সাধন চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৪৪ সালে, বরিশালের মাধবপাশার কাছে শোলনা গ্রামে। দেশভাগের সময়, মাত্র ৩ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গে আসা, ১৯৫৩ সাল থেকে সুকচর-পানিহাটির অধিবাসী। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তিনি পরিচিত। লিখেছেন অসংখ্য গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ। আজকের ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘কালের কড়চায় বৃহত্তর পানিহাটি’-কে (প্রকাশসাল ২০২১) কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে সাধনের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ প্রথম পর্ব।
তন্ময়— লেখালিখির জগতে আপনার মূল পরিচিতি গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক হিসাবে। সেখান থেকে সরে এসে, এই পঁচাত্তরোর্ধ্ব বয়সে একটি জনপদের ইতিহাস নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বই প্রকাশ করলেন। কেন?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— প্রথমত, আমি রবীন্দ্রসাহিত্য পড়তে পড়তে মাঝে মাঝেই ‘পেনেটি’ বলে একটা রেফারেন্স পেতাম। পরে তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’-তে দেখলাম, রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো থেকে বেরিয়ে প্রথম এসেছিলেন পানিহাটিতেই। সেটা ১৮৭২ সাল। রবীন্দ্রনাথের তখন ১১ বছর বয়স। এবং এখানে উনি ৪৮ দিন ছিলেন। পানিহাটি তাঁর জীবনে এতই প্রভাব ফেলেছিল যে, আজন্ম তিনি তা ভুলতে পারেননি। চিঠিতে, বক্তৃতায়, সাহিত্যে রেফারেন্স হিসাবে ‘পেনেটি’ এসেছে বারবার। এছাড়া ‘জীবনস্মৃতি’-তে তো তিনি এই পেনেটির দিনগুলোর কথা বিস্তারিতভাবে লিখে গেছেনই। আমি ওঁর সাহিত্য খুঁজে খুঁজে, যেখানে যেখানে রেফারেন্স হিসাবে ‘পেনেটি’ এসেছে, সেই প্রসঙ্গগুলোকে ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম। এরপর যখন রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মোৎসব হয়, তখন পানিহাটি মিউনিসিপ্যালিটিকে বলেছিলাম, এটা পানিহাটি পৌরসভার একটা গৌরবের বিষয়, আমি এই কাজটা করেছি, ওরা কি এটা ছাপতে আগ্রহী? ওরা বলল, ‘এ তো ভালো জিনিস।’ ওরাই ‘পেনেটিতে রবীন্দ্রনাথ’ বলে একটা চটি বই প্রকাশ করে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কমল চৌধুরী
১৮৭২-এর পর, রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার এখানে আসেন ১৯১৯-এ, যখন জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার প্রতিবাদে তিনি পদক ত্যাগ করবেন। সেই পদত্যাগপত্র লেখার জন্য উনি এখানে এসেছিলেন। কিন্তু এখানে বসে সেটা লেখেননি। এরপরে আবার উনি আসেন ১৯২৮ সালে—এখানে যে বাড়িটায় থাকতেন, ওই বাড়িটা একটা অনাথ আশ্রম হয়ে যায়—এক অনাথ মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে ওঁকে ডাকা হয় এবং উনি এসেছিলেন। সেখানে একটা আম গাছ লাগিয়েছিলেন। তারপর শেষ ১৯৩৪ সালে উনি আসেন বাসন্তী কটন মিল উদ্বোধন করার জন্য। সেখানে তিনি জাতীয় অর্থনীতির ওপর যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা অসাধারণ বক্তৃতা। আমি সবগুলো সংগ্রহ করে পৌরসভাকে বই করার জন্য বলেছিলেন। ওরাও করেছে। বইটা একটা চটি বই। কিন্তু মজাটা হচ্ছে, আমি শঙ্খ ঘোষকে অনুরোধ করতে, শঙ্খবাবু একটা ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। এবং এই বইটা পানিহাটিতেই উদ্বোধন করা হয়। শঙ্খবাবু আর পূর্ণেন্দু পত্রী এসেছিলেন। কিন্তু যা হয়—প্রশাসনই বলো বা রাজনৈতিক দল বলো—এরা ইতিহাস, আঞ্চলিকতা, সাহিত্য এসব নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামায় না। যেটা করে সেটা ভোটের জন্য। যার ফলে কী হল? বইটা অনেকের হাতেই গেল না। অনেকেই আমাকে বলেছেন যে বইটা পাচ্ছেন না। তারপর আমি জানলাম, গুদামের মধ্যে ফেলে রেখেছে বইটা তালাবন্ধ করে। আমি এই বইয়ের একটা কপি বিশ্বভারতীতে দিতে বিশ্বভারতী ওরা বইটা রবীন্দ্রভবনে প্রিসার্ভ করে। একমাত্র ওখানেই বইটা ছিল।
তো এটা নিয়ে আমার মধ্যে একটা ক্ষোভ ছিল, যে, এমন একটা ব্যাপার করলাম, কিছু হল না! তখন আমি চিন্তা করলাম, একটা জায়গায় শুধু একজন বিখ্যাত ব্যক্তি এসেছিলেন—এটাই তো শুধু ইতিহাস হতে পারে না। ইতিহাস হচ্ছে এখানকার জনজীবন, জীবনযাত্রা, তাদের সংস্কৃতি কী ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যাপারগুলো। ভাবলাম, এই নিয়ে একটা উপন্যাস রচনা করলে কেমন হয়! কেন-না আমি তখন এক প্রকাশকের ওখানে দৈনন্দিন আড্ডা মারতাম। তিনি খুব পুরনো প্রকাশক। সমরেশ বসুর সঙ্গে তাঁর বাবার খুব পরিচয় ছিল। সমরেশ বসুর একটি উপন্যাস ছিল ‘জগদ্দল’ বলে। এবং আমার ধারণা, এই উপন্যাসটি একটি ক্লাসিক উপন্যাস হতে পারত, কারণ একটা অঞ্চলকে নিয়ে এমন একটা উপন্যাস তৈরি করা—এটা কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তেমন একটা নেই। কিন্তু সমরেশ বসু তখন খ্যাতির শীর্ষে। তাঁর বিভিন্ন লেখার চাপ। তিনি এই উপন্যাসটার প্রতি খুব একটা সুবিচার করেননি। তার ফলে ‘জগদ্দল’ একটা উপন্যাস বটে, কিন্তু খুব একটা পরিচিত নয়। আমার তখন থেকেই মনে হয়েছিল, আমি যদি সময়-সুযোগ পাই তাহলে আমার অঞ্চল পানিহাটিকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব। এই উপন্যাস লেখার তাগিদে প্রায় বারো বছর ধরে যখন যেখানে ইতিহাসের টুকরো খুঁজে পেয়েছি— পানিহাটির মিউনিসিপ্যালিটির ৩৫টা ওয়ার্ড—প্রত্যেকটা জায়গা, তার মানুষ, সংস্কৃতি, কোথায় কী পুজো হয়— এইসব সার্ভে করতে করতে আমি দেখেছি এই বিষয়টা একটা খনি। এবং আমার মনে হয়, আঞ্চলিক ইতিহাস প্রত্যেকটা মানুষকে তার শেকড়ের সন্ধান দেয়। ফলে এই উপন্যাসটা আমি লিখি। তো, লেখা হল। উপন্যাস বেরোল, ২০১৬ সালে। ‘করুণা’ প্রকাশ করেছিল এটা। বার করার পরেই কিন্তু উপন্যাসটা সব জায়গায় সমাদৃত হয়। আমি ভাবলাম, এখানেই তো শেষ নয়। এবার কী হবে? উপন্যাস লিখতে গেলে কিছু কল্পনার মাধ্যমে ব্যাপারটা মেলাতে হয়, কিছু বাদ দিতে হয়, গোপন করতে হয়। কিন্তু ইতিহাস যদি লিখতে হয় আমাকে, তাহলে ইতিহাসের মতো করেই এগোতে হবে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — প্রথম পর্ব
ধরো একটা সময়তে, এখানে একটা সুতোকলের ইন্ডাস্ট্রি ছিল সোদপুর। ৮-১০টা সুতোকল ছিল এখানে। এটাই শেষ কথা নয়। এর পিছনে প্রফুল্ল রায়ের যে জাতীয়তাবোধ আন্দোলন রয়েছে—আমি ওই শিকড়গুলো খুঁজতে শুরু করলাম। সেইসময়—কলোনিয়াল যুগে যে একটা প্যারালাল ইকোনমি গড়ে তুলতে হবে এটা নিয়ে তিনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন বহু ছাত্রছাত্রীকে। এবং সেটা করতে গিয়ে কী কী পলিটিক্যাল বাধার সম্মুখীন হতে হয়—এই সমস্ত নিয়ে একটা কাজ শুরু করি। এখানে তখন বামফ্রন্ট সরকার। এরা পানিহাটি উৎসব বলে একটা উৎসব করত। পানিহাটি উৎসবে আমাকে একটা দায়িত্ব দেওয়া হল, যে আপনি একটা স্যুভেনির করুন।
এইবার আমার মনে হল, এখানে গ্রেট ম্যান কারা এসেছেন— সেটা তো হল, কিন্তু এটা আঞ্চলিক ইতিহাস নয়। আঞ্চলিক ইতিহাসে এখানকার মানুষ, তাদের জনজীবন, তাদের আচার-অনুষ্ঠান এবং তারা জীবননির্বাহ করছে কীভাবে—এটাই হচ্ছে প্রধান। এমনকি আমি জানতে পারলাম এখানকার একটা জমিদারির কথা, যারা বর্ধমান মহারাজার পরেই দ্বিতীয় জমিদার হিসেবে ট্যাক্স দিচ্ছে ইংরেজ সরকারকে। সেটা কম কথা নয়। আরও পেলাম, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলন হয়, যেটাকে আমরা সিপাহি বিদ্রোহ বলি, সেখান থেকে যে-সমস্ত সৈনিকরা বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে চলে এসেছিল, তাদেরক ধরে ফাঁসির ব্যবস্থা পর্যন্ত এখানকার জমিদাররা করেছে। আমার মনে হল যে, এইগুলোই প্রকৃত ইতিহাস। আমাকে এটাই ধরতে হবে। তখন পুরনো মানুষ অনেকে বেঁচে ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম যে, একটা খনির মধ্যে বসে আছি। ‘পানিহাটা’—একটা উপন্যাস তো এতটা ধারণ করতে পারে না। তখন সমস্ত কিছু ফেলে আমি এই ইতিহাসের সন্ধানে ঘুরতে শুরু করলাম। এখানে যে বৈষ্ণব সংস্কৃতি আছে, তার মধ্যেও আবার তিন-চার রকমের ভাগ। এইগুলো সব মাথায় রেখেই এই বইটা তৈরি করি।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন মাথায় এল। পানিহাটির ইতিহাস নিয়ে এর আগেও একাধিক বই বেরিয়েছে। কোনো অঞ্চল নিয়ে আগে কাজ হয়ে যাওয়ার পর আবার আরেকটা বই লেখা কতটা জরুরি? যদি নতুন তথ্যাদির সংযোজন না-হয়, তবে তা পুনরাবৃত্তি দোষে দোষিত হতে পারে। এই কাজে আপনি আপনার ‘পূর্বজ’-দের থেকে কীভাবে আলাদা হয়ে উঠলেন?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— কারোর কাজকেই আমি ছোটো করছি না। মূলত এই কাজ কৃশানু ভট্টাচার্য করেছে। কৃশানু আমার ছাত্র। আমার আগে থেকেই ও কাজটা করতে শুরু করেছে এবং সেটা গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেয়েছে। খুব সম্ভবত ওই যে ‘পেনেটিতে রবীন্দ্রনাথ’— ওই বইটাই পরবর্তী জেনারেশনকে আলোড়িত করেছিল ইতিহাস খোঁজার ব্যাপারে। আমার মনে হয়েছে, এঁরা ইতিহাসগুলো দেখছেন, তবে সাধারণ মানুষের যে-জীবন—সেটা ধরছেন না। বিশেষ বিশেষ কিছু জিনিসেই আলোকপাত করছেন—যেমন এখানে শশীপদ রায়চৌধুরী বিপ্লবী ছিলেন, ওমুকে তমুক ছিলেন—এঁরা ব্যক্তি-ইতিহাসটা বেশি করে ধরছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, আমি একটা কমিউনিটিকে ধরতে চেয়েছি। এখানে তো চৈতন্যদেবেরও প্রভাব অপরিসীম। তবে চৈতন্য কিন্তু মাত্র একবারই এখানে এসেছিলেন।
তন্ময়— পানিহাটি-খড়দহে তো নিত্যানন্দের ঘাঁটি ছিল বলা যায়।
সাধন চট্টোপাধ্যায়— নিত্যানন্দ এলেন কোথা থেকে? চৈতন্যদেবই কিন্তু পাঠিয়েছিলেন তাঁকে। এবং এই পাঠানোতেই শান্তিপুরের অদ্বৈত আচার্য খুশি ছিলেন না নিত্যানন্দের ওপর। তাঁরা ‘অ্যান্টি-নিত্যানন্দ’। কিন্তু নিত্যানন্দের অর্গানাইজিং পাওয়ার এত বেশি যে, চৈতন্যের মতো মানুষ তাঁকে পাঠিয়েছেন।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — প্রথম পর্ব
তন্ময়— আমার পরের প্রশ্নটা হয়তো প্রথম প্রশ্নেরই খানিকটা প্রসারণ। আপনি তার উত্তরও দিয়েছেন খানিকটা। গল্প-উপন্যাস লেখার সময় বাস্তবের সঙ্গে কল্পনারও আশ্রয় নিতে হয়, কিন্তু আঞ্চলিক ইতিহাস রচনা পুরোপুরি তথ্য ও অনুসন্ধান-নির্ভর একটি কাজ। এই কাজ করার সময় সাহিত্যিক মনন কি ইতিহাসকার সাধন চট্টোপাধ্যায়কে কোথাও প্রতিহত বা প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— না। এখানে একটা কথা বলে রাখি, আমি সাহিত্যিক নিশ্চয়ই। কিন্তু আমার ডিসিপ্লিন—আমার লেখাপড়া সবই কিন্তু বিজ্ঞানের—ফিজিক্সের। আমি মনে করি, তথ্য ইজ নট এনাফ। তথ্যটা বড়ো কথা নয়। তথ্যটাকে বিশ্লেষণ করতে হবে। কেন এটা হচ্ছে? কেন সোদপুরে এত সুতোকল হয়েছিল? এই লাইন ধরে বরানগর থেকে হালিশহর অবধি চটকল আছে সব জায়গায়— একমাত্র পানিহাটি মিউনিসিপ্যালিটিতে চটকলকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ঢুকতে দেয়নি, এটা থেকে এখানকার জমিদারের প্রতাপকে, তাঁর সংস্কৃতিকে বোঝা যায়। এখানে চটকল নেই—এটা তথ্য। কিন্তু কেন নেই? তার সামাজিক, ঐতিহাসিক ব্যাপারটা কী? আমার মনে হয়, আঞ্চলিক ইতিহাসে এই ব্যাখ্যাটাই দরকার। এই ব্যাখ্যা করতেই কিন্তু আমার অন্যান্য কাজ থাকা সত্ত্বেও এই কাজটায় হাত দিয়েছিলাম। শুধু পানিহাটি নয়, একটা সময় টিটাগড়কে নিয়ে আমি উপন্যাস লিখব বলে বাড়ি ছেড়ে টিটাগড়ের বস্তিতে থাকার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বস্তির মানুষরা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, আমি থাকতে পারব না। অতটা ডিক্লাসড হতে পারব না। ওরা বুঝেছিল, আমি বুঝতে পারিনি। এবং সেখানে ওই বস্তির মধ্যেও আমি এফেক্ট অফ কালচার দেখেছি। দেখেছি দেশিয় কালচারটা কীভাবে তাদের জীবনে প্রতিফলিত হয়। আজকে এখানে সেই দেশিয় কালচারটাকে সরিয়ে একটা সর্বজনীন কালচার, কনসিউমারিজম ঢুকছে। এই ইতিহাসটাও তো আমাকে এটার মধ্যে থেকে বার করে নিয়ে আসতে হবে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— পানিহাটি বৃহত্তর পরিসরে খ্যাতিলাভ করে ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে, চৈতন্য-নিত্যানন্দের সূত্র ধরে। দণ্ডমহোৎসব, রাঘব পণ্ডিতের ভিটে, নিত্যানন্দের খড়দায় বসবাস ইত্যাদির প্রভাবও কম নয়। কিন্তু পানিহাটি নামটি আরও সুপ্রাচীন। কারণ, চৈতন্যভাগবত-এই পানিহাটির উল্লেখ আছে। এবং তারও আগে পানিহাটিতে বৌদ্ধচর্চা ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রাচীন নাম ‘পণ্যহট্ট’ ইঙ্গিত দেয় এখানকার বাণিজ্য-সংস্কৃতির। চৈতন্য-নিত্যানন্দের আগে, অর্থাৎ চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে পানিহাটির ভূগোল, সংস্কৃতি, জনবসতি কেমন ছিল?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— তুমি বলতে চাইছ প্রাক-চৈতন্য যুগের কথা। এইটাই আমাকে আকর্ষণ করেছিল যে, পানিহাটিতে সে-আমলে বৌদ্ধ সংস্কৃতি প্রবহমান ছিল। আমি যে জায়গাটায় থাকি, তার নাম ‘পানশিলা’। সারা পশ্চিমবঙ্গে এরকম বেশ কয়েকটা পানশিলা পাওয়া যাবে। আর কিছু নয়, এটা এসেছে ‘পঞ্চশীল’ থেকে। এখানকার গৃহী বৌদ্ধরা পঞ্চশীল পালন করত—আমি অন্যের জিনিস না-বলে নেব না, মদ খাব না ইত্যাদি পাঁচটা জিনিস জীবনে তারা পালন করত। এই ব্যাপারটা প্রমাণ হয়ে গেল, যখন ওখান থেকে দশ টন ওজনের একটা পাথরের অংশ— যেটাকে খিলান বলা হয়, পাওয়া গেল…
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় — প্রথম পর্ব
তন্ময়— ঠিক কোন জায়গা থেকে পাওয়া গেল?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— এটা পাওয়া গেল সুকচর আর খড়দা— এখনকার খড়দা মিউনিসিপ্যালিটির সীমানায়। এককালে ওটাও সুকচর মৌজার মধ্যে ছিল। ওখানে যেই পাওয়া গেল, আমার কাছে খবর আসতেই বললাম, ওটা ধরে রাখো, কাউকে দিও না। সময়টা সত্তরের দশক, যখন আমি এই কাজের জন্য নেমে পড়েছি। তো যাই হোক, হঠাৎ আশুতোষ মিউজিয়াম থেকে লোক আসে ওটা নিয়ে যেতে। তো আমি বললাম, এটাকে নেওয়া যাবে না, এটা থাকবে এখানে। একটা আন্দোলনের মতো করে-টরে ওটাকে রেখে দিলাম। কিন্তু কোথায় থাকবে সেটা? ওটাকে নিয়ে গিয়ে খড়দা মিউনিসিপ্যালিসিটির একটা ঘরের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। পরে পড়াশোনা করতে করতে নিবেদিতার বই পড়লাম। পড়তে পড়তে জানলাম, নিত্যানন্দ একদিনে জোর করে অনেক বৌদ্ধকেই বৈষ্ণবে ধর্মান্তরিত করেছিল। এবং ওদের যে গুরুরা, তারা পুথিপত্র নিয়ে পালিয়ে গেছে।
তন্ময়— পরবর্তীকালে নিত্যানন্দের ছেলে বীরভদ্রও কম ধর্মান্তরিত করেননি।
সাধন চট্টোপাধ্যায়— ঠিক। এবার আমি অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ থেকে একটা কথা বলি। সেই সময়ে এখানকার মানুষদের জীবিকা কী ছিল? এখানে যে-নদী—সোনাই নদী, সেই নদীটা চুরি হয়ে গেছে। এটা নিয়ে পরে একটা উপন্যাসও লিখেছি আমি। এই নদীটা ঘোলার ওখানে গিয়ে পড়ত। ওখান থেকে বেরিয়ে চলে যেত।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: চন্দ্রামুখোপাধ্যায় — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— এই সোনাই নদীর উৎপত্তি প্রাথমিকভাবে যমুনা থেকে, তারপর বরতির বিলে এসে, সেখান থেকে আলাদা শাখা হয়ে বেরিয়েছে। ক্রমে সোদপুর, নাটাগড়, ঘোলা, আগরপাড়া হয়ে বেলঘরিয়ার পূর্বপ্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাগজোলা খালে মেশা— এই ছিল সোনাই নদীর প্রাচীন গতিপথ। এখনও নাটাগড়ে বিভিন্ন পুকুরের চিহ্ন দেখে সোনাই নদীর পথ কল্পনা করা যায়।
সাধন চট্টোপাধ্যায়— একদম, এটাই সোনাই নদীর ব্যাপারটা। ত্রিবেণী থেকে তো তিনটে নদী বেরিয়েছে—ভাগীরথী, সরস্বতী এবং যমুনা। যমুনার একটা শাখানদী—এই শাখানদীটা আমাদের পিছন দিক থেকে গিয়ে, এখন যেটা সল্টলেক—তার মধ্যে দিয়ে গিয়ে টালিনালা অর্থাৎ আদিগঙ্গায় পড়েছে। বর্তি বিলের ক্ষেত্রে লক্ষ করে দেখবে, শ্যামনগরের ওখান থেকে শুরু করে, শেষ হচ্ছে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে-তে। এই এক্সপ্রেসওয়েটা পুরোটা বিলের ওপর দিয়ে তৈরি হয়েছে। এই নদীটার নাম ছিল খুব সম্ভবত সুঁতি নদী।
তন্ময়— সুঁতি, সোনাই, সুবর্ণবতী—একই নদীর বিভিন্ন নাম।
সাধন চট্টোপাধ্যায়— একদম। একই নদী, বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন নাম। যাইহোক, আবার চৈতন্য-প্রসঙ্গে ফিরি। চৈতন্যের আগে যাঁরা বিভিন্ন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ছিলেন এবং বৈষ্ণব সাহিত্য নিয়ে ইম্পর্ট্যান্ট কথাবার্তা বলেছেন, তাঁরা—যেমন মালাধর বসু, এই মালাধর বসুরা ছিলেন দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়েত। এই দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়েতদের যে যে জায়গায় সেটেলমেন্ট ছিল, সেই জায়গাগুলোর প্রতি চৈতন্যদেবের অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। ওই যে বারুইপুর যাচ্ছেন, ওখানে একটা বড়ো সেটেলমেন্ট ছিল। পানিহাটিতেও দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়েৎদের মকরদ্ধ কর—ওই কররা ছিলেন। উনি পানিহাটিতে আসবার সময় যে সাতজন ওঁকে রিসিভ করেছিলেন, তাঁদের একজন এই মকরদ্ধ কর। এই কররা নাটাগড়ে বাস করত। চৈতন্যদেবের পানিহাটিতে আসার অন্যতম আকর্ষণ ওই দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থদের বাস। এবং হাতিয়াগড়েও তাঁরা বাস করতেন— চৈতন্য যে যে জায়গায় গেছেন, সেখানেই ছিল দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়েতদের বাস। এই জিনিসটা যখন মাথায় ঢুকল, আমি এভাবেই দেখানোর চেষ্টা করলাম। আরেকটা বড়ো জায়গা হচ্ছে হালিশহর…
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: অলোক সরকার — প্রথম পর্ব
তন্ময়— শিবানন্দ সেন…
সাধন চট্টোপাধ্যায়— হ্যাঁ, শিবানন্দ সেন। কবিকর্ণপুরের বাবা। শিবানন্দ সেন খুবই প্রভাবশালী মানুষ। পরবর্তীকালে এইসব জায়গাগুলোয় বৈষ্ণব সেন্টার হয়ে যায়। খড়দাতে চৈতন্যদেব যাননি। ওরা বলে বটে। পানিহাটিতে তিনমাস নিত্যানন্দ ছিলেন রাঘবের বাড়িতে।
তন্ময়— তার বছর দশেক পর তো খড়দহে বসবাসই শুরু করলেন।
সাধন চট্টোপাধ্যায়— হ্যাঁ, তারপরই তো ওখানে গিয়ে, বিয়ে-থা করে সংসারধর্ম করলেন। সেটা তো আলাদা ব্যাপার। এবং সেটা নিয়েও কাজকর্ম যে দু-একটা দেখেছি… আমার অসুবিধা হয় কী জানো? এদের হিস্টোরিয়াল পার্সপেক্টিভটা, বিশ্লেষণটা থাকে না। তথ্য দিচ্ছে, তার মধ্যে ধর্মীয় ব্যাপারটাই বেশি থাকে। মুশকিল হয়ে যায়, যখন অনেকে বলেন পানিহাটিতে চৈতন্যদেব দুবার এসেছিলেন। কিন্তু তা নয়। একবারই এসেছিলেন, রাঘব পণ্ডিতের কাছে। আর রাঘব তাঁকে দেখালেন, এই যে পানিহাটির তান্ত্রিক বৌদ্ধরা, এরাই কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করবে। আমাদের বাঙালি মুসলমানদের একটা বড়ো অংশই আদিতে তান্ত্রিক বৌদ্ধ।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: অলোক সরকার — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— মানে আপনি বলতে চাইছেন, প্রাক-চৈতন্য যুগে পানিহাটিতে মূল বসতি ছিল এদেরই? এবং পরবর্তীকালে বৈষ্ণবধর্মের প্রাবল্যের ফলে এরাই বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে?
সাধন চট্টোপাধ্যায়— হ্যাঁ।
(পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব)
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
Powered by Froala Editor