শুভদীপ চক্রবর্ত্তীর জন্ম ১৯৮৭ সালে, বাটানগরে। বর্তমানে একটি বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। এই ঈর্ষাক্ষাৎকারটি আবর্তিত হয়েছে তাঁর ‘একটি শিশির বিন্দু: বজবজ ও বাটানগর অঞ্চলের ছুঁয়ে দেখা গল্প-কথা-রাজনীতি-ইতিহাস’ (প্রকাশসাল ২০২২) বইটিকে কেন্দ্র করে। কথোপকথনে শুভদীপের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ প্রথম পর্ব...
তন্ময়— সাধারণত দেখা যায়, বয়স প্রৌঢ়ত্বের দিকে ঝুঁকলে তবেই আঞ্চলিক ইতিহাসের মতো বিষয় নিয়ে বই লেখেন বেশিরভাগ মানুষ। সেখানে তিরিশের কোঠায় বয়স যখন, আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে কাজটা করার পরিকল্পনা জন্মাল কীভাবে? পাশাপাশি, বজবজের ইতিহাস নিয়ে এর আগেও বই লেখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বর্তমান বইটির বিশেষত্ব কী?
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— প্রশ্নটাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে নিই। প্রথম ব্যাপারটায় আসি। তিরিশের দোরগোড়ায় বা সদ্য তিরিশ পেরোনো কেউ একজন আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে ভাবছে—এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে বিষয়টা কি খুব আশ্চর্যের? আপনি, তন্ময় ভট্টাচার্য, কুড়ি পেরিয়েই ‘বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে’ বইটি লিখে ফেলেছিলেন। এছাড়াও অলোক সরকারের শ্মশান-সংক্রান্ত বইটি পড়েছি। এই দুটি বই সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানায় লেখা। আমার ব্যক্তিগতভাবে দুটোই ভীষণ পছন্দের। আর, এই সময়ে আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে একদম যে কাজ হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। ভালোই কাজ হচ্ছে। আরেকটা বিষয় যেটা বললেন, বেশিরভাগ প্রবীণেরা কাজ করেছেন, আমার কাছে একটু বিষয়টা সন্দেহের। কারণ, আমরা যখন পড়ছি, তখন তাঁরা প্রবীণ হয়ে গেছেন। তাঁরা যখন কাজ করেছেন, তখন তাঁরা আদৌ কি প্রবীণ ছিলেন? আমি জানি না তাঁদের সম্পর্কে বিশেষ। কিন্তু আমি যখন আপনার নেওয়া কমল চৌধুরীর ইন্টারভিউ পড়লাম, অবিভক্ত ২৪ পরগনার ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন, উনি আদৌ তখন প্রবীণ ছিলেন না।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — প্রথম পর্ব
তন্ময়— তখন ওঁর চল্লিশ-পঞ্চাশের ঘরে বয়স।
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— হ্যাঁ। আমার যেটা মনে হয়, আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে এই কাজগুলোর ক্ষেত্রে—যদি কাউকে জায়গায় জায়গায় ঘুরে কাজটা করতে হয়, সেই কাজ যে-পরিমাণ অ্যাটেনশন বা যে-পরিমাণ শারীরিক সক্ষমতা দাবি করে, সেখানে নবীন বয়স থেকে শুরু না-করলে হয়তো সেই কাজটা সম্পূর্ণ করে ওঠা সম্ভব হয় না। বয়স বেড়ে গেলে যেটা হয়—আমি হয়তো অভিজ্ঞতা দিয়ে অনেকটা কাজ করে নিতে পারি, কিন্তু আমার শারীরিক উপস্থিতিটা কমতে থাকে।
এবার অন্য প্রেক্ষাপটে আসি। কেন আমি কাজটা শুরু করলাম? আমার আদৌ ইচ্ছে ছিল না যে আমি আঞ্চলিক ইতিহাসের ওপর কোনো বই লিখব। মানে আমার ভাবনাতেও ছিল না। আমি বিভিন্ন জায়গায় গেছি। দিনাজপুরে, মালদায়, মুর্শিদাবাদে… আমার আগের চাকরির সূত্রে। বাংলার দার্জিলিং বাদ দিয়ে তখন অবধি— মানে এক-দেড় বছর আগে অবধি—সমস্ত জায়গা ঘুরেছি। যেখানেই যাই না কেন, সমস্ত জায়গার একটা রেডি রেফারেন্স পেয়েছি। যে এই জায়গাটা আগে কী ছিল, এখন কী আছে। আমি হাতের কাছে কিছু-না-কিছু পেয়েছি। মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, দিনাজপুরের ইতিহাস, উত্তর ২৪ পরগনার ইতিহাস, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ইতিহাস—এই সবকিছু। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ২০১৯ সালের শেষ বা ২০২০ সালের শুরু— এরকম সময় আমরা একটা লিটল ম্যাগাজিন মেলা করতাম। বাটানগর বজবজ লিটল ম্যাগাজিন কার্নিভাল। সেখানে আমাদের আড্ডায় আড্ডায় একটা কথা উঠে আসে যে, আমরা এমন একটা জায়গায় থাকি, বাটানগর-বজবজ, বা আমাদের এই এলাকাটা, নঙ্গী— তো এই ‘বজবজ’ বা ‘নঙ্গী’ কেন? এর কাছাকাছি কোনো শব্দ কী আছে? কারণ খুব কমন শব্দ তো এগুলো নয়। যেমন বেলঘর থেকে বেলঘরিয়া। যদি আমি বেলঘর থেকে বেলঘরিয়া মেলাতে না-ও পারি, আমি একটা শব্দ ‘বেল’ কমন পাচ্ছি। কিন্তু বজবজের ক্ষেত্রে আমি কী কমন পাচ্ছি? কোনো শব্দ তো কমন পাচ্ছি না, ‘নঙ্গী’-র ক্ষেত্রেও নয়। এই নামগুলো কেন? আমি ভাবতাম যে, আমরা জানি না, কিন্তু কেউ-না-কেউ উত্তরটা জানে। ফলে আমরা কী করি, আমাদের কিছু সিনিয়র লোকজন, আমাদের মাস্টারমশাই, যাঁরা ইতিহাস পড়াতেন স্কুলে, তাঁদের জিজ্ঞেস করি। তাঁরা কেউ বলতে পারেন না। বাড়িতে এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করি, আমার বন্ধুর বাবাকে জিজ্ঞেস করি। তাঁরা সিনিয়র এবং প্রাজ্ঞ। তাঁরা কেউ বলতে পারেন না। তখন আমার মনে খটকা জাগে যে, একটা জায়গার নাম কেন কেউ বলতে পারছে না। এঁরা তো এতদিন ধরে থেকেছেন এখানে। প্রায় শেষ বয়সে এসে পৌঁছেছেন এঁরা। তখন আমি একটু খোঁজখবর শুরু করি। আমি জানি কোথাও-না-কোথাও থাকবেই। অনলাইনে থাকবে, নিউজ পেপারে থাকবে, কোনো-না-কোনো বইতে থাকবে। কোথাও পাই না।
তন্ময়— বজবজের আঞ্চলিক ইতিহাসের বইগুলো তখন সহজলভ্য ছিল না?
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— ওই বই খুঁজতেই আমি লাইব্রেরিতে যাই—লোকাল লাইব্রেরিতে। এই লাইব্রেরির সন্ধানের ইতিহাসটাও একটা আশ্চর্য ইতিহাস। সেটা কোভিড পিরিয়ডের ঠিক পরবর্তী সময়। দেখা যায় যে এলাকায় আর কোনো লাইব্রেরি জীবিত নেই। একমাত্র বজবজ পাবলিক লাইব্রেরি বাদ দিয়ে আর যত প্রাচীন লাইব্রেরি ছিল, সেগুলো একটাও লাইব্রেরি আর এখানে খোলা হয় না। সেগুলো কবে বন্ধ হয়েছে, কারোর জানা নেই। এবং বলে দেওয়া হয়েছে, এগুলো আর কখনও খোলা হবে না। এইসব লাইব্রেরিতে আমি একাধিকবার যাই, ঘণ্টা দুই-তিনেক লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে— দুপুর দুটো থেকে পাঁচটা অবধি, সকাল দশটা থেকে দুপুর একটা অবধি—বিভিন্ন টাইম স্প্যানে, যে কখনও-না-কখনও তো সেটা খোলা হবে। লাইব্রেরিগুলো দিনের পর দিন খোলা হয় না। ওগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে বলি, বজবজের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে যেসব বই আছে, ওই বইগুলো দিন। ওঁরা খুব আশ্চর্য হয়ে বললেন, বইগুলো আর নেই। ‘নেই’ মানে কী হতে পারে? কোথাও-না-কোথাও তো থাকবে, আপনারা খুঁজে রেখে দিন আমি পরের দিন আসব। তো বলেন, বইগুলো ছিল কিন্তু কোভিডের সময় ইঁদুরে বা উইয়ে কেটে দিয়েছে। এটা আমার কাছে প্রচণ্ডরকমের আশ্চর্য ব্যাপার, যে একটা আঞ্চলিক ইতিহাসের বই… খুব সাধারণ জিনিসই তো চেয়েছি! যে-এলাকার লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি, গভার্নমেন্ট ফান্ডেড, গভার্নমেন্ট স্পনসরড লাইব্রেরি—তাদের কাছ থেকে আমি সেই এলাকার ওপর লেখা বইগুলো চাইছি। যাই হোক, আমি সেখানে তিন-চারদিন লাগাতার যাই। তারপর ওঁরা বলেন যে, একটাই মাত্র বই ওঁদের কাছে আছে। বইটির নাম, ‘বজবজের ইতিহাস’। নকুড়বাবুর লেখা। নকুড় চন্দ্র মিত্র। এবং সেই বইটা বাদ দিয়ে ওঁদের কাছে এখন আর কোনো বই নেই।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— ওই বইটা কবে প্রকাশিত হয়েছিল?
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— নকুড়বাবুর বইটা অনেক আগের। ১৯৫০-৬০ সাল—এরকম সময়কালে লেখা। ওঁরা একমাত্র এই বইটিই আমাকে খুঁজে বের করে দেন। এক কপিই আছে ওঁদের কাছে। বইটার খুবই খারাপ অবস্থা। এবং ওখানে বইয়ের ছবি তোলা বা স্ক্যান করা বারণ। আমি বললাম, আমি বইটার ছবি তুলব। কারণ, আমি যদি একমাস পরে আসি, বইটা আর পাওয়া যাবে না তখন। হয়তো উইতে বা ইঁদুরে কেটে দেবে। এটা হয়তো একটু উদ্ধত বা অ্যারোগেন্ট শোনাতে পারে, কিন্তু আমি ততক্ষণে একমাস হেঁটে ফেলেছি, আক্ষরিক অর্থেই একমাস হেঁটে ফেলেছি একটা জায়গার নাম কেন এরকম সেই উত্তর পেতে এবং সেটার কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। তখন আমার মধ্যে একটা রোখ চেপে যায়। মানে একটা জায়গা, আমি যদি বাইরে কোথাও যাই, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তোমার জায়গাটার নাম কেন এটা, আমি বলতে পারব না! আমি তো জানি বালুরঘাটের নাম বালুরঘাট কেন। যেকোনো জায়গার নামের পেছনেও তো একটা উৎস থাকে। আমি খুবই সহজ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি যে বজবজের নাম বজবজ কেন? সেটা কেউ জানে না। এবং কারোর ইচ্ছেও হয়নি জানতে? এবং যে-জায়গাগুলোতে লেখা আছে বলছে ওঁরা— আমি নকুড়চন্দ্রের বইটা পড়ি। এছাড়াও এই এলাকার আরও কয়েকজন ইতিহাসবিদ ছিলেন— যেমন, গণেশ ঘোষ। ওঁর বেশ কিছু বই ছিল বজবজের ইতিহাস সংক্রান্ত। সেগুলো একটাও বজবজ পাবলিক লাইব্রেরিতে নেই। তারপর আমি গণেশ ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। দেখি, গণেশ ঘোষের বয়স নব্বই পেরিয়ে গেছে। এবং এই সম্পর্কে কথা বলার মতো কোনো স্মৃতিশক্তি ওঁর নেই আর। উনি কিছু মনে করতে পারেন না। ফলত, গণেশ ঘোষের সঙ্গে আমাদের দেখাও হয় না, ওঁর কোনো বই-ও আমার হাতের নাগালে আসে না।
আরও কিছু ইতিহাসবিদ আছেন, যাঁদের নাম আমি সচেতনভাবেই নেব না এখন, যাঁদের আমি লাগাতার ফোন করে যাই, দেখা করার কথা বলি। কেন আমি দেখা করতে চাইছি, সেটা জানার পর আর আমার সঙ্গে দেখা করতে চান না। আমি বলি, এই এলাকায় আমার বাড়ি, আমি জানতে চাইছি এই জায়গাটার নাম এরকম কেন, আমাকে বলা হয়েছে আপনি জানলেও জানতে পারেন, তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আপনার সন্ধানে যদি কোনো বই থাকে বা তথ্য থাকে, আমাকে জানালে খুব ভালো হয়। ওঁরা তারপর থেকে আমার আর ফোন তোলেন না। এবং জানান যে, কোভিডের জন্য ওঁরা কারোর সঙ্গে দেখা করছেন না। এটার পরে এতটাই একগুঁয়ে হয়ে যাই যে, একসময় ওঁদের বলি আমি আপনার বাড়িতে ঢুকব না, জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলব, ডবল মাস্ক পরে যাব। জানলার বাইরে থেকে প্রশ্ন করব, আপনি যতটুকু জানেন ভেতর থেকে উত্তর দেবেন। তারপর উনি আর আমাদের ফোন ধরেন না। এবং তার কিছু মাস পরে তিনি গত হন, মারা যান।
পরিস্থিতি যখন এমন, একমাত্র নকুড়চন্দ্রের ওই বইটা আমাদের নাগালে আসে। সেটা পড়ে দেখি সেখানে খুব বেসিক জিনিস লেখা আছে। বজবজ দুর্গ, কোমাগাতামারু আন্দোলন। এবং এই বজবজের নামকরণের কারণের জন্য উনি খুব ভাসা ভাসা একটা যুক্তি দিয়েছেন, সম্পূর্ণ বিষয়টার ভিতরে ঢুকতে পারেননি। হয়তো সেটা সম্ভব ছিল না সেইসময়। ওই সময়ে দাঁড়িয়ে, আমি নিজের জায়গা থেকে ফিল করলাম, ২০২১-এ দাঁড়িয়ে এই কাজটা করতে যদি এই পরিমাণ সমস্যার মুখোমুখি হই, তাহলে উনি যে-সময়ে কাজটা করেছেন, তখন কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন। আমি আমার বইতেও লিখেছি, নকুড়চন্দ্র মিত্র আমার হাত ধরেছিলেন, যখন আমি হোঁচট খাচ্ছি, তখন। সেখান থেকে আমার কাজটা শুরু হয়। এবং আমার একটা রোখ চেপে যায় এটা যে, এই যাঁরা আমার সঙ্গে কথা বলছেন না, দেখা করতে চাইছেন না— অথচ তাঁরা যে লিখছেন না, তা কিন্তু নয়। বিমলবাবু, এখন মারা গেছেন— উনি কোনো একটা লিটল ম্যাগাজিনে, বজবজের কোনো একটা পুরনো বিষয় নিয়ে লিখে গেছেন। কিন্তু সেটা কোন বিষয়, কোন লিটল ম্যাগাজিন সেটা কেউ জানে না। এবং ওঁকে বলতেও উনি মনে করতে পারছেন না। সবমিলিয়ে খুব ভাসা ভাসা, খুব ফ্র্যাগমেন্টেড কাজ হচ্ছিল, সেগুলো এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিল। সেগুলো কারোর নাগালে আসা সম্ভব ছিল না। এটা একটা অদ্ভুত মানসিকতাই বলব। যিনি যেটুকু জানেন প্রাচীন লোকেরা, তিনি সেটুকু তাঁর ভেতরে রেখে দিতে কোনো-না-কোনো কারণে সচেষ্ট ছিলেন। সেটাকে যে তিনি বাইরে আনবেন বা বলবেন, সেই সুবিধাটা আমরা তাঁদের থেকে পাইনি। পেলে হয়তো বইটা আমাকে আর লিখতেই হত না। উত্তরগুলো আমি একবারেই পেয়ে যেতাম। আমাকে হয়তো এই কাজটাই করতে হত না। আমার যেটা মনে হয়েছিল, আমি কোথাও যখন কিছু পাচ্ছি না তখন কাজটা আমিই করব। এবং ব্যাপারটা ডকুমেন্টেড করব।
বই হবে আমার কোনো ধারণা ছিল না। প্রাথমিকভাবে আমি ভেবেছিলাম যে ছবি তুলব, লিখব। আমার একটা ব্লগ আছে, সেই ব্লগ পেজে একের পর এক ঘটনাগুলো বা যে-ইতিহাসগুলো পাচ্ছি, সেগুলো লিখতে লিখতে যাব। ততদিনে খুঁজতে খুঁজতে আমি যে-ঘটনাগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, আমি যেটুকু প্রাচীন বইয়ের সন্ধান পেয়েছি, সেখানে সেই ঘটনাগুলো তখন নেই। আমি দেখছি যে, নজরুল একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ইতিহাসের। কোনো বইতে সেই বিষয়টা নিয়ে লেখা নেই। সুভাষচন্দ্র বোস নিয়ে কিছু লেখা থাকলেও, যেখানে তাঁর নামে একটা জায়গার নামই করা হচ্ছে সুভাষ উদ্যান, সেটা কেন সুভাষ উদ্যান হচ্ছে—সেই ঘটনার কারণটা কেউ বলতে পারছেন না। যাঁরা মুখে মুখে শুনে আসছেন, তাঁরা হয়তো বলছেন, কিন্তু তার পিছনের গল্পগুলো খোঁজা, এভিডেন্স জোগাড় করা, সেগুলো কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সেগুলো খুঁজতে শুরু করি এবং একটা সময় পেয়েও যাই। তখন আমি আমার বন্ধুমহলে গল্প করতাম যে, এঁরা তো আমাকে বলতে চাননি, কিন্তু কী লাভ হল, আমি তো বেরিয়ে এলাম। হ্যাঁ, অসুবিধেটা হল আমার দেড় বছর সময় লাগল খুঁজতে। কিন্তু আমি তো পেয়েই গেলাম। ওঁরা বলে দিতেই পারতেন। আমাকে ওইটুকু সাহায্য করলেই পারতেন। আমার পরিশ্রমটা একটু কম হত। এটাই ছিল প্রাথমিক। আমি বই লিখব, এরকম কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আমি সংকলন করার কথাও ভাবিনি। বজবজ এবং নঙ্গী— আমি এই জায়গাদুটোর নাম খুঁজতে চেয়েছিলাম। ওই এক খোঁজা থেকে আরেক খোঁজা, সেখান থেকে আরেক খোঁজা… এবং সেখান থেকেই আমার কাছে একের পর এক বিস্ময়, একের পর এক অধ্যায় উন্মোচিত হতে থাকে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় — প্রথম পর্ব
তন্ময়— অতএব, আপনার কাজের শুরু বা ভাবনাটাই বজবজের নামকরণের কারণ খোঁজার সূত্রে। এখানে পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল জাগবে, বজবজ নামকরণ কেন?
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— অমুক কারণেই বজবজের নাম বজবজ হয়েছে—এমন নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা মুশকিল। কিন্তু আমরা একটা ধারণায় পৌঁছাতে চেয়েছি। মানে যুক্তি দিয়ে ভেঙে ভেঙে… এবং এখন ভাবলে আমার একটু আশ্চর্যই লাগে যে, তখন এই বিষয়টার জন্য যাঁরা যাদবপুরে কম্পারেটিভ লিটারেচার পড়ছেন, তাঁদের ফোন করেছি, যাঁরা লিঙ্গুয়িস্টিক পড়ছেন, তাঁদেরও। কেন-না, আমার এইটুকু মনে হচ্ছে পরিষ্কার যে নঙ্গী বা বজবজ এগুলো বাঙালি নাম নয়। সেখান থেকেই সন্দেহটা আরও গাঢ় হয়। তারপর যত এই এলাকাটার সম্পর্কে জানতে থাকি, দেখা যায় যে এখানে একটা বড়ো পর্তুগিজ প্রভাব ছিল। ব্যবসার কারণেই। সে-ব্যবসা খারাপ না ভালো—সেটার মধ্যে এখন ঢুকছি না। কিন্তু এই এলাকায় ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্যের প্রভাব বিশালভাবে ছিল। সেটা ব্রিটিশরা আসার আগে থেকেই। বিশেষ করে পর্তুগিজদের প্রভাব এই অঞ্চলে খুবই বলিষ্ঠভাবে ছিল। তারপর শুরু হয় মুসলিমদের প্রভাব। পর্তুগিজদের আটকানোর জন্য আকবর, শাহজাহান বা আমাদের বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা—তাঁরা একটা বড়ো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
তন্ময়— না, সিরাজ-উদ-দৌলা নয়। সিরাজের অনেক আগেই পর্তুগিজরা বাংলায় ক্ষমতা হারিয়েছিল।
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— সরি, আমি গোলাচ্ছি। সিরাজের সময়ে ব্রিটিশদের আক্রমণটা শুরু হয়েছিল। এটা আরও আগে। যাই হোক, এখানে তখন পর্তুগিজরা মানুষ পাচারের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে, মগের মুলুক— মানে মগ দস্যুরা এলাকায় ইতিমধ্যে ঢুকে এসেছে, যথেচ্ছ লুটপাট করছে। পর্তুগিজদের আটকানোর জন্য তখন এই অঞ্চলে মুঘল শাসক বা মুসলিম শাসকদের প্রভাবটা বাড়ছে। ফলত এখানে ফার্সি ভাষার প্রভাবটাও বাড়তে শুরু করছে। ধরুন বজরা। এখানে তখন বড়ো বড়ো জাহাজ আসছে, বাণিজ্যিক জাহাজ ঢুকছে। সেগুলো নোঙ্গর করছে বজবজের খানিকটা আগে, দক্ষিণে। দক্ষিণ মানে এখানকার যে নঙ্গী এলাকা, সেটা। বজবজের পিছনের দিকটা। আমি যদি কলকাতার দিক থেকে এগোই, তাহলে প্রথমে পড়বে নঙ্গী, তারপর বজবজ। ওখানে নোঙ্গর করছে একটা জায়গায়, তারপর ছোটো ডিঙ্গি করে বা অন্য নৌকায় করে বজবজে যাচ্ছে। এবং ডায়মন্ড হারবারের দিক থেকে যে-বড়ো জাহাজগুলো ঢুকছে, সেগুলো আবার বজবজে এসে দাঁড়াচ্ছে। অর্থাৎ বড়ো জাহাজ ল্যান্ড করছে বজবজে এবং তুলনামূলক ছোটো জাহাজ নঙ্গীতে। নোঙ্গর থেকে নঙ্গী এবং বজরা থেকে বজবজ। এগুলো ভেঙে ভেঙে হয়তো এসেছে। হুগলি নাম যেভাবে এসেছে—‘ওগোলিম’, ‘ওগোলি’, ‘হুগলি’। ভাঙতে ভাঙতে এসেছে…
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— ওগুলো ইউরোপীয়দের উচ্চারণ-ভিত্তিক। সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্ব হল, হোগলা বনের ঝাড় থেকে হুগলি।
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— হ্যাঁ। বজবজের নামের পিছনেও এরকম একটা বাঙালি কারণ আছে। এতই কাদাময় একটা অঞ্চল আর চারিদিকে কচুরিপানা, পা দিলেই বজবজ করে শব্দ বেরোয়। এই প্রেক্ষিতে আমার একটাই প্রশ্ন— আমরা পশ্চিমবঙ্গে থাকি, চারপাশে গ্রামবাংলা, এমন তো নয় যে শুধু বজবজেই কচুরিপানার বন আছে কিংবা বজবজেই পা দিলে বজবজ করে শব্দ বেরোয়। যে-কোনো জায়গাতেই কচুরিপানায় পা দিলে বজবজ করেই শব্দ বেরোয়। তাহলে এই জায়গাটার নামই কেন বজবজ হবে, অন্য জায়গার নাম হবে না? তাহলে তো একাধিক জায়গার নাম বজবজ থাকার কথা। ফলে, এই কারণেই বজবজ নাম হয়েছে বা এই কারণেই নঙ্গী নাম হয়েছে—সেটা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা একটা লিঙ্গুয়িস্টিক অ্যাপ্রোচ থেকে, একটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাঙার চেষ্টা করে বোঝার চেষ্টা করেছি যে কেন এই নামটা হতে পারে। আগেকার লোকেরা যেটা বলেছেন, যে পা-রাখলেই বজবজ করে শব্দ বেরোয়, তাই সেটা বজবজ— এটা আমার অতি-সরলীকরণ বলে মনে হয়েছে। ওই অতি-সরলীকরণের রাস্তাটায় বা যে-জায়গাগুলোয় সন্দেহ হয়েছে, সেই জায়গাগুলোয় আমরা আরেকটু ভেতরে ঢুকে বুঝতে চেয়েছি আরকি। এবং সেটা শুধু ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নয়, ভাষার প্রেক্ষাপটেও।
তন্ময়— গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ হওয়ায় বজবজে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতির আগমন ঘটেছে। বজবজ, নঙ্গী, বাটানগর, আছিপুর— এইসব অঞ্চলে পর্তুগিজ, ইংরেজ, চিনা এমনকি বাটানগরে পরবর্তীতে চেকরাও এসেছে। কোমাগাতামারুর সময় শিখরা। সেই সঙ্গে স্থানীয় মানুষ হিসাবে হিন্দু-মুসলমানরা ছিলই। এই যে বহু জাতির উপস্থিতি, তা বজবজের গড়ে ওঠাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে?
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— এখন থেকে শুরু করে পিছনের দিকে এগোই। তাহলে আমার একটু বলতে সুবিধা হবে। তবে এটা বলতে কোনো অসুবিধা নেই বা অস্বীকার করার কোনো জায়গাও নেই, আমরা এমন একটা অঞ্চলে এই মুহূর্তে বসবাস করছি, যার একটা—আমার কাছে অন্তত, প্রবল ঐতিহাসিক মূল্য থাকা সত্ত্বেও প্রায় মৃতপ্রায় অঞ্চল। এখানকার মানুষদেরও গয়ংগচ্ছ মনোভাব। সেটা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক—সমস্তরকম দিক থেকেই। ফলত সমৃদ্ধ, ঐতিহ্যশালী এই অঞ্চলটার ইতিহাস নিয়ে কেউ ভাবিত নয়, কেউ খুব একটা জানেও না। কাউকে জানাতে গেলে সে খুব একটা উৎসাহী হয়, তাও নয়। তার একটা কারণ হতে পারে অর্থনৈতিক অবস্থা মানুষকে প্রচণ্ডভাবে দাবিয়ে রেখেছে, ন্যুব্জ করে রেখেছে, যার ফলে সে এতটাই ঘাসে মুখ দিয়ে চলছে যে ঘাস থেকে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশটা কত সুন্দর সেটা দেখার মতো ধৈর্য তাদের কাছে নেই। আরেকটা কারণ হতে পারে, আমরা একটা অদ্ভুত রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলছি তো—এখানে হয়তো চাওয়াই হচ্ছে এমন একটা সমাজ, যে, যত কম জানবে ততই ভালো। সত্যজিৎ বহু আগেই বলে গিয়েছিলেন, ‘যত বেশি জানে তত কম মানে’। এখন একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই চলছে সেটা। স্থানীয় স্কুল-কলেজের নাম না-বলাই ভালো। আমাদের সময়ে যে-স্কুলগুলোর নাম মুখে মুখে ফিরত, সেসবের পরিস্থিতি প্রচণ্ড খারাপ। সেই স্কুলগুলোতে যাঁরা পড়াশোনা করছে বা পড়াচ্ছেন—মানের দিক থেকে আগেকার জায়গায় পৌঁছাচ্ছে না। মাস্টারমশাইরা আমাদের সময়ে বলতেন, তোমরা পড়ার বই বাদে আর কী পড়ছ? সেটা রীতিমতো পাঞ্চ করা হত আমাদের মধ্যে, যে তুমি কিছুই পড়ছ না? এবং যেহেতু আমি কিছুই পড়ছি না, তাই স্কুলে এসে মাস্টারমশাই রিডিং পড়ে পড়ে পড়াতেন। ইংরাজি মাস্টারমশাই ইংরাজির ক্লাসে, আমরা স্টোরি রাইটিং করতে পারতাম না বলে বলতেন, দেখো শীর্ষেন্দু কীভাবে অদ্ভুতুড়ে সিরিজের গল্পগুলো শুরু করেন, আর তোমরা ‘ওয়ানস আপন আ টাইম’ বলে শুরু করছ, এটা কী ধরনের শুরু করা?
এখানে পাঞ্জাবিদের একটা গোষ্ঠী এখনও আছে। এঁদের বেশিরভাগই এখন গাড়ি চালান। এবং এঁ প্রায় সকলেই, কোমাগাতামারুর ঘটনার পর যাঁরা লুকিয়ে ছিলেন এদিক-ওদিক, যাঁরা বাড়ি যেতে পারেননি, তাঁদেরই বংশধর। এটা বইতে কোথাও লেখা নেই, তার কারণ হচ্ছে এঁরা কেউ-ই সেই ইতিহাসটা সম্পর্কে বলে উঠতে পারছেন না, কিন্তু তাঁদের পূর্বপুরুষ কোন সময় থেকে বজবজে আছে, সেটা যখন তাঁরা বলছেন, সেটা থেকে মোটামুটি আন্দাজ করা যাচ্ছে যে কোমাগাতামারুর ঘটনার পর যাঁরা এদিকে-ওদিকে লুকিয়ে ছিলেন, ফিরে যেতে পারেননি, তাঁদের বংশধর এঁরা। পরবর্তীকালে আরও বেশ কিছু পাঞ্জাবি লোকজন এখানে আসেন এবং তাঁরাও থেকে যান। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়—তিনি যখন ‘সন্দেশ’-এ তাঁর উপন্যাস লিখছেন ‘পিকলুর ছোটকা’—সেখানে তিনি খুব অদ্ভুতভাবেই পাঞ্জাবি ড্রাইভার, পাঞ্জাবি কন্ট্রাকটরদের রেফারেন্স এনেছেন। কোমাগাতামারুর ঠিক পিছনে একটা গুরুদ্বার আছে। যেটার নাম হচ্ছে কোমাগাতামারু গুরুদ্বার। সবাই ওটাকে বজবজ শিখ মন্দির বলে। কিন্তু ওটার নাম যে কোমাগাতামারু গুরুদ্বার, সেটা প্রায় কেউ উচ্চারণ করে না। কোমাগাতামারু জায়গাটাও (স্মৃতিস্তম্ভটা) বেশিরভাগ সময় ফাঁকা থাকে, তার যে বিপুল ঐতিহাসিক ভ্যালু, এখনকার দিনে সেটাও ভীষণ নিভে যাওয়া মনে হয়। দেখলে খারাপ লাগে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কমল চৌধুরী
তন্ময়— কোমাগাতামারু তো একটা জাহাজের নাম ছিল। এখন অঞ্চলের নামও কোমাগাতামারু হয়ে গেছে?
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— অঞ্চলটার নাম কোমাগাতামারু হয়নি। নামটা হঠাৎ করেই কোমাগাতামারু করে দেওয়া হয়েছে। ২০১৩-১৪ সালের পর থেকে, বা আমি একটু ভুল বলছি, মমতা ব্যানার্জি যখন রেলমন্ত্রী, তখন প্রবলভাবে চারিদিকে জায়গার নাম বদলে যাচ্ছে, তখন বজবজ স্টেশনের নাম বদলে কোমাগাতামারু বজবজ করে দেওয়া হয়। সবাই বলতে শুরু করে একটা জায়গার নাম কোমাগাতামারু। আদৌ সেটা নয়। এবং কোমাগাতামারু ঘটনা যেখানে ঘটে, সেটা এখনকার বজবজ স্টেশনের কাছেই নয়। সেটা ছিল পুরনো বজবজ স্টেশনের কাছে। সেই পুরনো বজবজ স্টেশন যেখানে বিবেকানন্দ ট্রেনে করে কলকাতা ফিরেছিলেন, যার ঠিক পাশে জালিয়ানওয়ালাবাগ ঘটনার আগে জালিয়ানওয়ালাবাগের একটা ট্রায়াল চলে। কিন্তু সেই ইতিহাসটা প্রায় নিভিয়ে দিয়ে একটা নতুন স্টেশনের নাম বজবজ করে দেওয়া হয়।
তন্ময়— আমাদের আলোচনাটা অনেক দূর চলে গেল। যেটা প্রশ্ন ছিল, এই বিভিন্ন জাতির উপস্থিতি কীভাবে অঞ্চলটাকে প্রভাবিত করল?
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— হ্যাঁ, সেই প্রসঙ্গে ফিরছি। একটা অঞ্চল যখন তৈরি হচ্ছে, একদম প্রাচীন জায়গায় যদি ফেরত যাওয়া যায়— মানে যখন লর্ড ক্লাইভ বজবজ দুর্গ আক্রমণ করছেন। ১৭৫৭ সালে পলাশী। তার ঠিক আগে, ১৭৫৬ সালে। ওই সময়কার বেশ কিছু বই ঘেঁটে দেখেছি, খুবই সাধারণ, গ্রামবাংলার যেমন জনজীবন হয়, একদম তেমনই জনজীবন। রাস্তাঘাটও সেরকম। কারণ, ব্রিটিশদের তখন একটা কামান বয়ে আনতে হচ্ছে গরুর গাড়ি করে। ব্রিটিশদের তখন এতটাই পরিস্থিতি খারাপ, আর্থিক অবস্থা খারাপ যে ওরা গরুও পায়নি। ফলে, গরুর গাড়িটাকে ম্যানুয়ালি টানতে হচ্ছে, মানুষদেরকে গাড়িটা টানতে হচ্ছে, কামানগুলোকে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। প্রচণ্ড উঁচুনিচু রাস্তা, গর্তময় রাস্তা। যেহেতু সেটা শীতকাল তাই কাদা নেই রাস্তায়, কিন্তু একটু বৃষ্টি হলেই কর্দমাক্ত হয়ে যাবে। এবং সেই রাতে ক্লাইভের লোকেরা যেখানে লুকিয়ে ছিল, সেটা বেশ কয়েক ফুট গভীর একটা জলাশয় যেখানে জল নেই। মানে বলছে সেটা পুকুর বা দিঘি টাইপের জায়গা, বৃষ্টি হলে যেটা ভরে উঠবে। খুব সাধারণ একটা গ্রামাঞ্চল। আমি যখন এগোই— একদম প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিকের দিকে এগোতে থাকি— তখন দেখা যায় যত বর্গি আক্রমণ ঘটেছে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে, সেখান থেকে বাংলার মানুষজন নিচের দিকে সরে এসেছে। সেইভাবে একটা জনজীবনের গতি পেয়েছে এই অঞ্চলে। এবং যখন মুসলিম যুগ শুরু হয়, তখন বহু মানুষ ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। সেই একটা ইতিহাস রয়েছে। কারণ বহু জায়গায় এরকম আমরা পেয়েছি যেখানে মুসলিম বাড়িতে তুলসীমঞ্চে প্রদীপ দেওয়া হয়, লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়া হয়। বজবজের মতো এলাকায়।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সোমা মুখোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব
তন্ময়— হিন্দু বাড়িতে যে পাঁচালি পড়া হয়, সেই একই ধরনের পাঁচালি?
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— হ্যাঁ, সাধারণ পাঁচালি। মানে সেইসব ব্যক্তিরা রূপান্তরিত হয়েছেন। কেন রূপান্তরিত হয়েছেন, সেই প্রসঙ্গে ঢুকছি না। সেটা অন্য আলোচনার বিষয়। যাই হোক, এভাবেই বর্গি আক্রমণের সময় কিছু মানুষ এখানে চলে আসেন, কিছু মানুষ ধর্মান্তরিত হন নির্দিষ্ট কারণে এবং পরবর্তীতে যখন ব্রিটিশ যুগ শুরু হয় তখন রাঢ়বঙ্গ থেকে বেশ কিছু মানুষ এখানে সরে আসেন। সেই কারণে রাঢ়বঙ্গের বিভিন্ন দেবদেবীর পুজো আমরা এই অঞ্চলে দেখতে পাই।
তন্ময়— কোন-কোন দেবদেবী?
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— পঞ্চানন ঠাকুর বা পাঁচু ঠাকুর। একদমই রাঢ়বঙ্গের দেবতা। বিশেষ করে বাঁকুড়াতে পঞ্চাননমঙ্গল বা পাঁচু ঠাকুরের পুজো প্রচলিত। আমি চমকে গিয়েছিলাম এখানে পঞ্চানন ঠাকুরের পুজো হতে দেখে। সেটা তারপর জানা যায় যে, বেশ কিছু মানুষ একটা নির্দিষ্ট সময়কালে রাঢ়বঙ্গ থেকে এইদিকে সরে আসে। আবার সুন্দরবন থেকে যত গাছ কেটে কেটে নগর তৈরি হতে থাকে, তখন বেশ কিছু মানুষ শহুরে এলাকার কাছাকাছি থাকবে বলে এইদিকে সরে আসে। একদম ধরো বজবজ খেয়াঘাট, সেখানে বনবিবির থান দেখা যায়। শুধু বজবজ খেয়াঘাট নয়, আরও যদি আমি বাটানগরের দিকে এগোতে থাকি, বেশ কিছু জায়গায় বনবিবির থান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেখা যায়।
পরবর্তীতে চিনাদের একটা আধিপত্য আছিপুরে শুরু হয়। কিছু মানুষ এখানকার লোকেদের সঙ্গে বিয়ে করেন। বেশিরভাগ চিনারা কলকাতার দিকে সরে যান, তবে কিছু মানুষ এখানে থেকেও যান। সেখানে আলাদা একটা জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে তাঁরা এখানকার লোকদের সঙ্গে মিশে যান। বাহ্যিক রূপটা হয়তো আলাদা, দেখলে এখনও বোঝা যায় যে আমাদের মতো দেখতে তাঁরা নন। কিন্তু তাঁরা কথা বলেন পরিষ্কার বাংলাভাষাতেই। বেশভূষা, কথা-বার্তা, আচার-আচরণ সব বাঙালিদের মতোই হয়ে গেছে। পাশাপাশি অস্বীকার করার জায়গা নেই, ১৯৪৭ সালের পর বা তার আগে থেকে—দেশভাগের আগে-পরের ওই সময়টায় গোটা এলাকার জনসৃজনে একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে। আমার বিশ্বাস যে ওই সময়টা হয়তো গোটা ২৪ পরগনারই জনগোষ্ঠীর একটা পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিল। এবং এটা তো অনস্বীকার্য, যে একটা শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে ওঠার ফলেও বাইরের বহু অঞ্চল থেকে বহু মানুষ এখানে জড়ো হতে শুরু করেন। স্বাভাবিক ভাবেই একটা ডাইভার্সিফায়েড জনসৃজন এখানে ঘটে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সোমা মুখোপাধ্যায়— দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— একটা মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায়। বর্তমানে প্রেক্ষিতে উনিশ শতকের বা বিশ শতকের ইতিহাস অনুসন্ধান করাটা একজন আঞ্চলিক ইতিহাসকার বা গবেষকের কাছে কতটা কঠিন? কারণ আঞ্চলিক ইতিহাসে অধিকাংশ সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম তথ্য ডকুমেন্টেড থাকে না, সেগুলো লোকমুখে বা ঘুরে ঘুরে উদ্ধার করতে হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েও গেছে অনেক, পুরোনো দিনের মানুষরাও কমে এসেছেন। সেই জায়গা থেকে এইসব কাজ কতটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে এখন?
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— চ্যালেঞ্জিং যে হচ্ছে, তা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। আপনি বললেন এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে, কিন্তু আগে কি সেটা সহজ ছিল? এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে আমি একটা বইয়ের খোঁজ পেয়েছি, বইটা এখানে কোথাও নেই, আছে ইংল্যান্ডের কোনো একটা ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে। এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে, সেটা হয়তো ২০২১-২২ সালে কাজটা করা বলেই, সেখানে যোগাযোগ করেছি, অ্যাডামেন্টলি মেইল করেছি, কী দরকার, কী প্রয়োজন সেগুলো বলেছি। তারপর আমি শুধুমাত্র সেই বইটার ক্ষেত্রে লাইব্রেরির অ্যাকসেস পেয়েছি। এই কাজটা যদি কেউ গত শতকে সালে করার কথা মনে হত, তাঁর হয়তো একইরকম ইচ্ছে আছে, একইরকম জেদ আছে—তিনি কি এই সুবিধাগুলো পেতেন? ফলে, এখনকার দিনে কাজটা করার সুবিধাও আছে, অসুবিধাও আছে। অসুবিধা হচ্ছে স্মৃতিধর মানুষের সংখ্যা কমে গেছে, মানুষের মধ্যে ইতিহাসচেতনা অনেকটাই কমে এসেছে। এবং একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সময়ের মধ্যে দিয়ে চলার কারণে ইতিহাসচেতনা আরও বেশি ভুলিয়ে দেওয়ার এবং গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। বিতর্কিত লাগলেও এই কথাটা আমি বলব এবং বার বার বলব। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই কাজটা করা বা সন্ধানগুলো করা নিশ্চয়ই চ্যালেঞ্জিং। যেমন, একটা স্থানীয় লাইব্রেরিতে গেলেও কোনো রেফারেন্স বই পাওয়া যাচ্ছে না। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে বইয়ের কথা বলা পরেও—একটি নির্দিষ্ট বইয়ের ক্ষেত্রে আমি ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে আমি দিনের পর দিন—প্রায় পনেরো বার গেছি, ওরা বইটা জোগাড় করে দিতে পারেনি। শেষে আমার ফোন নম্বর রেখে দিয়ে বলল, আমরা আপনাকে জানাব বইটা এলে, আপনার আসার দরকার নেই। ওরা আজ অবধি ফোন করেনি। পরবর্তীকালে বাধ্য হয়েই ফেসবুকে—বাটা-বজবজ-মহেশতলার যে-ফেসবুক পেজ আছে একটা, সেখানে লিখি, এই বইটা কারোর সন্ধানে থাকলে জানান, আমি বইটা হয় তাঁর থেকে পয়সা দিয়ে নেব কিংবা জেরক্স করে নেব কিংবা মূল্য দিয়ে বইটা একদিনের জন্য ভাড়া নেব। তারপর একজন যোগাযোগ করেন। বইতে তাঁর নাম আছে। নজরুল ইসলাম। তিনি আমাকে বইটি দেন। আমি তাঁর থেকে নিয়ে বইটি জেরক্স করিয়ে আনি। এবং সেটা আমাকে খুব একটা হেল্প করে না। কিন্তু এই বইটি এত বড়ো এলাকায় শুধুমাত্র একজনের কাছে আছে। বইটি যে পাবলিশারের বা প্রকাশকের থেকে ছাপা, সেই প্রকাশনীতে আমি দিনের পর দিন যাই, তাঁরা আমাকে বইটি জোগাড় করে দিতে পারেননি, ন্যাশনাল লাইব্রেরি দিতে পারেনি। ফলে এই প্রতিবন্ধকতাগুলো ছিলই। আমি বরং বলব এক্ষেত্রে তথাকথিত পড়াশোনা জানা বা শিক্ষিত মানুষদের থেকে আমি আসলে যাঁদের থেকে সাহায্য পেয়েছি, সেটা হল একদম গ্রামের তথাকথিত নিরক্ষর মানুষজন। তাঁদের কাছে ইতিহাসচেতনাটা হয়তো সেভাবে নেই। কিন্তু তাঁদের কাছে গল্পের ভাণ্ডার রয়েছে। পুজালির একজন মাঝি, যিনি নৌকা চালান, তিনি আমাকে আসল রাস্তাগুলো দেখিয়েছেন, প্রাচীন কথাগুলো বলেছেন। আমি পরে সেগুলো ভেরিফাই করেছি ঠিক না ভুল, কিন্তু উনি আমাকে রাস্তাটা দেখিয়েছেন। বিড়লাপুরের যে-জায়গায় গ্যারিসন গ্যারেজ ছিল, এখন যেটাকে বারুদ ফ্যাক্টরি বা বারুদের মাঠ বলে—সেখানে বয়স্ক মহিলা একজন, যিনি বসে হাতপাখা বিক্রি করছিলেন, তিনি আমাকে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিক দেখালেন জায়গাটা খোঁজার পিছনে। তাঁদের সচেতনতা দেখে ওইখান থেকে আমি আবার নতুন করে খুঁজতে শুরু করি। মানে শুধুমাত্র শিক্ষিত বা পড়াশোনা জানা লোকেদের থেকেই আমি সাহায্য পেয়েছি, সেটা নয়। বা বই থেকেই আমি সাহায্য পেয়েছি, সেটাও নয়। বরং এই কাজে আমাকে অজান্তেই অনেক বেশি সাহায্য করেছেন সেই মানুষগুলো যাঁরা হয়তো সেভাবে প্রথাগত শিক্ষার ধার ধারেননি বা পথ মাড়াননি।
(চলবে)
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
Powered by Froala Editor