মৌমিতা সাহার জন্ম ১৯৭১ সালে, কলকাতায়। পেশায় ভূগোলের শিক্ষিকা। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আঞ্চলিক ইতিহাস-গবেষণার সঙ্গে জড়িত। বর্তমান ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘ইস্ট সুবার্বন ও সল্টলেক: নগর কলকাতার পুবমুখী সম্প্রসারণের ইতিবৃত্ত’ (প্রকাশকাল ২০২৩) বইটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব...
তন্ময়— এখানে প্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন সেরে নিই। সল্টলেকের সঙ্গেই তো উল্টোডাঙা নামটা প্রায় একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। কারণ উল্টোডাঙার পর থেকেই সল্টলেকের শুরু। এই যে উল্টোডাঙা বা উল্টোডিঙি— এর উল্লেখ উনিশ শতকের বিভিন্ন ম্যাপেও পাওয়া যায়। অর্থাৎ, উল্টোডাঙা জায়গাটা অত্যন্ত প্রাচীন। এমন নামকরণের কারণ কী? শুনেছিলাম, রং-করা ডিঙি উল্টে রেখে শোকানো হত এখানে, তা থেকেই...
মৌমিতা সাহা— হ্যাঁ, সেটাই বলা হয়। কিন্তু ওখানে যে বড়ো একটা ঝড় হয়েছিল, ডিঙা উল্টে গিয়েছিল— এরকম কোনো রেফারেন্স পাইনি। যেটা আমাদের ১৭৩৭ সালে কলকাতার ক্ষেত্রে পাই— ডিঙাভাঙা জায়গাটা নিয়ে। এখানে সেরকম কোনো সূত্র পাইনি। মূলত যাঁরা নৌকো বানাতেন ও রং করতেন, তাঁদের বসবাস ছিল ওই অঞ্চলে এবং সেই সূত্রেই এসেছে এমন নাম।
তন্ময়— পূর্বে যে এই বিস্তীর্ণ জলাভূমি, তা নিয়ে কলকাতার সাহেবদের অভিযোগ ছিল যে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে হাওয়া দিলে পচা মাছের গন্ধ আসে। এ ছিল তৎকালীন এক বিরক্তির ব্যাপার। আবার, কলকাতার ঢাল যেহেতু পূর্বমুখী— বৃষ্টিবাদলা বা অন্যান্য জল ওইদিকে বয়ে যেত। সল্টলেক উপনগরী গড়ে ওঠায় কলকাতার আর কী কী উপকার হল?
মৌমিতা সাহা— কলকাতার নিকাশিটা স্বাভাবিক হল। যেটা না-থাকলে তৈরি করতে হত। সেটা তো কলকাতার কাছে একটা বিরাট আশীর্বাদ যে এত বড়ো সার্কুলার প্যানেল পাওয়া গেছে। ঢালটা পূর্বমুখী হওয়াতে নিকাশিটা খুব সহজে তৈরি করা গেছে।
তন্ময়— সল্টলেক তৈরির আগেও তো একটা স্বাভাবিক নিকাশিব্যবস্থা ছিলই। সল্টলেক তৈরির পর কি বাড়তি কিছু লাভ হয়েছে?
মৌমিতা সাহা— হ্যাঁ, সেটা আরও সায়েন্টিফিক্যালি তৈরি হয়েছে। যখন ভূগর্ভস্থ নালাগুলো তৈরি হল, জল ঠিক মতো বেরোবার জায়গা পেল। আগে যেমন, এমনিই পড়ত, এখন সেটাকে আরেকটু সংস্কার করা হল, যে জলটা সল্টলেকের দিকে, ধাপার দিকেই যাবে। সেটাতে কলকাতার লাভ হল। কিন্তু উল্টোটাও হল, বিদ্যাধরীকে কেন্দ্র করে যে-কর্মকাণ্ডটা হত, সেটা নষ্ট হয়ে গেল। মাছের জোগানটা অস্বাভাবিকভাবে কমতে শুরু করল। ১৯৩০ সালের আশেপাশে যখন এই নোংরা জলে মাছ চাষ শুরু হয়েছিল— সেটা দ্বিতীয় অধ্যায়। সল্টলেকে তো আগে নোংরা জলে মাছ চাষ হত না। আগে নোনাজলে মাছ চাষ হত। এই নিকাশি জল গিয়ে পড়ার পরই মাছের পরিমাণ যখন কমতে শুরু করল, তখন ওঁরা ভাবলেন তাহলে কী করা যেতে পারে? তখন থেকেই দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু। নোংরা জলটাকে কাজে লাগিয়ে এবার মাছ চাষ শুরু হল। কলকাতা দুদিক দিয়েই লাভবান হল। প্রথমত, নিকাশি গিয়ে পড়ল, আর সল্টলেকের মাছ পেত। কিন্তু সল্টলেক হওয়ার পর যে-পরিমাণ বিশুদ্ধ বাতাস এবং মাছের যোগান কলকাতায় যেত, সেটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল।
তন্ময়— সল্টলেক তৈরি হওয়ার পর কলকাতার জনসংখ্যার চাপ বা অফিস-কাছারির চাপ খানিক কমল— এটা কি লাভ হিসাবে ধরা যায় না?
মৌমিতা সাহা— হ্যাঁ, ধরা যায়। কিন্তু খুব বেশি লাভ হয়নি। সল্টলেকের যাঁরা বিরোধিতা করেছিলেন, কিছু সরকারি আধিকারিকদেরও সাক্ষাৎকার আছে যাঁরা বিরোধিতা করেছিলেন— তাঁদের মধ্যে একজন, আইসি শৈবাল গুপ্ত-র লেখা আমি উদ্ধৃত করেছিলাম। উনি পরিষ্কার বলেছিলেন, একটা আঙুলের পাশে আরেকটা আঙুল গজানোর মতো। এ-ছাড়া কিন্তু বেশি বেনেফিট হয়নি। কলকাতার জনসংখ্যা বিকেন্দ্রীকরণের কাজটায় সল্টলেক যে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে, তা কিন্তু নয়।
আরও পড়ুন: ঈর্ষাক্ষাৎকার: মৌমিতা সাহা — প্রথম পর্ব
তন্ময়— ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস এবং তৎসংলগ্ন এলাকা গত তিন-চার দশকে, বা আরও নির্দিষ্টভাবে গেলে সল্টলেক তৈরির পরে কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে?
মৌমিতা সাহা— বাইপাসটা হওয়াতে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে গেল। আমি যদি ট্রান্সপোর্ট, কলকাতার যাতায়াত— এই দিক থেকে দেখি তাহলে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু আমি যদি সল্টলেককে সংরক্ষণ করার কথা ভাবি, তাহলে কিন্তু বাইপাস তার সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি করেছে। ’৮০-৮২ সালে শুরু হয়েছিল এর নির্মাণ। আসলে বাইপাস তৈরিই হয়েছে নিউকাট ক্যানেলকে বুজিয়ে। ওখানেই তো গণ্ডগোল শুরু হল। ক্যানেলটার সংস্কার করা যেত, সেটা না-করে ক্যানেল বুজিয়ে বাইপাস তৈরি করা হল। বাইপাস তৈরি হওয়ার পর রিয়েল এস্টেটের ওইরকম ভয়ঙ্কর চাপ পড়তে শুরু করল। কারণ কলকাতাকে তো আর সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না। ফলে, রিয়েল এস্টেটের বড়ো বড়ো প্রোজেক্টগুলো ওখানেই তৈরি হতে থাকল। বাইপাস তৈরি করেছিল সিএমডিএ— সিএমডিএ-র নিজস্ব রিপোর্টেই ছিল যে এখানে কী কী করা যাবে না। অথচ সিএমডিএ নিজেই সেই নর্মসগুলো ভাঙতে শুরু করে। এখনও রিয়েল এস্টেটের বিপুল আকারের যে-চাপ গিয়ে পড়ছে— সেটা কিন্তু পুরো সল্টলেকটাকে আঘাত করছে। যার জন্য জলাভূমিগুলো রাখা বিশাল সমস্যার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধু জলাভূমি নয়, পূর্ব কলকাতার জলাভূমির মৎস্যজীবীদের দাবি— ওঁদের কাঁচামাল হল নোংরা জল, সেই নোংরা জলটাই ওঁরা পাচ্ছেন না। ওঁদের যে-কোনোভাবে দেখানো হচ্ছে যে, মাছ চাষটা ওখানে লাভজনক নয়। এটা যদি দেখানো যায়, তাহলে এই সমস্ত অঞ্চলগুলোকে রিয়েল এস্টেটে পরিণত করা সহজ হবে। ওঁরা বার বার বলছেন কর্পোরেশনকে, ইরিগেশনকে, যাতে নোংরা জলের সাপ্লাইটা ঠিকঠাক থাকে, যাতে মাছটা চাষ করতে পারেন। তত ওটাতেই আঘাত করা হচ্ছে। এটার কোনো কারণ নেই। ওঁরা বলছেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি না, কেন ঠিক মতো স্লুইস গেট খুলছে না।’ বিভিন্ন সময়ে ওঁরা বার বার দাবিপত্র দেন, ডেপুটেশন দেন। নোংরা জল যে যাচ্ছে না— সেটা খুব পরিকল্পিতভাবে, গুছিয়ে করা হচ্ছে, যাতে ওঁরা জলটা না-পান। ফলে, এই জায়গাগুলোকে বুজিয়ে ফেলে বাড়ি-ঘর বানিয়ে ফেলা যাবে। এই ব্যাপারটা এখন ওঁদের ওপর থ্রেট। কিন্তু ওই নোংরা জল দিয়ে ওঁরা এতটাই সম্পদ তৈরি করতে পারেন— কারণ ওই জলেই মাছ চাষ হচ্ছে, ওই জলেই সবজি চাষ হচ্ছে। ধাপার এই বিপুল অঞ্চলে যে-সবজি চাষ হয়, সব তো এই নোংরা জল দিয়েই। এই নোংরা জলটা না-পেলে ওঁদের রুটি-রুজি বন্ধ হয়ে যাবে। এই ব্যাপারটাতে তো কোনো নজরই দেওয়া হয় না।
তন্ময়— তাহলে এখন সল্টলেক বা তৎসংলগ্ন এলাকার মূল থ্রেট হচ্ছে রিয়েল এস্টেট। শিল্পায়নও কি থ্রেট হয়ে দাঁড়াচ্ছে মাছ চাষের ক্ষেত্রে?
মৌমিতা সাহা— না, না, মাছ চাষটাও তো কৃষিভিত্তিক শিল্প। এটার ওপরেও তো কতকিছু নির্ভর করে। সেটা কোথায় হচ্ছে? বরং, এর জন্য ওঁরা সরকারের কাছে কিচ্ছু চান না। ওঁরা নিজেরা এতটাই খেটে, গায়ে-গতরে কাজ করতে পারেন, তা অভাবনীয়। ওঁদের উদ্ভাবনী শক্তি দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। আজকে তো তবু ওঁরা লেখাপড়া শিখেছেন। উনবিংশ শতকে, বিংশ শতকে বা তারও আগে এঁরা কী জানতেন? কলকাতার সঙ্গে ওঁদের যোগাযোগ খুবই কম ছিল। এই যে বিপুল অঞ্চল— এগুলো তো এক সময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষজন এসে ওই জঙ্গলকে পরিষ্কার করে বসবাস তৈরি, জলাশয়—নিজের ক্ষমতায় করেছেন। এখন এগুলো সরকার দেখছে। কুমোরটুলির গোবিন্দরাম মিত্রদের পরিবার এই অঞ্চলে জমিদারিটা কিনেছিল। ওরাই তো রাজবংশীদের নিয়ে এসেছিল। এখানে বাঘ, সাপ, কুমির— সবের সঙ্গে এঁরা লড়াই করেছেন, লড়াই করে এই জায়গাটাকে ডেভেলপ করেছেন। সেইসব রাজবংশী পরিবার তো ওখানে এখনও থাকে। তাঁরা তো কারোর কাছে কোনো সাহায্য চাননি। নিজেদের মেধা, নিজেদের শক্তি দিয়ে এটা তৈরি করেছেন। কিন্তু তাঁদের ন্যূনতম সম্মান জানানো বা রিহ্যাবিলিটেশন নিয়ে কোনো ভাবনাচিন্তা করা হয়নি— তাঁদের শ্রম নেওয়া হয়েছে, কিন্তু শেষাবধি সেখানে কী করা হল? ধনী মানুষদের বাসস্থান। কিন্তু গরিবদের, শ্রমিকদের আশ্রয় কোথায়? বাসস্থান কোথায়? তাঁদের জীবিকাটা কোথায় গেল? সেটাই বক্তব্য আমাদের, সবসময়ই আমরা দেখছি এঁদের সামনে রাখা হল, কিন্তু সবশেষে এঁদেরকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হল।
তন্ময়— সল্টলেকে যে-অবশিষ্ট জলাভূমি বা চাষের জমি রয়েছে, তার ভবিষ্যৎ কী বলে মনে হয়?
মৌমিতা সাহা— আমার মনে হওয়ার থেকে বড়ো কথা, ওঁদের কথা শুনলে বুঝতে পারি ওঁরা খুবই ভয়ের মধ্যে আছেন। হয়তো আরেকটা জেনারেশন থাকতে পারবে।
আরও পড়ুন: ঈর্ষাক্ষাৎকার: মৌমিতা সাহা — প্রথম পর্ব
তন্ময়— এটা যে রামসার সাইট বলে ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা কি কোনোভাবে তাঁদের নিরাপত্তা দিচ্ছে না?
মৌমিতা সাহা— খাতায় কলমে দিচ্ছে। একটা জায়গা বুজিয়ে ফেলে রিয়েল এস্টেট হল— শুধু এইটুকু ভাবলে ভুল হবে। নানাভাবে ওঁদের থ্রেট করা হচ্ছে। শুধু যে-জলাভূমি বুজে যাচ্ছে, এটা নয়। ওঁদের যে জল দেওয়া হচ্ছে না— এটাও একটা থ্রেট। এখনকার ছেলেমেয়েদেরকে ওঁরা আগ্রহী করতে পারছেন না মাছের কারবারে। ওঁদের ছেলেমেয়েদেরকে বোঝানোই হচ্ছে, এসব কাজ কোরো না, এতে কোনো লাভ নেই। ওঁদের বাবা-মায়েরাও চাইছেন না এই পেশায় সন্তানরা জড়িত হোক। তাঁরা ভাবছেন, আমাদের ছেলেমেয়েদের আমরা কোথায় রেখে যাব? ভয় পাচ্ছেন। ভাবছেন, অন্য কোনো কাজ করলে হয়তো বেটার হবে।
তন্ময়— রাজারহাট আদতে প্রাচীন একটা জনপদ। রাজারহাট-নিউটাউন— এই যে তথাকথিত উন্নয়ন বা যে-নতুন টাউনশিপ তৈরি— এর ভালো বা মন্দ কী কী দিক দেখতে পান?
মৌমিতা সাহা— নগরায়ণের ভালো কী বলব আর? ভালো বলতে কিছু বাসস্থান হল। আর ইন্ডাস্ট্রি সেভাবে নয়, তবে আমরা যদি আইটিকে ইন্ডাস্ট্রি বলি— তবে তার একটা বেনিফিট রয়েছে। কিন্তু যেটা মূল জিনিস ছিল— গ্রামভিত্তিক সভ্যতা— আমরা ধরেই নিলাম যে ওটা সভ্যতাই নয়। গ্রামভিত্তিক সভ্যতা থেকে আমরা ‘সভ্যতা’-টাকে সরিয়ে নিলাম। ধরেই নিলাম গ্রাম মানে ওটা পিছিয়ে আছে, এগ্রিকালচারাল বেসড যা যা অকুপেশন আছে, সেটা ব্যাকওয়ার্ড। শহর হোক, নগর হোক, তাহলেই সেটা এগিয়ে যাবে। তাহলেই সেটা উন্নয়ন। এই বেসিক কনসেপশনটাই আমরা ভুল জায়গা বসিয়ে দিলাম। গ্রামকে আমরা অসভ্য ধরে নিলাম, শহরকে সভ্য। এই যদি আমার মাথার মধ্যে আমি বসিয়ে রাখি, তবে নিউটাউন তো আরও বড়ো হবে, আরও এগোবে। আমি তো গ্রামটাকে গুরুত্বই দিলাম না। সল্টলেক ছিল মাছ চাষের জন্য আর রাজারহাট ছিল মূলত সবজি ও ফুল-ফল চাষের জন্য বিখ্যাত। এই রাজারহাটের যে-প্রাণিজ সম্পদ ছিল— গরু-ছাগল, যে-সম্পদ ছিল কৃষিতে— তার ওপর ভিত্তি করে কি আমরা ওখানে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়তে পারতাম না? সল্টলেকে মাছের ওপর ভিত্তি করে কি কোনো শিল্প গড়া যেত না? সভ্যতা বলতে তো রাস্তা আর বড়ো বড়ো অট্টালিকা নয়। গ্রামভিত্তিক যে-সভ্যতা, তাকে আমরা নগণ্য ভাবলাম। ফলে ওটা ভেঙে দাও, নতুন করে তৈরি করো। যার ফলে আমাদের মনে হল এখানে বড়ো বড়ো টাউনশিপ করতে হবে। মূল জায়গাতেই তো গণ্ডগোলটা হয়ে আছে। এটা সবার মধ্যেই ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেখবেন প্রায়ই একটা কথা শোনা যায়, ‘এখন তো কত ডেভেলপ হয়েছে, কত বাড়ি হয়েছে, কত রাস্তা হয়েছে!’ কথাটা আমার খুব কানে লাগে। তার মানে আগে যেটা ছিল সেটা কি ডেভেলপমেন্ট নয়?
তন্ময়— সল্টলেকের নির্মাণ বর্তমানে মোটামুটি সম্পূর্ণ। তবে রাজারহাট-নিউটাউন এখনও একটা ভাঙা-গড়ার পর্যায়ে রয়েছে। আপনার কাছে একটা হাইপোথেটিক্যাল প্রশ্ন রাখি। ধরুন ষাট বছর আগে যদি সল্টলেক নির্মিত না-হত এবং নব্বইয়ের দশক থেকে রাজারহাট-নিউটাউনে ‘উন্নয়ন’ না-হত, অর্থাৎ যেমন ছিল তেমনই থাকত এবং সময়ের স্বাভাবিক গতিতেই পরিবর্তিত হত, তাহলে ২০২৪-এ পৌঁছে সল্টলেক এবং তৎসংলগ্ন এলাকার অবস্থা কেমন হত?
মৌমিতা সাহা— আমার একটা কথা হচ্ছে, যা ছিল, তার ওপর ভিত্তি করে কি আমরা কিছু করতে পারতাম না? আজকে যদি শান্তিনিকেতনের কথা ভাবি— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো সমবায়গুলোকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে, বোলপুরের গ্রামে-গ্রামে আদিবাসীর নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে-প্রকল্পগুলো নিয়েছিলেন, সেগুলো আমরা জানি। পান্নালাল দাশগুপ্ত বোলপুরে যা করতে চেয়েছিলেন, সেগুলোর কি কোনো ভিত্তি নেই? তার কি কোনো দাম ছিল না? সেরকম প্রকল্প যদি সল্টলেক বা রাজারহাটে করতে পারতাম, তাহলে ভালো হত। গ্রামকে ভিত্তি করেই তো আমরা অনেক উন্নতি করতে পারি। ভালো রাস্তা তৈরি করো, যদি ইলেকট্রিসিটি আনো, স্যাটেলাইট কানেকশন আনো— তাতে তো গ্রামের সঙ্গে শহরের কোনো সংঘাত নেই। এই বেসিক পরিকাঠামোটা দিয়ে, গ্রামের রুটি-রুজিকে ভিত্তি করে যদি আমরা অগ্রসর হতে পারতাম, তবে ওখানে ব্যবসা-বাণিজ্য হতে পারত, শিল্প হতে পারত, স্কুল-কলেজ হতে পারত। গ্রামভিত্তিক পরিবেশবান্ধব শিল্পগুলো বড়ো হওয়ার প্রচুর স্কোপ ছিল। যাঁরা বোদ্ধা মানুষ আছেন, যাঁরা এগুলো নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা যদি এগিয়ে আসতেন তাহলে সিনারিওটা অন্যরকম হতে পারত। তাহলে সেই রাজারহাটই থাকত, সেই সল্টলেকই থাকত। ভাবুন না সেকালে ওইরকম পরিবেশে যদি উল্লেখযোগ্য ইকোনমিক কর্মকাণ্ড ঘটাতে পারেন সল্টলেকের মৎস্যচাষিরা, তবে আজ একশো বছর পর এত লেখাপড়া শিখে, এত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে, তার ওপর ভিত্তি করে আমরা কি কিছু করতে পারতাম না? নিশ্চয়ই পারতাম। কিন্তু আমরা ধরে নিয়েছি, নগরায়ণের মধ্যে দিয়েই সভ্যতায় যেতে হবে। ফলে এটাকে ডেমোলিশ করো। এর মধ্যে একটা কর্পোরেটের ইন্টারেস্ট, আরবাইনাইজেশনের ইন্টারেস্ট লবিটা বেশি করে কাজ করে।
তন্ময়— আপনি দমদম নিয়ে কাজ করেছেন, পরবর্তীতে সল্টলেক নিয়েও। দমদম দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে একটি সুসংগঠিত জনপদ। আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করার জন্য যে যে উপাদানগুলোর দিকে আমরা তাকাই— সেসব দমদমে চাইলে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কারণ সেসবের নথিভুক্তিকরণ হয়েছে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, অপেক্ষাকৃত নতুন জনপদ হলেও, সল্টলেকের ইতিহাসের ঠাসবুনোট তথ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। ফলে, সল্টলেক নিয়ে কাজ করার সময় কী কী প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল?
মৌমিতা সাহা— একদম ঠিক বলেছেন। আপনি নিজেও তো কাজ করেন, তাই ধরতে পেরেছেন। সল্টলেকে তথ্যের ভীষণরকম ক্রাইসিস ছিল। ক্রাইসিস ছিল মানে, এখনও আছে। অনেক ভালোভাবে কাজ করা যেত, যেটা দমদমের ক্ষেত্রে করা গেছে, সেটা এখানে করা সম্ভব হয়নি। তার কারণ হচ্ছে, তথ্য-মানচিত্রের অভাব। ব্রিটিশদের আমরা যতই যা বলি, দমদমের কাজটা করা সম্ভব হয়েছে ব্রিটিশ ডকুমেন্টেশনের জন্য। কিন্তু সল্টলেকে তো বেশিরভাগটাই গ্রাম ছিল, ফলে সেখানে ব্রিটিশ ডকুমেন্টেশন তৈরি হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা বড়ো সল্ট-ওয়াটার লেককেই ওরা চিহ্নিত করেছে। ফলে, আমাদের খুব বেশি করে ক্ষেত্রসমীক্ষার ওপরে জোর দিতে হয়েছে। দমদমের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রসমীক্ষার থেকেও আমাদের বেশি হেল্প করেছে আর্কাইভ, লাইব্রেরি। কিন্তু সল্টলেক, রাজারহাটের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক উল্টো। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে অনেকের কাছে অনেক জিনিস সংরক্ষিত ছিল। বিশেষ করে ভূপেশবাবু— ওঁর নাম না-বললেই নয়— ভূপেশ কুমার প্রামাণিক— ইনি লবণহ্রদের জমিদার লক্ষ্মীকান্ত প্রামাণিকের ভ্রাতুষ্পুত্র। বর্তমানে মারা গেছেন, কিন্তু উনি দীর্ঘদিন আমাদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন এবং ওঁর লেখা একটা বইও আমরা প্রকাশ করেছিলাম। ওই বইটাই ছিল আমাদের গাইডবুক। ওটা ধরেই আমরা ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজটা করি। এরপর বিভিন্ন পরিবারের কাছে গেছি, সমবায়গুলো যাঁরা চালাতেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। এমনকি এই কাজ করতে গিয়ে আমরা জানতে পারলাম, সতীশ দাশগুপ্তের বুনিয়াদী শিক্ষালয় ছিল সল্টলেকে। সেটা তো জানতামই না, কেউ-ই জানত না। সেটা ক্ষেত্রসমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে। সল্টলেকে যে এত বড়ো বিদ্যাধরী স্পিল সমবায় ছিল, সেটা ভূপেশবাবু উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তার টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো তো আর পাওয়া যায়নি। আমরা ক্লু-গুলো পেয়েছি, তারপর সেগুলো আমাদের খুঁজতে হয়েছে। সেটার জন্য প্রচুর সময় লেগেছে। সরকারি দপ্তরগুলোতে ভিজিট করতে হয়েছে, তাদের রিকোয়েস্ট করতে হয়েছে। তবে কয়েকটি সরকারি দপ্তরও কিন্তু আমাদের ভীষণভাবে সাহায্য করেছে। যেমন, সমবায় দপ্তর, সেচ দপ্তর— সেচ দপ্তরের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়, কারণ জল এবং জলাভূমি অঞ্চলে ইরিগেশনের একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। এগুলো না-হলে আমরা বেরই করতে পারতাম না। কিন্তু সরকারি দপ্তরগুলোর একটা মুশকিল হচ্ছে, তাদের ওখানেও আর্কাইভ মেনটেইন হয়নি। সেখানে তো অন্তত আর্কাইভ মেনটেইন হওয়া দরকার ছিল। আমি নিজে শুনেছিলাম, ইরিগেশন বিল্ডিং-এর নিচের তলায় একটা মিউজিয়াম ছিল, সল্টলেক তৈরি হওয়ার সময়কার জিনিসপত্র নিয়ে। কিন্তু এখন সেটা নেই। এখন যাঁরা অফিসার আছেন, তাঁরা তাঁদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যদি না-রাখা থাকে, তাহলে তাঁরাই-বা কী সাহায্য করবেন! তার মধ্যেও যতটা সম্ভব হয় সেটা করা গেছে। আপনি শুনলে অবাক হবেন, আমাদের আরবান ডেভেলপমেন্টের একটা বিরাট লাইব্রেরি আছে। সেই লাইব্রেরিটা কোনো ফাংশন করত না। এই কাজগুলো করতে গিয়ে আমরা সেটা জানতে পারলাম। সিআইটি-র লাইব্রেরিটা কোথায় গেল? আজকে দেখুন, তিনশো বছর আগের ইতিহাস লেখা সহজ হচ্ছে অথচ ষাট বছর আগের ইতিহাস লেখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কারণ হচ্ছে, ব্রিটিশরা তথ্য সংরক্ষণ করে গেছে। আর আমাদের এখানে, কাজ করার পর সেই নথিগুলো সংরক্ষিত হয়নি। সে-কারণে ষাট বছরের ইতিহাস লেখা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই ডিপার্টমেন্টগুলোর আর্কাইভ সংরক্ষণ ভীষণভাবে জরুরি।
আরও পড়ুন: ঈর্ষাক্ষাৎকার: মৌমিতা সাহা — প্রথম পর্ব
তন্ময়— আপনারা পরিবেশের ক্ষতি, রিয়েল এস্টেটের রমরমা ও তার কুফল নিয়ে বার বার সরব হয়েছেন। যাঁরা ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছেন, তাঁদের কি কোনো প্রতিকূলতা বা হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে কখনও?
মৌমিতা সাহা— আমাদের ‘দেশকাল’ পত্রিকাতে শুধু নিউজ পাবলিশ হত না। যখন রাজারহাট টাউনশিপ তৈরি হয়, তখন আমরা একটা পরিবেশগত এবং চাষিদের কমপেনসেশনের ব্যাপারে একটা অ্যাক্টিভিস্টের রোল প্লে করেছিলাম, নব্বইয়ের দশকে। আমাদেরই একজন সহকর্মী, নীলোৎপল দত্ত, আমরা নীলুদা বলতাম, তাঁর কোনো খোঁজই পাওয়া গেল না। মানে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। মূল অ্যাক্টিভিস্টের কাজটা করেছিলেন তিনিই। আমরা সেইসময় সভা করা, চাষিদের বোঝানো, তাঁদের সঙ্গে যাওয়া বিভিন্ন জায়গায়— সবমিলিয়ে অ্যাক্টিভিস্টের কাজটা করেছিলাম। যার ফলে আমাদের উদ্দেশ্যটা শুধুমাত্র লেখা, বই করা বা কাগজ করা ছিল না। ওঁদের আন্দোলনের সঙ্গে আমরাও যুক্ত ছিলাম। তখন তো থ্রেট অবশ্যই হয়েছে। নানাভাবে হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে অনেক ইনফরমেশনই ছিল। ফলে এই বই করার সময় আমরা কোনো থ্রেট পাইনি, কিন্তু সেইসময়ে— যখন আমরা অ্যাক্টিভিস্টের রোল প্লে করতাম— তখন হামেশাই থ্রেট আসত। তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণই হচ্ছে নীলুদার নিরুদ্দেশ হওয়াটা।
তন্ময়— সল্টলেক বা রাজারহাট অঞ্চল থেকে সাম্প্রতিক অতীতে বেশ-কিছু প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়। সেগুলো সম্পর্কে যদি বিস্তারে বলেন…
মৌমিতা সাহা— এটা তো কোচপুকুর আরও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কোচপুকুর হল অ্যাকোয়াটিকার ঠিক পাশে। ২০১৭-১৮-র একটা ঘটনা বলি। সেখানে যখন আমরা কাজ করেছিলাম, তার পাশেই মেট্রোরেলের কাজ হচ্ছিল। তখন ওখানকার গ্রামবাসীরা বলেছিলেন, ওখানে যখন মেট্রোরেলের কাজ হচ্ছে, মাটির তলা থেকে নাকি ভাঙা জাহাজের অংশ পাওয়া গিয়েছিল। তা আমি জানতে চাইলাম, সেই জিনিসটা গেল কোথায়? ওঁরা বললেন, ‘আমরা নিয়ে সবাই বিক্রি করে দিয়েছি।’ জিজ্ঞেস করলাম কী বিক্রি করা হয়েছে? একজন বললেন, লোহার পাত। জানালেন, যে লোহার পাতটা উনি পেয়েছিলেন, সেটার ওজন ৩৫ কেজি মতো। আমার একটা কথা— আজ থেকে একশো বছর আগে রেল লাইন পাতার কাজ করতে গিয়েই কিন্তু হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো পাওয়া গিয়েছিল। আর আজকে আমরা ঠিক একশো বছর পর মেট্রোরেলের কাজ করতে গিয়ে কিছু আর্কিওলজিক্যাল এভিডেন্স পেলাম। একশো বছর আগে রেল কিন্তু কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। এত বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে, তাহলে ব্যাপারটা কী? তারপর তো আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে ছুটে যায়। গবেষণা হয় এবং ব্যাপারটা বেরিয়ে আসে। যাই হোক, মেট্রোরেলের তো উচিত ছিল জিনিসগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখা। অন্তত সংরক্ষণ না-করলেও ওদের গুদামঘরে রাখতে পারত। পরে সেগুলোকে দেখা যেত। ফলে এই একশো বছরে আমরা এগোলাম তো না-ই, বরং পিছিয়ে গেলাম।
তন্ময়— এটা ২০১৭-১৮ সালের ঘটনা যখন, কেউ কোনো ছবিও তুলে রাখেনি?
মৌমিতা সাহা— না, কেউ না। মানে এটা কেউ জানেই না তো। আমরা তো জানতে পারলাম, ওখানের গ্রামবাসীরা বলল বলে। বিরাট বড়ো একটা জাহাজের অংশ… ওঁরাই বলছেন, এখানে তো বিদ্যাধরী নদী ছিল, ফলে জাহাজ পাওয়া যেতেই পারে। মাটির তলা থেকে প্রচুর লোহার অংশ পাওয়া গিয়েছিল। যার মধ্যে ওই ছেলেটিই একটা ৩৫ কেজির লোহার পাত পেয়েছিল, বিক্রি করে দিয়েছিল। এই অঞ্চলটা শুধুমাত্র জীববৈচিত্রের কারণে নয়, ইতিহাস, আর্কিওলজি ইত্যাদির কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া কোচপুকুরের কবরস্থান যেটা— ওটা একটা পারিবারিক সম্পত্তির অংশ। ওই অঞ্চলটায় দেওয়ান পরিবার থাকেন। মানে, ওই গ্রামটায় যাঁদের জমি, তাঁদের পদবি দেওয়ান। এই দেওয়ানদেরই পারিবারিক কবরস্থান। এবং ওখানে খুব সুন্দর একটা মাটির স্ট্রাকচার আছে। ওঁরা পারিবারিক বিশ্বাস থেকেই ওটাকে কংক্রিটের করেননি এখনও। একবার ছাদ পাকা করার চেষ্টা হয়েছিল— পাকাও নয়, টিনের শেড বা ওই জাতীয় কিছু, সেটা ভেঙে গিয়েছিল। এখন ওঁদের মত হচ্ছে, ওঁরা স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন, ওটাকে কখনও যেন পাকা না-করা হয়। ফলে ওঁরা পাকা করেননি। যার জন্যই জিনিসটা টিকে আছে। টিকে আছে বলেই ওই প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিসগুলো পাওয়া গেছে। ওটা পারিবারিক কবরস্থান যদি না-হত, তাহলে কবেই ধ্বংস হয়ে যেত।
আরও পড়ুন: ঈর্ষাক্ষাৎকার: মৌমিতা সাহা — প্রথম পর্ব
তন্ময়— পরবর্তীকালে তাহলে খনন করলে ওখানে আরও প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে?
মৌমিতা সাহা— হ্যাঁ, অবশ্যই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তো বলেছে, ওরা খনন করবে। জানি না ওদের কী পরিকল্পনা আছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ— ওরাই এই বিষয়টা দেখেছিল এবং দেখে বলেছিল ভবিষ্যতে ওদের ইচ্ছে আছে এই জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করে দেখার। এটা কবে কী করা যেতে পারে— আশা করি সেটা নিয়ে ওদের কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা আছে।
তন্ময়— এবার আমার শেষ প্রশ্ন, হয়তো ইতিহাসের নয়, খানিকটা আবেগেরই। যাঁরা সল্টলেক বা নিউটাউনের বাসিন্দা নন— যাঁরা মফস্বল বা বাইরে থেকে এই অঞ্চলে আসেন, তাঁদের অনেকেরই মনে হয়, এই উপনগরী অনেকটাই যান্ত্রিক এবং প্রাণহীন। তার কারণ হতে পারে অতি-পরিকল্পিত হওয়া— যা স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠেনি, তথাকথিত ঝাঁ-চকচকে পরিবেশ ইত্যাদি। এবং সেই অর্থে পাড়া-সংস্কৃতি নেই। আপনার কী মনে হয়?
মৌমিতা সাহা— একদম ঠিক। একদিন আমি কী কারণে হেঁটে কোচপুকুর যাচ্ছিলাম। সেইসময় প্রচণ্ড রোদ। এত রোদ যে আমি কোনো গাছের তলায় দাঁড়াব— সেই জায়গাটাও পাচ্ছিলাম না। অন্য জায়গায় কী হয়? বৃষ্টি পড়লে শেডের তলায় যেতে পারি, রোদ হলে গাছের তলায় দাঁড়াতে পারি। আপনি নিউটাউনে যাচ্ছেন, আপনি একটা গাছ খুঁজে পাবেন না। মানে শেডি ট্রি যেগুলোকে আমরা বলি, সেটা নেই। তখন আমার যেতে যেতেই মনে হল, এখানে একটা গাছতলাও নেই। কারণ, কোনো বড়ো বৃক্ষই ওখানে আর নেই। সবগুলোই হচ্ছে প্লান্টেড। এবং যে-গাছগুলো বসানো হয়েছে সেগুলো বৃক্ষ না।
এবার পাড়া কালচারে আসি। এখানে রাস্তার ধারে জল থাকে। কলকাতায় চলতে ফিরতে কল থাকে, অনেক জায়গায় টিউবওয়েল থাকে। বৃষ্টি হলে রাস্তার ধারে আশ্রয় পান। এগুলো তো খুবই সাধারণ— আরও বড়ো বড়ো বিষয়গুলো নয় বাদই দিলাম। নিউটাউনে এগুলো কিছুই পাবেন না। একই কথা সল্টলেকের ক্ষেত্রে। ওখানে প্ল্যান্টেড ট্রি। বট, অশ্বত্থ, পাকুড়, শাল, শিমুল, আম, জাম, কাঁঠালের যে স্বাভাবিক বনসৃজন তা ওখানে নেই। নেই পাড়াগত আত্মীয়-বন্ধু কালচার। আর সেই জন্যই সল্টলেক আজ পাড়াহীন বৃদ্ধাশ্রম।
(সমাপ্ত)
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor