথম পর্ব...

তন্ময়— আপনি প্রায় তিন দশক ধরে লোকসংস্কৃতি-চর্চার সঙ্গে যুক্ত। এই দীর্ঘ সময় ধরে করা আপনার বিভিন্ন কাজ সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। বর্তমান কাজটি—যা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, ‘বঙ্গের রামপূজা ও রামায়ণ সংস্কৃতি’—সম্পাদিত বই হলেও, আপনার অন্যান্য কাজের তুলনায় খানিকটা ব্যতিক্রমী। হঠাৎ এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা মাথায় এল কীভাবে? 

স্বপনকুমার ঠাকুর— আমি একটু সংক্ষেপে ব্যাকগ্রাউন্ডটা বলি, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে, আমার কাজের ধারার সঙ্গে কীভাবে এই ব্যাপারটা যুক্ত হল। আমি যেখানে মানুষ হয়েছি, অর্থাৎ আমার যেটা গ্রাম—আমি মূলত শহর কাটোয়া থেকে ১৪ কিলোমিটার এবং মঙ্গলকোট থেকে ১৩ কিলোমিটারের মধ্যবর্তী এক গ্রামে বসবাস করি—সেই গ্রামেই আমার বাল্য-কৈশোর-যৌবন—অর্থাৎ চাকরি পাওয়ার আগে পর্যন্ত জীবন কেটেছে। স্বাভাবিকভাবে আমার প্রথম জীবনে, যেহেতু বাড়িতে একটা সাংস্কৃতিক আবহ ছিল—সাহিত্যচর্চা, তার সঙ্গে গান-বাজনা, রামায়ণ গান, তার সঙ্গে অভিনয় করা—এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে একদম ছোটো থেকে জড়িয়ে ছিলাম। আমি গল্প লিখতাম, কবিতা লিখতাম, যাত্রাপালার স্ক্রিপ্ট করতাম। আমাদের গ্রামটা ছিল অত্যন্ত প্রাচীন একটি প্রত্নসমৃদ্ধ গ্রাম এবং মঙ্গলকোটের সমসাময়িক। সেখানে খুব বড়ো একটা প্রত্নডাঙা ছিল। সেই ডাঙা থেকে বিভিন্ন প্রত্নদ্রব্য বেরিয়ে আসত। এসবে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ অনুভব করিনি তখন। সম্ভবত তখন ৯২-৯৩ সাল। এমএ করছি তখন। একদিন হঠাৎ করে ওই ডাঙাতেই, বেশ বারো-চোদ্দো বিঘে জুড়ে—সেখানেই ছিল আমাদের আড্ডাখানা, বন্ধুবান্ধব মিলে আড্ডা দিতাম—ওখানে হঠাৎ করে একজন আমাকে বলল, বিনয় ঘোষের ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ বইটা একটু পড়ে দেখিস তো। আমি বললাম কী নিয়ে লিখেছেন? তো বলল, এইসব গ্রাম-টাম নিয়েই লেখা, আমরা তো গ্রামের লোক, তাই পড়ে ভালো লাগল, তোরাও এই বিষয়টা নিয়ে একটু পড়িস। তো ওই বইটা পড়ার পর থেকে আমার ভিতর থেকে জাগরণ এল। যে জিনিসপত্রগুলো দেখছি চোখের সামনে, যেগুলোকে ফেলে দিয়েছি অবহেলা করে—বইটা পড়ার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ সংস্কৃতির প্রত্ন অন্বেষক হয়ে উঠি। প্রত্নদ্রব্য সংগ্রহ করতে থাকি। এবং একের পর এক জনপদ সমীক্ষা ওই সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে আমার শুরু হয়। যেটা আজও চলছে। 

এই চলতে চলতে বিভিন্ন জায়গায় গেছি, বিভিন্ন গ্রামে গেছি। এখনও পর্যন্ত আমার ঘোরা গ্রামের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন শতাধিক। রাঢ়বঙ্গের অত্যন্ত প্রাচীন সব গ্রাম। আমার প্রচুর প্রত্নদ্রব্যের কালেকশনও রয়েছে। যার মধ্যে ব্রাহ্মী লিপির ইনস্ক্রিপশন আছে, অনেক ধরনের নিওলিথিক টুলস আছে—কারণ ওগুলো আমার অধিকাংশই গ্রাম থেকে পরবর্তীকালে আবিষ্কার করা। বিভিন্ন জনপদ—মূলত বর্ধমান, খানিকটা মুর্শিদাবাদ, খানিকটা নদিয়া, বীরভূম—যখন ঘোরাঘুরি করতে শুরু করি এবং গ্রামগুলোর ইতিহাস, সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি—এগুলো যখন পরপর সংগ্রহ করতে থাকি, তখন দেখি সেখানে রামচন্দ্রের মূর্তিও পুজো হচ্ছে। টেরাকোটা মন্দিরের মধ্যেও রামচন্দ্রের ফলক দেখছি, শিলারূপে পুজো হচ্ছে—দেখেছি তা-ও। আবার অনেক গ্রাম আছে যেখানে রামচন্দ্রের গানবাজনা হত—আমাদের গ্রামেই যেমন রামায়ণের দল ছিল, সেখানে রামচন্দ্রের গানবাজনা শুনেছি, দেখেছি। এদিকে, এই কাজটা করার আগে, বিভিন্ন কাগজে দেখেছিলাম রামচন্দ্র নিয়ে অদ্ভুত একটা রাজনীতিকরণ চলছে—যেখানে বলছে রামচন্দ্রের প্রভাব নাকি পরবর্তীকালের, অনেক অর্বাচীন। তখন আমার মনে হল যে, বাস্তবতাটা দেখানো দরকার। রামচন্দ্র রাজনীতির বিষয়, সেটা আলাদা। কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কীভাবে রামচন্দ্রের সংস্কৃতি বা রামায়ণ আমাদের জীবনের পাকে পাকে জড়িয়ে আছে—সেইটা আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করল। যেহেতু আমি দীর্ঘদিন বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে পরিক্রমা করেছি, আমার কাছে রামচন্দ্র সম্পর্কে অনেক তথ্য টোকা আছে। তখন তো আর বুঝিনি যে, রামচন্দ্র নিয়ে কোনোদিন কাজ করব! তো তখন আমার মনে হল, এটাই একটা উপযুক্ত সময়। 

আমাদের দেশের সবচেয়ে যেটা দুর্ভাগ্যের বিষয়, যাঁরা তথাকথিত পণ্ডিত বলে মান্য, সারস্বত পণ্ডিত—দেখি তাঁদের লেখার সঙ্গে ফিল্ডের কোনো যোগ নেই। ফলে আমার মনে হয়েছে, তাঁদের লেখা অনেক একপেশে। তাঁরা শুনে লিখেছেন। প্র্যাক্টিক্যাল ফিল্ডে যাওয়া এবং তারপর পড়াশোনা করে লেখা—এই জিনিসটার ভীষণ অভাব আমি উপলব্ধি করি। তারপরই আমার মনে হয়, রামচন্দ্র নিয়ে একটা বইয়ের পরিকল্পনা করা দরকার। যেটার মধ্যে অন্ততপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছুটা জায়গায় রামচন্দ্রের গ্রাউন্ড রিয়্যালিটিটা কীরকম, সেটা পাঠকের কাছে হাজির করতে হবে।

আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার:  অলোক সরকার — প্রথম পর্ব

তন্ময়— বাংলার অনেকেরই একটা ধারণা আছে যে, অন্যান্য দেবদেবীরা বাংলায় যত-না পূজিত, রামচন্দ্রের পূজা সেই তুলনায় অনেকটাই কম। আমাদের ছড়া-কবিতা-পাঁচালি কিংবা দৈনন্দিনতাতেও রাম আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছেন। কিন্তু সামাজিক উৎসব হয়ে ওঠার নিরিখে রামভজনা কি সার্বিকভাবে পিছিয়ে নেই?

স্বপনকুমার ঠাকুর— ওয়াটসন সাহেবের একটা বই আছে, শ্রীরামপুর মিশন থেকে বেরোয়, ‘দ্য হিন্দুস’—দুটো ভলিউমে বইটা লেখা হয়, ১৮১৫-তে একটা, ১৮১৮-তে একটা। এই বই পড়ে আমার সন্দেহ ঘুচে যায়। নইলে আমারও মনে সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। বাংলায় রামচন্দ্রের সেইভাবে কোনো উৎসব আমরা দেখতে পাচ্ছি না কেন? তবে কি প্রাচীনকালে কোথাও কি কোথাও একটা লিঙ্ক গ্যাপ হয়েছে? এই বইটা পড়ার পর আমার চোখটা খুলে গেল। সেখানে রামচন্দ্র সম্পর্কে অনেক তথ্য দেওয়া আছে। এখন ১৮১৫ আর ১৮১৮-তে এই খণ্ডদুটো প্রকাশিত হয়, তার মানে হচ্ছে, আগেকার বেশ কয়েকটা শতকের হিসেব ওই বইটার মধ্যে রয়েছে। দেখা গেল, বইটায় রামচন্দ্র সম্পর্কে অনেক তথ্য দেওয়া আছে। এক, বলা হচ্ছে, রামচন্দ্রের প্রচুর মৃন্ময় মূর্তি পূজিত হয়। দুই হচ্ছে, রামচন্দ্রের দোল উৎসব হয়। তিন, রামচন্দ্রের মূর্তিপুজো ব্যতিরেকে রামের জন্মদিবস উপলক্ষে সে-সময়কার লোকেরা দোকানে হালখাতা পর্যন্ত করত। কিন্তু হিন্দু সংস্কৃতির দিক থেকে আমার যেটা মনে হয়েছে, বাংলায় আমাদের গ্রাস করেছে কৃষ্ণ অবতার। কৃষ্ণ অবতারের পুজোটা শ্রীচৈতন্যদেবের হাত ধরে ব্যাপকভাবে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। সেখানে কৃত্তিবাসের আমল থেকে তৈরি করা যে রামভক্তিটা ছিল, সেটা কৃষ্ণভক্তি আত্মসাৎ করেছে। যে কারণে এখানে একটা ফাঁক রয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়েছে।

আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: অলোক সরকার — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— ঠিক। আমার একটা প্রশ্ন আপনার এই কথার সূত্র ধরেই আসছে। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের প্রাবল্য আসে চৈতন্য-নিত্যানন্দের হাত ধরে। তার আগে এই বঙ্গদেশে রাম-ভজনা এবং তার পরবর্তীকালে রাম-ভজনা—এই দুইয়ের মধ্যে ফারাকটা কী?

স্বপনকুমার ঠাকুর— এটা খুবই ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন। রামচন্দ্রের সম্পর্কে আগে যে-ধারণাটা ছিল, রাম ভক্তিবাদটা—অর্থাৎ, রামচন্দ্র কিন্তু ভক্তিবাদের আশ্রয়ে পূজিত হচ্ছেন। রামচন্দ্রের প্রথম পরিচয়ই হচ্ছে, তিনি একজন রাজা। কেমন রাজা? মানুষের, সর্বপ্রজার সুখ-দুঃখের তিনি অংশীদার, এমন একজন রাজা। এরকম রাজা তো আমাদের ইতিহাসেও মান্যতা পেয়েছে। অশোককে আমরা যেমন মেনেছি। তা এমন একটা রাজা, সেই রাজাকে কৃত্তিবাসের চোখ দিয়ে দেখানো হল যখন, তাঁর শৌর্য-বীর্য কিন্তু কৃত্তিবাস গ্রহণ করেননি। মানে, গ্রহণ করেছেন ঠিকই, কিন্তু তার প্রকাশটা করেছেন ভক্তিরসের মধ্যে দিয়ে। তো এই প্রাক-চৈতন্যযুগের যে ভক্তিরস, সেই ভক্তিরসের আধারেই মূলত এই বিগ্রহগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দুই হচ্ছে, যে ভক্তিবাদ পরবর্তীকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম পুরোপুরি গ্রাস করে নিয়েছে। কারণ আমরা জানি, রূপ-সনাতনের এক ভাই ছিলেন রামভক্ত, তারপর আমরা এটাও দেখেছি যে, মুরারি গুপ্ত স্বয়ং রামভক্ত ছিলেন। যদিও চৈতন্যদেব এত বড়ো মাপের মানুষ ছিলেন, কখনোই উনি বলেননি যে তুমি রাম-ভজনাটাকে ছেড়ে দিয়ে কৃষ্ণপূজা করো। কিন্তু চৈতন্য এমনই একটা অমোঘ টান, যে-ই তাঁর কাছাকাছি যাচ্ছে, তাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে নিচ্ছেন। সবকিছু ভুলে গিয়ে, তিনি যে-পথে যাচ্ছেন, মানুষ সেই পথের পথিক হয়েছে চৈতন্যোত্তর যুগ থেকে। ফলে এটা বলা ভালো, গৌড়ীয় বৈষ্ণব বলতে যেটাকে বলা হচ্ছে, সেটার মধ্যে শুধু চৈতন্য-আশ্রিত ধর্ম নয়, তার মধ্যে ঢুকে আছে আমাদের রামভক্তিবাদ। তার আগের বিপুল পরিমাণে বিষ্ণুপুজোর রীতি, যা রাঢ়বাংলাতে ছড়িয়ে পড়েছিল, এখনও পর্যন্ত যে-সব মূর্তি পাওয়াটা একটা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে—সেই ভক্তিবাদও এর মধ্যে ঢুকে আছে।

আরেকটা জিনিস উল্লেখ করা দরকার ভীষণভাবে। আমরা ফিল্ড করতে গিয়ে একটা জিনিস দেখেছি। গৌড়বাংলায় যেভাবে চৈতন্যধর্ম প্রভাব বিস্তার করেছিল, পূর্ববঙ্গে সেই অর্থে করতে পারেনি। করতে পারেনি বলেই অধিকাংশক্ষেত্রে—যেমন শান্তিপুরে রামচন্দ্রের যতগুলো ঘরানা আছে সবই পূর্ববঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কিত। দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর যখন ওরা পূর্ববাংলা থেকে আমাদের পশ্চিম বাংলায় চলে এল, তখন সবচেয়ে যেটা ক্ষতি হয়েছে যে, পূর্ববঙ্গে চৈতন্যের গ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়া যে রামভক্তিবাদ, সেটাও কিন্তু এখানে নিয়ে এসেছে তারা। বিশেষ করে হুগলি আর নদিয়াতে। যদি দেশ বিভাজন না হত, তাহলে আমরা রামচন্দ্রের ভক্তিবাদের আরেকটা ভিন্নতর আঙ্গিকগত রূপ দেখতে পেতাম পূর্ববঙ্গে।

আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: বিশ্বজিৎ রায় — প্রথম পর্ব


তন্ময়— আপনার এই প্রসঙ্গ ধরেই বলছি, গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের যে প্রাবল্য এল চৈতন্যের পরে, তার পাশাপাশি বিষ্ণুর দশাবতারের একজন রাম—সেই তত্ত্বও কি কোথাও রাম-ভজনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেয়েছে বাংলায়?

স্বপনকুমার ঠাকুর— হ্যাঁ, অবশ্যই গুরুত্ব পেয়েছে। অবতারবাদের তালিকায় দশটা অবতার আছে ঠিক কথাই। কিন্তু আমাদের দেশের যেটা প্রথম ঘটল, বৌদ্ধধর্মটা পুরোপুরি গ্রাস করা হল। যে-কারণে বুদ্ধ হয়ে গেলেন অবতার। ঢুকে গেলেন অবতারের তালিকায়। কিন্তু অবতারের তালিকায় যখন গৌতম বুদ্ধ ঢুকলেন, তখন কি আলাদা করে বুদ্ধপুজো হয়েছে? হয়নি তো। আলাদা করে কি বুদ্ধপুজো হিন্দু সংস্কৃতির প্রতিটা বাড়িতে হয়? হয় না তো…


তন্ময়— কোনো অবতারেরই বোধ হয় আলাদা করে সর্বজনীন পুজো হয়নি।

স্বপনকুমার ঠাকুর— তার কারণ হচ্ছে, অবতারগুলো এক-একটা যুগে জনপ্রিয় হয়েছে। এক-একটা অঞ্চল বিশেষে জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলায়, বিষ্ণুর—বিষ্ণু তো আর অবতার নয়, বিষ্ণুই বিপুলভাবে পূজিত হতে লাগলেন। একসময় সর্বভারতীয় স্তর থেকে কাঠামোগতভাবে উৎসারিত হয়ে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল বিষ্ণু উপাসনা। সেটা কিন্তু অবতারবাদ নয়। অথচ, অবতারবাদ তখন থেকেই শুরু হয়েছে। পরে দেখা গেল, সেটা কিন্তু ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। চৈতন্যদেব ও তাঁর অনুগামীরা বিষ্ণুর যে অবতার—কৃষ্ণ—সেই কৃষ্ণকে নিয়েই উপাসনা শুরু করলেন। এখন তো কৃষ্ণরাজই চলছে। কিন্তু, ঐতিহাসিক দিক থেকে কখনোই বলা যাবে না বাংলায় অবতারবাদ ছিল না, কারণ আমরা এখানে বরাহ অবতারের মূর্তি পেয়েছি। তাই না? কিন্তু সেটা কোনোদিন সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। একটা যুগে ছিল। যেমন বিষ্ণুপুজোটা যখন ছিল…

আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: বিশ্বজিৎ রায় — দ্বিতীয় পর্ব


তন্ময়— সেন আমলে বিষ্ণুই রাজত্ব করেছেন।

স্বপনকুমার ঠাকুর— ঠিক। তারপর দেখা গেল, মহাপ্রভু যখন দ্বিভুজ কৃষ্ণের উপাসনাটা শুরু করলেন বিপুলভাবে, সেইটা জনমানসে ছড়িয়ে পড়ল। এবং দেখাদেখি হল কী? রামচন্দ্রের নিজস্ব যে আইডেনটিটিগুলো ছিল, সেগুলো হারিয়ে গেল। দেখা গেল, কৃষ্ণের দোলের সঙ্গে রামের দোলও মিশে গেল।


তন্ময়— রামচন্দ্রকে পুজো করার সময়, তাঁর মূলত দুটো রূপ প্রাধান্য পায়। শুধু বাংলায় নয়, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে। একটা হচ্ছে, রামের প্রজাপালক রূপ—প্রজাপালক রাম, আরেকজন হচ্ছেন যোদ্ধা রাম। বাঙালি কোন রামকে সবচেয়ে বেশি আপন করে নিয়েছে?

স্বপনকুমার ঠাকুর— এটা সত্যিই খুব ইন্টারেস্টিং। বাঙালি রাম-ভজনার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য দেখিয়েছে বেশি। আমি যত মূর্তি রামচন্দ্রের দেখেছি, তাকে কয়েকটা বিভাগে যদি বিভক্ত করি তাহলে দেখব, রামচন্দ্রের হাতে তির আছে, ধনুক আছে, কিন্তু তিনি উপবিষ্ট। আবার দাঁড়ানো রামচন্দ্র, তির-ধনুক—অর্থাৎ, যোদ্ধাবেশেও বাঙালি পুজো করত রামচন্দ্রকে। দ্বিতীয়ত, তিনি প্রজাপালক রাজা। অর্থাৎ, যেটাকে রাম দরবার বলা হয়—

আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — প্রথম পর্ব

তন্ময়— যেখান থেকে আসছে, সুশাসনের অঙ্গাঙ্গী হল রামরাজত্ব…

স্বপনকুমার ঠাকুর— ঠিক, সুশাসনের একটা প্রতীক আসছে। আবার, এটারই একটু ভিন্নতর রূপ দেখছি। পুরোপুরি দরবার নয়। সেখানে হনুমান আছেন, সেখানে রামচন্দ্র আছেন, তাঁর গোঁফ আছে, তাঁর স্ত্রী আছে মাথায় ঘোমটা দিয়ে, তাঁর ভাই আছে পাশে দাঁড়িয়ে—ফলে বাংলার রামচন্দ্রের উপাসনার এই বৈচিত্র্যগুলো এক-একটা সামাজিক ঐতিহাসিকতাকে নির্দেশ করে। কেমন? যেমন আমি যদি দেখি, যে-যোদ্ধারূপে যেমন তাঁর পুজো হচ্ছে, তেমনই আমাদের যেমন একটা একান্নবর্তী সংসার ছিল, যে-সংসারে বাবা মারা যাওয়ার পর বড়ো ভাই হচ্ছে সংসারের কর্তা, ছোটোভাই হচ্ছে তাঁর আজ্ঞাবহ, বৌদি হচ্ছেন মাতৃসমা। এই একান্নবর্তী জীবনটারই একটা প্রতীক এইধরনের রামচন্দ্রের উপাসনা। আমার অন্ততপক্ষে এমনটা মনে হয়েছে। সে-জীবনটা হারিয়ে গিয়েছে বলেই আমরা এই দিকটা দেখতে পাচ্ছি না। দাদা বসে আছে, পাশে ভাই—একটা অখণ্ড সমাজজীবনের ছবি। যেটা রবীন্দ্রনাথ ধরেছিলেন খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে, যে, রামকথা হচ্ছে আমাদের ঘরের কথা। এই ঘরের কথার আরেকটা রূপ আমি রামপুজোর মধ্যে দেখেছি। 

আরেকভাবেও উপাসনা হয়—শিলারূপে। এই যেমন, রামকৃষ্ণদেরই পরিবারেই শিলারূপে রামপুজোর রীতি ছিল। এটা বিশেষত ব্রাহ্মণদের মধ্যেই ছিল। তারপর আমাদের কলকাতার জানবাজারের রানি রাসমণিদের ছিল। তাছাড়াও এমন অনেক জায়গায় দেখেছি এখনও আছে। আমার ডাইরি খোঁজ করলে দেখা যাবে, অন্ততপক্ষে দশ থেকে পনেরোটা জায়গায় দেখেছি যে রামচন্দ্রের শালগ্রাম শিলারূপে পুজো হয়। যিনি একটু ইতিহাস বোঝেন তিনি বুঝবেন, এই যে ফ্যামিলি ট্র্যাডিশনের যে-পুজো, সেখানে বড়ো বড়ো রামচন্দ্রের বিগ্রহ পুজো হত। ঠিক যেমন বিষ্ণুবিগ্রহের পুজো করত মানুষ। বিষ্ণুবিগ্রহ থেকে ক্রমশ নারায়ণ শিলায় রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যে যেমন ইতিহাসের অনেক তাপ-উত্তাপ এবং যন্ত্রণার কথা আছে, ঠিক এখানেও তেমনই রামচন্দ্রের মূর্তি না-পাওয়ার কারণ একটা এটাই। রামচন্দ্রের মূর্তি ওই বিষ্ণুমূর্তির মতোই ভাঙাচোরা হয়েছে, বিপর্যস্ত হয়েছে, নষ্ট হয়েছে। ফলে, আর রিস্ক না নিয়ে, তাঁরা কনভার্ট করেছেন শিলাতে। সেই শিলাই নারায়ণ-রূপে পূজিত হচ্ছে। 

আবার এটা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে দুরকমভাবে আমরা দেখতে পাই। আমরা দেখতে পাই, বাঙালি বহু সর্বভারতীয় তীর্থস্থানে গিয়েছে। সেখানে ঘুরে এসেছে। সেই তীর্থ করতে যাওয়াটা, প্রাচীনযুগের ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যায়, বাঙালি দলে দলে তীর্থ করতে যেত। আবার সেই তীর্থ করতে অযোধ্যায় গিয়ে প্রভাবিত হয়েছে, সেখান থেকে রামচন্দ্রের কোনো স্মৃতি নিয়ে এসে বাড়িতে পুজো শুরু করেছে। পাশের গ্রাম—আমাদের এখানেই আছে, শ্রীখণ্ড। শ্রীখণ্ডের একটা পরিবারের ইতিহাসই হচ্ছে, ওঁরা অযোধ্যা গিয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে মোটিভেটেড হয়ে, সেখান থেকে আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হিসাবে রঘুনাথ শিলাকে সংগ্রহ করে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন। আবার এটাও দেখা গেল, আমাদের তো বারবার জীবিকাগত কারণে অভিবাসন করতে হয়েছে, তেমনই উত্তরপ্রদেশের অনেক লোক, উচ্চবর্ণের লোক—তাঁরাও এসেছেন। তাঁরাও রামচন্দ্রের স্মৃতি নিয়ে, রামচন্দ্রের বিগ্রহ নিয়ে—বিশেষত আখড়াগুলো, রামায়ত আখড়া, তাঁরা তো প্রচারক, তা সেই রামায়ত আখড়াগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। এদেশে এসে তাঁরা অস্থলগুলো তৈরি করেছেন। বহু বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি রয়েছে এর পিছনে। তার জন্যই আমি বলেছিলাম, গ্রাউন্ড রিয়্যালিটিটাকে এখন দেখানো ভীষণভাবে দরকার। এবার পাঠক সিদ্ধান্ত নেবেন কী আছে, না-আছে। অঞ্চলে অঞ্চলে তাঁর রূপ, কী তাঁর ইতিহাস, কী তাঁর লোকসংস্কৃতি, কী তাঁর পুজোর পদ্ধতি—এই বিভিন্ন দিকগুলো ধরার জন্যই এই বইটা করার পরিকল্পনা মাথায় আসে আমার।

আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— এই প্রসঙ্গ থেকেই আমার পরের প্রশ্ন। বাংলার গত সাতশো-আটশো বছরের ইতিহাস দেখলে, বিশেষত রাঢ়বঙ্গে যে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জমিদারির পত্তন হয়েছিল, সেই জমিদারদের অনেকেই কিন্তু পরিচয়গত দিক থেকে প্রাথমিকভাবে বাঙালি ছিলেন না, বাইরের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে এসে জমিদারি শুরু করেন। তাঁদের বাইরের থেকে আসাই কি কোথাও বাংলার রামভজনাকে প্রতিষ্ঠানিকভাবে ছড়ানোর সুযোগ দিয়েছিল?

স্বপনকুমার ঠাকুর— এটা হয়তো আংশিকভাবে সত্য। কিন্তু আমরা যদি পুরনো লিপিমালা দেখি, পুরনো কপার প্লেটগুলো দেখি, তাতে দেখতে পাব—ঐতিহাসিক রাজাদের ক্ষেত্রে, ধর্মপাল কিংবা লক্ষ্মণ সেন কিংবা তাঁর আগে বল্লাল সেন বা তাঁরও আগে অনেকে—এঁদের যে তাম্রফলক, তাঁদের যে কবি বা যিনি এই লিপিমালা বা প্রশস্তিটা লিখছেন, সেখানে অনিবার্যভাবে রামচন্দ্রের উপমা তাঁকে নিয়ে আসতে হচ্ছে সেই রাজার সম্পর্কে। যেহেতু রামচন্দ্র হচ্ছেন রাজা এবং আদর্শ রাজা। শুধু রাজাই নন, আদর্শ যুবরাজ, আদর্শ রানি, আদর্শ সেনাপতি। রামচন্দ্রের রানি হচ্ছেন সীতাদেবী, যুবরাজ এবং প্রশাসনের অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছেন লক্ষণ। রাজা যেটা আদেশ করছেন, সেটাকে পালন করার জন্য, বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি যেন দাঁড়িয়ে আছেন। যে-কারণে আমরা দেখতে পেলাম, রামায়ণের এই দৃশ্যটা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করল স্থানীয় জমিদারদের টেরাকোটা মন্দিরের লিপিতে। টেরাকোটার আলোকে দেখলে, কেন সেখানে রামায়ণ লিপিবদ্ধ হবে? এরা তো স্থানীয় জমিদার! বহু প্রাচীনকাল থেকে, আমাদের রাজন্যতন্ত্রের যে ধারণা—সেই ধারণার মধ্যে কিন্তু রামচন্দ্র-কেন্দ্রিক এই রাজন্যতন্ত্রের একটা আবছা স্মৃতি তাঁদের মনের মধ্যে চলে এসেছে। কেমনভাবে? না, রামচন্দ্র হলেন প্রজাপালক। প্রজাদের জন্য তিনি নিজের স্ত্রী—যে স্ত্রীর জন্য তিনি সারাজীবন পণ করলেন, সেই স্ত্রীকে পরিবর্তন করতে বিন্দুমাত্র আক্ষেপবোধ করলেন না। এই যে রাজ-কর্তব্যের দিকটা রামচন্দ্রের তো একটা সাংঘাতিক দিক। এটা একটু উল্টিয়ে ব্যাখ্যা করি আমরা, এখনকার বুদ্ধিজীবীরা করে আরকি। কিন্তু একজন সত্যিকারের শাসক জনগণের জন্য তাঁর ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াটাকে বলি দিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেননি—রামচন্দ্রের এই ঘটনাটা কিন্তু ভীষণভাবে প্রতীক বা সিম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যে-কারণে ওই লিপিমালা থেকে শুরু করে মন্দিরে রামের উল্লেখ। অধিকাংশ মন্দিরের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কিন্তু আঞ্চলিক জমিদাররা বা রাজারা—সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই বাইরে থেকে এসে যাঁরা জমিদারি করছেন, তাঁরা তো করবেনই, তাঁদের তো ওটা একটা প্রধান রীতি, আমাদের এখানে যেমন কৃষ্ণ উপাসনাই প্রধান। কিন্তু ওঁদের জন্য যে পুরোটা, তা নয়। এটা সর্বভারতীয়। এই টিউনটা আমাদের বাংলাতেও দেখা গিয়েছে, বাংলাতে বরং তাঁর বৈচিত্র্যটা বেশি দেখা গিয়েছে।

আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — প্রথম পর্ব

তন্ময়— আমার অন্যান্য কাজের সূত্রে এবং আপনার এই বইটির পড়েও মনে হয়েছে, গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় রাঢ়বঙ্গের রন্ধ্রে রাম বেশি ছড়িয়ে আছেন। আপনার কি তেমনটা মনে হয়?

স্বপনকুমার ঠাকুর— হ্যাঁ, আমি তো বললাম যে, রামচন্দ্রের যে ধারাটা, রামচন্দ্রের বিগ্রহকেন্দ্রিক যে ধারা—সেটা কিন্তু পূর্ববঙ্গের ইতিহাস। হিন্দু-সংস্কৃতি লোপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বিলুপ্ত হয়েছে। তার একটা ফসিল বা জীবাশ্ম রূপে গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গে পাওয়া যায়। যেহেতু তারা দেশভাগের পর চলে এসেছে এ-দেশে, তেমন কিছু কিছু মূর্তি, যেমন শান্তিপুর ঘরানা ও ইত্যাদি আরও কিছু কিছু রয়েছে। কিন্তু এটা একদম সঠিক যে, রামচন্দ্রের রামায়ণকেন্দ্রিক যে প্রভাব, সেটা রাঢ়বাংলাতেই বেশি। শুধু তাই নয়, রাঢ়ের যোগাদ্যা—সেই যোগাদ্যাতে রামায়ণদান অবশ্যম্ভাবী। সেখানে মহীরাবণ প্রসঙ্গ রয়েছে। পাতাল থেকে মহীরাবণের খপ্পর থেকে চামুণ্ডাকে বা যোগাদ্যাকে তুলে নিয়ে এসে মর্ত্যের মাঝখানে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়ে… এটা তো বহু প্রাচীন একটা ধারা। রাঢ়বঙ্গের অন্যতম এক কাব্য, যেটা ন্যাশনাল এথিক অফ রাঢ়ও বলেছে, ধর্মমঙ্গল—সেই ধর্মমঙ্গলের পালাতেও হনুমান সেখানে একটা ক্যারেক্টর, এই হনুমান বজরঙ্গবলী হনুমান নয়, কিন্তু হনুমান একটা আলাদা ক্যারেক্টর রূপে এসেছে।

আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— হ্যাঁ, সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। কিন্তু পূর্ববঙ্গ বাদ দিলাম, গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গে কেন রাম অতটা প্রাধান্য লাভ করলেন না? তার কারণ কী? এখানে প্রায় ছশো বছর ধরে চৈতন্যের প্রভাব রাঢ়বঙ্গের থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল বলে?

স্বপনকুমার ঠাকুর— শক্তিশালী তো হয়েছেই। তার কারণ হচ্ছে, মেইনস্ট্রিমের যে প্রাক-বৈষ্ণব, পৌরাণিক বৈষ্ণবধর্ম, সেটা বাংলায় কিন্তু ব্যাপকভাবে ছিল, তার প্রমাণ হচ্ছে বিষ্ণুমূর্তিগুলোর উপস্থিতি। দ্বিতীয়ত, পাশাপাশি দুটো মেইনস্ট্রিমের ধর্ম লোপ পাচ্ছে। একটা হচ্ছে জৈন ধর্ম, অন্যটা বৌদ্ধধর্ম। তাঁরা গেলেন কোথায়? তাঁরা গিয়ে ঢুকেছেন চৈতন্য-আশ্রিত ধর্মে। কারণ তাঁদের যে প্রধান টিউন, অহিংসা—সেটা তো দুটো ধর্মেরই বেসিক কথা, চৈতন্যের সঙ্গে তো তার যোগ আছে। ফলে চৈতন্যের পর থেকে র্যা পিডভাবে রাঢ়বঙ্গ এবং গোটা দক্ষিণ বাংলা জুড়ে বিপুলভাবে বৈষ্ণবদের দাপট দেখা দিল। উদাহরণ কী আছে? রাঢ়ের অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে সতীপীঠ এবং ক্ষীরগ্রাম। কিন্তু ক্ষীরগ্রামে গিয়ে যেটা দেখবেন সেটা হচ্ছে একটা মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি, যেটা নবীন ভাস্কর বানিয়েছেন, ওই ১৮৫০-৯০-এর দিকে। কিন্তু অরিজিনাল মূর্তি কি? কোনো অরিজিনাল মূর্তি নেই। তার কারণ হচ্ছে, এটা মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। অবাক-করা কাণ্ড, সেখানে তিনটি বিষ্ণুমূর্তি আছে। এই বিষ্ণুমূর্তিগুলোর নির্মাণকাল হচ্ছে, দশম-একাদশ শতক। সেখানে ভাগবত-এর অনুলিপি পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে ক্ষীরগ্রামের মতো একটা জায়গায় আর্টিফিসিয়ালভাবে একটা জনজাতির বিকাশ ঘটানো হয়েছে। সেখানে মুসলমানদের প্রতিহত করার জন্য পুরোপুরি মুসলমান বসতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাঢ়ের ক্ষত্রিয়, বিশেষ করে উগ্র ক্ষত্রিয়রা নানাধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করছেন দেবীকে রক্ষা করার জন্য। গোটাটাই আমি ফিল্ড করেছি, একদম দক্ষিণ বর্ধমান পর্যন্ত। এটা তো পুরো শাক্তবলয়, একদা সেখানে নরবলি দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে। কারণ এগুলো মুসলিম আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য তৈরি করেছিল। পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম ইসলামিক মুভমেন্ট হওয়া উচিত ছিল, সেটা পূর্ববঙ্গের দিকে গেল কেন? এদিক থেকে মুভমেন্ট ঘোরানো হল কেন? এদের জন্যই। অ্যাকচুয়ালি এগুলো সব বৈষ্ণব বেল্টের। তাহলে বিষয়টা হচ্ছে, এটা যোগাদ্যাতন্ত্র যেই ঢুকে গেল, তখনই রামচন্দ্রের কাহিনিটা চলে এল। আর প্রথম লোককাহিনিটা যিনি লিখলেন, তিনি হলেন কৃত্তিবাস ওঝা।

(পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব)

অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor