সুশীলকুমার বর্মনের জন্ম ১৯৬০ সালে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবং ব্লকের নোনামাধবচক গ্রামে। বর্তমানে ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ (গার্লস উইং)-এর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ, গল্প ও ভ্রমণকাহিনি লেখেন। রয়েছে কয়েকটি বইও। বর্তমান ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘অব্রাহ্মণ পুরোহিত’ (প্রকাশকাল ২০২৩) বইটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে সুশীলকুমারের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব...
তন্ময়— আমার পরের প্রশ্ন খানিকটা রাজনৈতিক। বর্তমানে সারা ভারতে একধরনের ধর্মীয় আগ্রাসন এবং হিন্দুত্ববাদের হিড়িক দেখা যায়। জঙ্গলমহলের থানগুলিতে এবং সেখানকার মানুষজনের মনেও কি তার প্রভাব পড়েছে?
সুশীলকুমার বর্মন— এখন মানুষ অনেক সচেতন হচ্ছে। হিন্দুধর্মের আগ্রাসন থেকে নিজেদের ধর্মটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের এই অঞ্চলে কিন্তু মানুষ অনেক সচেতন। তাঁরা শিক্ষিত হয়েছেন। আমার অনেক বন্ধু আছেন, যাঁরা সাঁওতাল। তাঁরা নিজেদের ধর্মটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করছেন। এঁরা কিন্তু গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেননি। তাঁরা লড়াই করে সাঁওতালি ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, অষ্টম তফসিলে আনতে পেরেছেন। এইভাবে আরেকটা ভাষা— মাহাতোদের কুড়মালি ভাষাকেও অষ্টম তফসিলে আনার চেষ্টা চলছে। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মটাকেও বাঁচিয়ে রাখার যে প্রবণতা— এটা কিন্তু বৃদ্ধি পাচ্ছে, কমে যাচ্ছে না। এবং যাঁরা রাজনৈতিক নেতা, তাঁদের কিন্তু কথা দিতে হচ্ছে… যেমন, আমাদের ঝাড়গ্রামের সংসদের সিটটা আদিবাসী সংরক্ষিত। ফলে যাঁরা আদিবাসী, তাঁরা ছাড়া এই সিটে কনটেস্ট করতে পারবেন না। তাঁদেরকে কিন্তু গ্রামে গ্রামে গিয়ে কথা দিতে হচ্ছে যে আমরা আমাদের ধর্মটাকে বজায় রাখব। আর অনেক জায়গায় আমি দেখেছি— যেমন ধরুন সাঁতরাগাছিতে প্রচুর মানুষ আছেন, যাঁরা সাঁওতাল, তাঁদের অনেকে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করেন—
তন্ময়— সাঁতরাগাছি বলতে কি আপনি হাওড়ার সাঁতরাগাছির কথা বলছেন?
সুশীলকুমার বর্মন— হ্যাঁ। আমার বাড়ি ওখানে। একটা সেকশন আছে যাঁরা ধর্ম মানেন না, ধর্ম থেকে দূরে থাকেন। আবার এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা সাঁতরাগাছিতেও জাহের থান করেছেন। সাঁওতালদের ধর্মস্থানটাকে বলা হয় জাহের থান। একটা জিনিস এখানে বলে দিই, এখানে যে অব্রাহ্মণ পুরোহিতদের নিয়ে আলোচনা, এখানে কোথাও আপনি সাঁওতাল কমিউনিটির পুরোহিত পাবেন না। সাঁওতালরা কিন্তু অন্য ধর্মের দেবদেবীদের পুজো করেন না। সাঁওতালরা পুরোপুরি ইন্ট্রোভার্ট, কনফাইন্ড। ওই যে জাহের থান বললাম, জাহের থানই তাঁদের দেবস্থান।
তন্ময়— শবর বা কুড়মিদের লোকদেবতার থানে বিভিন্ন বর্গের মানুষ এসে পুজো দেন। সাঁওতালদের থানে কি অন্যান্য বর্গের মানুষরা যান না?
সুশীলকুমার বর্মন— না, যান না। এবং সেখানে সাঁওতাল পুরোহিতই দেখা যায় কেবল। ব্রাহ্মণ্যবাদ ঢুকতে পারেনি। ওখানে সাঁওতাল ছাড়া কেউ-ই পুরোহিত হতে পারবেন না। তবে সাঁওতালরা অন্য থানে গিয়ে পুজো দিচ্ছে— এটা কিন্তু হয়েই থাকে।
তন্ময়— একটা সামাজিক পরিস্থিতি বুঝে নিতে চাই। শোনা যায়, গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে বিজেপি বা আরএসএস তাদের প্রোপাগেন্ডা ছড়াচ্ছে। আমরাও দেখেছি গ্রামবাংলায় বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ করে ঝাঁ-চকচকে হনুমান মন্দির গড়ে উঠছে। এসব জঙ্গলমহলে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় কতটা?
সুশীলকুমার বর্মন— হচ্ছে, হচ্ছে। মানে এই যে সাময়িক একটা চমক, সেই চমকে ফলে কোথাও কোথাও হনুমান মন্দির প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, পুজো হচ্ছে।
তন্ময়— আপনি যেটা বললেন একটু আগে, বিভিন্নভাবে তাঁরা হিন্দু হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ওঁদের মনেও কি ‘হিন্দু’ হয়ে ওঠা বা ‘হিন্দু’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বাসনা দেখা দিয়েছে? নাকি দূরে থেকেই তাঁরা খুশি?
সুশীলকুমার বর্মন— এখন যত বেশি শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে, তত বেশি তাঁরা স্বাতন্ত্র্য বা জাতি-সচেতন হচ্ছেন। তাঁরা যে আদিবাসী হিসাবে গর্বিত, সেটা কিন্তু বলছেন। কেউ কেউ আছেন, যাঁরা আদিবাসী পরিচয় দিতে চান না। কিন্তু আমি দেখেছি যাঁরা শিক্ষিত মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁরা কিন্তু আদিবাসী হিসাবে গর্বিত। নিজস্ব আচার-আচরণ নিয়ে তাঁদের কিন্তু কোনো দুর্বলতা বা সংকীর্ণতা নেই। ‘হিন্দু’ হলেই উত্তরণ ঘটবে— এমনটা কিন্তু ভাবছেন না তাঁরা।
তন্ময়— বিশ্বায়ন-পরবর্তী যুগে, বিশেষত স্মার্টফোন আসার পরে সাধ ও সাধ্যের ফারাক কমিয়ে তোলার যে ইচ্ছে, তা সমাজের বিভিন্ন স্তরে দেখা যায়। আদিবাসীরা এই জোয়ার থেকে দূরত্বে থাকছেন, নাকি যুবসমাজ সেই মূলস্রোতেই মিশে যাচ্ছে?
সুশীলকুমার বর্মন— হ্যাঁ, এটা কিন্তু বিশেষ করে সংস্কৃতির দিক থেকে হচ্ছে। মোবাইলের যুগ এসে গিয়ে মানুষ কিন্তু আর সাঁওতালি গান, সাঁওতালি নাচ, চাং নাচের চর্চা করছেন না সেভাবে। চাং নাচ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। কোথাও যদি তার প্র্যাকটিস না-হয়, তাহলে তো সেটা হারিয়েই যাবে। এভাবেই তথাকথিত যে আদিবাসী সংস্কৃতি, সেটা অবলুপ্ত হচ্ছে। আদিবাসীরা নিজেদের আইডেনটিটি বজায় রাখার চেষ্টা করছেন, কিন্তু বেশিরভাগ আদিবাসী যুবক-যুবতী হিন্দি গান বা চটুল যে-সব গান, নাচ— সেসবের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে।
তন্ময়— স্থানীয় মেলাগুলোতেও সেসবের অনুপ্রবেশ ঘটছে?
সুশীলকুমার বর্মন— হ্যাঁ। ডিজে-টিজে বাজিয়ে এখন টুসু হচ্ছে। আগে টুসু ভাসানোর সময় টুসু গান গেয়ে গেয়ে যাওয়া হত। আমি সেই টুসু ভাসানোর যে-আমেজ— গান গাইতে গাইতে মেয়েরা টুসুকে নিয়ে যাচ্ছেন, জলে ভাসান দেবেন— এতদিন যে তাঁরা টুসুকে প্রতিপালন করেছেন, পুজো করেছেন, এবার মকর সংক্রান্তিতে টুসুকে ভাসিয়ে দেবেন— সেই যে দুঃখ এবং ধর্মীয় আবেগ, তা এখন উধাও। এখন ডিজে বাজিয়ে, ভ্যান ভাড়া করে, লরি ভাড়া করে, জেনারেটার চালিয়ে, ধমক ধমক করে তাঁরা ঝুমুর গান বাজাচ্ছেন বা চটুল হিন্দিগান বাজাচ্ছেন। আসল জিনিসটাই উধাও।
তন্ময়— পরের প্রশ্নে আসি। যাঁরা অব্রাহ্মণ পুরোহিত, মূলত বংশ-পরম্পরায় পুজো করেন। নয়তো আত্মীয়-স্বজনের ওপরেই দায়িত্ব বর্তায়। নবীন প্রজন্ম যাঁরা, তাঁরা কতটা এই পেশায় আসতে কতটা আগ্রহী? তাঁরা কি অন্যান্য পেশার দিকে পা বাড়াচ্ছেন?
সুশীলকুমার বর্মন— এটা খুবই ভালো প্রশ্ন। আমি দেখেছি, যাঁরা শিক্ষিত হয়ে যাচ্ছেন…
তন্ময়— ‘শিক্ষিত’ বলতে কি আপনি স্কুল-কলেজের ডিগ্রিলাভ করার কথা বলছেন?
সুশীলকুমার বর্মন— হ্যাঁ। যাঁরা স্কুল-কলেজের ডিগ্রিলাভ করছেন, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন তাঁরা বিকল্প জীবিকার সন্ধানে চলে যাচ্ছেন। যাঁরা পড়ে থাকছেন, তাঁরাই এই প্রথাটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বংশ-পরম্পরায় ব্যাপারটা চলছে সেখানে। আরেকটা বড়ো ব্যাপার আছে। বহু উচ্চশিক্ষিত মানুষও আকৃষ্ট হচ্ছেন, কেন-না এখান থেকে একটা ভালো উপার্জন আসে। এই উপার্জনের যে পথটা, সেটা তো কেউ ছেড়ে দেবে না। এক-একটা বংশে আগে একজন ছিলেন, আজকে সেখানে আঠারোজন, কুড়িজন, তিরিশজন হয়ে গেছে। কিন্তু সেই পরিমাণ ভক্তের সংখ্যাও বেড়েছে। একদিন পালা পড়লে যদি এক মাসের উপার্জন হয়ে যায়, তাহলে সেটা ছাড়বে না কেউ-ই। ফলে, এখানে একটা অর্থকরী দিক আছে।
তন্ময়—আমরা লৌকিক ধর্মের ক্ষেত্রে অনেকসময়ই দেখি, পূজারী বংশ কিংবা প্রতিষ্ঠাতা বংশের বংশধররা উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতা লাভ করেন। এবং বংশ-পরম্পরায় তাঁদের ভক্তকুল বজায় থাকে। জঙ্গলমহলে ছবিটা ঠিক কীরকম?
সুশীলকুমার বর্মন— এখানে দেবতাই মুখ্য। দেবতার উপাসক কারা, তা বিশেষ বিবেচ্য নয়। দেবতার উপাসকরা দেবতা হয়ে ওঠেন না। ভক্তরা দেবতাকেই পুজো দিতে যায়। পুরোহিতের দিকে তাঁদের লক্ষ থাকে না। তবে সেটা শহরের দিকে হচ্ছে। একটা উদাহরণ দিই। হাওড়া এবং হুগলির বর্ডারে একটা গ্রাম আছে, সেখানে ধর্মঠাকুরের পুজো হয়। সেখানে যাঁরা পুজো করেন, তাঁরা ব্রাহ্মণ। এবং যাঁরা ওখানে জড়িবুটি ওষুধ দেন… এটা একটা উল্লেখ করার মতো কথা, যাঁরা অব্রাহ্মণ পুরোহিত তাঁরা আবার চিকিৎসা করেন— ‘ফেইথ হিলিং’ বলা হয়। হাওড়ার দিকে দেখেছি বংশ-পরম্পরায় ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। বেশিরভাগই নিঃসন্তান দম্পতি, তাঁদের বাচ্চা হবে, তার জন্য পুরিয়া দেওয়া হচ্ছে ঠাকুর দালানে বসে। তাঁদের আবার যজমান আছে। আমাদের এখানে, জঙ্গলমহলে এই যজমানগিরিটা নেই। যে যখন পুজো করছেন, সেই তখন ওঝা বলুন কি গুণিন বলুন, তাঁর কাজটা করছেন। মূলত দেবতাকেই তাঁরা পুজো করেন। আর দেবতার যাঁরা দেহরী, তাঁদের কাছ থেকে অনেকে ওষুধ নেয়।
তন্ময়— একজন গবেষক এবং ক্ষেত্রসমীক্ষক হিসাবে আপনার কি মনে হয়, তথাকথিত উচ্চবর্গীয় সমাজ এইসব থান এবং তাদের অব্রাহ্মণ পুরোহিতদের খানিকটা হীন চোখে দেখে?
সুশীলকুমার বর্মন— না, আমাদের স্থানীয় যাঁরা উচ্চবর্গীয় মানুষ, তাঁরা আমার ক্ষেত্রসমীক্ষায় বেশি সাহায্য করেছেন। অনেক ব্রাহ্মণ আছেন, যাঁরা আমাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছেন। ওঁরাই কিন্তু আমার পথপ্রদর্শক। ওঁরাও কিন্তু ওইসব থানে পুজো দেন। ব্রাহ্মণ মানুষ, উৎকল ব্রাহ্মণ, তিনি আমাকে এক জায়গায় নিয়ে গেলেন। বললেন, ওই পুরোহিত তাঁর বন্ধু হয়। তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসালেন। পুরোহিত এসে বেশ হৃদ্যতার সঙ্গে কথা বললেন। আর দেখলাম সেই ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতের কথাবার্তার মধ্যে উঁচু-নিচু বা অস্বস্তির ব্যাপার সেরকম কিছু নেই।
তন্ময়— ব্যক্তিগতভাবে রাঢ়ের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষেত্রসমীক্ষায় গিয়ে এমন অনেক অব্রাহ্মণ পুরোহিতের মুখোমুখি হয়েছি, যাঁরা বিভিন্ন লোক দেবদেবীর পূজা করেন। তাঁরা সংস্কৃত মন্ত্রের প্রতি ওয়াকিবহাল নন বা সংস্কৃত মন্ত্র জানেন না। যদিও ধর্মঠাকুরের ক্ষেত্রে কিছু কিছু জায়গায় বাংলার সঙ্গে সংস্কৃত মন্ত্র মিশে গেছে। তবে ধর্মঠাকুর ছাড়া বেশিরভাগ থানে বাংলাতেই তাঁরা মনস্কামনা জানান। এটা অব্রাহ্মণ পুরোহিতদের অন্যতম প্রধান এক বৈশিষ্ট্য। আপনার কি মনে হয়, উপাসনামন্ত্র সর্বত্রই মাতৃভাষায় উচ্চারিত হওয়া উচিত নয়?
সুশীলকুমার বর্মন— এটা তো বহুদিন ধরেই আমি বলছি। আমার বন্ধু-সমাজে বা বিদগ্ধ সমাজে বার বারই বলি। দেবতা কি শুধু সংস্কৃতই জানেন? বাংলা জানেন না? আমাদের রামকৃষ্ণ তো কোনোদিন এইভাবে বলেননি। রামকৃষ্ণকে আমি এই জন্যেই শ্রদ্ধা করি। কারণ রামকৃষ্ণ— ওই যে একটা গান আছে না, ‘আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানিনে মা’— প্রসাদী গান। রামকৃষ্ণ ওটা খুব ভালোই চর্চা করতেন। এই গানটাই বিশ্বাস করতেন। মা আমি মন্ত্র জানি না, আমি তোকে খেতে দিয়েছি, তুই আমার হাতে খা। আমি তোকে খাইয়ে দিচ্ছি, তুই খা। আমরা এই একই কথা জঙ্গলমহলে অব্রাহ্মণ পুরোহিতের কাছেও পাই। মন্ত্র কেন বলব? ‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে/ বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাং দেহি নমস্তুতে’ না বলে আমি যদি বলি মা সরস্বতী, তুমি আমাকে বিদ্যা দাও— তিনি কি বুঝবেন না? দেখবেন অনেক পুরোহিত ঠিকঠাক সংস্কৃত উচ্চারণটুকুও করতে পারেন না। তবু তাঁরা বংশ-পরম্পরায় করে আসছেন। আমার মনে হয়, নিজের ভাষায় গানের মাধ্যমে যদি আমরা দেবদেবীকে আহ্বান করি, সেটা অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে।
তন্ময়— অব্রাহ্মণ পুরোহিতদের আচারে— যেহেতু তাঁরা অনেকেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর— তাঁদের আচারে আদিম সমাজের কী কী চিহ্ন লক্ষ করেছেন?
সুশীলকুমার বর্মন— দেওঘরিয়া থেকে ‘দেহরী’ কথাটা এসেছে। দেবতাকে দেহরক্ত মিশিয়ে অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়। এটা একটা গোপন ব্যাপার। যাঁরা দেহরী— মানে অব্রাহ্মণ পুরোহিতদের দেহরী বলা হয়, দেয়ারী, দেবাংশীও বলে, দেহরীটাই বেশি চালু— তো দেহরীরা করেন কী, যখন প্রথম বলি হয়, সেই বলির সঙ্গে নিজের ঊরুদেশে কাঁটা দিয়ে কিংবা যে অস্ত্র দিয়ে বলি দিচ্ছে, সেটা দিয়ে চিরে দেন। সেই দেহরক্ত ছাগ-রক্তের সঙ্গে বা মোরগ-রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে দেবতাকে নিবেদন করেন। এই যে দেহরক্ত মিশ্রিত করা— এটাকে আমার মনে হয়, পূর্বে নরবলির প্রচলন ছিল… জানি না একেবারে আদিম যুগ থেকেই এটা ছিল নাকি রাজারা এসে এখানে এটা চালু করেছিলেন, নাকি তান্ত্রিকরা চালু করেছিলেন। যাই হোক, এই প্রথাটা এখনও এঁদের মধ্যে চলছে। আজই একজন আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, জঙ্গলমহলে এত বলি কেন হয়? অন্য কলেজ থেকে তিনি এসেছিলেন। কলকাতার ভদ্রমহিলা। আমি তার উত্তরে বলেছিলাম, মানুষ দেবতাকে কী নিবেদন করে? যেটা সেটা নিজে খাবে, সেটাই সে দেবতাকে অর্ঘ্য হিসাবে দেয়। যেটা সে নিজে খেতে পারবে না, সেটা দেবতাকে কোনোদিনও অর্ঘ্য হিসাবে দেবে না। আমি ফল দিচ্ছি, মিষ্টি দিচ্ছি, চিঁড়ে দিচ্ছি, বাতাসা দিচ্ছি, কই পাথর তো দিচ্ছি না! যেটা আমার খাদ্য, সেটাই আমি দেবতাকে দিচ্ছি। এবং দেবতার গ্রহণের পর সেটা আমরা প্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করছি। জঙ্গলমহলের মানুষের মূল খাদ্য হচ্ছে মাংস। আদিম যুগ থেকে মানব সভ্যতার খাদ্য কী ছিল? প্রথমে কাঁচা মাংস ছিল, তারপর ঝলসানো মাংস, তারপর সে রান্না করতে শিখেছে। তা এই যে মাংসটা— সেটা তো প্রিয় জিনিস— সেটাকেই দেবতাকে দিই। জঙ্গলমহলের মাংসাশী মানুষ, শিকারজীবী মানুষ, পশুশিকার করে তারা মাংস খেত। আগে সেই মাংসের কিছুটা দেবতাকে অর্পণ করে, বিশেষ করে মাথাটা অর্পণ করে তারপর সেই মাংসটা গ্রহণ করত।
তন্ময়— ওই অঞ্চলের অনেক থানেই দেখা গেছে, জৈন দেবদেবীদের বা জৈন মূর্তির অবশেষ লৌকিক দেবদেবীতে বিবর্তিত হয়েছে। এসব ইঙ্গিত ওই অঞ্চলে এককালীন জৈন প্রভাবের দিকে নির্দেশ করে। এই বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সুশীলকুমার বর্মন— রাঢ়ে জৈন মূর্তি— সে তো এক বিশাল গল্প! সংক্ষেপে বলি। মানুষের প্রবৃত্তি হল, মূর্তি যদি কোথাও পাওয়া যায়, তাকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করা। জৈনরা একসময় ছিল এতদঞ্চলে। আজ থেকে এক হাজার বছর আগে পর্যন্ত। মানে বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেনের বাংলা অধিকারের আগে পর্যন্ত। এই অঞ্চলে জৈনদের একটা বিশাল প্রভাব ছিল। সেন আমলে শঙ্করাচার্যের শৈবধর্মের যে জোয়ার— সেই শৈবধর্মের জোয়ারে বৌদ্ধ এবং জৈনরা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়। রাঢ়বাংলায় বৌদ্ধ তেমন ছিল না, ছিল জৈনরা। ফলে এখানে জৈনদের বহু অবশেষ পড়ে আছে। পরবর্তীতে যখনই মানুষ দেখেছে এটা একটা দেবমূর্তি— সেটা উলঙ্গ হলেও দেবতার মূর্তি, তাকে তুলে নিয়ে এসে পুজো করার প্রবণতা দেখা গেছে। মূলত নদীতে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল জৈনরা। নদী বা জলাশয় থেকে সেইসব মূর্তি তুলে নিয়ে এসে এই নিম্নবর্গীয় মানুষরা বিভিন্ন নাম দিয়ে পুজো করছেন। কোনো দেবতা পেলে… যদিও মূর্তিপুজোয় বিশ্বাসী নন— কিন্তু দেবতা এভাবে পড়ে থাকবেন? চলো ওঁরই পুজো করি— এভাবেই এঁরা দেবতার পুজো করছেন।
তন্ময়— জঙ্গলমহলের মানুষদের ভিতরে মূর্তিপুজোর প্রচলন কি এই জাতীয় কুড়িয়ে পাওয়া মূর্তি থেকেই? নইলে আদিম শিলাখণ্ড, প্রস্তরখণ্ডই পূজিত হত?
সুশীলকুমার বর্মন— হ্যাঁ, এটাই আসল কথা। এখানে যে জৈনমূর্তি পূজিত হচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
তন্ময়— বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় তথাকথিত শাস্ত্রীয় দেবদেবীও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
সুশীলকুমার বর্মন— হ্যাঁ। শাস্ত্রীয় দেবদেবীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে শৈবধর্ম, কালীমূর্তি বা দুর্গাপূজার প্রচলন হচ্ছে। যখনই নগরায়ন হচ্ছে, গ্রামকে গ্রাস করে নিচ্ছে নগর, তখনই এগুলো হচ্ছে।
তন্ময়— মহিলা অব্রাহ্মণ পুরোহিতরা ওই অঞ্চলে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পৌরোহিত্যের যে পেশাভিত্তিক অবস্থান, সেটা পুরুষকেন্দ্রিক বা পুরুষশাসিত নয়। জঙ্গলমহলে মহিলা পুরোহিতের অবস্থা এখন কীরকম?
সুশীলকুমার বর্মন— মহিলা পুরোহিত আগে থেকেই ছিল। এখনও আছে। দেখুন, পুরুষাতান্ত্রিক সমাজ যখন এসে গেছে— সেটা কত বছর আগে থেকে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে কয়েক শতাব্দী আগে থেকে তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এসে গেছে। এই একটু আগে যেটা বললাম— বংশ-পরম্পরা— কোনো বংশে যদি পুরুষ সন্তান না-থাকে, তাহলে তার যে কন্যা সন্তান, সে-ই পুজোর অধিকার পাচ্ছে। এটা বহু থানেই আমি দেখেছি। সেটা আদিবাসীদের মধ্যেও দেখেছি, তফসিলিদের মধ্যেও দেখেছি। তবে সংখ্যায় খুবই কম।
তন্ময়— সেটা স্থানীয় মানুষ বা লোকজনের কাছে খুবই স্বাভাবিক? শহরাঞ্চলে যেমন ব্যতিক্রম হিসেবে দেখা হয়, এখানে কি সেই বিস্ময়ের পরিসর আছে?
সুশীলকুমার বর্মন— না, এটা এখানে একেবারেই স্বাভাবিক। মহিলা পুরোহিত পুজো করছে, ভক্তরাও সেভাবে সহযোগিতা করছে। এটা স্বাভাবিক। তবে কী জানেন? যেহেতু আদিবাসী বা অব্রাহ্মণ পুরোহিত পূজিত স্থানে বলিটা প্রধান, মহিলা পুরোহিতরা বলিটা দেন না। বলিটা দেন পুরুষ পুরোহিত। যার ফলে পৌরোহিত্যের কাজে মহিলাদের অংশগ্রহণটা কম।
তন্ময়— আমরা এতক্ষণ ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ পুরোহিতদের নিয়ে যে-আলোচনা করলাম, পুরোটা— এই পৌরোহিত্য বিষয়টাই তো ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তবে এমন কিছু থান আছে, যেখানে কোনো পুরোহিত লাগে না। ভক্তরাই নিজেরা অর্ঘ্য দেন। যেটা আবার বাংলার অন্যান্য জায়গায় খুব একটা সুলভ নয়। বেশিরভাগ জায়গাতেই মাধ্যম হিসাবে পুরোহিতরা থাকেন। এই যে পুরোহিতহীন থান— এই থানগুলো জঙ্গলমহলের প্রেক্ষিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
সুশীলকুমার বর্মন— এটা আমার কাছে খুবই আশার আলো। আমি যেটা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিই, সেটা হচ্ছে, ভক্ত এবং ভগবানের মাঝখানে একজন মধ্যবর্তী মানুষ থাকবেন কেন? আমি ভক্ত, আমার যে দেবতা আছেন, তাঁকে আমিই পুজো করব। আমি যা জানি, সেটাই দেবতাকে বলব। দেবতা আমার অর্ঘ্য গ্রহণ করবেন। এবং পুজোর ব্যাপারটা— মন্ত্র-তন্ত্র, এটা-ওটা, লোকাচার, তিথি ধরে কাজ করতে হবে, কিছুরই দরকার নেই। আমি ভক্ত, ভগবান আছে আমার, এর মাঝে কারোর থাকার দরকার নেই। পুরোহিতের কোনো দরকার নেই। এটা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটাই আশার আলো। আপনি যদি খড়গপুরে আসেন, তার ঠিক আগের স্টেশন জগপুর, তার আগের স্টেশন নাদপুর। যখপুর আর মাদপুরের মাঝে একটা গ্রাম আছে, মইষা নাম। ট্রেন লাইন থেকে দেখা যায়, মইষা গ্রামের ফাঁকা মাঠের ভিতরে বিশাল এক মনসা থান আছে। সেই মনসাথানে কোনো পুরোহিত নেই। ওখানে একটা গোষ্ঠী আছে, পরিচালন সমিতি আছে, তারাই পুজো পরিচালনা করে। ওই থানে পুজো দেওয়ার জন্য কোনো ব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণ কাউকে লাগে না। সেখানে যে আসছে, সে-ই গিয়ে পুজো দিচ্ছে। মনসা মায়ের মাথায় জল ঢালা, দুধ ঢালা, ফুল-মালা-শাড়ি-শাঁখা দেওয়া— এসব তাঁরা নিজেরাই করছেন। মৌচাকের মতো চারিদিকে জড়িয়ে যাচ্ছেন ভক্তেরা। যে যাঁর মতো যাচ্ছেন, ভক্তি ভরে প্রণাম করছেন, ফুল চড়াচ্ছে্ন, মালা চড়াচ্ছেন, শাড়ি দিচ্ছে্ন, যার যা কিছু দেওয়ার— এই হচ্ছে ঘটনা। আমাদের এখানে কোদাইবুড়ির থান আছে, সেখানেও একই ঘটনা।
তন্ময়— শেষ প্রশ্ন। ধর্ম বিষয়টির সঙ্গে তো একপ্রকার বিশ্বাস এবং মোহের আবরণ জড়িয়ে। অনেকক্ষেত্রেই মিশে থাকে চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারও। সেটাকে যদি সরিয়েও রাখি, এতক্ষণের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, স্থানীয় মানুষজন দেবতার প্রতি যথেষ্ট আস্থাবান বা নিষ্ঠাশীল। শহরাঞ্চলে বা নগরজীবনে যেমন দেখা যায়, ধর্মচর্চা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ততটা প্রভাব ফেলে না। জঙ্গলমহলের সমাজে ধর্ম কি অন্যতম চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে?
সুশীলকুমার বর্মন— যে-সমস্ত মানুষ এখনও শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে আছেন, তাঁরা কিন্তু ধর্মবিশ্বাসটা আঁকড়ে ধরে আছেন। বিজ্ঞানশিক্ষা বা উচ্চশিক্ষায় যাঁরা শিক্ষিত হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে তো ভ্যালুয়েশনটা আসছেই। আমার কথাই ধরুন, আমার একটা শিক্ষা আছে, আমি অন্যান্য জিনিস যেভাবে ভাবি, ধর্মটা সেভাবে আমি ভাবি না। এটা নাস্তিকতা ঠিক নয়, কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বাসটা অন্যরকম আছে। এই যেমন আমি বলছি পুরোহিতের দরকার নেই। গড ইজ নট দ্য ক্রিয়েটার অফ ম্যান, ম্যান ইজ দ্য ক্রিয়েটার অফ গড। আমার মতো অনেকেই আছেন যাঁরা এই ভাবনায় বিশ্বাসী। কিন্তু আমরা দেবতাকে মানি। একজনকে মানতে হয়। বিশ্বাসটা রাখতে হয়। সেই বিশ্বাস রাঢ়বাংলা বা জঙ্গলমহলের মানুষের মধ্যে ভরপুর, এটুকু বলতে পারি।
(সমাপ্ত)
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor