সুশীলকুমার বর্মনের জন্ম ১৯৬০ সালে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবং ব্লকের নোনামাধবচক গ্রামে। বর্তমানে ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজ (গার্লস উইং)-এর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ, গল্প ও ভ্রমণকাহিনি লেখেন। রয়েছে কয়েকটি বইও। বর্তমান ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘অব্রাহ্মণ পুরোহিত’ (প্রকাশকাল ২০২৩) বইটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে সুশীলকুমারের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ প্রথম পর্ব...
তন্ময়— বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে অব্রাহ্মণ পুরোহিত দেখা গেলেও, তথাকথিত মূলধারায় এই বিষয়টি প্রায় অচর্চিত। এইরকম একটি বিষয়কে কাজের ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিলেন কেন?
সুশীলকুমার বর্মন— আমি মূলত জঙ্গলমহলে, ঝাড়গ্রাম অঞ্চলে এসেছি দশ বছর আগে, কলেজের শিক্ষকতার কাজে ট্রান্সফার হয়ে। আগে গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্সে আমি অধ্যাপক ছিলাম। তবে ঝাড়গ্রামে আমার যাতায়াত ১৯৭৭-৭৮ সাল থেকে। তখন থেকে ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার কৌতূহল তৈরি হয়। কারণ, ঝাড়গ্রাম একটি আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। ঝাড়গ্রাম-জঙ্গলমহলে এমন অনেক অনেক জায়গা আছে যেখানে অজস্র আঞ্চলিক ইতিহাস লুকিয়ে আছে, যেগুলো সম্পর্কে গবেষণা, লেখালিখি বা কাজ অনেক কম হয়েছে। সেই কৌতূহল থেকে— যদিও আমি বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক বা ছাত্র তবুও এই বিষয়ে আমার আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। এখানে এসেই আমি পেয়েছিলাম ডক্টর সুব্রত কুমার মুখোপাধ্যায় নামের একটা বিদগ্ধ গবেষককে। এরকমই একজন মানুষকে খুঁজছিলাম, যিনি আমাকে এই বিষয়ে পথ দেখাবেন। তার আগে মূলত আমি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছি, গল্প লিখতাম, শুকতারা ছোটোদের গল্প বেরিয়েছে, বড়োদের গল্পও লিখেছি। তো এখানে এসে আমি সুব্রতবাবুকে পেলাম। ওঁর বাড়িতেই ভাড়া নিলাম— কাকতালীয়ভাবেই ওঁর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। ওঁর বাড়িতে ওঁর যে কাজ সেগুলো আমি দেখলাম, পড়লাম। শবরদের নিয়ে ওঁর প্রচুর কাজ আছে। শবরদের একটা নাচ-গান, যাকে বলা হয় ‘চাং’ নৃত্য। এই ‘চাং’-টা হারিয়ে যাচ্ছিল, সুব্রতবাবু বিভিন্ন শবরপাড়ায় ঘুরে সেটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। সুব্রতবাবু মূলত এই অঞ্চলেরই লোক। মানে জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই ঝাড়গ্রামে— যদিও তাঁর বাবা মাইগ্রেটেড হয়ে এসেছিলেন কৃষ্ণনগর থেকে। উনি হেডমাস্টার ছিলেন একটা স্কুলের। শীতলামঙ্গল নিয়ে তিনি গান গাইতেন। মনসামঙ্গল নিয়েও দীর্ঘদিন চর্চা করেছেন।
সুব্রতবাবুকে বলেছিলাম, আপনি তো শবরদের নিয়ে কাজ করেছেন, যে-উপজাতিদের নিয়ে সেভাবে কাজ হয়নি আমি তেমন উপজাতিদের নিয়ে কাজ করতে চাই। তাঁর থেকেই পেলাম ‘মাহালি’ উপজাতির সন্ধান। সাঁওতাল, মুণ্ডা, শবর যেমন আছে, মাহালিও তেমনই একটি উপজাতি। দেখলাম, এঁদের নিয়ে কাজ কম হয়েছে। সুব্রতবাবুর সঙ্গেই মাহালি গ্রামে গ্রামে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করি। তারপর হঠাৎ আমার বদলি হয়ে যায় পুরুলিয়ার এক কলেজে। সেখানে মাহালিপাড়ায় গিয়ে আমি দেখতে পাই, ওখানে খেলাইচণ্ডী নামে পুজো হয় যে-মূর্তির, সেটা ঋষভনাথের মূর্তি। এই ঋষভনাথকে দেখেই লোকসংস্কৃতি থেকে আমার ধ্যান-জ্ঞান সরে যায় প্রত্নতত্ত্বের দিকে— বিভিন্ন জায়গায় যে জৈন অবশেষ আছে, তার দিকে। ঋষভনাথ পুজো করছে মাহালিরা! যেদিন টুসু হয় অর্থাৎ মকর সংক্রান্তিতে তার মেলাও বসে। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। আমি ওখান থেকেই সুব্রতবাবুকে বিষয়টা বললাম, জিজ্ঞেস করলাম, ঝাড়গ্রামেও কি এরকম আছে? উনি জানালেন, ঝাড়গ্রামেও এরকম মূর্তি উনি দেখেছেন, আমি ফিরলে দেখাবেন। তার প্রায় দেড় বছরের মাথায় ঝাড়গ্রামে ফিরে এলাম। বর্তমানে আমি এখন যে-কলেজে আছি— রানি ইন্দিরা দেবী গভ. গার্লস কলেজ— এই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে জয়েন করি। এবং তখন থেকে পাগলের মতো এই মূর্তি খুঁজে বেড়াই, সুব্রতবাবুকে নিয়েই। এবং এই মূর্তি খোঁজার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য একটা জিনিস দেখলাম, গুপ্তমণির মতো একটা খুব জনপ্রিয় একটা দেবস্থান বা থান, জয়চণ্ডীর মতো থান, নয়াগ্রামের কালুয়া থান— এরকম অনেকগুলো থান, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ এবং প্রতিদিনই পঞ্চাশ-ষাটটা করে মোরগ ও দশ-বারোটা করে ছাগল বলি হয়— সেইসব থানের পুরোহিত কিন্তু ব্রাহ্মণ নয়। এটা হঠাৎ নজরে আসার পর সুব্রতবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার এটা কীরকম ব্যাপার? এঁরা তো কেউ-ই ব্রাহ্মণ নন। এঁরা কারা? সুব্রতবাবু জানালেন, ঝাড়গ্রামে বেশিরভাগ থানের পুরোহিত অব্রাহ্মণ। এটা নিয়ে তখনও পর্যন্ত কোনো চর্চা আমি দেখিনি, যেখানে বলা হচ্ছে অব্রাহ্মণ পুরোহিত পুজো করছে দেবস্থানে! এই বিষয়ে অনেকে টুকটাক লিখেছে, পত্রপত্রিকায় তেমন উদাহরণ আছে—কিন্তু বড়ো আকারে এই কাজ হয়নি। তখনই অব্রাহ্মণ পুরোহিত— যাঁদেরকে দেহরীও বলে— তাঁদের নিয়ে কাজটা করার ভাবনাচিন্তাটা এল। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা— যেগুলো এই অঞ্চলের পত্রিকা, যেমন, ‘এবং সায়ক’ বলে সূর্য নন্দীর পত্রিকা, হাওড়া-বীরশিবপুর থেকে বেরোয় তপন সেনের পত্রিকা ‘গ্রামীণ পুঁথি’, তাছাড়া আনন্দবাজার ‘জেলার পাতা’-য় তখন প্রবন্ধ বেরোত— সেসব জায়গায় লিখতে শুরু করলাম অব্রাহ্মণ পুরোহিত নিয়ে। সেসব লিখতে লিখতেই শেষ পর্যন্ত একটা বই প্রকাশ করা গেল। এ-ই ছিল এই বইয়ের ইতিহাস।
তন্ময়— জঙ্গলমহলের অব্রাহ্মণ পুরোহিতদের মধ্যে কি কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছেন যা অন্যত্র অনুপস্থিত?
সুশীলকুমার বর্মন— অন্যত্র অনুপস্থিত— এই কথাটা বলতে গেলে অন্যত্র গিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে হয়। আমি কিন্তু সেই স্টাডি করিনি। আমি মূলত জঙ্গলমহল এবং রাঢ়বাংলার জেলাগুলো— পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বীরভূম— এইসব জেলায় মূলত ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছি। আর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার তথ্য নিয়েছি আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। সেটা আমি এখানে চ্যাপ্টার হিসাবে দিইনি, উপসংহারে উল্লেখ করেছি। ফলে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে অব্রাহ্মণ পুরোহিতদের তফাৎ নিয়ে আমি বলতে পারি, কিন্তু বাংলার অন্যত্র অব্রাহ্মণ পুরোহিত কীভাবে পুজো করেন, তার তুলনামূলক বিবেচনা, বিশ্লেষণ সেভাবে করিনি। কারণ, ফিল্ড সার্ভে সেভাবে হয়নি আমার।
তন্ময়— রাঢ়বাংলার একটা বিশেষ অংশ— পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম— এই সমস্ত অঞ্চলে আপনি ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছেন। তাছাড়া গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গের যে-জেলাগুলি— নদিয়া, দুই চব্বিশ পরগনা, হুগলি, হাওড়া ইত্যাদি— এই জেলাগুলোতে যে-সব লৌকিক দেবদেবী পূজিত হন, তাঁদের মধ্যে কোনো-কোনো দেবতার পুজো রাঢ়বঙ্গেও দেখতে পাওয়া যায়। আবার কোনো-কোনো দেবদেবী আছেন, যাঁরা একেবারেই স্থানভিত্তিক। যেমন, দক্ষিণরায়, বনবিবি, বদর প্রমুখ। ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ীও বিভিন্ন দেবদেবীর উদ্ভব হয়। এবং এই জাতীয় লৌকিক পূজার্চনার ক্ষেত্রে অব্রাহ্মণ পুরোহিতদেরও দেখতে পাওয়া যায়। আপনার সমীক্ষা অনুযায়ী, ভূগোলের কারণে কি অব্রাহ্মণ পুরোহিতদের মধ্যে কোনো ফারাক জন্মাতে পারে?
সুশীলকুমার বর্মন— হ্যাঁ, এই বিষয়ে একটু বলি। আমার যেটা অবজারভেশন সেটা হল, আমরা যতই নগর থেকে দূরে যাই ততই এটার প্রভাব বেশি দেখতে পাই। নগরকেন্দ্রিক বা নগরের আশেপাশের যে-জনবসতি, যেটাকে বলা হয় ডেমোগ্রাফি— সেই ডেমোগ্রাফির যে-বিস্তার, সেটা অন্যরকম। মানে শহর এবং শহর-ঘেঁষা মফস্বলে তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষের বসবাস বেশি। আর যতই শহর থেকে দূরে যাবেন— যদি আপনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলে যান, কিংবা হাওড়া পেরিয়ে মেদিনীপুর যখন ঢুকছেন, তখন তথাকথিত নিম্নবর্গীয় মানুষের বসবাসটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তো আমার ধারণা— শুধু ধারণা নয়, আমি দেখেছিও, পূর্বে কলকাতার মধ্যেও প্রচুর দেবদেবী ছিলেন বা দেবস্থান ছিল যেখানে অব্রাহ্মণ পুরোহিত— মূলত ডোম ও হাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষরা পুজো করতেন। হয়তো আরও ভালো করে স্টাডি করলে এই বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যেতে পারে। তবে যাঁরা প্রাচীন পুথি সংগ্রহ করেছেন, সেই পুথির পাতায় হয়তো এই বিষয়টা খুঁজে পাওয়া যাবে। এবার আমি হাওড়ায় আসি। হাওড়ায় বহু জায়গায় বিশেষত ধর্মঠাকুর— ধর্মঠাকুরের পুজো, এটা মূলত করত ডোমরা। এটার প্রচলন করেছিলেন রামাই পণ্ডিত।
তন্ময়— যিনি ধর্মপূজা পদ্ধতি লিখেছিলেন। ‘শূন্যপুরাণ’-এর রচয়িতা…
সুশীলকুমার বর্মন— ঠিক। যিনি শূন্যপুরাণের রচয়িতা। তিনি জাতিতে ছিলেন ডোম। যদিও এই বিষয়টা বিতর্কিত। তবে আশুতোষ ভট্টাচার্য একেবারে পরিষ্কার বলেছেন, তিনি জাতিতে ছিলেন ডোম। সব জায়গাতেই ধর্মঠাকুরের পুজো করতেন ডোমরাই। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ধর্মঠাকুর পুজো করছেন ব্রাহ্মণরা। আমার বইতেই হাওড়ার একটা ধর্মঠাকুরের কথা বলেছি, যেখানে ডোম পুরোহিত। তার পাশের গ্রামে, সেখানে পুজো করতেন ডোম, তাঁর পদবি ছিল পণ্ডিত। এখন ওই পণ্ডিতকে বিতাড়িত করা হয়েছে ধর্মঠাকুরের থান থেকে। পণ্ডিত আর নেই। সেখানে স্থানীয় মানুষ ব্রাহ্মণ পুরোহিত নিয়োগ করেছেন। যখন ওই অঞ্চল ছিল ডোম অধ্যুষিত, তখন ডোমরাই ছিলেন প্রধান। তাঁরাই পুজো করতেন। পরবর্তীতে যখন ওই অঞ্চলে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষজন বসবাস শুরু করলেন, তখন ডোমরা পুজো-পুরোহিতগিরি থেকে বাদ পড়লেন। এই ব্যাপারটা আমাদের জঙ্গলমহলে কিন্তু এখনও হয়নি। বেশিরভাগ জায়গায় আদি পুরোহিত-প্রথার ব্যাপারটা থেকে গেছে। এই যে আপনি বললেন শতাব্দীর পর শতাব্দী— আসল কথা হল, বাংলায় তো ব্রাহ্মণ এসেছেন ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। এটা তো মান্যতা পাবে যে বল্লাল সেনের হাত ধরে। রাঢ়ী শ্রেণির ব্রাহ্মণকে আনা হয়েছিল। তারপর বাংলা একটা জাতে উঠেছে। তার আগে, মহাভারতের যুগে বাংলা ছিল অচ্ছুৎ জায়গা। এখান থেকে কেউ ফিরে গেলে তাঁকে শুদ্ধ হতে হত। তো সেই আদিমতাটা এখনও থেকে গেছে রাঢ়বাংলার জঙ্গলমহল এলাকায়। এবং এই যে উপজাতি, তথাকথিত নিম্নবর্গীয় জাতি এবং উপজাতির মানুষ, তাঁরা যে হাজার হাজার বছর আগে থেকে পুজো করে আসছেন— প্রকৃতি-পুজো, সেই প্রকৃতি-পুজোর পুরোহিত হিসাবে তাঁরাই কিন্তু এখনও আছেন। এঁদের উত্তরসূরি হচ্ছেন বিশ্বাবসু শবর। জগন্নাথদেব নীলমাধব হিসেবে যখন ছিলেন— তিনি তো প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজার হাত ধরে, কিন্তু ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা কর্তৃক প্রতিষ্ঠার আগে জগন্নাথদেব পূজিত হতেন নীলমাধব রূপে, বিশ্বাবসু শবরের হাতে।
তন্ময়— বেশ। এবার জঙ্গলমহল নিয়েই এই আলোচনাটা এগোক। আমাদের আলোচনায় এটা উঠে এল যে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রচলন ছিল। বর্তমানেও সেই ঐতিহ্যেরই উত্তরাধিকার চলে আসছে। কিন্তু এর মধ্যে কি কখনো ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিস্পর্ধা হিসাবে অব্রাহ্মণ পুরোহিত নিয়োগ হয়েছে বা আবির্ভাব হয়েছে? ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্যের মুখে দাঁড়িয়ে একটা জেদ বা প্রতিবাদের চিহ্ন স্বরূপ অব্রাহ্মণ পুরোহিতের আগমন— এরকম ইতিহাস কি কোথাও পাওয়া যায়?
সুশীলকুমার বর্মন— এটা উল্টো। যেটা আমি বললাম— যেখানে অব্রাহ্মণ পুরোহিত ছিলেন, সেখানে ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে নিয়োগ করা হয়েছে। এখনও জঙ্গলমহলে অব্রাহ্মণ পুরোহিতের সঙ্গে কোথাও কোথাও ব্রাহ্মণ পুরোহিত পুজো করেন বিশেষ বিশেষ সময়ে— যেমন, জয়চণ্ডী বলে একটা থান আছে, সেখানে লোধা পুরোহিত— লোধা শবর। কিন্তু দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী থেকে নবমী বা দশমী পর্যন্ত সেখানে পুজো করছেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত। প্রথমে লোধারাই সমস্ত পুজো করতেন এখানে। পরে যখন এই অঞ্চলে— জয়চণ্ডীর স্থানীয় অঞ্চলে উচ্চবর্গীয় মানুষের বসবাস হল, তখনই জমিদারকে প্রভাবিত করা হল। জমিদার হুকুম দিলেন, এখানে লোধারা পুজো করতে পারবেন না, ব্রাহ্মণ পুজো করবেন। তারপর লোধারা চলে যায় জয়চণ্ডীর ঘট নিয়ে। তাঁরা জয়চণ্ডীর পুজো করতে থাকেন জঙ্গলের মধ্যে। এদিকে দেখা যায় লোধারা যেখানে পুজো করছেন সেখানেই বেশি লোকের ভিড়। আসলে এই অঞ্চলে তো বেশিরভাগই নিম্নবর্গীয় মানুষ। এই অঞ্চলে একটা ধারণা রয়েছে যে দেবী লোধা-পূজিত হলে তবেই মনস্কামনা পূর্ণ হবে।
তন্ময়— এটাই আমার পরের প্রশ্ন ছিল। যে-সমস্ত জায়গায় অব্রাহ্মণরা পূজারী, সেখানে যখন পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ পূজারীরা এসেছেন, ভক্তরা কি ব্রাহ্মণদের দিকে ঝুঁকেছেন নাকি প্রাচীন যে-ঐতিহ্য সেদিকেই বেশি টান?
সুশীলকুমার বর্মন— আদিমতা যেখানে আছে, তার দিকেই ভক্তদের টান বেশি— এটা দেখেছি। হয়তো জৌলুসের জন্য... এই জয়চণ্ডীর ক্ষেত্রেই ধরুন— ব্রাহ্মণরা এসে বলছেন, তোরা তো চণ্ডীপাঠ করতে পারবি না, দুর্গাপুজোতে চণ্ডীপাঠ লাগে, ফলে আমরা চণ্ডীপাঠ করব, এই ক’দিন আমরাই পুজো করব। তো ব্রাহ্মণরাই সেই চণ্ডীপাঠ করছেন, মন্ত্রোচ্চারণ করছেন, শাস্ত্রমতে পুজো হচ্ছে। সে-সময় কিছু মানুষের ঢল আসে। কিন্তু আমি দেখেছি যখন দুর্গাপূজা নেই— যেমন মকর সংক্রান্তিতে— এখানে আইখান বলে, আমাদের জঙ্গলমহলে সবচেয়ে পবিত্র দিন আইখান, মানে পয়লা মাঘ— আইখানে যখন জয়চণ্ডীর পুজো হয়, আমি দেখেছি পাঁচশো পুরুষ আর সাত-আটশোর বেশি মহিলা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন পুজো দেওয়ার জন্য। তখন কিন্তু সেই লোধা পুরোহিত পুজো করছেন। মানুষ তাঁর হাতেই পুজো দিচ্ছেন। এটা কী প্রমাণ করে? ব্রাহ্মণ এলে মানুষ বেশি আসে, লোধারা পুজো করলে মানুষ কম আসে? তা কিন্তু নয়। ওরা লোধা পুরোহিতের হাতেও ভক্তি সহকারে পুজো দেয়।
তন্ময়— জঙ্গলমহলে লৌকিক দেবদেবীর থানগুলোতে পূজারী ব্রাহ্মণ না অব্রাহ্মণ তা ভক্তদের কাছে আদৌ গুরুত্ববাহী, নাকি দেবতার প্রতি অর্ঘ্য নিবেদনটাই প্রধান?
সুশীলকুমার বর্মন— হ্যাঁ, এটাই হল মূল কথা। মানুষের বিশ্বাস। আবহমান কাল ধরে এটা চলে আসছে জঙ্গলমহলে। বিশ্বাসেই মানুষ এইসব জায়গায় আসেন। আর বিশ্বাস তো সর্বত্রই— ব্রাহ্মণ যেখানে আছেন, সেখানেও তো বিশ্বাস। বিশ্বাস ছাড়া তো ভক্তি হয় না, বিশ্বাস ছাড়া তো দেবতা হয় না। তো সেখানে এই বিশ্বাসই মানুষের মধ্যে আছে যে, কে পুজো করছে সেটা বড়ো কথা নয়। কিংবদন্তি আছে, গুপ্তমণি একজন দেবী, গুপ্তমণি মনস্কামনা পূর্ণ করেন। এবং বহু মানুষের মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে— এমনটাই বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকেই এখানে বহু মানুষ এসে মানত করেন। পরবর্তীতে মানত পূরণ হলে তাঁরা আবার এসে পুজো দেন। এভাবেই আবহমান কাল ধরে এটা চলে আসছে।
তন্ময়— আপনার গবেষণা বা ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে এটা বোঝা যায় যে, গত এক শতাব্দীতে অব্রাহ্মণ পুরোহিতেরা ব্রাহ্মণ পুরোহিতের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছেন। ষাট-সত্তর বছর আগেও হয়েছেন, এমনকি সম্প্রতিকালেও। বিভিন্ন থানে এমন নজির রয়েছে। তাতে স্থানীয় মানুষ বা অব্রাহ্মণ পুরোহিতদের প্রতিক্রিয়া কী? তাঁরা কি ব্যাপারটাতে অসন্তুষ্ট? এবং যেখানে ব্রাহ্মণ পুরোহিত স্থায়ীভাবে নিয়োগ হয়েছেন ভবিষ্যতে কি তাঁদের সরিয়ে প্রাচীন অব্রাহ্মণদের রীতি ফিরে আসার সম্ভাবনা কি কোথাও লক্ষ করেছেন?
সুশীলকুমার বর্মন— সেই সম্ভাবনা নেই আর। কারণ, যেখানে ব্রাহ্মণ পুরোহিত নিয়োগ হয়েছেন সেখানে উচ্চবর্গীয় মানুষের গরিষ্ঠতাও এসেছে। প্রাধান্য এসেছে। এই প্রাধান্যের ফলে উচ্চবর্গীয় মানুষরা যে-ব্রাহ্মণকে নিয়োজিত করেছেন, সেখানে কিন্তু অব্রাহ্মণ পুরোহিতের ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। কেন-না, এই অব্রাহ্মণ পুরোহিত যাঁদের দ্বারা সমর্থিত, সেটা তাঁদেরই কমিউনিটি। সেই কমিউনিটি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। বিশেষত শহুরে অঞ্চল থেকে। ময়নার বহু গ্রামে ধর্মঠাকুর আছে। পঁচিশ বছর আগের একটা বইটা আমি পড়েছি, ডক্টর সুকুমার মাইতি সম্পাদিত নরসিংহ বসুর ‘ধর্মমঙ্গল’। সেখানে ড. মাইতিও ফিল্ড সার্ভে করেছেন, ময়নার বিভিন্ন প্রান্তে উনি দেখেছেন পুজো করছেন অব্রাহ্মণ পুরোহিত। আমি সেইসব গ্রামের ধর্মঠাকুরের বর্তমান পুরোহিতের ফোন নম্বর জোগাড় করে কথা বললাম। তাঁর নাম জিজ্ঞেস করে জানলাম, পদবি কুলভী। আমি বললাম, এখানে তো সত্যজিৎ পণ্ডিত আগে পুজো করতেন! আমাকে বলা হল, তিনি মারা গেছেন, তাঁর ছেলেরা ডোম মেয়েকে বিয়ে করে চলে গেছে। আসল কথা, ওঁরা ডোম। পণ্ডিতরা, যাঁরা পুজো করতেন, তাঁরা ডোম…
তন্ময়— হ্যাঁ, ধর্মঠাকুরের পুরোহিতরা বরাবরই মূলত ডোম সম্প্রদায়েরই হন। তাঁরা তামা ধারণ করে পণ্ডিত পদবি নেন।
সুশীলকুমার বর্মন— একদমই তাই। যেমন পৈতে ধারণ করে ব্রাহ্মণ হওয়া যায়, তেমনই তামা ধারণ করে ওঁরা পৌরোহিত্য লাভ করেন। হাতে তামা ধারণ করেন— আংটি ধারণ করেন। আমি বাঁকুড়ার মটগোদা ধর্মঠাকুরের ক্ষেত্রে ওটা বিস্তারিতভাবে বলেছি। সুতরাং এই সম্ভাবনা আর নেই। কারণ, মানুষের আধুনিকতার যে-জোয়ার, সেই জোয়ারে যেখানে ব্রাহ্মণ পুরোহিত নিযুক্ত হয়েছেন, সেখানে অব্রাহ্মণ পুরোহিত ফিরে আসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই।
তন্ময়— এই যে রাঢ়ের বিভিন্ন অঞ্চলে যেখানে অব্রাহ্মণ পুরোহিত ছিলেন, সেখানে আপনি দেখেছেন এই বদলটা একমুখী। মানে অব্রাহ্মণ থেকে ব্রাহ্মণ পুরোহিত নিয়োগ। আপনি একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন এর আগে। শহর ধীরে ধীরে গ্রামকে গ্রাস করছে। শহর বা নগরায়ন যত বিস্তারিত হতে থাকবে তত ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য বাড়বে। এই ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে আদিম যে-প্রচলনগুলো রক্ষা করার কি কোনো পথ আপনি দেখতে পেয়েছেন? কিংবা এমন কোনো থান বা এমন কোনো জায়গা যেখানে শত বদল ঘটে গেলেও ব্রাহ্মণ্যবাদের থাবা পড়বে না— দূরদৃষ্টিতে এরকম কোনো বিশ্বাস কি জন্মেছে?
সুশীলকুমার বর্মন— আমার আশঙ্কা, জয়চণ্ডীর থান কোনোদিন হয়তো ব্রাহ্মণদের হাতে চলে যাবে। গুপ্তমণি ক্রমশ যেভাবে ‘হিন্দু’ হচ্ছেন, মানে যেভাবে সংস্কার হচ্ছে আরকি, তাতে আশঙ্কা থেকেই যায়।
তন্ময়— গ্রামবাংলার লৌকিক দেবদেবীর থানের প্রেক্ষিতে বারবার ছলনের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এসেছে। এই ছলন কি থানের চারিদিকে মাটির হাতি-ঘোড়ার স্তূপাকারে ঘিরে থাকা?
সুশীলকুমার বর্মন— হ্যাঁ। এই যে পোড়ামাটির হাতি-ঘোড়া, এগুলোকে বলা হয় ছলন। এই ছলনে কোথাও কোথাও বাঘের মূর্তিও দেওয়া হয়।
তন্ময়— ছলন শব্দটা নিশ্চয়ই ছল থেকে এসেছে? দেবতার প্রতীক রূপে পূজা করা হয় বলেই কি ছলন?
সুশীলকুমার বর্মন— অনেকে সেভাবেই বিশ্বাস করেছেন যে, ছল থেকে ছলন। বা ‘চলন’ থেকেও কথাটা আসতে পারে। ভক্তরা মনে করেন, আমি যে-হাতিটা দিলাম, ঘোড়াটা দিলাম— আমার দেবী বা দেবতা সেই হাতি বা ঘোড়ায় চড়ে আমাদের এই এলাকাটাকে সুরক্ষিত রাখবেন। এটা তাঁদের ধারণা।
তন্ময়— এবং সেই দেবতার কোনো লিঙ্গ নেই নিশ্চয়ই? মানে সেটা দেবতা বা দেবী উভয়ই হতে পারেন?
সুশীলকুমার বর্মন— হ্যাঁ, উভয়ই হতে পারেন। তবে মূলত দেবীই। আমাদের এখানে পুরুষ নামের দেবতাকেও দেবী হিসাবেই পুজো করা হয়।
তন্ময়— এতে কি আপনি আদিম জনগোষ্ঠীর যে মাতৃতান্ত্রিকতার ছাপ দেখতে পান?
সুশীলকুমার বর্মন— শুধু মাতৃতান্ত্রিকতা নয়। এটা হল মাতৃরূপে দেখা— যেটা প্রজননের সঙ্গে জড়িত। কৃষি প্রজনন হতে পারে, মানব প্রজনন হতে পারে, সেটা পশু প্রজননও হতে পারে। প্রজননের আধার হলেন দেবী বা মা। মা-র থেকেই প্রজনন। সেই মা-কে যদি সন্তুষ্ট করতে পারি তাহলে আমাদের শস্য বাড়বে, পশু উৎপাদন বেশি হবে, আমার সন্তান-সন্ততি জন্মাবে এবং তারা সুখে-শান্তিতে থাকবে, দুধে-ভাতে থাকবে। এই হল মাতৃবন্দনা। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। এই সন্তানের মঙ্গলকামনা থেকেই কৃষিপ্রজনন, পশুপ্রজনন— আর সেটাই মাতৃরূপে পুজো করার প্রধান কারণ। আবার এটা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বা মাতৃতান্ত্রিকতার সঙ্গেও রিলেটেড, যেটা আপনি বললেন। তবে আমি বেশি গুরুত্ব দিই প্রজননের আধার হিসাবে।
তন্ময়— আপনার কথা থেকেই উঠে এসেছে, বিভিন্ন প্রাচীন থান, যেগুলো হয়তো স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায় যেভাবে পুজো করতেন, ধরুন গাছের গোড়ায় বা কোনো বেদির ওপর, অনেকক্ষেত্রেই সেগুলোর অত্যধিক আধুনিকীকরণ হচ্ছে। মার্বেল বসছে, ভোল পাল্টে যাচ্ছে। এবং তার ফলে ইতিহাস বা ঐতিহ্য ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে। এই যে-পরিস্থিতি তার কোনো বিপরীত বদলের উপায় নেই। যত দিন এগোবে, প্রাচীন্সংস্কৃতি আরও ধুয়েমুছে যাবে!
সুশীলকুমার বর্মন— হ্যাঁ। প্রাচীনতার যে-একটা ঐতিহ্য, মানে মূল ভাবনা বা ঐতিহ্য বা তার সঙ্গে ভক্তিশ্রদ্ধা বা আবেগ জড়িয়ে থাকে। প্রকৃতি পুজোর আসল উদ্দেশ্য— একটা গাছ থাকবে, তার নিচে একটা পাথর থাকবে, তার চারদিকে গাছের বেষ্টনী থাকবে, আর সেই বেষ্টনীর মধ্যে আমার দেবী অধিষ্ঠান করবেন। গুপ্তমণির থান আজকে একটা ছোটো মন্দিরে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, যে-পাথরটাকে গুপ্তমণি নামে পুজো করা হত, যেটা গুপ্ত অবস্থায় ছিল… গুপ্তমণি মানে কী? বনের মধ্যে গাছের তলায় তিনি গুপ্ত ছিলেন। তিনি এখন আর গুপ্ত নেই। তিনি ব্যপ্ত হয়ে যাচ্ছেন। সেখানে আসল পাথর অবহেলিত। সেখানে কী বসছে? সন্তানসন্ততি-সহ মা দুর্গার রূপ। মানে ছোটো মেয়ের আকারে দশভূজা দুর্গার রূপ পেছনে রাখা আছে। এদিকে ঢুকতে গিয়েই একটা দুর্গামূর্তি। এই যে একটা হিন্দু ধর্মের প্রভাব... আসলে আদিবাসীদের ধর্ম হল ‘সারনা’ ধর্ম।
তন্ময়— এই সারনা ধর্ম সম্পর্কে যদি একটু সামান্য কিছু বলেন।
সুশীলকুমার বর্মন— সারনা ধর্ম মূলত সাঁওতাল, লোধারা পালন করেন। এখন আবার দেখবেন মাহাতো যাঁরা, কুর্মি সমাজ— তাঁরা সারনা ধর্মে বিশ্বাসী বলে আদিবাসী হতে চাইছেন। তো আদিবাসী মানুষদের যে-ধর্ম, সেটাকেই বলা হয় সারনা ধর্ম। সেই সারনা ধর্মের স্বীকৃতি পেতে চাইছেন আদিবাসী মানুষরা। স্বীকৃতি মানে, তাঁদের নিজেদের কাছে তো স্বীকৃতি আছেই! কিন্তু সংবিধান বা আমাদের রাষ্ট্রের কোনো স্বীকৃতি নেই। রাষ্ট্র জানে হিন্দু, মুসলিম, জৈন, বুদ্ধ। যখন ফর্ম ফিলআপ করছি, তখন রিলিজিয়ন কী দিচ্ছি? ওঁদের ধর্মটা যেহেতু সেই তালিকায় নেই, ওঁরা হিন্দু লিখতে বাধ্য হচ্ছেন। হিন্দুইজম, বুদ্ধিজম, জৈনিজম থাকলেও সারনাইজম নেই সেখানে। সারনা ধর্মটাই আদিবাসীদের মূল ধর্ম। এটা খুবই বিপদের মুখে বা আশঙ্কার দিকে চলে যাচ্ছে এইসব থানগুলোতে যখন আধুনিকীকরণ হচ্ছে। গাছ কেটে দিয়ে থানগুলো যখন মন্দির হয়ে যাচ্ছে, তখন তার যে-আদিরূপ, সেটা হারিয়ে যাচ্ছে। যখন প্রদীপের আলোর বদলে ইলেকট্রিকের আলো জ্বলছে— আগে সন্ধের পর ওখানে যাওয়া যেত না, এইসব থান ভয়ঙ্কর ছিল— সে-সব জায়গায় এখন ইলেকট্রিকের আলো বসছে। তো এই আধুনিকতার ধাক্কায় এইসব আর বেশিদিন থাকবে না। এটাও আবার আমার একটা লক্ষ্য ছিল যে, আমি যদি এগুলো নথিভুক্ত করে রাখতে রাখতে পারি, তাহলে পঞ্চাশ বছর পরে কেউ মিলিয়ে দেখলে দেখবে আগেকার সেই স্বর্গবাউড়ি, আগেকার সেই কালুয়া ষাঁড়, জয়চণ্ডী— এগুলো আর নেই। যেগুলো এখনও গাছতলায় আছে, সেগুলোও থাকবে না, পাথর বাঁধানো মন্দিরে অধিষ্ঠিত হবে। লোকে বলবে, আমি উপকার পেয়েছি তাই এক লক্ষ টাকা দান করছি। কিংবা বড়ো বড়ো মন্ত্রীরা মন্দিরের শিলান্যাস করবে, মন্দির উদ্বোধন করবে, তার অনেক নাম হবে। এটা হচ্ছে আধুনিকতার সবচেয়ে বিষাক্ত দিক।
(চলবে)
অনুলিখন— শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor