ঈর্ষাক্ষাৎকার: সোমা মুখোপাধ্যায়— দ্বিতীয় পর্ব

সোমা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৬৫ সালে, উত্তর কলকাতায়। নারীর ক্ষমতায়ন, শিল্পকলার ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন। বর্তমান ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘বাংলার ব্যতিক্রমী দারুবিগ্রহ’ বইটিকে (প্রকাশকাল ২০২৩) কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে সোমার সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব...


(প্রথম পর্বের পর...)

তন্ময়— পুরীর জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার দারুবিগ্রহের বারো বছর অন্তর নবকলেবর হয়। বাংলায়, জগন্নাথ-প্রসঙ্গ যদি সরিয়েও রাখি, বিভিন্ন দেব-দেবীর যে-অসংখ্য দারুবিগ্রহ আছে, সেগুলির ক্ষেত্রেও কি নবকলেবর-প্রথা প্রচলিত?

সোমা মুখোপাধ্যায়— আমাদের বাড়িতে দেখেছি, মহাপ্রভুর নবকলেবর হত অনেক বছর অন্তর অন্তর। কাঠ জীর্ণ হলে ওটাকেই ঠিক করে রং করে দেওয়া হয়। কাঠটা বাতিল হয় না। নতুন করে হয় না। আমাদের তার ওপরেই সংস্কার করে অঙ্গরাগ করা হয়। বহু খরচসাপেক্ষ বলেই এখন কেউ সেভাবে নবকলেবর করেন না। যাঁদের ক্ষমতা আছে তাঁরা করেন, যাঁদের নেই তাঁরা করেন না। যার জন্য বহু মূর্তি জীর্ণ হয়ে নষ্টও হয়ে যাচ্ছে।


তন্ময়— সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের যে-সমস্ত দারুবিগ্রহ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে আছে, সেগুলো কি আদি মূর্তিই? নাকি নবকলেবরের ফলে বদলে-বদলে গেছে?

সোমা মুখোপাধ্যায়— না না। অনেক জায়গায় সেগুলোকে অঙ্গরাগ করেছে। কিন্তু যতদিন অন্তর অঙ্গরাগ করা দরকার, সেটা হয়নি। এমন অবহেলিত মূর্তি বহু আছে।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — প্রথম পর্ব

তন্ময়— অঙ্গরাগ আর নবকলেবরের মধ্যে তো তফাৎ আছে।

সোমা মুখোপাধ্যায়— নবকলেবর মানে কাঠটাকে সংশোধন করা।


তন্ময়— নবকলেবরের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ করে বিগ্রহ তৈরি করা হয়?

সোমা মুখোপাধ্যায়— না, সেরকম খুবই কম। আমি পাইনি সেভাবে। আমি যাঁদেরকেই জিজ্ঞেস করেছি, তাঁরা কিন্তু পুরনো জীর্ণ কাঠের বিগ্রহকেই ঠিকঠাক করে নবকলেবর করেছেন। এইটুকুই আমি জানি।


তন্ময়— নবদ্বীপে গৌরাঙ্গের যে-মূর্তিটি রয়েছে—বিষ্ণুপ্রিয়া যে-মূর্তিটি পুজো করতেন এবং কথিত আছে বিষ্ণুপ্রিয়া নাকি ওই মূর্তিতেই বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন। চৈতন্যের মৃত্যু বা অন্তর্ধানের ক্ষেত্রেও এরকম মিথ প্রচলিত। কেউ বলেন টোটা-গোপীনাথের বিগ্রহের বিলীন হয়েছিলেন, কেউ বলেন জগন্নাথ মূর্তিতে বিলীন হয়েছিলেন। যাই হোক, চৈতন্যের মৃত্যু বা অন্তর্ধান নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। কিন্তু আজও বিষ্ণুপ্রিয়ার মৃত্যু বা অন্তর্ধান ধোঁয়াশাচ্ছন্ন এবং অনালোচিত। আপনার মত কী? বিষ্ণুপ্রিয়ার মৃত্যু কীভাবে?

সোমা মুখোপাধ্যায়— আমি এই বিষয় নিয়ে কাজ করিনি। যেহেতু আমার বিগ্রহ নিয়ে কাজ, আমি ওইটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিলাম, ভেতরে যাইনি। বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে সেভাবে কোনো চর্চাই হয়নি। কারণ বিষ্ণুপ্রিয়া সেভাবে পেছনেই চলে গেছেন। কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রচুর অবদান। একটা গোষ্ঠী আছেন, যাঁরা বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে বহু চর্চা করেন। অনেক যুগলে পুজো করেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতে যুগলমূর্তিতে পুজো করা সমীচীন নয় বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু ‘মা-দাদার গণ’-রা—যাঁরা বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে আছেন, যেখানে তাঁদের স্বেচ্ছাসেবক অনেক বেশি—তাঁরা কিন্তু এই বিষ্ণুপ্রিয়া, গৌরাঙ্গের যুগলমূর্তিতে পুজো করেন। আমাদের সিমলার এখানেও একটি পরিবার—গোস্বামী পরিবারই, তাঁরা যদিও নিজেদের ‘মা-দাদার গণ’ বলেন না, কিন্তু তাঁরা বিষ্ণুপ্রিয়া-গৌরাঙ্গের যুগল মূর্তিতে পুজো করেন। এটা নবদ্বীপে যেমন আছে, আমাদের সিমলাতেও দেখেছি এবং অন্যত্রও। রিষড়াতেও। রিষড়ার সেই ভদ্রলোকের বাড়িতে আমি গিয়েছিলাম—দাস পরিবার তাঁরা।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— বিষ্ণুপ্রিয়াও যখন গৌরাঙ্গের সঙ্গে পূজিত হচ্ছেন, সেটা নিশ্চিতভাবেই তাঁর মৃত্যুর পরে। অন্তত সপ্তদশ শতকের আগে গৌরাঙ্গের পাশে বিষ্ণুপ্রিয়ার পুজোর প্রচলন ছিল না—এমনটাই ধরে নেওয়া যেতে পারে।

সোমা মুখোপাধ্যায়— একদমই তাই। ছিল না।


তন্ময়— আপনি যেখানে গৌরাঙ্গের পাশে বিষ্ণুপ্রিয়ার মূর্তি দেখেছেন, দারুবিগ্রহ— তার মধ্যে সর্বপ্রাচীন কোন সময়ের?

সোমা মুখোপাধ্যায়— আমি যেগুলো দেখেছি, তার মধ্যে সর্বপ্রাচীন বলতে আড়াইশো বছর আগেকার। আড়াইশো বছর বা তার একটু পরের। কলকাতার সিমলাতে শ্রীমানী বাজারের কাছে রাজেন্দ্র সেন লেনের গোসাঁইবাড়িতে যেটা আছে, ওটাই আড়াইশো বছরের পুরনো বলেছেন ওঁরা।


তন্ময়— বাংলার শাক্ত ধারার যে-সমস্ত দেবী, তাঁদেরও বেশ কিছু দারুবিগ্রহ নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সেটা পরিমাণে বৈষ্ণবদের আরাধ্য দেবতাদের—তা কৃষ্ণই হোক বা গৌর-নিতাই, জগন্নাথ, এমনকি রাম—এঁদের তুলনায় অনেকটাই কম। এর কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?

সোমা মুখোপাধ্যায়— শাক্ত দেবদেবী তো অনেক পরে এসেছেন। আসলে ভক্তি আন্দোলনের ধারা শাক্তদের স্পর্শ করেছে। শাক্ত দেবদেবীর যে-মূর্তিগুলো আছে, সেগুলো অনেক নমনীয় কিন্তু। ভয়ঙ্কর মূর্তি খুব কম আছে দারুবিগ্রহে। দারুবিগ্রহের যে-ধারা, সেটা মেনেই সমস্ত নির্মাণ। এত যে লোকদেবতার বিগ্রহ হয়েছে, সেগুলো কিন্তু পরবর্তী সময়ের। এখন ভক্তি আন্দোলন যাঁদের স্পর্শ করেছে, সেইসব দারুবিগ্রহ, যেমন ধন্বন্তরি কালী—জয়নগর মজিলপুরের, একটা অদ্ভুত সুন্দর কালীমূর্তি। সেই কালীকে দেখলে অন্যরকম লাগে। আবার ডাকাতে কালীও আছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার অনেক জায়গায় দারুনির্মিত ডাকাতে কালীও দেখা গেছে। কিন্তু তাঁরা ততটা ভয়ঙ্করও নয়। তবে মূল দারুবিগ্রহ বলতে বৈষ্ণবদের উপাস্য রাধাকৃষ্ণ, গৌর-নিতাই এবং রামচন্দ্র। এমনকি রামচন্দ্রের দারুবিগ্রহও সম্পূর্ণভাবে বৈষ্ণব প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছে। সেগুলো সারা বাংলাজুড়ে পাওয়াও যাচ্ছে। বিচিত্র জগন্নাথ এবং বিচিত্র রামচন্দ্র।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় — প্রথম পর্ব

তন্ময়— তাহলে এই আলোচনা থেকে কি আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, শাক্ত দেবী—যেমন কালী, দুর্গা, অন্নপূর্ণা ইত্যাদি—এঁদের পূজার সঙ্গে যেহেতু বিসর্জনের একটা সম্পর্ক ছিল, সেই কারণে স্থায়ী মূর্তি নির্মাণের বদলে মৃৎমূর্তি নির্মাণকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল?

সোমা মুখোপাধ্যায়— এটা হতে পারে। খুব ভালো একটা পয়েন্ট। এটা নিয়ে পরবর্তীতে ভাবনা-চিন্তা করব।


তন্ময়— আর বৈষ্ণব দেবদেবীর ক্ষেত্রে যেহেতু বিসর্জনের প্রচলন নেই, স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত, তাই-ই কি কাঠের প্রাধান্য?

সোমা মুখোপাধ্যায়— শুধু তা-ই নয়। বৈষ্ণব দর্শনের সঙ্গে দারুবিগ্রহের একটা ভীষণরকম যোগ আছে। যেটা চৈতন্যদেব নিয়ে এসেছিলেন ভক্তি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। শাক্তধারাতেও তো ভক্তিবাদ স্পর্শ করেছে। কিন্তু এখানে অন্যরকম বিষয় যেটা— ঘরের ছেলের মতো আরাধনা করা—সেটা কৃষ্ণই বলুন আর চৈতন্য। কালীকেও নিশ্চয়ই করা হয়েছে, কিন্তু রাধাকৃষ্ণ বা অন্যান্য বৈষ্ণব মূর্তিগুলো আরও বেশি গ্রহণযোগ্য।


তন্ময়— আমার পরের প্রশ্নটা এর সঙ্গে সংযুক্ত, আবার খানিকটা আলাদাও। আমরা মূলত আলোচনা করছি পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময় অর্থাৎ মূলত প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগ নিয়ে। এই সময়ে দারুবিগ্রহের পাশাপাশি অন্যান্য দারুশিল্প— মানে ভাস্কর্য, স্থাপত্য ইত্যাদির কী কী উদাহরণ পাওয়া যায়?

সোমা মুখোপাধ্যায়— এমনিতে যেটা বলা হয়, সেটা হচ্ছে, ইসলাম আসার পর ভীষণভাবে আসবাবপত্রে দারুশিল্পের ব্যবহার শুরু হয়। এটাও কিন্তু ভাস্কর্য। আমার এরিয়াটা দারুবিগ্রহ, তবে সূত্রধরদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, দারুনির্মিত আসবাবপত্রের কারণে সূত্রধরদের পেশা অনেকটা হারিয়ে যায়। কারণ তাঁরা মূর্তি তৈরি করতেন বা আরও বড়ো মাপের কাজ করতেন। সেখান থেকে এসে অলঙ্করণ বা স্থপতির কাজে যুক্ত হন তাঁরা। এটা একটা বড়ো ডিজাস্টার ছিল তাঁদের মধ্যে। আর এমনিতেই তো বিভিন্ন ধরনের আসবাব, যেটা ব্রিটিশ আমলের সময়ে দেখা যায়—প্রচুর নকশা করা পালঙ্ক বা দরজা-জানলা—এগুলো তো ভাস্কর্যের একটা জায়গা। এটা আমার এরিয়া নয়, এটা নিয়ে আমি কাজও করিনি, যেটুকু দেখেছি, সেটুকুই।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: চন্দ্রামুখোপাধ্যায় — দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— যে-কোনো বিগ্রহেই—ধাতুনির্মিত হোক, পাথর বা কাঠ—দেবতাদের পোশাক-আশাক মূর্তির মধ্যেই খোদাই করে দেওয়া হত। পরবর্তীতে বহিরঙ্গে আলাদা করে পোশাক পরানোর প্রচলন হয়। দারুবিগ্রহকে কেন্দ্র করেই বলি, পরবর্তীতে যখন নগ্নমূর্তি তৈরি করা হল এবং তার ওপর আলাদা করে পোশাক পরানো হল—সেই পোশাকনির্মাতাদেরও কি আলাদা কোনো গোষ্ঠী ছিল?

সোমা মুখোপাধ্যায়— আমি এটা অতটা ডিটেলে যাইনি। আমি যেটা দেখেছি—অনেকের বাড়িতে যেটা হত, আমাদের বাড়িতেও—সাধারণ একটা ধুতি বা ঠাকুর-দেবতার যে-জিনিস কেনা হত, সেখান থেকেই তৈরি হত। এখন তো অত্যন্ত বাহারি জিনিস পরানো হয়। আগে বাড়ির মানুষেরাই এই পোশাক তৈরি করতেন, করে ঠাকুরকে পরাতেন। ঠাকুরের জন্য আট-হাতি ধুতি বা আট-হাতি শাড়ি পাওয়া যায়। সেগুলো এনেও পরানো হত। এখন এটা অনেকটা শৌখিন জায়গায় চলে গেছে। জরি-টরি ইত্যাদি সমস্ত দিয়ে ঠাকুরের পোশাক হয়। বড়ো বড়ো ফ্যাক্টরিও তৈরি হয়েছে এইসব পোশাক নির্মাণের।

আগে নবদ্বীপেও ভীষণ ভালো ভালো ঠাকুরের পোশাক পাওয়া যেত। মানে তাঁতে বোনা হত। বা অনেকে সিল্ক দিয়েও বুনতেন। চেলি কাপড় বলা হত সেগুলোকে। মহাপ্রভুর জন্যও আসতে দেখেছি। এখন সেটা অন্য জায়গায় চলে গেছে। ইন্ডাস্ট্রি হয়ে গেছে সর্বত্র।


তন্ময়— আচ্ছা মূর্তিনির্মাণ আর অঙ্গরাগ-শিল্প—এই দুটো কি পৃথক পেশা? নাকি যাঁরা মূর্তি নির্মাণ করতেন তাঁরাই অঙ্গরাগের কাজ করতেন?

সোমা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ। যেমন শিল্পী দুলাল চক্রবর্তী আছেন—উনি মূর্তিনির্মাতা আবার একইসঙ্গে অঙ্গরাগও করেন। তবে অঙ্গরাগশিল্পী হিসাবেই তাঁর বেশি পরিচয়। নবদ্বীপেরই বাসিন্দা। পরম্পরাগতভাবে তাঁর পরিবারই ধামেশ্বরে মহাপ্রভুর অঙ্গরাগ করে আসছে।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কমল চৌধুরী

তন্ময়— এটা তো আপনি বর্তমানের উদাহরণ দিলেন, তার আগের যে তিনশো-চারশো বছরের ইতিহাস, তখনও কি এই একই ধারা বজায় ছিল?

সোমা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ। একইসঙ্গে হত। যিনি মূর্তিনির্মাণ করতেন, তিনিই অঙ্গরাগ করতেন। ওই যে বললাম, মৃৎশিল্পীরাই এই পেশায় চলে আসেন। মৃৎশিল্পী কী করেন? নিজে তৈরি করে তাতে রং করেন। এঁরা ঠিক তাই। কাঠের কাজ আর মৃৎশিল্পের কাজ অনেকটা একরকম। বিশেষ করে নতুনগ্রামে যে-কাঠের কাজগুলো এখন আমরা দেখি—ওঁরাও তো ভাস্কর, ওঁরাও মূর্তি তৈরি করতেন। ওঁরা যেভাবে কাঠের পুতুল রং করেন, সেভাবেই মূর্তিগুলোকেও রং করেন। একইভাবে আগেও শিল্পীরা মূর্তি তৈরি করে তারপর সেটাকে রং করতেন। কিন্তু এখন আলাদা করে অঙ্গরাগশিল্পী আছে। আমার চেনা আধুনিক প্রজন্মের অঙ্গরাগ শিল্পী অর্ক দাস—অর্ক নিজেও মূর্তি তৈরিও করতে পারেন।


তন্ময়— ইদানীং যে বিভিন্ন নতুন মন্দির তৈরি হয়, সেখানে দারুবিগ্রহ প্রতিষ্ঠার প্রচলন কতটা? নাকি এই প্রথা বিলুপ্ত বলা চলে?

সোমা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ, অনেকটাই বিলুপ্তির দিকে। কারণ একটা ছোটো দারুবিগ্রহ, নিমকাঠের, তৈরি করতে যথেষ্ট খরচ লাগে। আমরা সাধারণত দেখতে পাই নিমকাঠেরই দারুবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়—কারণ নিমকাঠে ঘুণ ধরে না এবং নিমে একটা ঔষধি গুণ আছে। দারুব্রহ্ম—তিনিও নিমকাঠ দিয়ে তৈরি। চৈতন্যদেবও নিম খুব পছন্দ করতেন। যাইহোক, নিমকাঠের দারুবিগ্রহ তৈরি খুবই খরচসাপেক্ষ। একটা ছোটো দারুবিগ্রহের দামই কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকা। তো সেটা দিয়ে তৈরি করার বদলে প্লাস্টার অফ প্যারিস বা পাথরের গুঁড়োর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করছে—এরকমই শুনছি। মানে বর্তমানে দারুবিগ্রহটা একটা বিলুপ্তপ্রায় জায়গায় চলে যাচ্ছে।


তন্ময়— একুশ শতাব্দীতে সম্পূর্ণ নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—আপনি ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় এমন দারুবিগ্রহের কি হদিশ পেয়েছেন?

সোমা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ। আমাদের একটা ভেঞ্চার নেওয়া হয়েছিল গত বছরে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র-সংক্রান্ত বিভিন্ন জিনিস সংরক্ষণ করে—‘জয়শ্রী পত্রিকা ট্রাস্ট’ নাম—ওরা একটা উদ্যোগ নিয়েছে। রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে একটা প্রাচীন রামমন্দির আছে। রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, হনুমান, জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা—এই সাঁটটা বিগ্রহ সেখানে ছিল। অনেক দিনের পুরনো। সেই বিগ্রহগুলোর অবস্থা খুব খারাপ ছিল। মন্দিরের অবস্থাও তথৈবচ। এই ট্রাস্ট পুরো দায়িত্ব নিয়ে মন্দিরটাকে সংস্কার করে। একদম আধুনিক না-হলেও—যতটা দরকার, মানে একতলা বাগান মন্দির, তাকে সেই ধাঁচে রেখেই রেনোভেট করে। এই বিগ্রহগুলোও সমস্ত খারাপ হয়ে গেছিল। সেগুলোকে নতুনভাবে তৈরি করে অঙ্গরাগ করে সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটা একটা খুব সাম্প্রতিক ঘটনা। গত বছরের ঘটনা এটা।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব

তন্ময়— তাহলে বলা যায়, পাথর বা অন্যান্য ধাতুমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা যতটা সহজ, দারুবিগ্রহ ততটা সহজ নয়। তাই তো?

সোমা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ দারুবিগ্রহ মেনটেইন করাও খুব কঠিন। আমার জানা একটা পরিবার, যাঁদের রথ হয় খুব বড়ো করে—চুনিমণি দাসীর ঠাকুরবাড়ি, বৌবাজার গোবিন্দ সেন লেনে। তাঁদের কুড়ি ফুট উচ্চতার রথ এবং সেই রথটাও কাঠের, তার একটা ভাস্কর্য আছে, মেনটেনেন্স-এর ব্যাপার আছে। এবং ওখানে বিশাল বড়ো একক জগন্নাথ আছেন। এটাও একটা ব্যাপার—বৈষ্ণব পরিবার হলে সেখানে কিন্তু একক জগন্নাথ থাকেন। বলরাম, সুভদ্রা থাকেন না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। সেই অত বড়ো, সাড়ে তিন ফুট উচ্চতার জগন্নাথ, তার সঙ্গে আড়াই ফুটের রাধা-কৃষ্ণ— এগুলো অঙ্গরাগ করা। দেখা যাচ্ছে ক্রমশ পরিবারে এখন—যাঁরা মেনটেইন করেন—রাজকুমার দে আর তপনকুমার দে, এই দুই ভাই মিলেই গোটাটা দেখেন—এক নম্বর হেরিটেজ হওয়া সত্ত্বেও ওঁরা কোনো সাহায্য পাননি কোথাও থেকে। ওঁদের নিজেদের কাজটা করতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যায়। তার সঙ্গে রথের আয়োজন করা—সোজা রথ ও উল্টোরথ দুটোই খুব বড়ো করে হয়, তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো লোক প্রসাদ পায় ওখানে—তো এই সবটা আয়োজন করতে খুবই সমস্যা। যিনি অঙ্গরাগ করেন ওখানে—পুরনো যে ভাস্কর ছিলেন তাঁর ছেলে অশোক কুণ্ডু—তিনি আসেন বিনোলা জয়পুর থেকে। কাঠের ভাস্কর্যের তো অনেকগুলো সেন্টার ছিল, তার মধ্যে একটা ছিল হাওড়া জেলার জয়পুর কৃষ্ণবাটী, বিনোলা বলেও পরিচিত জায়গাটা। প্রতিবছর সেখান থেকে এসে ওঁরা অঙ্গরাগ করেন। ওই অঙ্গরাগটুকু আর রথ রং করতেই ওঁদের কালঘাম ছুটে যায়। সেখানে নতুন করে দারুবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা বা নবকলেবর করা একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার।


তন্ময়— আপনি তো বাংলার জগন্নাথ নিয়েও কাজ করেছেন। বাংলায় যে এত জায়গায় জগন্নাথ মূর্তি আছে, সেটা পারিবারিক হোক বা বারোয়ারি হোক— বাংলার এইসব জগন্নাথ মূর্তিতেও কি নবকলেবর প্রথা প্রচলিত নেই?

সোমা মুখোপাধ্যায়— না, আমি দেখিনি কোনো বাড়িতে করতে। সকলে অঙ্গরাগটাই করে। আমি যে বণিক পরিবারের কথা বলছিলাম—গড়িয়ার রথবাড়ি, তাদের পরিবারের একজন ছেলেই কিন্তু অঙ্গরাগ করেন ঠাকুরের। নবকলেবর মানে সম্পূর্ণ নতুন করে দারুবিগ্রহ তৈরি করা। সেটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এবং নবকলেবর করা হয় বহু পুরনো মূর্তি খুব জীর্ণ হলে তবেই। আমি তো বললাম, আমাদের নিজেদের ঠাকুরকেই নবকলেবর করতে দেখেছি। কিন্তু বদলে ফেলতে দেখিনি। তবে কিছু কিছু জায়গায় নাকি হয়। আমাদের উত্তর কলকাতাতেই নাকি একটি জায়গা আছে, সেখানে ওড়িশার রীতিতে হয়। তারা নাকি ওখানেই সমাধি দেয় ঠাকুরকে। তবে আমি সেটা দেখিনি। সেই মন্দির দর্শন করতে পারিনি। সাবেকি পদ্ধতিতে তারা ওড়িশার রীতি মেনে করে—এটুকুই শুনেছি।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— বর্তমানে এত দারুবিগ্রহ বাংলার বিভিন্নপ্রান্তে ছড়িয়ে আছে—শাক্তদের, বৈষ্ণবদের। দারুনির্মিত শিবমূর্তি বা শিবলিঙ্গ কি কখনও দেখেছেন?

সোমা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ, শিবমূর্তি আছে। আমি দেখেছি শিবমূর্তি। যদিও সেটা বিতর্কিত। দারুবিগ্রহ আমরা যখন নির্মাণ করছি, তার ওপর গঙ্গামাটির প্রলেপ দেওয়া হয়—এটা বড়ো একটা স্টেপ। অনেকের বক্তব্য, যেহেতু ওখানে মাটি দেওয়া, সেহেতু ওটা মাটির বিগ্রহ। এখন হাত দিয়ে তো পুরোটা দেখা যায় না! কালীঘাটের কাছে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে একটি বাড়িতে অন্নপূর্ণা আছেন। সেখানেই কাঠের তৈরি শিবঠাকুর আছেন।


তন্ময়— শিবলিঙ্গ না শিবমূর্তি?

সোমা মুখোপাধ্যায়— শিবমূর্তি। আর তাছাড়াও দারুনির্মিত কালীর সঙ্গে শায়িত শিবও তো সবই কাঠের। দারুবিগ্রহ হিসাবে কালী যেখানে যেখানে দেখা যায়, সেখানে শিবও কাঠেরই। তারপর ধরুন দশমহাবিদ্যা। রতনবাবুর ঘাটের। সেখানে বটুক ভৈরব শিব তো দারুবিগ্রহ।


তন্ময়— চৈতন্যের মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে কি দারুমূর্তিরই প্রাধান্য বেশি?

সোমা মুখোপাধ্যায়— গৌরাঙ্গের মাটির মূর্তি আমি খুবই অল্প দেখেছি। গৌর-নিতাইয়ের বিগ্রহ সবটাই কাঠের হয়। মাটির বিগ্রহ আমি দেখিনি সেভাবে। সেটা হয়তো ঝুলন-টুলনে বাচ্চাদের খেলার জন্য পুতুল তৈরি হয়। কিন্তু পুজোর জন্য বড়ো আকারের মাটির বিগ্রহ আমি দেখিনি।


তন্ময়— আমরা মন্দিরের রেস্টোরেশন এবং রেনোভেশনের ক্ষেত্রে দেখেছি, যখন মন্দির সংস্কার করা হয়, তখন সংস্কারের নামে তার স্থাপত্য, টেরাকোটার সূক্ষ্ম কাজ—সমস্তকে ধূলিসাৎ করে প্রাচীনত্বকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। বাংলার কোণে কোণে সংস্কারের নামে ইতিহাস বা সূক্ষ্ম শিল্পগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার উদাহরণ প্রচুর। দারুবিগ্রহে অঙ্গরাগের সময়ও কি তার সৌন্দর্য নষ্ট করে দেওয়ার কোনো উদাহরণ ঘটেছে?

সোমা মুখোপাধ্যায়— খুব দক্ষ লোকের হাতে না-পড়লে সেটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমি তেমনটা দেখিনি। কারণ আমি যে-কটা বিগ্রহ দেখেছি প্রতিটাই যত্ন নিয়ে তাঁরা অঙ্গরাগ করেন। অর্ক যেগুলো করেন, সেগুলো অন্যভাবে অন্য পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আর তো প্রবীণ মানুষ হিসাবে দুলালবাবু আছেন। আর অঙ্গরাগশিল্পী আমি সেভাবে অত জানি না। স্বল্পবয়সি অনেকেই কাজ করছেন। তাঁদের কাজ আমি জানি না অতটা। তবে দুলালবাবুর কাজ আমি দেখেছি। আরেকটা হচ্ছে, প্রীতম খান বলে একটা ছেলে আছে, ও-ও খারাপ কাজ করে না। বজবজে একটা মহাপ্রভুর মন্দির—সেখানে একটা রেয়ার মহাপ্রভুর মূর্তি ছিল। সুদর্শন চক্রধারী মহাপ্রভুর একটি বিগ্রহ এবং অদ্ভুত জগন্নাথ ও বলরামের একটি বিগ্রহ। প্রীতম খানই সেগুলোর অঙ্গরাগ করেন। আর আমাদেরই পরিচিত এক বন্ধু, বিপ্লব দাশগুপ্ত—উনি ওঁর ক্ষমতা অনুযায়ী সংস্কার ও অঙ্গরাগ করার সহায়তা করেছিলেন।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সোমা মুখোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব

তন্ময়— সার্বিকভাবে বাংলায় এত দারুবিগ্রহ ছড়িয়ে আছে, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে গড় সচেতনতা কতটা দেখতে পেয়েছেন? নাকি অবহেলাই গ্রাস করছে সামগ্রিকভাবে?

সোমা মুখোপাধ্যায়— অবহেলাটাই গ্রাস করছে তো। অনেকে অবহেলায় রেখে দেয়। যেটা সোনারপুর রাজপুরের রামচন্দ্রের ওই মন্দিরের ক্ষেত্রে দেখেছিলাম—খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল। কীভাবে ছিল সেটা না-দেখলে বোঝা যাবে না। যাঁরা করেছেন অঙ্গরাগ, তাঁরাই বলতে পারবেন আরকি। এছাড়াও অনেকরকম বিষয় আছে। অনেকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়েও নিয়ে চলে যেতে চাইছে। এটা তো কিউরিও একটা ধরনের।


তন্ময়— পাথর বা ধাতব মূর্তির ক্ষেত্রে যেমন স্মাগলিং বা পাচারের ঘটনা ঘটে বাংলা বা ভারতে। দারুবিগ্রহের ক্ষেত্রেও কি তেমনটা লক্ষ করা যায়?

সোমা মুখোপাধ্যায়— এটা দারুবিগ্রহতে দেখিনি। ফলে অতটা সঠিকভাবে আমরা বলতে পারব না।

(সমাপ্ত।)

অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই

Powered by Froala Editor