ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — দ্বিতীয় পর্ব

সুপ্রিয় চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৬ সালে, কলকাতার গড়পারে। পরবর্তীকালে পার্ক সার্কাসের বাসিন্দা। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্রোহজ’, যা প্রকাশ পাওয়ামাত্রই পাঠকমহলে সাড়া পড়ে যায়। তার পরে লিখেছেন একাধিক উপন্যাস ও গল্প। ২০২১ সালে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনে শহিদদের স্মৃতিতে নির্মিত বেদি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করেন সুপ্রিয়, যা পরবর্তীকালে ‘স্মৃতি বিস্মৃতির শহিদ বেদি ৭০’(প্রকাশকাল মে ২০২২) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বর্তমান কথোপকথনটি আবর্তিত হয়েছে সেই বইটিকে কেন্দ্র করেই। কথোপকথনে সুপ্রিয় চৌধুরীর সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।


(প্রথম পর্বের পর)

তন্ময়— যাঁরা নকশালপন্থী, তাঁরাও পরবর্তীকালে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে গেলেন। তৈরি হল সিপিআই(এমএল)-এর বিভিন্ন শাখা। এমন ঘটার কারণ কী?

সুপ্রিয় চৌধুরী— আমার ব্যক্তিগত ধারণা কী জানেন? বাঙালির এটাই হওয়ার ছিল। বললে ভাববেন, খুবই প্রতিক্রিয়াশীল মন্তব্য। ধরুন, আজকের দিনে আমার বাইপাস সার্জারি হয়েছে, অথচ আমি অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া হিমালয়ে চলে গেছি, বা হেঁটে হিমালয়ে উঠে গেছি। এটা যেরকম অবাস্তব, সেই পরিমাণ অবাস্তব ব্যাপারটা ঘটে যেত, যদি সত্যি সত্যিই নকশালরা ক্ষমতায় এসে বসত। তেমনটা হলে আমি শিওর যে, ছ-মাসের মধ্যে সিএম ও সরোজ দত্ত মার্ডার হয়ে যেতেন। আমি একদম নিশ্চিত।


তন্ময়— সেটা কেন? দলীয় খেয়োখেয়ির জন্য?

সুপ্রিয় চৌধুরী— হ্যাঁ। একদম, একদম। এসব দেখেই ওগুলো নিয়ে বলতে চাই না। যার জন্য আমি ওই একটা সময় কিছুটা বালখিল্য দৌড়াদৌড়ি করা ছাড়া, পরবর্তীকালে আর কোনো উপদল, কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গেই যুক্ত নই।


তন্ময়— বুঝেছি। আচ্ছা, আমি আরেকটা বিষয় বলছি। আপনি সত্তরের দশকের শহিদ বেদি নিয়ে কাজ করলেন। আমি বিভিন্ন সময় ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে বেশ কিছু শহিদ বেদির নোট নিয়েছিলাম, যেগুলো হয়তো অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সময় বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলন, বিভিন্ন কলকারখানায় ইউনিয়ন লিডার, শ্রমিক নেতা— তাঁদেরও হত্যার স্মৃতিতে শহিদ বেদি আছে…

সুপ্রিয় চৌধুরী— হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছেন ভাই। এইটা মনে হয় আমার খামতি থেকে গেল, জানেন? আমি এটা অনেক পরে ভাবলাম। 

পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — প্রথম পর্ব

তন্ময়— না, আপনার খামতি নেই। আপনি তো কাজটা সত্তর দশক নিয়ে করেছেন। আর এটা তো অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সময়কার…

সুপ্রিয় চৌধুরী— আমি তার সত্তরের দশকের পরেরটাকে আর ধরতামও না। আমি জানি যে, নকশালপন্থীদের আরও অনেক শহিদ বেদি নদিয়া-সহ উত্তরবঙ্গে আছে। আমি সত্তরের সময়টাকে ধরেছি বলেই তাঁদের বাদ দিয়েছি। এমনকি '৮২তে রথীন পালচৌধুরী— এঁদের শহিদ বেদিগুলোকে আমি ধরিনি। বাহাত্তর থেকে সত্তর থেকে সাতাত্তর—এই সময়ে, মানে ওই স্প্যানটাতে যাঁরা শহিদ হয়েছেন আমি তাঁদেরকেই ধরেছি। তারপরে আমি আর ধরিনি। লক্ষ করলে দেখা যাবে, সাতাত্তর হচ্ছে আমার টেনে দেওয়া একটা লাইন। তবে সত্যি কথা, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সময়কার শহিদবেদি নিয়েও একটা কাজ হওয়া উচিত। হয়তো কেউ সেটা করবেন কোনোদিন। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির খাদ্য আন্দোলনে, লতিকা-প্রতিভা-অমিয়া— যাঁরা শহিদ হলেন বউবাজারের মোড়ে, বিধান রায়ের সরকারের গুলিতে— এরকম বহু উদাহরণ আছে।


তন্ময়— অন্য একটা প্রসঙ্গে আসি। নকশাল আন্দোলন চলাকালীন যারা সেই আন্দোলনে যোগ দেয়নি, সাধারণ যুবক-কিশোর, যারা গড়পড়তা সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করছে, তাদের প্রতি নকশালপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল? আপনারও তখন ১৫-১৬ বছর বয়স। আপনার যে-সমস্ত বন্ধু এই আন্দোলন থেকে দূরত্ব রেখেছিল, তাদের কি করুণার বা অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হত?

সুপ্রিয় চৌধুরী— হ্যাঁ, তেমন একটা মনোভাব ছিল। যে তোরা করলি না! খুবই ক্লোজ বন্ধুবান্ধব। যেমন দেখো, একটা স্কুল কিংবা একটা পাড়ায় তো সবাই নকশালপন্থী হয়ে যায়নি। তবে হ্যাঁ, সে-সময় এমন দাপট ছিল যে, না-করাটাই একটা আশ্চর্য ব্যাপার বলে মনে করা হত।


তন্ময়— মানে নকশাল আন্দোলন একটা ক্লাসের ব্যাপার— এমন কিছু?

সুপ্রিয় চৌধুরী— হ্যাঁ, কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা, তখন তালেগোলে হয়ে যাচ্ছিল। কীরকম বলো তো? কেউ যে খুব মার্ক্সবাদ পড়ে ফেলছে, ব্যাপারটা ওরকম নয়। খুব ছোটো ছোটো ঘটনা ঘটছিল আরকি। মানে কাগজে এসেছিল ভিয়েতনাম, কাগজে এসেছিল চে গুয়েভারা তার ৩ বছর আগে মারা গেলেন— এইসব মিলিয়ে-মিশিয়ে একটা সময়। আমরা যখন আন্দোলন করছিলাম, তখন সময় জীবন্ত ছিল আরকি। তখন ভিয়েতনাম, লাল চিন দেখতে পাচ্ছি। তার বাইরেও প্যালেস্তাইনের মুক্তিযুদ্ধ। আজকে প্যালেস্তাইনকে সন্ত্রাসবাদী বলা হয়, তখন ইয়াসের আরাফাত আমাদের কাছে হিরোর সম্মান পেতেন। মৃদুল দাশগুপ্ত তাঁর কবিতায় লিখছেন, আরব গেরিলাদের সমর্থন করি। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় গদ্যেও তাঁর লাইন ব্যবহার করছেন, এই একই লাইন, ‘আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি’। তা তখন তাঁরা আরব গেরিলা ছিলেন, আজকে মোদী-ট্রাম্পের যুগে তাঁদের সন্ত্রাসবাদীই বলা হয়। তো সবমিলিয়েই এইটা। টুকরো-টুকরো ব্যাপার। স্কুলে হঠাৎ দেখা গেল দেওয়ালে লেখা আছে, ‘প্রতিবার আর প্রতিরোধ যদি থাকেই তোমার স্বভাবে/ স্বাগত স্বাগত স্বাগত তোমায় আমাদের ইনকেলাবে’। এসব যখন দেখছে একটা বাচ্চা ছেলে, ওইটাই যথেষ্ট হয়ে যাচ্ছে…


তন্ময়— আপনি যদি একটা সমাজব্যবস্থার দিকে তাকান, তাহলে এ-কথা তো অনস্বীকার্য যে, যে-কোনো গণ-আন্দোলনের ক্ষেত্রে ছাত্রদের বা যুবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। কিন্তু নকশাল আন্দোলনের সময় ব্যাপক হারে কিশোররাও নেমে এসেছিল। বয়সের নিরিখে তা হয়তো খানিক ব্যতিক্রমীও বটে। এই জিনিসটাকে আপনি এই ৬৬ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে কীভাবে দেখেন? আদর্শের তাড়না, নাকি ভুল পথে যাওয়া?

সুপ্রিয় চৌধুরী— দীর্ঘসময় ধরে তাঁদের মধ্যেও একটা ভাবনা চলছিল। সেটা হয়তো ভাসা-ভাসা। কিন্তু যেটা চলছে, তা ঠিক চলছে না। আর ওই সময়ে দারুণ সব ব্যাপার-স্যাপার ঘটেছিল। ভালো ভালো সব স্কুল-কলেজের দাদারা বা শিক্ষক… আমার ‘দ্রোহজ’-র একটি চরিত্র হয়তো আপনার মাথায় রয়েছে, অমিতেশ স্যার— তো এই যে টিচাররা এলেন, তাঁরা বললেন, ‘আজকে পড়াব না, আজকে চল তোদের ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ শোনাই, কিংবা আজকে তোদের ‘ধীরে বহে ডন’ শোনাই, মিখাইল শোলোখভ…’ গল্পের মতো করে বোঝাচ্ছেন, অসম্ভব ভালো স্টোরিটেলার ছিলেন তাঁরা। বোঝাচ্ছেন, আমরা শুনছি। তারপর সুকান্ত পড়ছি, ‘বলতে পারো বড়ো মানুষ মোটর কেন চড়বে?/ গরিব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?’ এইগুলোই আমাদেরকে তৈরি করে দিয়েছিল। এখন এইধরনের কবিতাও আর পড়ে না কেউ। সেটা নিয়ে ভালো-খারাপ কিছু বলব না। সময়ই তো এরকম হয়ে গেছে। 

পড়ুন প্রথম পর্ব

তন্ময়— সে-সময় যুবক-কিশোররা কখনো অগ্রজদের দেখানো পথে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামছেন, কখনো নকশালবাড়ির আদর্শ হয়ে উঠছে তাঁদের জোর। বর্তমানে যে রাজনৈতিক কিংবা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে তরুণ প্রজন্ম দিন কাটাচ্ছে, তাতে নকশালবাড়ি বা ওইজাতীয় কোনো আদর্শ কি এই বিশ্বায়ন-পরবর্তী পৃথিবীতে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে?

সুপ্রিয় চৌধুরী— হ্যাঁ, পারবে। তবে দুটো জিনিস বলি। আজকে যে ছেলেটি ধরো বিপ্লবী চেতনা বা বিপ্লবী রাজনীতিতে যাচ্ছে, তার সামনে তো খুব একটা সময় নেই। ওইরকম একটা সময় তার সামনে দাঁড়িয়ে নেই পথ-প্রদর্শক হয়ে। ফলে তার পক্ষে কঠিন। তবে একটা জিনিস, ৭৭-৭৮ সাল বা নব্বইয়ের দশকে যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় যাদের রাজনীতিটা করতে দেখেছিলাম, তাদের যা জ্ঞান, তারা যে পরিমাণ পড়াশোনা করে এসেছিল, সেটা বর্তমানে ভীষণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। ইভেন আমি সেটা যাদবপুর, প্রেসিডেন্সিতেও দেখতে পাচ্ছি। বোধটা, মানে রাজনীতির জ্ঞানটা অনেক কমে গেছে। নব্বইয়ের দশকের যে ছেলেমেয়েদের দেখেছি, তাদের তুলনায় হালফিলে জ্ঞান অনেকটা কম। কেন হয়েছে সেটা, আজকে স্কুল-কলেজ-ইউনিয়নে যাঁরা ছাত্র রাজনীতি করছেন বা যাঁরা যাঁরা আছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন। তাঁরা একটু ভেবে দেখতে পারেন।


তন্ময়— আপনি বললেন, নকশালরা যদি ক্ষমতায় আসত, তবে ছ’মাসের মধ্যে সরকারের পতন ঘটত। সেই সম্ভাবনাটা সরিয়ে রেখে যদি ভাবি যে আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁরা প্রশাসনে এলেন এবং প্রশাসন চালালেন, তাহলে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আজকের সমাজ ব্যবস্থাটা কীরকম দাঁড়াত?

সুপ্রিয় চৌধুরী— তেমনটা হতই না। আমি যে-পরিমাণ খেয়োখেয়ি দেখেছি, তাতে স্পষ্ট, ওসব কিছুই হত না। এই পরিমাণ ভেঙে যাওয়া… আজকেও কি দেখতে পাচ্ছ না? উপদল, উপদল, উপদল… মানে বিভক্ত প্রত্যেকে। আমি জানি, নকশালদের নিজেদের কোনো স্বার্থ নেই। কিন্তু ওই, প্রত্যেকে প্রত্যেকের নিন্দে করে বেড়াচ্ছেন। প্রত্যেকে প্রত্যেককে ভাবছেন যে শ্রেণিশত্রু। এমনকী আমার ‘শহিদ বেদি’ বইটি যেদিন প্রকাশ হয়, সেদিনও ওখানে অভিজিৎ মজুমদার ছিলেন। অভিজিৎ মজুমদারকে কিন্তু আমি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, তিনি সিএমের সন্তান বলে। মানে আমাদের সেইসময়ের সিএম-এর ছেলে। তাতেই আমাকে পরেরদিন পাঁচ হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, ‘তার মানে ওই গোষ্ঠীকে আপনি প্রাধান্য দিতে চাইছেন?’ কী মুশকিল রে ভাই! তো আমি বললাম, সিএম একটা আইকন। তাঁর ছেলে, তিনি তো এখনও রয়েছেন জীবিত। ফলে… তো এরকম অনেক অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে আমাকে।


তন্ময়— পরের প্রশ্নটা তবে খুব সরাসরিই করি। নকশাল আন্দোলনে তরুণ প্রজন্মের যোগদান যে অনেকাংশেই আদর্শতাড়িত, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সেই সময়ে অনেকে সমর্থন করতেন, বর্তমান প্রজন্মেরও অনেকে করেন। কিন্তু তার যে প্রয়োগ, পথ বেছে নেওয়া— তাতে কি ভুল ছিল?

সুপ্রিয় চৌধুরী— তখন এত বয়স কম ছিল আমাদের, যে, এইগুলো বলার জায়গায় আমি নেই। তার পরবর্তীকালে আমি রাজনীতি চর্চা খুব বেশি করিনি। আমার আবেগটা অন্য জায়গায়। এখনো সেই আবেগগুলোই রয়েছে। তবে ভুল তো তারাই করে, যারা… যার জন্য সিএম বা সরোজ দত্তর সমালোচনা করতে আমি রাজি নই। কারণ তাঁরাই তো ভারতবর্ষের প্রথম কমিউনিস্ট, প্রথম সারির দুই নেতা। সারা বিশ্বেই এমনটা বিরল যে, যুদ্ধের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে তাঁরা প্রাণ দিচ্ছেন। দুজনেই। তাঁরা বলতেন, ‘যুদ্ধে সবসময় সৈন্যরাই প্রাণ দেবে, তা আবার হয় নাকি কখনও? জেনারেলদেরও প্রাণ দিতে হবে।’ তাঁরা সেটা একদম বাস্তবে করে দেখিয়েছেন। তাঁদের ভুল-ঠিক ধরার আমি কে? তাঁরা তো প্রাণ দিয়ে তাঁদের কথার সত্যতা প্রমাণ করেছেন। কিন্তু একটাই ব্যাপার, এই যে সমস্ত কিছু গোপন করে দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাও, কোনো ওপেন-টোপেন খেলা চলবে না; তখন এই কথাটা খুব প্রচলিত ছিল— সর্বস্ব দিয়ে চলে যেতে হবে। তার ফলে একটা ব্যাপার হয়েছিল। যখন ফার্স্ট সেট-ব্যাকটা এল, প্রথম দলটা যখন মার খেয়ে জমিতে পড়ল, তখন আর ব্যাক-আপ ফোর্সটা তৈরি হল না। হবে কী করে? সব তো বন্ধ হয়ে গেছে। আর ছেলেপুলে নেই। নতুন ছেলেপুলে আসছে না। অনেক কিছুর মাধ্যমে সেইসব ছেলেপুলে গড়ে উঠত— গণনাট্য বা স্কুলের লিটল ম্যাগাজিন— ওই যে বলছি না একটা কবিতা, ওইটুকু লাইন স্কুলের দেওয়াল পত্রিকায় লেখা… এইগুলো বন্ধ হয়ে গেল তো, ফলে নতুন ছেলেপুলে আর এল না। সেই জায়গায় বেনোজলের মতো সমাজবিরোধীরাও ঢুকল। আর মার যখন খেল তখন আর ব্যাক-আপ ফোর্সটাও রইল না। আমি এই নীতিটাতে খুব একটা… মানে জানি না, এগুলো খুবই ছোটো ব্যাপার। এইটুকুই মনে হয়েছে আমার।


তন্ময়— আপনি শহিদ বেদি নিয়ে যে গবেষণা করেছেন, তাতে তুলে ধরেছেন যে, সেগুলির অধিকাংশই এখন অবহেলার শিকার। তবু যাঁরা দেখভাল করছেন আজও, ১০-১৫ বছর পর তাঁরাও থাকবেন না। তারপর এই শহিদ বেদিগুলোর ভবিষ্যৎ কী? আপনার কী মনে হয়?

সুপ্রিয় চৌধুরী— আমি একটা কথা আগে খুব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই। আমি কোনো গবেষণা করিনি। আমার একটা আবেগ ছিল। সেইটাই উঠে এসেছে। আমি কখনো ইতিহাস খুঁজে বের করেছি, বহু পত্রপত্রিকা পড়েছি, তাঁরাও সত্যিই আমাকে সাহায্য করেছেন, মানে অকুণ্ঠ সাহায্য। যেখানেই গেছি সেখানেই সাহায্য পেয়েছি। আমার নিজের মনে হয়, এটা আমার করতে সুবিধা হয়েছে কারণ আমি কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত নই।

একবার আমি হুগলির শিয়াখালায় গিয়েছিলাম। সেখানে আলাপ হল এক অসুস্থ কর্মীর সঙ্গে, যিনি একসময় মহাদেব মুখার্জির গোষ্ঠী করতেন। পরবর্তীকালে তাঁদের সঙ্গেও ওঁর মতভেদ তৈরি হয় চূড়ান্তভাবে। তো সেই কর্মী আর কিছু করেন না এখন। কিন্তু সিএম-এর পূর্ণাবয়ব স্ট্যাচু একমাত্র ওখানেই আছে— শিয়াখালাতে। উনি ওঁর গ্রামের বাড়িতে ঢোকার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আগে বলুন আপনি অ্যান্টিলিন না প্রোলিন?’ আমি বললুম, আমি বিলীন, আমি কিছুই না! তো উনি হেসে ফেললেন, বললেন, ‘আসুন’। তারপর উনি সব কথা বললেন।

এঁরা কেউ খারাপ না, জানেন! দু-একটা বদমাইশ ছাড়া। তাঁদের নাম এখানে আর করলুম না। দু-একজন একদম সচেতন বদমাইশ। মানে একেবারে নেতৃত্বের চূড়ান্ত জায়গায় গিয়েও তাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং সেটা খুব সংখ্যা কম। বাদবাকি সব ঠিক আছে। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। কেউ পার্লামেন্টারি পথকেই আবার আঁকড়ে ধরেছেন, কেউ মনে করেছেন হাতে বন্দুক নিয়েই কাজ হবে— তাঁদের কারোর প্রতিই আমার কোনো অসূয়া, কোনো দ্বেষ কিচ্ছু নেই। সবাই চাইছেন বদল আসুক। এই চাওয়াটায় কোনো খামতি নেই। দু-চার জন বদমাইশ কেবল তাঁদের মতো করে ভাবছেন।

আর আপনার যেটা মূল প্রশ্ন, তার উত্তরে বলি— এইসব শহিদ বেদি থাকবে না। আমি এ-ব্যাপারে খুবই পেসিমিস্টিক। ভীষণরকম হতাশাবাদী। থাকবে না এগুলো। 

পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— প্রশাসনও নিশ্চয়য়ই সেগুলো সংরক্ষণের কোনো পদক্ষেপ নেবে না?

সুপ্রিয় চৌধুরী— না, না, ওরা চাইবে এগুলো ভেঙে দিতে। যতদিন এগুলো থাকবে, ওদের মধ্যে অস্বস্তি জাগাবে। প্রশ্ন তুলবে। ওঁরা তো প্রশ্নই তুলেছিলেন। সুতরাং প্রশাসনই চাইবে যে এগুলো ভেঙে যাক। দু-চারটে জায়গা একটু বেশিদিন থাকবে। কারণ সেখানে এখনও কিছু লোকজন আছেন, তাঁরা করেন। তারপর আমি এই লেখাটেখার পর— না, নিজেকে খুব বড়ো জায়গা দিচ্ছি না, কিন্তু অনেকে পাড়ায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা নড়েচড়ে বসলেন। কাজটা তাঁরাই করলেন। বেদিগুলো— বেশ কয়েকটি বেদির সংস্কার হল। সেখানে নতুন করে তাঁরা শহিদ স্মৃতিরক্ষা কমিটি করলেন। যা পাঁচজন, দশজন আছেন— তাঁরাই তো গড়ে ফেললেন ব্যাপারটা। আমি একটু লিখেছিলাম। এসব করেই আর যতদিন টিকিয়ে রাখা যায় আরকি।


তন্ময়— এর পরের প্রশ্ন আপনার অন্য আরেকটি বই, ‘পাতালপুরাণ’ নিয়ে। বইটা সামগ্রিকভাবে পড়লে বোঝা যায়, ১৯৪৬ থেকে ২০২০ অবধি যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাঁদের ছত্রছায়ায় সবসময়ই একদল সমাজবিরোধী আস্ফালন করতে থাকে। সেটা সরাসরি রাজনৈতিক ছত্রছায়াতে হোক বা না-হোক। শহরে হোক, গ্রামে হোক, শহরতলিতে কিংবা মফস্‌সলে— সব জায়গাতেই সমাজবিরোধী গোষ্ঠীর রমরমা। বর্তমানে আমরাও তা দেখছি। সেখান থেকে, একজন যুবক হিসাবে আমার একটা প্রশ্ন আপনার কাছে। আমরা এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম— সমাজবিরোধীদের এই অত্যাচার থেকে আমাদের কি মুক্তির কোনো জো নেই? সমাজ কি এভাবেই চলবে?

সুপ্রিয় চৌধুরী— এটা এরকমই চলবে। এটা একবারই বাধা পেয়েছিল। সেটা আমি আমার ‘পাতালপুরাণ’-এও লিখেছি, যে সমাজবিরোধী এবং পরবর্তী-সমাজবিরোধী, এদের মাঝখানে পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়েছিল নকশালরা। হল না। সেটা ব্যাডলাক। আমি ‘ব্যাডলাক’ শব্দটা অনেকদিন পর ব্যবহার করলাম। এটা সত্যি কথা, আচ্ছা আচ্ছা দাদাভাইরা সব মার খেয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছিল। বড়ো বড়ো কথা বলে আজকে, মার খেয়ে সবাই ঘরে ঢুকে পড়েছিল। এই যে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী আর সুব্রত মুখোপাধ্যায়— সুব্রত মুখার্জি মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে স্বীকারও করে গেছেন, চার বছর মহাজাতি সদনের ছাদে উঠে পুলিশ পাহারায় বসে থাকতে হত। বীণা সিনেমার সামনে ফাটাকেষ্ট তাঁর কালীঠাকুর ফেলে চলে গেছিলেন। সেই দৃশ্য— সিআরপিএফ এসে কালীঠাকুর ভাসান দিতে নিয়ে যাচ্ছে। সব হয়েছিল ভাই। দাদাভাইয়াদের রংবাজি কমে গিয়েছিল একমাত্র নকশাল আন্দোলনে। ভানু বোস বলেছিল, মানে আমাদের কিংবদন্তি ভানু বোস— পরবর্তীকালে শংকরলাল ভট্টাচার্যের একটা বই বেরোয়, ‘কলকাতার শেষ মস্তান’— সেখানে ভানু বলছেন, ‘আমরা কখন ভয় পেলাম জানো বাবা? বাচ্চা বাচ্চা দুধের দাঁত না ওঠা ছেলেগুলো শুধু ধমকি দিচ্ছে না, জানে মেরে দেবে।’ এই একবারই, একবারই… লোকেরা দরজা-জানলা খুলে ঘুমাতে পারত। ডাকাত ছিল না। চুরি-ডাকাতি হয়নি। দমদম, বরাহনগর, অশোকনগর— জোনের পর জোন, কোনো জায়গায় ডাকাতি হয়নি, মেয়েরা নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে পারত। এইটাই… অ্যাকশন আরম্ভ হলে সেটা আলাদা কথা। কিন্তু মেয়েদের ইজ্জত, পাড়ায় গুন্ডা-বদমাইশ, রংবাজি— সব ঠান্ডা হয়ে গেছিল।


তন্ময়— তার মানে বর্তমানে যা পরিস্থিতি, সেখান থেকে মুক্তি নেই আমাদের, এটাই বলছেন?

সুপ্রিয় চৌধুরী— না, না। যদি-না নকশাল আন্দোলন আবার হয়। ওই একটা জিনিস হয়েছিল বটে! এটা সবচেয়ে পজিটিভ দিক ছিল। গুন্ডাদের ঠেঙিয়ে ঠান্ডা করে ফেলা হয়েছিল। 

পড়ুন প্রথম পর্ব

তন্ময়— শেষ প্রশ্ন এবার। বর্তমানে রাষ্ট্র এবং রাজ্যের ক্ষমতা যাঁদের হাতে, তাঁদের নিয়ে আমজনতার মধ্যে বিভিন্ন স্তরে অসন্তোষ আছে— বিভিন্ন কাজ, বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্য। আপনিও কি মনে করেন, তৃণমূল বা বিজেপির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সিপিআইএম-ই বিকল্প? পাশাপাশি, ভবিষ্যতে আরেকটা সশস্ত্র অভ্যুত্থান কি সমাজ বদলানোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে?

সুপ্রিয় চৌধুরী— আপাতত আমি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ব্যাপারটা, আমার যে বৃত্ত দেখলাম, সেখানে নেই। মানে খুব একটা আশাবাদী আমি নই। তবে এই অবস্থায় এসে মনে হচ্ছে— তৃণমূল, বিজেপি— তাহলে কি মানুষ আবার— মানে ওই আরকি বেটার অপারচুনিটি হিসাবে ভবিষ্যতে আবার সিপিএমকেই ফিরিয়ে আনবে? আমি জানি না এটা। খুবই অরাজনৈতিক লোক আমি। আমার যেটুকু কাঙ্ক্ষিত আবেগ, যেগুলো প্রতিফলিত হয়, সেগুলো বহু আগের ধরে রাখা। দুটো জিনিস আমার মনে হয়েছে, সিপিএম ভয়াবহ। আসল কথা কী, সিপিএম হল একটা সংগঠিত মাফিয়া দল। আর সেখান থেকে আমরা এসে পড়েছি লুম্পেন ডেমোক্রেটিক ফোর্সের হাতে। এই জায়গাটাতেই প্রবলেম। তাও আমার মনে হয়, যদি তৃণমূল আর বিজেপির ব্যাপারটা ধরি, তাহলে তৃণমূল হচ্ছে পাড়ার ফাটাকেষ্ট, কিন্তু বিজেপি হচ্ছে মুসোলিনি— একটা নির্দিষ্ট ফ্যাসিজমের ভিত্তিতে আসবে। এলে একবার, চলে যাওয়া খুব মুশকিল হবে। বিজেপির বিকল্প— আপাত, আপাতভাবে বিজেপির বিকল্প হিসাবে এরাই থাকুক কিংবা সিপিএম আসুক— এটাই কাম্য। কিন্তু কাম্য হলেই তো সবসময় আর হয় না। আমি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক নই, তবে সক্রিয়ভাবে কোনো দল বা রাজনীতিটাও তো করি না। ফলে এই উত্তরটা দিতে পারব না।

এই উত্তরটা আপনাকে খুশি করছে না আমি জানি, কারণ এটা খুব বেশি রাজনৈতিক সচেতন উত্তর হচ্ছে না। কিন্তু আমি জানি না কী হবে। তবে বিজেপি অসম্ভব একটা ফ্যাসিস্ট শক্তি তো, নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা আছে, নির্দিষ্ট একটা ম্যানিফেস্টো আছে, তারা ওই বুলডগের কামড়ের মতো একটু একটু করে ধরে এগোনোটা কিন্তু থামাচ্ছে না। তবে এত কিছুর পরেও আমি মনে করি, বাংলা একটু অন্যরকমভাবে ভাবে। একবার ঢুকে পড়লে কিন্তু এই চিন্তাটাকে ওরা সমস্ত— মননে, শারীরিকভাবে— সমস্তভাবে ওরা দুমড়ে-মুচড়ে দেবে। যেটুকু আছে, সেটুকুও আর থাকবে না। যদিও কিছুই নেই প্রায়। ত্রিপুরায় একজন সিপিএম করেন— ত্রিপুরায় সিপিএমের লোকজন অনেক বেশি সৎ ছিল এ-রাজ্যের চেয়ে— যাই হোক, তিনি স্কুল মাস্টার, দরিদ্র, রিটায়ার করে গেছেন— বলছেন, ‘আমার নাতির নাম আমি ‘লেনিন’ রাখছিলাম বইল্যা আমায় রাস্তায় ফেলায়ে পিটাইসে…!’ এইরকমই আরকি। ব্যাপারটা কি এখানেও এমন হবে? কে জানে!

অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই

Powered by Froala Editor