সোমা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৬৫ সালে, উত্তর কলকাতায়। নারীর ক্ষমতায়ন, শিল্পকলার ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন। বর্তমান ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘বাংলার ব্যতিক্রমী দারুবিগ্রহ’ বইটিকে (প্রকাশকাল ২০২৩) কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে সোমার সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ প্রথম পর্ব...
তন্ময়— বাংলার দারুবিগ্রহ অর্থাৎ কাষ্ঠনির্মিত দেববিগ্রহ নিয়ে খুব বেশি চর্চা দেখা যায় না। এমন ব্যত্রিক্রমী বিষয় নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা কীভাবে এল?
সোমা মুখোপাধ্যায়— ২০১৭ সালে, পুতুল নিয়ে আমার একটা বই হচ্ছিল। ‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশনার সঙ্গে কথা হয়েছিল। এই বইটা করার পরে, ‘প্রতিক্ষণ’-এর প্রিয়ব্রত দেব—আমার দেখা একজন অসামান্য মানুষ, কিছুদিন আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন—উনিই আমাকে বলেছিলেন ডোকরা নিয়ে একটা কাজ করতে। এই বিষয়ে ওঁর বই করার খুব ইচ্ছে ছিল। উনি একটি পাণ্ডুলিপি পেয়েছিলেন ওঁদের শিল্পকলা সিরিজের জন্য। কোনো কারণে কাজটা ওঁর মনঃপূত হয়নি। ৪৮ পাতার বই হওয়ার কথা ছিল এটা। ছবি দিয়ে বই। মানে খুব অল্প করে লেখা। এটা খুব কঠিন কাজ ছিল। কারণ, সংক্ষেপে লিখে তার সঙ্গে ছবি থাকত। ওই শিল্পকলা সিরিজে আমার দু-নম্বর বই ছিল ডোকরা। ওই বইটা যখন লেখার কাজ করছি আমি—এটা ২০১৮ সালের কথা, পুতুলের বইটা বেরোনোর পর পর—জুলাই মাস নাগাদ উনি আমাকে হঠাৎ বললেন, লোকদেবতা নিয়ে কিছু ছবি আছে? আমি জানিয়েছিলাম, লোকদেবতা নিয়ে আমার কাজ আছে, কিন্তু সারা বাংলার লোকদেবতা সম্পর্কে তথ্য তো আমার কাছে নেই! তখন উনি বললেন, এই বিষয় নিয়ে ওঁর কাজ করার খুব ইচ্ছে, যদি আমি ব্যবস্থা করে দিই। আমার কাছাকাছি দক্ষিণ ২৪ পরগনাতে অনেক লোকদেবতা আছেন—দেখতে সুবিধে হবে বলে আমি নিজেই ওই জায়গাগুলোতে যেতাম। এই যেতে যেতেই দেখি অনেক লোকদেবতার মূর্তিই আসলে দারুবিগ্রহ, মানে কাঠের তৈরি।
আমার মামার বাড়ি নিত্যানন্দের বংশের। আমরা বীরভদ্রের ছেলের পরিবারের, আমার মায়ের দিক থেকে। আমরা হচ্ছি ষোলোতম পুরুষ। খড়দা থেকে আমার মামার বাড়ির, মানে মায়ের বংশের এক মা গোসাঁই চলে এসেছিলেন এখানে। সিমলায় যে-গোঁসাই বাড়ি, আমার মামার বাড়ি যেখানে, তার কথা বলছি। তো যাই হোক, আমাদের বাড়িতে যুগল বিগ্রহ আছে। মানে মহাপ্রভু-নিত্যানন্দের দু-জোড়া বিগ্রহ। একটা যেটা পুরনো সেটা ওই মা গোসাঁই নিয়ে এসেছিলেন খড়দা থেকে। শোনা যায়, সেটি গঙ্গায় ভাসিয়ে আনা হয়। পারিবারিক কারণে পালিয়ে এসেছিলেন উনি। সম্পত্তি নেওয়া নিয়ে যা তখনকার দিনে হত। এটা ছিল বীরভদ্র গোস্বামীর নিজের হাতে প্রতিষ্ঠা করা বিগ্রহ। আমার দাদুদের আরও যারা আছে—শরিক যারা—তাদের বাড়িতে ওই বিগ্রহ পালা করে যেত। তারপর ভেঙে যাবে বলে আমার দাদুর এক ভাই তিনি তাঁর বাড়িতে ওটি রাখেন। এই বিগ্রহ প্রায় চারশো বছরের।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — প্রথম পর্ব
তন্ময়— গৌর-নিতাই উভয়েরই?
সোমা মুখোপাধ্যায়— নিত্যানন্দ, গৌরাঙ্গ—দুজনেরই। এইটা যে কতটা প্রাচীন তা দেখলেই বোঝা যায়। তার গঠনশৈলী, তার অঙ্গরাগ—সমস্ত। ওটা এখন আমার মায়ের জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে। আমার মামারবাড়ির পাশেই ওই বাড়ি। পুরনো বাড়ি। সেটা এখনও অক্ষত রয়েছে। আমার মামার বাড়ি তো ভেঙে গেছে। মানে কিছুটা অংশ, পুরনো নাটমন্দির ভেঙেছে, যা হয়। ঠাকুর আছেন তাঁর মতো ফ্ল্যাটবাড়ির ওপরে। সেটা দ্বিতীয় জোড়া বিগ্রহ। সেই বিগ্রহটা—তখনকার দিনে নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে একজন সন্ন্যাসিনী ছিলেন, তাঁর পূজিত। তখন রাস্তা ভেঙে চওড়া করা হচ্ছিল। ব্রিটিশ আমল, ওই সন্ন্যাসিনীকে বলা হয় উনি কোথায় বিগ্রহ দেবেন। উনি তখন এই গোঁসাই পরিবারকে দিয়ে যান। তাছাড়াও জমিটি অধিগ্রহণের জন্য যে-অর্থ দেওয়া হয় তাঁকে, সেগুলো সব এই পরিবারকে তিনি দান করে যান। এমনকি কোর্ট থেকে এখনও মাঝে মাঝে অল্প একটা টাকা আসে, সকলের মধ্যে ভাগ করার জন্য, এটা আমি দেখেছি। সেই যে-বিগ্রহ, সেটিই রয়ে গেছে আমার নিজের মামার বাড়িতে। আমার ছোটোমামার বাড়িতেই সেটি আছে। তবে সবাই মিলেই এই বিগ্রহটি দেখেন। এই দু-জোড়া বিগ্রহই কিন্তু দারুবিগ্রহ।
তখন তো এমনিই ঠাকুর-দেবতা পুজো-আচ্চা হত, কিন্তু এতটা ভাবনা-চিন্তা ছিল না। আমি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়েছি। সেইসময় মূর্তিতত্ত্ব কিছু পড়েছি— আমাদের সিলেবাসে পড়ানো হত। এইগুলো তখন জানতাম, বিশেষ করে পাথরের মূর্তিগুলো—পুরনো আমলের পাথর বা ধাতুর যে-মূর্তিগুলো ছড়িয়ে রয়েছে সারা ভারত জুড়ে, সেগুলো নিয়েই আমাদের পড়াশোনা। কিন্তু বাংলার যে নিজস্ব দারুবিগ্রহ—সেটা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। বাড়ির মূর্তি দেখলেও, এটার সম্পর্কে প্রথম ইন্টারেস্ট জাগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার লোকদেবতার সন্ধান করতে গিয়ে। এত লোকদেবতা, সব কাঠের বিগ্রহ। ‘বাংলার লৌকিক দেবতার সন্ধানে’ নামে ওই কাজটা বের হয়। আমার একটা ছদ্মনামও সে-সময় উনি (প্রিয়ব্রত দেব) দিয়েছিলেন— সরস্বতী মৈত্র। কারণ সে-সময় আমার যেহেতু ডোকরার কাজটা হচ্ছিল, উনি বলেছিলেন, ‘একই লেখকের দুটো বই তো আমি একসঙ্গে বের করতে পারি না, কিন্তু এই বইটা প্রকাশ করার আমার প্রচণ্ড ইচ্ছা। তুমি লিখে দাও।’ যাই হোক, সেই বইটিও বেরোয়। এবং তখনই কথা হয়, উনি বলেন, একটা বেশ মোটা বই বের করতে চান, রঙিন ছবি দিয়ে, অন্ততপক্ষে দুশোটা ছবি থাকবে তাতে—এই দারুবিগ্রহ নিয়েই। আসলে আমি দারুবিগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন গল্প করতাম ওঁর কাছে। সেখান থেকেই উনি বলেছিলেন, সারা বাংলার দারুবিগ্রহ নিয়ে এই কাজটা তুমি করবে।
আমি কাজটা করতে থাকি। কিন্তু তারপর উনি অসুস্থ হয়ে যান। ওঁর অসুস্থতায় কাজটা আর প্রতিক্ষণ থেকে করা হয়ে ওঠে না। এটাই হল মূল প্রেক্ষাপট।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— বাংলায়, চিত্র বাদ দিলে যে-বিগ্রহগুলো দেখা যায়, সেগুলো হয় ধাতুনির্মিত, নয় মৃৎ বা কাষ্ঠনির্মিত। এর মধ্যে ধাতু হল সবথেকে টেকসই। তার বাইরে মাটি আর কাঠ—এই দুটোর মধ্যে কি কাঠের তুলনায় মৃৎমূর্তির প্রচলন বাংলায় বেশি? যদি তা-ই হয়, তবে তার কারণটা কী?
সোমা মুখোপাধ্যায়— এটা বুঝতে গেলে আমাদের প্রথম বুঝতে হবে, শাস্ত্রমতে এই বিগ্রহ যেগুলো দেখছি আমরা—পুজোর জন্য বিগ্রহ যেটা, সেই বিগ্রহ কিন্তু শিল্পশাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে এবং পৌরাণিক বিগ্রহগুলো কীভাবে পুজো হবে, তার ধ্যানমন্ত্র ইত্যাদি অনুসারে নির্মিত হচ্ছে। সেখানে মাটির বিগ্রহ নিয়ে সেভাবে কিছু বলা নেই। বলা হচ্ছে, মাটির বিগ্রহ ক্ষণস্থায়ী। মাটি, বালি আর চিত্র বা লেপন বলছেন ওঁরা— এগুলো তৈরিতে শাস্ত্র-নির্দেশ না-মানলেও হবে। কারণ এগুলো ক্ষণস্থায়ী, পুজো করে ভাসান দেওয়া হয়।
সাতটা মাধ্যম—যে-সাতটা মাধ্যমে বিগ্রহ নির্মাণের কথা আমাদের বলা হয়েছে, সেই সাতটা মাধ্যম হচ্ছে— মাটি, কাঠ, পাথর, ধাতু, ধাতু তিনরকম—সোনা, রুপো, তামা ও শেষে লেপন বা চিত্র। এই হল সাতটা মাধ্যম। তার মধ্যে ভারতে সবথেকে বেশি দেখা যায় পাথর আর ধাতু। মাটির মূর্তি কিন্তু অতটা নেই। মাটির মূর্তি তৈরি করা হত পুজো করে ভাসান দেওয়ার কথা মাথায় রেখেই।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — প্রথম পর্ব
তন্ময়— পাথর বা ধাতুর মূর্তির ক্ষেত্রে কি ভাসানের অভ্যাসটা ছিল কখনো? দারুবিগ্রহের ক্ষেত্রেই-বা কীরকম?
সোমা মুখোপাধ্যায়— ধাতু বা পাথর দিয়ে মূর্তিগুলো তৈরি করা হত, যাতে সেগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়। সেগুলো প্রতিষ্ঠা করা মূর্তি। ভাসানের জন্য নয়। অন্যদিকে দারুবিগ্রহের সমস্যা হচ্ছে, দারুবিগ্রহকে ভীষণ উৎকৃষ্ট বলা হলেও, এই বিগ্রহ ক্ষণস্থায়ী এবং ভঙ্গুর হয়ে যায় তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই। সেই কারণে বাংলায় আমরা সুপ্রাচীন দারুবিগ্রহ দেখতে পাইনি। সেভাবে পুরনো দারুবিগ্রহের নজির নেই। কিন্তু বিভিন্ন লিপিমালা থেকে শুরু করে লেখার মধ্যে উল্লেখ আছে, এটার প্রচলন সারা ভারতবর্ষে ছিল। এমনকি উদাহরণ আছে, মহাবীরের সময়ে নির্মিত তাঁর মূর্তি জীবন্ত স্বামী হিসাবে পুজো হত। এই তথ্য অধ্যাপক কল্যাণ দাশগুপ্তর লেখায় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সেই মূর্তিটা আমরা দেখতে পাইনি। এমন উদাহরণ আরও আছে। হিউয়েন সাঙ নাকি চিনে কাঠের বুদ্ধমূর্তি নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেসবের বর্তমান নজির বা নিদর্শন পাওয়া যায় না, কারণ কাঠও ভঙ্গুর। বরাহমিহিরের ‘বৃহৎ সংহিতা’-য় বলা হচ্ছে, কাঠের বিগ্রহ যিনি পুজো করেন তিনি ঐশ্বর্যশালী হয়ে ওঠেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা কাঠের মূর্তি পাই না। বাংলায় বিশেষ করে। সেগুলো কালের আবহে হারিয়ে গেছে। কারণ, বাংলার জল-হাওয়া এতই আর্দ্র যে, এখানে কাঠের মূর্তি বেশিদিন স্থায়ী হয় না।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছি, সারা বাংলাতেই লোক-দেবদেবীর মূর্তিগুলি মূলত মাটি বা কাঠের তৈরি। আপনার পর্যবেক্ষণও সে-কথাই বলে। ধাতু বা পাথরের নির্মাণ খুব কম। তার কারণ কি এইসব মূর্তি নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষদের দ্বারা পূজিত বলে?
সোমা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ, একদমই তাই। লোকদেবতা এবং কাঠের মূর্তির যে ইতিহাস বাংলায়, সেখানে কিন্তু দেখা যায় এই মূর্তির নির্মাতা বা শিল্পীরা স্থানীয় লোকশিল্পী। মাটির কাজ করতে করতে তাঁদের দিয়ে কাঠের কাজ করানো হচ্ছে। কারণ, তুর্কি আক্রমণের পর থেকে বাংলায় যাঁরা পাথরের মূর্তি নির্মাণ করতেন, তাঁদের কাজটা বন্ধ হয়ে যায়। নতুন যে শাসক এল, তারা মূর্তির পূজারী নয়। যেহেতু ইসলাম ধর্মের, তারা মূর্তিপুজো করছে না। আগের যে-রাজা, মানে সেন বংশ পর্যন্ত যে-মূর্তি হয়েছে, এমনকি পালযুগেও—পালযুগে যদিও ওরা বৌদ্ধ ছিল, কিন্তু তথাপি বিভিন্ন ধর্ম সমন্বয়ের কথাও জানা যায়—সে-যুগের বিষ্ণুমূর্তি বেশ ভালো সংখ্যক পাওয়া গেছে। সেন আমলে আরও বেশি করে পৌরাণিক মূর্তি পাওয়া গেছে, যেহেতু ওরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রচারক ছিল। নানা ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মূর্তি সেখানে পাওয়া যায়—যার মধ্যে ধাতুও আছে, পাথরও আছে। কাঠও নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু সেটা আমরা পাইনি, কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। যদিও ওই ধামরাই-এর যশোমাধবের কথা বলা হয়, কিন্তু এতবার অঙ্গরাগ ও নবকলেবর হয়েছে যে সেটা আদৌ কেমন ছিল, সে-সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি না। ওটা আমাদের একটা কল্প-ধারণা, কল্প-কিংবদন্তি এবং পাথরের মূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। মূর্তিটা যেহেতু একইরকম, সেই হিসাবে বলা হয় ওটা যশোপাল—যিনি সামন্ত ছিলেন পালেদের, তাঁর সময়ে তৈরি। অর্থাৎ সপ্তম-অষ্টম শতকে। কিন্তু সেভাবে কোনো ঐতিহাসিক নির্দশন নেই। সবচেয়ে পুরনো ওটাকেই বলা হচ্ছে। এরপর পাল-সেন যুগের কয়েকটা বিগ্রহ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে, তবে খুবই ভঙ্গুর অবস্থায়।
ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি আক্রমণের পর থেকে যখন মূর্তি নির্মাণ বন্ধ হয়ে গেল, তখন পাথরের কাজ যাঁরা করতেন… এখানেও একটা কথা বলে রাখা দরকার। মূর্তি নির্মাণের শিল্পী যাঁরা, যাঁদের আমরা সূত্রধর বলে চিনি, তাঁদের অনেক ভাগ ছিল। সেই ভাগের একটা ভাগ ছিল ভাস্কর। ভাস্কর যাঁরা, তাঁরা মূলত পাথরের কাজ করতেন। এবং তাঁরা নিজেদের অনেকটা উচ্চ পর্যায়ের মনে করতেন। তারানাথের লেখা থেকে বিটপাল এবং ধীমান নামে পাল আমলের দু-জন ভাস্করের কথা জানা যায়। ধরে নিচ্ছি, তাঁরা কাঠের মূর্তি করতেন না বা করলেও খুব কম করতেন। তো এই পাথরের কাজের মানুষগুলোই বেশি ছিলেন সেই আমলে। তাঁরা হারিয়ে গেলেন। কারণ তাঁদের যে-মজুরি দেওয়া হত, রাজা চলে যাওয়ায় সেই পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়ে যায়। আর দ্বিতীয় কথা, পাথর আসত বাইরে থেকে। বাংলায় পাথর পাওয়া যায় না। ফলে, যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ। তবে মুসলিম যারা শাসক হয়ে এল, তারা তো এটা সমর্থন করত না, তাও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই কাজটা হত।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় — প্রথম পর্ব
এমন পরিস্থিতিতে, গ্রামের মানুষ নিজেদের উদ্যোগে এবং সামন্তরাজা-জমিদারদের উদ্যোগে নিজেদের দেবদেবী ও অনেক সময়ে গ্রামবাসীরা যৌথভাবে কাষ্ঠনির্মিত বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিষ্ঠা করতেন। কেন? তার কারণ কাঠটা ছিল সহজলভ্য। বাংলায় যে বন-জঙ্গল, সেখান থেকে কাঠ সংগ্রহ করাটা খুব একটা দুঃসাধ্য ছিল না। কিন্তু কারা কাজটা করবেন? সেই সমস্ত শিল্পী, যাঁরা মাটির কাজে অভ্যস্ত। মাটির কাজের লোকরা কিন্তু অনেকদিন ধরেই প্রতিমা নির্মাণ করতেন। এঁদেরই কাঠের শিল্পে নিয়ে আসা হল। কিন্তু কাঠের যে সুন্দর খোদাই কাজ—যেরকম কাজ পাথরের ক্ষেত্রে দেখা যেত পাল-সেন আমলে—সেই শৈল্পিক নিপুণতা এঁদের মধ্যে নেই। ফলে আমরা মার্গশিল্পের নৈপুণ্য পেলাম না কিন্তু লোকশিল্পের একটা সহজ-সরল আবেদন নিয়ে বাংলায় কাঠের বিগ্রহ বা দারুবিগ্রহের এক নতুন ধারা শুরু হল। আর সেটা পূর্ণতা লাভ করল চৈতন্যদেবের সময় থেকে।
চৈতন্যদেব মনে করতেন, এই মূর্তি হল ভক্ত ও ভগবানের মূল মিলনস্থল। বিগ্রহের মাধ্যমেই তার ভগবানের কাছে ভক্ত পৌঁছে যাবে। তাই বিগ্রহ নির্মাণ করা হয় একেবারে মানুষের মতো করে। কিন্তু দেববিগ্রহ আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্য কী? এ-নিয়েও কিন্তু অনেক আলোচনা আছে। চৈতন্য-পরবর্তী যুগে যাঁরা তাঁর মানুষী মূর্তি তৈরি করলেন, তাঁরা বত্রিশ মহাপুরুষ লক্ষণ বিগ্রহের মাধ্যমে তুলে ধরলেন। অর্থাৎ, যে-বিগ্রহে সবসময় তাঁর মাথা বড়ো হয়, তাঁর কান বড়ো হয়, ঠোঁট অন্যরকম হয়। এভাবেই মানুষী মূর্তি হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা। এগুলো অবতারের বিগ্রহ। দেববিগ্রহের ক্ষেত্রেও এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, যা শাস্ত্রীয় নিয়ম অনুসারে হত। কিন্তু বাংলার দারুবিগ্রহ সেই নিয়ম অনুসরণ করেনি। ফলে দেখা যায়, লৌকিক সারল্যের কারণে বাংলার দারুবিগ্রহ অন্যরকম রূপ পেল। এখনও দক্ষিণ ভারতে বহু জায়গায় কাঠের বিগ্রহ তৈরি হয়। সেটা কিন্তু পুরোপুরি পাথরের বিগ্রহকে অনুসরণ করে করা হয়। এবং তার মধ্যে একটা কাঠিন্য আছে। বাংলায় যেটা দেখা যায় না। বাংলাতেই শুধু এই বিগ্রহ পাওয়া যায়। আমি বাংলা বলতে অবিভক্ত বাংলা বলছি, শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়। এখনও পূর্ববঙ্গেও প্রচুর এমন বিগ্রহ রয়েছে, খুঁজলেই পাওয়া যাবে। সেগুলো কিন্তু তৈরি হয়েছে ওই ধারা মেনে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— তার মানে আমরা সহজ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, পাথর থেকে কাঠে শিফট করার মধ্যে বাংলার একটা অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিতও লুকিয়ে রয়েছে?
সোমা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ।
তন্ময়— সাধারণত বাঙালি কাঠ বা দারুবিগ্রহ বলতে প্রথমেই মনে করে দারুব্রহ্ম বা পুরীর জগন্নাথের কথা। পুরীতে যেহেতু এই সহস্রাব্দের প্রথমদিকেই জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার কাঠের মূর্তি নির্মিত হয়েছিল, সেই কারণেই কি পরবর্তীকালে যত জগন্নাথমূর্তি নির্মিত হল, তার সিংহভাগই কাঠের তৈরি?
সোমা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ, বাংলার দারুবিগ্রহে জগন্নাথদেবের একটা বিশাল ভূমিকা আছে। কেন? চৈতন্যদেব এই জগন্নাথের মধ্যেই কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করেছিলেন। এমনিতে বলা হয়, পুরীর যে দারুবিগ্রহ—একটা বিতর্ক আছে যে এটা আদিবাসীদের বিগ্রহ ছিল, ওই ধরনের তিনটি কাঠে তারা পুজো করত এবং অনেক জায়গায় এরকম দেখা যায়, সেসবের মধ্যে আমি যাচ্ছি না—তবে চৈতন্য জগন্নাথদেবের মধ্যে নিজের ইষ্টদেবতাকে দর্শন করলেন। জগন্নাথদেবের সম্বন্ধে একটা কিংবদন্তি আছে যে, ভক্ত যেভাবে তার ইষ্টকে দেখতে চাইবে, জগন্নাথ তার কাছে সেইভাবেই ধরা দেবেন। চৈতন্যদেব কিন্তু তাঁকে ওইভাবেই দেখেছিলেন। এখন চতুর্দশ, পঞ্চদশ শতকে ভক্তি আন্দোলনের দুটো ধারা বইছিল—একটি রামচন্দ্রের ধারা, আরেকটা কৃষ্ণের ধারা। আমাদের এখানে কিন্তু রামচন্দ্রের একটা ধারা এসেছিল ভক্তির সূত্রে। কারণ অনেক আখড়া ছিল। যদিও আমরা যেগুলো দেখি, সেগুলো পরবর্তী সময়ের, সপ্তদশ শতকের।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কমল চৌধুরী
তন্ময়— রামায়েত সম্প্রদায়ের আখড়া রাঢ়বঙ্গে এখনও অনেক জায়গায় রয়েছে।
সোমা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ, কিন্তু চৈতন্যদেবের পূর্ববর্তী বা সমসাময়িক আখড়ার কথা জানা যায়নি। যে-আখড়াগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি সেগুলো সপ্তদশ শতকের এবং সেগুলোতে সম্পূর্ণভাবে চৈতন্যদেবের ধারাতে রামের বিগ্রহ তৈরি হয়েছে। বৈষ্ণব ধারা, বৈষ্ণব প্রভাবে রামচন্দ্রের একটা শৈলী ফুটে ওঠেছে, যে-শৈলী জগন্নাথেরও তৈরি হয়েছে। সে-প্রসঙ্গে আমি আসছি পরে।
কৃষ্ণের যে-সবচেয়ে প্রাচীন দারুবিগ্রহ, সেটা পঞ্চদশ শতকের, ১৪৯৮ সালে যেটি আদিসপ্তগ্রামের গোবর্ধন দাস তাঁর পুত্র রঘুনাথ দাসের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদিও বলা হচ্ছে রাধা-কৃষ্ণ মূর্তি, তবে রাধা সেখানে অনেক পরে এসেছে, ওটা কৃষ্ণের মন্দির ছিল। সেখানে কৃষ্ণের গড়নটা দেখলে বোঝা যায়, তাঁর মুখাবয়ব, তাঁর খোদাইকার্য, সমস্তটাই কিন্তু সেই সময়কালের ইঙ্গিত দেয়। বলা হয়, চৈতন্যদেবের সময় দারুবিগ্রহের একটা নবজাগরণ বা রেনেসাঁ শুরু হয়।
তন্ময়— অত প্রাচীন পাথর-নির্মিত কৃষ্ণমূর্তিও আছে নিশ্চয়ই!
সোমা মুখোপাধ্যায়— আছে তো! দ্বাদশ শতক থেকে যখন জয়দেবের গীতগোবিন্দ শুরু হল, যখন গোপীনাথের ধারণা—বংশীধারী দ্বিভুজ কৃষ্ণের ধারণা চলে এল, তখন থেকেই পাথরের কৃষ্ণবিগ্রহ নির্মাণ শুরু হল। কিন্তু কাঠের বিগ্রহের ক্ষেত্রে বলা যায়, আদিসপ্তগ্রামেরটাই দারুনির্মিত প্রথম কৃষ্ণবিগ্রহ।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব
তন্ময়— সেনযুগ পর্যন্ত যেমন বিষ্ণুমূর্তি তৈরি করা হত, তারপর থেকে আস্তে আস্তে সেটা কৃষ্ণে পরিবর্তিত হয়?
সোমা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ, দ্বাদশ শতক থেকেই অবতারের ধারণা চলে আসে।
তন্ময়— বাংলায় প্রাক-চৈতন্য যুগের প্রস্তরনির্মিত কৃষ্ণমূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে—এমন উদাহরণ কোথায় কোথায় দেখা যায়?
সোমা মুখোপাধ্যায়— পাথর নিয়ে তো আমার ততটা পড়াশোনা নেই, ফলে আমি স্পষ্টভাবে বলতে পারব না। পাথর নিয়ে আমি অতটা ওয়াকিবহাল নই। খুঁজলে দেখা যাবে, অনেক পাথরের মূর্তিতে কৃষ্ণ পূজিত হচ্ছেন। মিউজিয়ামেও আছে, মন্দিরেও আছে। কিন্তু ওটা নিয়ে আমি কাজ করিনি। আমার এরিয়া অফ ইন্টারেস্টও নয়।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এই যে বাংলায় জগন্নাথদেবের দারুনির্মিত বিগ্রহের প্রাবল্য, সেটা চৈতন্যদেবের কারণেই?
সোমা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ, চৈতন্যের হাত ধরেই। তার আগে বলা হয় যেটা, সেটা হল মাহেশের জগন্নাথ। তাঁকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে। তাছাড়া চৈতন্যদেবের সমসাময়িক একজনের কথা আমরা জানতে পারি— জগদীশ্বর পণ্ডিত বা জগাই পণ্ডিত—চাকদহে যাঁর মন্দির রয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহটিও প্রাচীন। তবে মাহেশই নাকি বাংলার প্রাচীনতম। অবশ্য অনেকে দাবি করেন, পাবনাতে হান্ডিয়ালে যে-জগন্নাথ বিগ্রহ আছে, সেটা নাকি মাহেশের থেকেও প্রাচীন। সেই জগন্নাথ একদম অন্যরকমের। নীলবর্ণের জগন্নাথ। নীলমাধব রূপে ওঁকে দেখা হয়। সেখানে যে-জগন্নাথকে দেখি, তাতে কোথাও রামচন্দ্রের প্রভাব ওঁর ওপর পড়েছে, কোথাও কৃষ্ণের প্রভাব।
বাংলাতে বিচিত্র সব জগন্নাথ আছেন। বিচিত্র তাঁর আচার-অনুষ্ঠান, বিচিত্র বিগ্রহতত্ত্ব—এগুলো সবই চৈতন্যদেবের কারণে হয়েছে। কারণ, চৈতন্যদেবের কাছে তিনি কৃষ্ণের প্রতিভূ এবং সম্পূর্ণ মানসী অবয়ব, হাত-পা হীন নন। দারুবিগ্রহে সেটাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ফলে, বাংলার অনেক জগন্নাথ বিগ্রহেই হাত-পা দেখা যায়।
(দ্বিতীয় পর্ব)
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor