সাধন চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৪৪ সালে, বরিশালের মাধবপাশার কাছে শোলনা গ্রামে। দেশভাগের সময়, মাত্র ৩ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গে আসা, ১৯৫৩ সাল থেকে সুকচর-পানিহাটির অধিবাসী। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তিনি পরিচিত। লিখেছেন অসংখ্য গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ। আজকের ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘কালের কড়চায় বৃহত্তর পানিহাটি’-কে (প্রকাশসাল ২০২১) কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে সাধনের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
(প্রথম পর্বের পর...)
তন্ময়— বরাহনগর থেকে শুরু করে কাঁচরাপাড়া পর্যন্ত, উত্তর চব্বিশ পরগনার গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদগুলিতে বিভিন্ন সময়ে একাধিক গড় নির্মিত হয়েছে। প্রত্যাপাদিত্যের ভূমিকা এক্ষেত্রে কম নয়। আবার মিথ আছে যে, পানিহাটিতে চন্দ্রকেতু বলে বলে একজন ‘ভবানীপুর’ নামের একটি গড় নির্মাণ করেছিলেন। আপনিও নাটাগড়ে একটি গড়ের ধ্বংসাবশেষের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘ভবানীপুর’ বলে জায়গাটি পরিচিত হয়েছিল দেবী ভবানীর দেবীর অবস্থানের কারণে। এই ইতিহাসের কি অবশেষ কিছু রয়েছে? নাকি সেটা বিস্মৃতির অতলে?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— পানিহাটির একটা জায়গা আছে গড়-ভবানী। এখন ভুলেই গেছে মানুষ। ভবানী হচ্ছে কালীর একটা রূপ। ১৭৪২ সালে যখন মারাঠা আক্রমণ হয়, তারা কাটোয়ার দিকের জায়গাগুলো তছনছ করে দিয়েছিল। সেই সময়ে সবে কলকাতা গড়ে গড়ছে। বর্ধমান জেলায় বর্গি আক্রমণের ফলে, কলকাতাতেও আতঙ্ক তৈরি হয়। মারাঠারা যাতে আসতে না-পারে, সে-জন্য কলকাতায় মারাঠা-ডিচ কাটা হয়েছিল। সেই সময়ে বালির এক জমিদার পরিবার—পদবি ‘গাঙ্গুলি’—তাঁরা তাঁদের পূজিত দেবী ভবানীকে এপারে এসে পানিহাটিতে রেখে যায়, যাতে মারাঠারা এসে অপবিত্র না-করে। পানিহাটিতে খুব পুরনো একটা জায়গা আছে ‘ঘোষপাড়া’ বলে, ওখানেই রাখে। জায়গাটা ছিল দুর্গম। সাধারণত চোখে পড়ে না। এখান পানিহাটির রূপকার হিসাবে যাঁর নাম উঠে আসে, ত্রাণনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর বাবা গরিব পুরোহিত ছিলেন। তিনি ওটা দেখতে পান। তিনিই কালীরূপে পুজো করতে থাকেন। পরবর্তীতে ত্রাণনাথবাবুর ভাগ্য ফুলে-ফেঁপে উঠলে, পানিহাটির আধুনিকীকরণের সময় স্কুল, রাস্তাঘাট, শ্মশানঘাট ইত্যাদি ইত্যাদি করেন। একইসঙ্গে গড়ভবানী-তে একটি মন্দির তৈরি করেন। মন্দিরটি ভুবনেশ্বরের মন্দিরের মতো শৈলীতে নির্মিত।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: অলোক সরকার — প্রথম পর্ব
তন্ময়— অর্থাৎ দেউল, জগমোহন, নাটমন্দির ইত্যাদি?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— একদম একদম। ত্রাণনাথ ঘাটে দাঁড়ালে, তার বাঁদিকেই রয়েছে একটা রাস্তা, ওই ঘাটের সঙ্গেই। ওখানেই ওই মন্দিরটা আছে। বহুলোকে জানে না। ওই মন্দিরটা থেকেই ‘গড়ভবানী’ নাম এসেছে। অবশ্য এখন আর গড়ভবানী বলে না।
তন্ময়— এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা জিজ্ঞেস করি। কমল চৌধুরীর লেখায় পড়েছিলাম, এখানে জনৈক চন্দ্রকেতু আসেন এবং তিনিই ভবানীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য বাংলায় চন্দ্রকেতুর মিথ অজস্র। এখানে চন্দ্রকেতু নামটা কীভাবে জড়াল?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— চন্দ্রকেতুর সঙ্গের তো বেড়াচাঁপার চন্দ্রকেতুগড় জড়িত। তাঁর সঙ্গে গড়ভবানীর কোনো সম্পর্ক নেই। প্রায় ছ-শো বছরের ফারাক। সময়কালটাই তো মিলছে না। কমলদা পানিহাটি নিয়ে এটা ঠিক লেখেননি।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: অলোক সরকার — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— আর নাটাগড়ের নির্মাণ কীভাবে?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— নাটাগড় ছিল নদিয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের জায়গা। এবং সেই গড়—গড় মানে দুর্গ না কিন্তু, গড় মানে পরিখা দিয়ে ঘেরা। আমরা খুব ছোটোবেলায় ধ্বংসাবশেষ দেখেছি। বিরাট—দু-দিকে মাটি উঠে গেছে আর মাঝখান দিয়ে একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে। তুমি ওপার থেকে এপারে আসতে পারবে না। তখনকার দিনে কেউ আক্রমণ করতে যাতে না-পারে, সেই জন্য গড় তৈরি করে রাখা হত। নাটাগড়ের লোকজনকে আমি জিজ্ঞেস করে জেনেছি, ওখানে আরও গড় ছিল। কারণ নাটাগড়ে কৃষ্ণচন্দ্রের রাধা-কৃষ্ণের মন্দির ছিল। এখনও আছে। খুব পুরনো। নাটাগড় খুবই ইম্পর্ট্যান্ট।
তন্ময়— এখানে যে খড়দহ খাল, সেটা তো প্রাকৃতিক নয়। সেটাও কি কোনো গড়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— না না, প্রাকৃতিক নয়, কাটা খাল। এটা খনন করেছিলেন প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস। ‘ছাব্বিশ শিবমন্দির’ যাঁর নির্মাণ, সেই প্রাণকৃষ্ণ।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — প্রথম পর্ব
তন্ময়— মানুষ কি আদৌ ইতিহাস-সচেতন? আঞ্চলিক ইতিহাস রক্ষার্থে তাদের ভূমিকাকে আপনি কী চোখে দেখেন? এবং সরকার বা প্রশাসনেরই-বা কতটা সদর্থক ভূমিকা নেওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— সাধারণ মানুষ এই ব্যাপারে আদৌ সচেতন নয়—এ-কথাই আমি বলব। তার কারণ, যখন ওই সুখচরে, তান্ত্রিক বৌদ্ধদের এলাকায় পুকুর কাটানো হয়েছিল, সেখানে প্রচুর পরিমাণে মাটির পাত্র থেকে শুরু করে যা-কিছু উঠেছে, সেসবের সাক্ষী ছিলেন কাবেরীবাবু। উনি কুলীন পাড়ার লোক, এখন মারা গেছেন। তিনিও কিন্তু আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তিনি কিছু লিখে গেছেন কিনা, আমি জানি না। তাঁর কাছে আমি শুনেছি, এগুলো যখন উঠেছে, যে যার মতো নিয়ে চলে গেছে। তাকে রক্ষা করার কোনোরকম কোনো মানসিকতা নেই। এবার প্রশাসনের প্রসঙ্গে আসি। ওই যে দশ টন ওজনের খিলানটা, যেখানে বুদ্ধদেব বসে আছেন, ওটা কোথায় যে আছে কেউ জানে না। প্রশাসন একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে ফেলে রেখেছে।
তন্ময়— আর সামগ্রিকভাবে পানিহাটির ঐতিহ্য রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— আমি একটা উদাহরণ দিই। রবীন্দ্রনাথ এখানে যে এসেছেন, সেই যে তাঁর প্রথম আসা, তিনি যে-বাড়িটায় এসেছিলেন, সেটা হচ্ছে ছাতুবাবুর বাড়ি। আশুতোষ দেব। ছাতুবাবু ঘোষপাড়াতে বিয়ে করেছিলেন। ওখানেই ওঁর শ্বশুরবাড়ি। এবং এই যে-বাড়িটা উনি করেছিলেন, এখানে রবীন্দ্রনাথের বাবা, রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নিরা—অনেকে এসেছেন। সরলা দেবীর অন্নপ্রাশন এখানে হয়েছে। এই বাড়ির সঙ্গে ওঁদের সম্পর্ক ছিল। তারপর এটা শেরপুরের জমিদারের কাছে চলে যায়। পরে সেটা বিক্রি করে দেয়। বেনারসি দাস বলে একজন হিন্দুস্থানি সেটা কেনেন। ইত্যাদি ইত্যাদি হয়ে যাওয়ার পরে এটা এখন হেরিটেজ তো? এখানে একটা অনাথ বালিকাদের আশ্রম তৈরি হয়। যখন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এখানকার ডিএম—আলাপনবাবুর রাজনৈতিক ব্যাপার যা-ই হোক, তিনি দুটো কাজ করেছিলেন। এক হচ্ছে, নৈহাটির বঙ্কিমবাবুর বাড়িতে যে-শরিকি ঝামেলা ছিল, সেটাকে ক্লিয়ার করে একটা বঙ্কিম অ্যাকাডেমি করে দিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, এখানে সুভাষ চক্রবর্তীর ইনিসিয়েটিভে ও আলাপনবাবুর চেষ্টায় পানিহাটির বাড়িটা হেরিটেজ হিসাবে ডিক্লেয়ার করা হয়। তা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত স্থানীয় মানুষদের তীব্র বিরোধিতা, যে, ওই অনাথ আশ্রমের মেয়েদের তোলা যাবে না। এখন হয়তো গোটা চল্লিশেক মেয়ে আছে। আমরা এটাও বলেছিলাম যে, বিরাট জায়গা তো! আপনারা অনাথ আশ্রমটাকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে আসুন, ওটা একটা হেরিটেজ হোক, ওখানে একটা রবীন্দ্র মিউজিয়াম তৈরি করা হোক। কিন্তু সেটা হয়নি। এই থেকে আমার মনে হয় যে, আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ ইতিহাসই বলুন কিংবা ঐতিহ্য, এসব ব্যাপারে কোনোরকম মাথা ঘামায় না। সরকারও উদাসীন এই ব্যাপারে। ওটা একটা নাম-কে-ওয়াস্তে। যদি কোনো প্রশাসক ব্যক্তিগতভাবে এ-ব্যাপারে উৎসাহী হন, তিনি খানিকটা করেন। তাছাড়া এ-জিনিস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এই হল আমার মত।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— প্রাণনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতভিটে এখন প্রায় ভগ্নস্তূপ। এমনকি গঙ্গার ধারে দাঁ-দের যে ঠাকুরবাড়ি ও জগদ্ধাত্রী মন্দির ছিল, সেটা ইসকন অধিগ্রহণ করে তাদের মন্দির তৈরি করে নিয়েছে। মফস্সলের ছবি দ্রুত পাল্টাচ্ছে, কোথাও কোথাও তার ওপর ধর্মীয় কর্পোরেটরা থাবা বসাচ্ছে। এসবের মধ্যে দিয়ে ইতিহাস কি আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ছে না?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— আমার তো মনে হয় যেভাবে প্রোমোটার-রাজ চলছে, এরপর ইতিহাস— আঞ্চলিক ইতিহাসের বড়ো বড়ো জায়গাগুলোই থাকবে শুধু। ছোটোখাটো নজিরগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আমার শোনা কথা, ত্রাণনাথবাবুর বাড়িটা নাকি প্রোমোটাররা নিয়ে নিয়েছে। আমি ওখানে একসময় ঢুকেছিলাম। ওখানকার যে ঠাকুরদালান ওরফে মঞ্চ, সেখানে কে আসেনি বলো তো? ওটা প্রোমোটারকে দিয়ে দিল! ওখানে আর ঢোকা যাচ্ছে না। ওখানে কলকাতার নাট্যজগতের বিশিষ্টজনেরা এসেছেন এককালে। আমরা ওই বাড়ি রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। আমি নিজে এ-কথা বলেছি। প্রশাসন এ-নিয়ে মাথা ঘামায় না। স্থানীয় মানুষেরও কোনো হেলদোল নেই। না-হলে পানিহাটিতে যে-ঐতিহাসিক জায়গাগুলো ছিল... এখানে একটা ডক অর্থাৎ জাহাজ সারানোর জায়গা ছিল, সে-সব নষ্ট হয়ে গেছে।
তন্ময়— এই ডকের কথা তো একেবারেই চর্চিত নয়! কোথায় ছিল এটা?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— ডকটি উনিশ শতকে তৈরি। ত্রাণনাথবাবুর ঘাট থেকে একটু এগিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে। সুখচরের দিকে। ওখানে শঙ্করদাস মিত্রদের বাড়ি আছে। ওদের বাড়ির কাছেই ডক ইয়ার্ড ছিল। এখন আর নেই। শেষ করে দিয়েছে। হাটখোলার দত্তদের যে-বাড়িটা, যেটাকে বলা হত বারোমন্দির ঘাট, সেখানে প্যারিস থেকে আনানো যে-সমস্ত মূর্তিগুলো বসানো ছিল, সেগুলো একটাও নেই। আমি দেখেছি প্যারিস থেকে আনানো সেইসব পরীর মূর্তি। ওসব কথা তুমি পাবে যম দত্ত বলে একজন লেখকের লেখায়, উনি পানিহাটির কিছু সামাজিক ইতিহাস লিখে রেখেছেন। আমি আমার ‘পানিহাটা’ উপন্যাসে যম দত্তের লেখা তথ্যগুলো কাজে লাগিয়েছিলাম। এমনকি আমি নিজেও যা-যা দেখেছি, সেসব এখন কিছুই প্রায় নেই।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — প্রথম পর্ব
তন্ময়— পানিহাটির ঐতিহ্যের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না, এমন একটা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করি। ওপর থেকে চেপে বসা ইস্কন-সংস্কৃতি এখানে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং দণ্ডমহোৎসবতলার পাঁচশো বছরের ঐতিহ্যে থাবা বসিয়েছে। এমনিতে ক্রমের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, নবদ্বীপ, শান্তিপুরের পর পানিহাটি-খড়দহ গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের তৃতীয় মুখ্য তীর্থ। ইস্কনের মতো সংস্থার হাত ধরে কি এখানকার সংস্কৃতিকে ইদানীং ভিন্ন খাতে চালিত করার চেষ্টা চলছে? একজন ইতিহাসবিদ হিসাবে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— কী ববলি বলুন তো! স্থানীয় ইতিহাসকে মেরে ফেলা হচ্ছে। আজকের এই পশ্চিমবঙ্গ সরকার, তার প্রশাসক থেকে শুরু করে সমস্তটাই এর জন্য দায়ী। এবং এই ইস্কন—আমি স্থানীয় মানুষদের কথা শুনেছি, তাঁরা এর ঘোর বিরোধী, অসহায় তাঁরা। ওই দাঁ-দের ঠাকুরবাড়িটা পুরোটাই ইস্কন নিয়ে নিয়েছে। এখন চেষ্টা করছে দণ্ডমহোৎসববতলা ঘাটে যে বটগাছ— মূল বটগাছটা তো নেই, একটা ডাল আছে, ’৫২ সালে মূল গাছটা পড়ে যায়—সেটা দখল করারও চেষ্টা চলছে। রাজনৈতিক দল যারা, তারাও চুপ করে আছে কিংবা ওখান থেকে তাদের স্বার্থ চরিতার্থ হচ্ছে। এছাড়া আর কিচ্ছু নেই। বাকি যে দু-চারজন সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস বিষয়ে সচেতন, তারা হায় হায় করছে। এছাড়া আর কিচ্ছু হচ্ছে না। ভয়ঙ্কর অবস্থা। বিশেষ করে এই বরাহনগর থেকে এই জায়গাটা পর্যন্ত। এই চেতনাটা যদি না-আসে, তাহলে কিন্তু পঞ্চাশ বছর পর কিচ্ছু ইতিহাস খুঁজে পাবে না। এবং তারও একটা কারণ আছে। কারণ, জনবিন্যাসটা এমনভাবে উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে...
তন্ময়— আমার পরের প্রশ্নটাই এই প্রসঙ্গে। পানিহাটি তো অন্তত প্রায় আটশো বছরের ঐতিহ্যবাহী জনপদ। তার অতীত-গরিমা, যেটা হয়তো চৈতন্যের সময় থেকে শুরু হয়েছে এবং পরবর্তীতে পল্লবিত হতে হতে বিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধিও বজায় ছিল। আমাদের গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদগুলোর যে বেল্ট—যদি নৈহাটির থেকে শুরু করে বরাহনগর অর্থাৎ কলকাতার আগে অবধি যদি আসি, এই পুরো এলাকাটার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য জনপদ পানিহাটি। ঐতিহ্যের দিক থেকেও প্রাচীন, সংস্কৃতির দিক থেকেও। বর্তমানে জনবিন্যাস পাল্টাচ্ছে, বাইরের মানুষ ঢুকছে, প্রোমোটারদের আস্ফালনে পুরনো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট-হাউজিং কমপ্লেক্স উঠছে। নতুন প্রজন্ম স্থানীয় ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, আগ্রহীও নয়। বিশ্বায়ন ও বিশ্বায়ন-পরবর্তী যুগে পানিহাটিও কি আর পাঁচটা জনপদের মতো সাধারণ হয়ে গেল?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— কেউ সচেতন নয়। তোমরা যদি বিটি রোড ধরে আসো, বেঙ্গল কেমিক্যালের পরের স্টপেজটাই বিবি বাগান, যেখান থেকে নারুলার ডেন্টাল কলেজে যাতায়াত করা যায়। ওখান থেকে শুরু করে রাজা রোড পর্যন্ত এই যে-জায়গাটা, এর দুপাশে কলকাতার নাম-করা সব বিরিয়ানির দোকানের আউটলেট এসে গেছে। এমনকি মিত্র ক্যাফের মতো প্রতিষ্ঠান, তারাও। সঙ্গে গোদরেজ থেকে শুরু করে প্রথমসারির প্রোমোটিং সংস্থাগুলোও। যে-সব মানুষরা আসছে এখানে, তাদের সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতির কোনো যোগ নেই। তাদেরও তো এক ধরনের কালচারের দরকার!। তাই তারা সুখচর গির্জার ওখানে একটা মন্দির করেছে—সাঁইবাবার মন্দির। এবং আমি দেখতে পাই যে, আমাদের ঘরের বউ-মেয়েরা সাঁইমন্দিরে পুজো দিয়ে আসে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— হনুমান মন্দির হলেও একই হত। ডানলপের মোড়ে একটা করেছে।
সাধন চট্টোপাধ্যায়— এখানেও কল্যাণনগরে একটা করেছে হনুমান মন্দির। এখন এই কালচারাল ইনভেশন ঘটেই চলেছে। এমনকি এখানে মুসলিম কালচার একটা বড়ো জায়গা ছিল। মুসলমান পাড়া বলে একটা পাড়া ছিল। এখন যেটার নাম হলধর বসু রোড, অর্থাৎ পানিহাটি ও আগরপাড়ার সীমানা—ওই জায়গাটাকে আগে বলা হত মুসলমান পাড়া। ওখানে মুসলিমরা থাকত। তারপর বিবিবাগান— এই নাম কেন? কারণ, মুসলমান বিবিদের মানে মহিলাদের কবর দেওয়া হত। এখন যেটা ডেন্টাল কলেজ যেটা হয়েছে— গুরুনানক ডেন্টাল কলেজ— প্রভাতী টেক্সটাইল তুলে দিয়ে হয়েছে। স্থানীয় ভূগোল সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে, কোথাও কিছু নেই। যার জন্য বেগম রোকেয়ার কবর যথাযথ হয়নি বলে প্রশাসন জোর করে সেটা অন্য একটা জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এখন যেখানে দেখা যায়, পানিহাটি স্কুলের মধ্যে, ওটা বেগম রোকেয়ার আসল কবর নয়।
তন্ময়— ‘যথাযথ হয়নি’ বলতে?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— যথাযথ হয়নি এই জন্য যে, ‘বেগম রোকেয়ার কবরটা কোথায়?’—বাংলাদেশ থেকে যখন এই প্রশ্ন আসে, তখন বামফ্রন্ট সরকার এখানে। এখানকার চেয়ারম্যান, তিনি আমার অত্যন্ত পরিচিত, তিনি বললেন, ‘এইরকম বাংলাদেশ থেকে এনক্যোয়ারি হচ্ছে, সেটা কি এখানে আছে? তুমি এসব নিয়ে খবর-টবর রাখো, একবার দেখো তো।’ আমি তখন যত মুসলিম কবরখানা আছে এখানে, খুঁজতাম। তারপর হঠাৎ একদিন শুনলাম, পাওয়া গেছে। কেমন সে পাওয়া? পানিহাটি গার্লস স্কুলের মধ্যে একটা কঙ্কাল পাওয়া গেল, সেই কঙ্কাল তুলে সেটা বেগম রোকেয়া বলে ঘোষণা করে দেওয়া হল।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় — প্রথম পর্ব
তন্ময়— এটার মধ্যে কি নিজেদের প্রমাণ করার কোনো দায় ছিল সরকারের?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— হ্যাঁ, ওদের তাড়াহুড়ো তো ছিলই। এটা নিয়ে পরবর্তীকালে অনেকেই আপত্তি জানিয়েছে। কেমব্রাউন স্ট্রিটে যখন বেগম রোকেয়াকে কবর দেওয়া হয় এবং ওখানকার কনজার্ভেটিভরা সেটা অ্যালাউ করে না, তখন সুখচরে একজনের ব্যক্তিগত জমিতে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তো সেটা মৌজা সুখচর। সুখচর মৌজায় না-খুঁজে পানিহাটিতে খোঁজা কেন? আমি এটা মানি না। যারা করার করছে। যতদিন পর্যন্ত ওরা ক্ষমতায় ছিল, প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর খুব জাঁকজমক করে রোকেয়ার মৃত্যুদিন পালন হত। অনেক বাইরের লোক আসত। ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভুল ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
তন্ময়— আপনার কি মনে হয় না, বিকৃত ইতিহাসের উদযাপনও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকৃতিকেই সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করে দেয়? সেটাকেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সত্য বলে চেনে?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— হ্যাঁ, সেটা তো বটেই। তবে আমাদের কাজ হবে সেটাকে ভেঙে দেওয়া। আমি মনে করি আগামীদিনে ইতিহাসের প্রতি যাদের দায়বদ্ধতা আছে, তাদেরকে এটা ভেঙে দিতে হবে। আমি তো সুযোগ পেলেই বলি যে ওটা ঠিক নয়। এবং এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। বিষয় হল, ক্ষমতা তো চিরদিন থাকে না। যতদিন ক্ষমতা ছিল, ততদিন ঢাকঢোল পিটিয়ে এটা করতে পেরেছে। এখন ধীরে ধীরে কিছু মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে, সত্যিই তো এটা নয়। আমি অনেককেই বলেছি খোঁজো। এখন সেটা খুঁজতে গেলে, তাহলে জমির ইতিহাস জানতে হবে। সুখচরে সোহরাওয়ার্দির জমি আছে। ওখানে কারখানা-টারখানা হয়ে গেছে। আমাকে একজন এসে বলল, ওই কারখানার মধ্যে একটা কবরখানা আছে। আমি তখন বললাম, খোঁজ করো ওখানে। তারপর যা হয়। এখন যা পলিটিক্যাল অবস্থা, কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। না-হলে ওই রাজনৈতিক দল ছাড়া ঢোকা যাচ্ছে না। ওই জায়গাতেই কবর আছে বেগম রোকেয়ার। কিন্তু একটা ভুল ইতিহাস আমরা বহন করে যাচ্ছি। আমি এই কথা এই জন্য বলি যে, যাঁরা স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে বা স্থানীয় সংস্কৃতি নিয়ে নিরলস কাজ করছেন, তাঁদের কাছে অনেক বাধা আসবে। আমাকেই অনেকে হয়তো বলবে, এটা তো ঠিক নয়, এ-কথা কেন বলছেন আপনি? আমি মনে করি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে এই বিরোধিতা আমি করব এবং এই বিরোধিতাও আসবেই। কিন্তু সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা দরকার। যাঁরা স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের কাছে এটা খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। স্থানীয় ইতিহাস বহু ভুল তথ্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: চন্দ্রামুখোপাধ্যায় — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— বিটি রোড ও গঙ্গার ধারে যে জনপদগুলো আছে, সেগুলোতে উনিশ শতক থেকেই একের পর এক শিল্প চালু হয়, কলকারখানা তৈরি হয়। রেলপথ স্থাপনের পর শুধুমাত্র স্থানীয়রা নয়, এইসব কারখানাগুলোতে কাজ করার জন্য বাইরের থেকেও বিভিন্ন মানুষ আসে। তখন থেকেই এই অঞ্চলগুলিতে মিশ্র সংস্কৃতি, মিশ্র জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এখন আস্তে আস্তে শিল্প প্রায় অন্তর্হিত। আপনি যেহেতু পানিহাটিতে শিল্পের অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্ব—দুটো দিকই দেখেছেন, এই এলাকার অর্থনীতি এবং পট-পরিবর্তন কীভাবে হল?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— একটা সময়, আমাদের ছোটোবেলা, ঘড়িতে নিয়ন্ত্রণ হত না। নিয়ন্ত্রিত হত কারখানার সিটিতে। ভোঁ পড়ত একটা। তার নানারকম ভিন্নতা ছিল। আমরা ওইটা দেখতাম। ধীরে ধীরে সব পাল্টে গেছে। আমি তো এক বছর সুখচরে ছিলাম, শুনতাম, কত রকমের বাঁশি বাজত! আগে সমাজের মধ্যে একটা স্থিতিস্থাপকতা ছিল। কারণ, একটা নিয়মের মধ্যে ব্যাপারটা চলছিল। এখন বর্তমানে অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে পাল্টে গেছে। যখনই অনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি চলে, তখনই নানাধরনের সামাজিক উৎপাত শুরু হয়। প্রতিযোগিতা, মারামারি। আগে ছোটো-ছোটো লেদ কারখানা ছিল। পানিহাটিতে বাড়ি-বাড়ি স্মল ইন্ডাস্ট্রি ছিল। আজ সেগুলো নেই। ফলে, আজকের সমাজের মধ্যে অ্যান্টি-সোশ্যাল টেন্ডেন্সি একদিকে বাড়ছে, আরেকদিকে পাওয়ার দেখানোর ব্যাপার প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেছে। নেগোশিয়েশনের মধ্যে দিয়ে কোনো জায়গায় আসতে পারবেন না আপনি। যে-কোনো ইস্যুতে মারামারি হয়ে যাবে। আপনি সমাধান করতে পারবে না। সেটা এ-জন্যে, কেন-না অর্থনীতিটা হচ্ছে অসংগঠিত অর্থনীতি। অসংগঠিত অর্থনীতি ভয়ঙ্কর জিনিস। এরা নির্ভর করে শাসক শ্রেণির ওপর। ৩৪ বছর ইউনিয়নগুলো একটা দলকে সাপোর্ট করেছে। যেই চলে গেল, পরেরদিন থেকে ঝান্ডা পাল্টে গেছে। কাল যদি আরেকটা অন্যদল আসে তাহলে আবারও ঝান্ডা পাল্টে যাবে। ফলে, একটা টেনশন সমাজের মধ্যে আছে। এই টেনশনটা যদি কান পেতে কেউ শুনতে পারে, তাহলেই বুঝে যাবে আমাদের সেই পুরনো সমাজটা নেই। আমরা এই সন্ধিক্ষণগুলো দেখে এসেছি। সমগ্র অঞ্চলে একটা ল’লেসনেস চলছে। কেউ কারোর কোনো কথা শোনার নেই।
তন্ময়— একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা বা আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে লেখালিখিকে কি আপনি সাহিত্যচর্চার অঙ্গ হিসাবে দেখেন?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— আঞ্চলিক ইতিহাসটাই সাহিত্য নয়। কিন্তু আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে সাহিত্য রচনা করা যেতে পারে। অর্থাৎ, ইতিহাসচর্চাটা সাহিত্য হতে পারে না, কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে ইতিহাস আসতে পারে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কমল চৌধুরী
তন্ময়— কিন্তু ইতিহাস-বর্ণনার মধ্যে সাহিত্য এলেই যে সেটা গল্প, উপন্যাস হয়ে যাবে, তেমনটা নাও হতে পারে…
সাধন চট্টোপাধ্যায়— নাও হতে পারে। কিন্তু আমরা সাহিত্যপাঠের মধ্যে থেকে আমরা ইতিহাসের সন্ধান করতে পারি। আমি একটা উদাহরণ দিই। সমরেশ বসুর প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’। ওঁর প্রথম উপন্যাস পড়লে টের পাবেন, এই সমস্ত অঞ্চলে কখন কীভাবে ইন্ডাস্ট্রির পত্তন ঘটেছিল। এইসব কৃষি অঞ্চল মধ্যে থেকে কেন চটকল গড়ে উঠল? এই প্রশ্নটা থেকে যায় তো? সমরেশ বসুর ‘উত্তরঙ্গ’ পড়লে কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরটা বোঝা যাবে। তার মানে এই নয় যে, উত্তরঙ্গটা পুরোটাই ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু ওর মধ্যে একটা বীজ থাকে। আমারও তাই মনে হয় যে, আধুনিক সাহিত্যের মধ্য থেকে একটা ইতিহাসের আভাস উঠে আসা দরকার।
তন্ময়— সাহিত্যচর্চা—সাহিত্যচর্চা বলতে গল্প, উপন্যাস, কবিতার কথাই বলতে চাইছি—সাহিত্যচর্চা ও আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে লেখালিখি কি পাশাপাশি চলতে পারে? যাঁরা গল্প, উপন্যাস, কবিতা ইত্যাদি লেখেন, তাঁদের বেশিরভাগ জনের মধ্যেই ইতিহাস নিয়ে লেখালিখির আগ্রহ দেখা যায় না। এর কারণ কী? কেউ যদি দুটোই একইসঙ্গে পাশাপাশি নিয়ে এগোতে চান, তাঁদের কী পরামর্শ দেবেন? প্রবন্ধলিখন বা অতিরিক্ত তথ্যনির্ভর কাজ কি কবিতা, গদ্য ইত্যাদি লেখার সংবেদী মনকে স্তিমিত করে দেয়?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— এটা খুবই জটিল প্রশ্ন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলছি, আমি তথ্যনির্ভর সাহিত্য খুব একটা পছন্দ করি না। কারণ, তথ্যনির্ভরতা তো সংবাদপত্রও করতে পারে। আজ তো তথ্যনির্ভরতা সংবাদপত্রই করে। তাই যদি করে, তাহলে আমি অতিরিক্তভাবে সাহিত্য আমি কেন পাঠ করব? আমি সাহিত্য পাঠ করব এই জন্য, যেখানে সংবাদপত্র শুধু তথ্য স্পর্শ করতে পারে না। তথ্যকে অতিক্রম করার যে-জায়গা, সাহিত্য সেই জায়গায় পৌঁছোবে। যেমন, আমি যে-প্রসঙ্গটা একটু আগেই বলছিলাম—উত্তরঙ্গ—উত্তরঙ্গ কিন্তু স্থানিক ইতিহাস নয়, স্থানিক ইতিহাসকে অতিক্রান্ত করে জীবনের কিছু কথা উনি বলেছেন। সাহিত্যিক বলেই উনি এটা করতে পেরেছেন। না-হলে ওই অঞ্চলের ইতিহাস ঘেঁটে অনেকেই তো বই তৈরি করেছেন, আমরা আজ সেটাকে মনে রাখিনি। সাহিত্যের কাজ হচ্ছে ওই জায়গাটা।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব
তন্ময়— না, সে-কথা বলছি না। আমি ধাপে-ধাপে প্রশ্নটা করি বরং। সাহিত্যচর্চা ও আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে লেখালিখি কি পাশাপাশি চলতে পারে?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— হ্যাঁ, পাশাপাশি চলতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলছি, ‘পানিহাটা’ উপন্যাস আমি লিখেছি, লেখার পরেও আমার মনে হয়েছে ইট ইজ নট এনাফ। তাই আমি পাশাপাশি অন্যভাবে ‘কালের কড়চা’-য় ‘বৃহত্তর পানিহাটি’ বইটি লিখেছি। না-হলে এইসব কথাবার্তা কিছু কিছু তো আমার ‘পানিহাটা’ বইটিতেও এসেছিল। তবে আমার মনে হয়েছে দুটো আলাদা। ভূমিকাও আলাদা হবে সেখানে।
তন্ময়— যাঁরা গল্প, উপন্যাস, কবিতা ইত্যাদি লেখেন, তাঁদের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই ইতিহাস নিয়ে লেখালিখির আগ্রহ দেখা যায় না। এর কারণ কী?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— এর কারণ, এটা করতে গেলে যে-পরিশ্রমটা করতে হয় এবং এটা করতে গেলে যে-লাইব্রেরি ওয়ার্ক, যে-রিসোর্স থাকা দরকার, সেটা থাকে না। আমি একটা উদাহরণ দিই। হোসে সারামাগো। বিখ্যাত পর্তুগিজ লেখক, যিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন, তিনি একটা উপন্যাস লিখেছিলেন। সেই উপন্যাসটা হচ্ছে ‘গসপেল অ্যাকাউন্টিং টু জেসাস ক্রাইস্ট’। তিনি জেসাস ক্রাইস্টকে— ইতিহাসের জেসাস ক্রাইস্টকে যেভাবে তুলে এনেছিলেন, পড়ে আমরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তার কারণ, তিনি ধর্মীয় আবেগ, সবকিছুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে জেসাস ক্রাইস্টকে ওই সময়ের তাঁর আর্থিক, সামাজিক পরিস্থিতিকে বিচার করে মানুষটাকে তুলে এনেছেন। এটা করতে গিয়ে তাঁর যে-লাইব্রেরি ওয়ার্ক, তার যে-বিভিন্ন সোর্সগুলোকে তিনি ইউটিলাইজ করেছেন, আমার দেশে সে-সমস্ত নেই। ফলে, আমার দেশে যাঁরা ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে চান, একটা ইতিহাসের পটভূমিকায় রোম্যান্স থেকে শুরু করে নানাধরনের প্রেক্ষাপট— যেগুলো অ্যাট্রাক্টিভ হবে, সেই কাজটা করেন।
তন্ময়— কেউ যদি একইসঙ্গে দুটোই— সাহিত্যচর্চা ও ইতিহাসচর্চা করতে চান, তাঁকে আপনি অগ্রজ হিসাবে কী পরামর্শ দেবেন?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— আমি বলব, যখন তিনি ইতিহাসচর্চা করছেন, তখন তাঁকে সাহিত্যিক সত্তাটা সরিয়ে রাখতে হবে। এটা না-সরালে হবে না। মেশানো যাবে না। এবং তার সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানও বুঝতে হবে। সচেতন থাকতে হবে অতি-অবশ্যই। না-হলে দুটো মিলেমিশে গণ্ডগোল হয়ে যাবে। সেটা না-হবে সাহিত্য, না-হবে ইতিহাস।
তন্ময়— এবার শেষ প্রশ্ন। ইতিহাসচর্চা বা এই জাতীয় গবেষণামূলক কাজ তো এক অর্থে তথ্য এবং তার বিশ্লেষণের গণ্ডিতেই ঘোরাফেরা করে। এই তথ্যনির্ভরতা বা তথ্যবিশ্লেষণ—এটা একটা বিজ্ঞানসম্মত প্রসেসও বলা যায়। এই তথ্যনির্ভরতা কি গদ্য, কবিতা ইত্যাদি লেখার একটা সংবেদী মন, সেটাকে কোথাও স্তিমিত করে দেয়? মানে একধরনের চর্চা কি আরেকধরনের চর্চার যে-শৈল্পমাধুর্য—সেটার ওপর প্রভাব ফেলে? সেটাকে গিলে নেয়?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— প্রভাব ফেললেও, এখানে কিন্তু সংযমটা বড়ো কথা। বঙ্কিমবাবু ‘বিষবৃক্ষ’ লিখছেন, আবার যখন ‘কৃষ্ণচরিত্র’ লিখছেন, দুটো সম্পূর্ণ আলাদা, তখন তিনি যুক্তির ওপর চলছেন। এই জায়গাটাকে বজায় রাখতে হবে। এই জায়গাটা যিনি করতে পারেন, তিনিই পারেন। আমাদের এখানে ইতিহাসের যে-উপন্যাসগুলো লেখা হয় সেগুলো ইতিহাসের উপন্যাস নয়। সেগুলো হচ্ছে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় কল্পনা ও রোম্যান্স মিলিয়ে লেখা উপন্যাস, যেখানে কিছু তথ্য সংগ্রহ হচ্ছে। আমার মনে হয় ইতিহাস সেটা নয়। ইতিহাস হচ্ছে, রাজারাজড়ার যুগে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্মীয় চিন্তাভাবনা, চেতনা—এগুলো। লেখকরা কিন্তু যখন উপন্যাস লেখেন, তখন সেদিকে যান না। তাঁরা ওই রাজারাজড়া আর প্রধান ঘটনাক্রম নিয়েই কাজ করেন। গণ্ডগোলটা ওখানেই হয়।
(সমাপ্ত)
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
Powered by Froala Editor