ঈর্ষাক্ষাৎকার: মৌমিতা সাহা — প্রথম পর্ব

মৌমিতা সাহার জন্ম ১৯৭১ সালে, কলকাতায়। পেশায় ভূগোলের শিক্ষিকা। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আঞ্চলিক ইতিহাস-গবেষণার সঙ্গে জড়িত। বর্তমান ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘ইস্ট সুবার্বন ও সল্টলেক: নগর কলকাতার পুবমুখী সম্প্রসারণের ইতিবৃত্ত’ (প্রকাশকাল ২০২৩) বইটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ প্রথম পর্ব...

তন্ময়— ইস্ট সাবার্বান ও সল্টলেক নিয়ে এই গবেষণা আদতে যৌথ প্রচেষ্টার ফসল। তবে গ্রন্থকার হিসাবে এর তত্ত্বাবধান আপনিই করেছেন বলা চলে। পাশাপাশি, এই বই আঞ্চলিক ইতিহাস সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে আদর্শ বলেও মনে হয়েছে আমার। অপেক্ষাকৃত ‘নবীন’ এই অঞ্চল নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা কীভাবে জন্ম নিয়েছিল?

মৌমিতা সাহা— প্রথমেই বলি, 'দেশকাল' একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মুখপত্র। নিছক একটি বাণিজ্যিক প্রকাশনা সংস্থা নয়। 'থিঙ্ক গ্লোবাল, অ্যাক্ট লোকাল'-কে মূল মন্ত্র করে স্থানিক বিষয়ে গবেষণা, পরিবেশ সচেতনতাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বৃহত্তর দমদমে কাজ শুরু করেছিল 'দেশকাল'। যার ফলে সংবাদ পাক্ষিক রূপে ১৯৮৪-তে 'দেশকাল' প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে। ক্রমশ তার ব্যাপ্তি ঘটে। অবিভক্ত চব্বিশ পরগণা জেলার বহু সমমনোভাবাপন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর যৌথ প্রয়াসের কেন্দ্রবিন্দু হতে পেরেছিল 'দেশকাল'। এই প্রয়াসের ফসল 'দমদমা হাউস' বা 'ক্লাইভ হাউস' সংরক্ষণ ও প্রত্ন অনুসন্ধান নিয়ে ব্যাপক আন্দোলনের সূচনা। আমাদের প্রধান কর্মক্ষেত্র ছিল দমদম, সল্টলেক, রাজারহাট হয়ে বারাসাত অবধি। এই অঞ্চলেই আমাদের মূল সার্কুলেশন ছিল। স্টোরিগুলোও এই অঞ্চলের উপর লেখা হত। অন্যান্য বিষয় থাকলেও কোর সাবজেক্টটা ছিল লোকাল হিস্ট্রি, আর্কিওলজি আর এনভায়রনমেন্ট। দাম ছিল মাত্র দু-টাকা, তা আমাদের এই লেখাগুলো এতটাই গভীর হত যে, সবাই বললেন, এত কম দামে এত ভালো লেখা বেরচ্ছে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই কাগজগুলো সংরক্ষণ করতে অসুবিধা হয়। আমাদের অনেকেই বলেন, তোমরা বই করছ না কেন? আমরা মাঝখানে সংক্ষিপ্ত আকারে দমদম ও সল্টলেকের উপর বই প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু সেগুলোতে সব বিষয় আনা যায়নি। তো করোনা পিরিয়ডের আগে থেকেই মূলত ২০১৬ সাল থেকে আমরা ঠিক করলাম বৃহত্তর দমদম অঞ্চলের বিস্তারিত তথ্য সমৃদ্ধ ইতিহাস বই আকারে প্রকাশ করব। দমদমের কাজটা করতে গিয়ে দেখা গেল, ব্রিটিশরা 'দমদম অ্যান্ড এনভায়রন্স' বলতে যেটাকে মার্ক করেছিল, তাতে দমদম বিশাল এলাকা। আজকের সল্টলেক, রাজারহাটও তার মধ্যে আছে। দমদমের তিনটি মিউনিসিপ্যালিটি উত্তর, দক্ষিণ ও শুধু দমদম। এটা দমদমের আরবান এরিয়া। আর দমদমের রুরাল এরিয়া হিসাবে ওরা বোঝাত সল্টলেক, রাজারহাটকে।

সল্টলেক বলতে আজকে আমরা যেটা বুঝি, তার ব্যাপ্তি আদতে আরও বেশি ছিল। ব্রিটিশদের হিসাবে, দমদমের ক্লাইভ হাউসের পর থেকেই সল্টলেক শুরু হয়েছিল। তার আগে হয়তো আরও বড়ো ছিল। সেকালের সল্টলেক, দমদমের ক্লাইভ হাউসের পাশ থেকে শুরু হয়ে বর্তমান সল্টলেক, এমনকি উল্টোডাঙা, বেলেঘাটা, কাঁকুড়গাছি, ফুলবাগান ধরে অধুনা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভোজেরহাটের কাছে তাড়দহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ব্রিটিশরা নাম দিয়েছিল সল্ট ওয়াটার লেক। সল্টলেক বলতে আমাদের ধারণা ছিল এখনকার সল্টলেক। কিন্তু দেখা গেল সেটা আদতে বিশাল একটা অঞ্চল। স্থানিক ইতিহাসে বেশিরভাগই রাজা, জমিদার বা ওই অঞ্চলের পুরনো মন্দির, মসজিদগুলোর ওপরই শুধু গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, নদীর কথা, জলাশয়ের ইতিহাস, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খুব কম গুরুত্ব পায়। অথচ সল্টলেক-রাজারহাটের ইতিহাসটাই গড়ে উঠেছে নদী আর জলাশয়কে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে মৎস্যজীবীদের যে এত বড়ো কর্মকাণ্ড গড়ে উঠেছিল নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এখনও আমরা যতটা দেখতে পাচ্ছি সেটাও কিন্তু সেই ইকো-সিস্টেমের ওপর ভিত্তি করেই।


তন্ময়— সল্টলেক নিয়ে গবেষণা করা, তথ্য জোগাড়— হয়তো কিছু তথ্য আপনাদের পত্রিকা করার সময় সংগ্রহ করা ছিল— সেখান থেকে বা পরবর্তীকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রসমীক্ষকদের সাহায্য নেওয়া— এই জার্নি কীরকম ছিল?

মৌমিতা সাহা— ক্ষেত্রসমীক্ষা করার জন্য আমরা দমদমের সাতটা কলেজের ইতিহাস বিভাগকে যুক্ত করেছিলাম। সাতটা কলেজের ইতিহাস বিভাগের দু-জন করে ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে চোদ্দো জনের একটা টিম হয়েছিল। সমীক্ষার একটা প্রোফর্মা তৈরি করেছিলাম। এই প্রোফর্মাটা তৈরি করতে আমদের সাহায্য করেছিলেন ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা। প্রোফর্মাটাকে অ্যাপ্রুভ হওয়ার পর ওই চোদ্দো জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। দমদমের সরোজিনী নাইডু কলেজে প্রথম কর্মশালা হয়েছিল। তারপর অন্যান্য কলেজগুলোতেও হয়। বিভিন্ন এক্সপার্টদের এনে ছাত্রছাত্রীদের আমরা শিখিয়েছিলাম যে কীভাবে সমীক্ষাটা করা হবে। এর মাঝেই করোনা চলে আসে। ফলে অনলাইনে ক্লাস চলত। দেখানো হত কীভাবে কাজ করা হবে। যখন করোনার প্রভাব খানিকটা কমল, প্রথম ওয়েভটা চলে গেল, যেহেতু বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই দমদমের আশের পাশের অঞ্চলে থাকে, তাদের দিয়ে বাড়ির আশেপাশে, যাতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার না করতে হয়, হাঁটা পথে বড়োজোর রিক্সা করে বাড়ির কাছাকাছি জায়গাগুলোর ক্ষেত্র সমীক্ষা করা যায় তার ব্যবস্থা করলাম। এতে ওদেরও একটা ট্রেনিং হল, সঙ্গে আমরা যেটা চেয়েছিলাম, একেবারে গ্রাউন্ড লেভেল থেকে তথ্যণ্ডালো উঠে আসুক সেটাও আমরা এই ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে করিয়েছিলাম। রাজারহাটে প্রচুর স্পট ছিল। কিন্তু সল্টলেকের বেশিরভাগটাই তো ভেড়ি ছিল। ফলে মহিষবাথান, দত্তাবাদ এই অঞ্চল ছাড়া সল্টলেকের আর কোনো প্রাচীন জায়গা সেই অর্থে ছিল না। এই দুটোই ছিল আবাসস্থল। প্রাচীন পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। আর বাকি যে কাজটা আর্কাইভ ও লাইব্রেরির কাজ সেটা আমি নিজেই করেছিলাম, তারপর আমাদের সিনিয়াররা আছেন, তাঁরাও হেল্প করেছিলেন, সাজেশন দিয়েছিলেন আরও কীভাবে কী করা যেতে পারে। এইভাবে মোটামুটি কাজটা হয়েছিল।


তন্ময়— এই যে সল্টলেক ওরফে লবণহ্রদ— বাংলায় তো লবণহ্রদ বলা হত— আমরা আঠেরো শতকের মানচিত্রেও এই জলাভূমির অস্তিত্ব দেখেছি। এই যে-বিস্তীর্ণ জলাভূমি, এর জন্ম বা উৎপত্তি কীভাবে? বিদ্যাধরী নদীর সঙ্গে এর সম্পর্কই বা কী?

মৌমিতা সাহা— এই প্রশ্নের সমাধান তো আমরা এখনও পাইনি। আমাদেরও ভীষণ জানবার ইচ্ছে ছিল, এই বিদ্যাধরীর গতিপথটা ঠিক কী? এখন যে-বিদ্যাধরী আছে, সেটা নয়। বিদ্যাধরী দুটো ভাগ হয়ে গেল। একটা রাজারহাট এবং সল্টলেক হয়ে বেলেঘাটার খুব কাছ দিয়ে গিয়ে মাতলায় গিয়ে মিশল— সেই বিদ্যাধরীটা কোথায় গেল? সেটা কীভাবে হারিয়ে গেল? ব্রিটিশদের একাধিক সমীক্ষা রয়েছে এর ওপরে। সেই সমীক্ষাগুলো যতটা সম্ভব আমরা দেখেছি। কিন্তু কিছুতেই রুট ম্যাপ পেলাম না। অন্তত হালকাভাবেও যদি বোঝা যেত বিদ্যাধরী ঠিক কোথা দিয়ে গেছে! যেটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা— বিদ্যাধরীর এত শাখা-প্রশাখা ছিল যে, আমরা যখনই ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গেছি রাজারহাট ও সল্টলেকে, সবাই বলতেন, ‘আমাদের বাড়ির কাছ দিয়েই বিদ্যাধরী যেত শুনেছি।’ বিদ্যাধরী তো সবার বাড়ির কাছ দিয়ে যেতে পারে না। পরে আমার ধারণা হল, নদীটির শাখা-প্রশাখাগুলোকেও বিদ্যাধরী বলা হত। এঁরা কিন্তু এঁদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকেও বিদ্যাধরী শুনে আসছেন। সব জায়গাতেই। এই যে এত বড়ো নদীপথটা হারিয়ে গেল, ব্রিটিশরা অনেক কিছু করল, কিন্তু বিদ্যাধরীর রুটম্যাপটা তৈরি করে গেল না। সেটা থাকলে আমরা বুঝতে পারতাম, হারানো বিদ্যাধরীর শাখা ঠিক কোথা দিয়ে প্রবাহিত হত। আমাদের ধারণা ছিল, বিদ্যাধরী উত্তর থেকে এসে দক্ষিণে পড়েছে। কিন্তু ১৯৩০ সালের একটা টোপোগ্রাফিক্যাল ম্যাপে দেখলাম, বিদ্যাধরী নিচ থেকে, মানে মাতলা হয়ে উপরের দিকে উঠে বেলেঘাটার কাছে এসে মিশে যাচ্ছে। এটা কিন্তু একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস। পরে আমার ধারণা বদলে গেল। হয়তো বিদ্যাধরী ওপর থেকে এসেছে। কিন্তু বিদ্যাধরীর মূল শাখার নোনাজলটা নিচ থেকে উঠে— অর্থাৎ জোয়ার-ভাটার জলটা ওপরে এসে মিশেছে। ফলে ওপর থেকে মিষ্টিজল আর নিচ থেকে নোনাজল— এই দুইয়ের মিশ্রণে সল্ট ওয়াটার লেক নামক একটা অদ্ভুত চরিত্র তৈরি হয়েছিল। আর এখানে যে মাছের এত বড়ো কারবার তৈরি হল, জলাশয় তৈরি হল, সেটা দ্বিমুখী জলের এই অদ্ভুত সংমিশ্রণে। এক অদ্ভুত বাস্তুতন্ত্র তৈরি করল। কিন্তু এই ব্যাপারটাও আবার হারিয়ে যায়। উনবিংশ শতকের মাঝের থেকে শেষের দিকে যখন কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা উন্নত হতে শুরু করল, তখন সম্পূর্ণ নিকাশি জল ঠেলে দেওয়া হল লবণ হ্রদের দিকে।


তন্ময়— বিদ্যাধরীর ইতিহাস দেখলে জানা যায়, উনিশ শতকের শেষের দিকে নদীটা মরে আসতে শুরু করে এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধেই মৃত নদী হিসাবে ঘোষণা করে দেওয়া হয়। তাহলে আপনি বিদ্যাধরীর যে-শাখার অস্তিত্ব অনুমান করছেন, যেটা সল্টলেকের ওপর দিয়ে যেত এবং জোয়ারের জল ওখানে আটকে গিয়ে সল্ট-ওয়াটার লেক তৈরি হয়েছে— সেটা তাহলে মূল বিদ্যাধরীর বিলুপ্তিরও কয়েক শতাব্দী আগের ঘটনা।

মৌমিতা সাহা— হ্যাঁ। তবে এই সবটাই আমাদের আন্দাজে ধরতে হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান সেভাবে আজ অবধি হয়নি।


তন্ময়— ঠিক। আমরা জানি, ষোলো শতকের গোড়ায় ভূমিকম্পের ফলেই সম্ভবত সরস্বতী নদী থেকে জল সরে যায়। ১৮৬৪-র ঘূর্ণিঝড়ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষতিসাধন করেছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর বোধকরি ১৭৩৭-এর ঘূর্ণিঝড়ই। এরকম কোনো কারণ বা ঘটনা কি চিহ্নিত করা যায় সল্টলেকের জন্ম সম্পর্কে?

মৌমিতা সাহা— হ্যাঁ। কেউ কেউ আমাদের বলেছিলেন, ১৭৩৭ সালের ঘূর্ণিঝড়টায় সল্টলেকের উৎপত্তি। আমার কিন্তু মনে হয়, তারও আগে সল্টলেকের জন্ম। সেটা বিদ্যাধরী নিজেই তৈরি করেছিল। এইবার আমাদের এখানে তো জিও-আর্কিওলজি নিয়ে পড়াশোনা সবে শুরু হয়েছে— কেউ কেউ পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে। এই জায়গাটার ওপর জিও-আর্কিওলজিক্যাল একটা গবেষণা ভীষণভাবে জরুরি। না-হলে কিন্তু ধরা যাবে না। আন্দাজের ওপরেই থাকতে হবে আমাদের। কিন্তু সত্যিকারের যদি সায়েন্টিফিক স্টাডি করতে হয়, তাহলে সেই স্তরের পড়াশোনার দরকার হয়। বড়ো মাপের গবেষণা না-হলে, এটা ধরা মুশকিল হবে।


তন্ময়— আঠেরো-উনিশ শতকে সল্টলেক বলতে যে-অংশটা বোঝাত— মূলত জলাভূমি এবং চাষের জমি— তার কতটা এখনও অস্তিত্ব বজায় রেখেছে?

মৌমিতা সাহা— ওই এখন যেটা রয়েছে সেটা হচ্ছে ইস্ট ক্যালকাটা ওয়েটল্যান্ড বা পূর্ব কলকাতার জলাভূমি। দক্ষিণের যেটা সল্টলেক, সেটাও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। সেটা এই সোনারপুর, বারুইপুর অংশের মধ্যে ঢুকে গেছে। দক্ষিণের সল্টলেক কিন্তু আরও বড়ো ছিল। উত্তরের সল্টলেকটা হচ্ছে এখনকার সল্টলেক। আর দক্ষিণের সল্টলেকটা আরও বিপুল আকারের ছিল। ওটা কিন্তু আমাদের সল্টলেক প্রোজেক্টের মধ্যে ঢোকেনি। পরবর্তীকালে সোনারপুর, বারুইপুর, গড়িয়া— এগুলো যত এক্সটেনশন হয়েছে, তত এই জলাশয়গুলো গিলে নিয়েছে। বাকি তাহলে যেটুকু রয়েছে, সেটা হল পূর্ব কলকাতার জলাভূমি। পূর্ব কলকাতার জলাভূমি হল ওই বড়ো সল্ট-ওয়াটার লেকেরই একটা খণ্ডিত অংশ।


তন্ময়— ১৯৬২ সালে সল্টলেক উপনগরীর নির্মাণ শুরু হয়। ক্রমে বহু নিম্নভূমি ও জলাভূমি বুজিয়েও ফেলা হয় এবং বাস্তুচ্যুত হন বহু স্থানীয় বাসিন্দা। এই উপনগরী নির্মাণ সম্পর্কে গবেষক হিসাবে সার্বিকভাবে আপনার বিশ্লেষণ কী? ভালো-মন্দ, তার প্রভাব সব মিলিয়ে। এবং এই প্রসঙ্গে এইটাও আপনি একটু বলে দিন, এটার প্রথমে কলকাতা উপনগরী নাম ছিল…

মৌমিতা সাহা— প্রাথমিকভাবে এর নাম ভাবা হয়েছিল ‘কলকাতা উপনগরী’। এমনকি নিউটাউনেরও প্রথমে নাম ছিল ‘কলকাতা মেগাসিটি’। পরে নিউটাউন নাম হল। আসলে কলকাতারই স্যাটেলাইট টাউনশিপ হিসাবে এগুলো তৈরি হয়েছিল। বিধানচন্দ্র রায়কে বলা হয় সল্টলেকের মাস্টারমাইন্ড। উনি কী বলেছেন? তখনকার নিউজপেপারগুলো আমি ভালো করে দেখলাম। বিধান রায়ের সরাসরি উদ্ধৃতি খুব বেশি পেলাম না। মানে তখনকার খবরের কাগজে। এবার যখন সল্টলেক তৈরি হচ্ছে, তখনকার অ্যাসেম্বলি প্রসেডিংসেও বিধান রায়ের কোনো উক্তি নেই। এটা আমার খুব আশ্চর্য লেগেছে। অথচ বলা হচ্ছে বিধান রায় হচ্ছে এটার মাস্টারমাইন্ড। তাহলে তো তাঁর কোনো-না-কোনো বক্তব্য থাকবে। কিন্তু আমি সেটা কোনো প্রসেডিংসেও পাইনি, খবরের কাগজগুলোতেও পাইনি। কিছু ছোটোখাটো সংবাদ আছে। কিন্তু ওঁর যে একটা বিশেষ বিশ্লেষণ— কেন করতে চাইছেন, কী করতে চাইছেন— সে-ব্যাপারে খুব বেশি ডিটেইলড নথি কিছু পাওয়া যায়নি। অন্যান্য সেকেন্ডারি এভিডেন্স থেকে দেখা যাচ্ছে বিধান রায়ের পরিকল্পনা ছিল, বিধান রায় চেয়েছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এই চাওয়া হল কীভাবে? এবার অন্যান্য এভিডেন্সগুলো দেখি। একটা হল, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন। আরেকটা হচ্ছে, কলকাতায় যাঁরা নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত— তাঁদের জন্য। এঁদের জন্য রিহ্যাবিলিটেশন দরকার। কলকাতাকে বড়ো করতে হবে। আর কিছু অফিস পাঠিয়ে দেওয়া হবে ওদিকে, কলকাতার চাপ কমাবার জন্য। সে-জন্যেই সল্টলেক তৈরি করা হল। এইবার প্রথম দিকে— ১৯৬২ সালের ১৬ এপ্রিল সল্টলেক প্রকল্পের উদ্বোধন, আর ওই বছরেরই ১ জুলাই বিধান রায় মারা গেলেন। ওই যে প্রথমদিককার পরিকল্পনা থেকে যে সরে আসা হল, সেটা বিধান রায় আর দেখে যেতে পারলেন না। কারণ, ’৬২ সালে তো সবে জমি ভরাট হচ্ছে। কাজ শেষ হতে হতে— যদি খুব ভুল না-করি ’৭০ সালে সম্ভবত প্রথম বাড়ি হয়— নাম ‘মূলঘর’। তাহলে তো বিধান রায় জমি ভরাটই দেখে যেতে পারেননি। শুধু শুরু দেখে গেছেন। তাহলে এই যে ডিভিয়েশন হয়ে গেল ওঁর পরিকল্পনার, সেটা কিন্তু আর ওঁর জ্ঞাতসারে হল না। এবং ’৭৫-’৭৭ থেকে জমির দামও বেড়ে গেল। এবং অ্যাসেম্বলি প্রসেডিংসেও এই কথা উঠেছিল যে, জমির দাম এত বেড়ে গেলে মধ্যবিত্তরা জমি পাবে কী করে?

যখনই কোনো পরিকল্পনা হয়েছে, নিউটাউনের ক্ষেত্রেই বলুন আর সল্টলেকের ক্ষেত্রে— সামনে রাখা হয়েছে গরিবদের— তাঁদের কর্মক্ষেত্র, তাঁদের রিহ্যাবিলিটেশন, তাঁদের সমস্ত কিছু। কিন্তু আল্টিমেটলি হয়ে যাওয়ার পর দেখা গেছে, তাঁরা এইসব অঞ্চলে ছিটেফোঁটাও জায়গা পাননি। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এই প্রোজেক্টগুলো তৈরি হচ্ছে যাঁদের জন্য, তাঁরা কিন্তু বেনিফিটেড হচ্ছেন না। তাহলে তাঁদের কী হচ্ছে? তাঁরা এখানে অটো চালান, রিক্সা চালান, কাজের লোক হিসাবে নিযুক্ত হন, রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। এখানেই আমাদের শহুরে ডেভেলপমেন্টের গণ্ডগোলটা হচ্ছে, শুনতে ভালো লাগে বলে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের সামনে রাখা হয়েছে, কিন্তু তাঁরা কোনোভাবে বেনিফিটেড হননি। অন্তত আমি সল্টলেক আর রাজারহাট-নিউটাউন— এই দুটোর ক্ষেত্রে বলছি। আর উদ্বাস্তু পুনর্বাসন— এটা কোনো সায়েন্টিফিক ডেটা আমি কোত্থাও পাইনি। কতজন উদ্বাস্তুকে এখানে রিহ্যাবিলিয়েট করা হল? কোথাও-না-কোথাও তার তো একটা উল্লেখ থাকবে। কোত্থাও নেই। এবং সল্টলেক তৈরি হয়েছে কবে? ’৬২ সালে। এবং নিউটাউন তৈরি হয়েছে কবে? ’৯৩ সাল থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু যদি তুলনা করতে যাই— কী করতে চেয়েছিলাম আর কী করেছিলাম— কোনোরকম সংরক্ষণ হয়নি নথির, যে আমি কতজনকে জায়গা দেব বলে ঠিক করেছিলাম। সব প্রোজেক্টই যে ভালো হবে, একশো শতাংশ মিলবে— এটা কোথাও সম্ভব নয়। কিন্তু আমার তো একটা টার্গেট থাকবে যে কাদের এখানে রাখতে চাইছি, কত শতাংশ রাখতে চাইছি— সে-সবের কোনো সংরক্ষণই হয়নি। তার মানে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনেরও কোনো নথি নেই। আর গরিব বা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত কতজনকে জমি দিতে পারলাম— তারও নথি নেই। মাত্র এই পঞ্চাশ-ষাট বছরের ঘটনা, কিন্তু আমরা কোনো নথি সংরক্ষণ করতে পারলাম না।


তন্ময়— বেশ কয়েকজন প্রবীণের মুখে শুনেছিলাম, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সল্টলেকে নাকি শিবির বানিয়ে বেশ কিছু উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল সাময়িকভাবে। এই বিষয়ে কি কিছু নথি বা ডকুমেন্টেশন পেয়েছেন?

মৌমিতা সাহা— না, আমি তেমন কিছু পাইনি।


তন্ময়— সল্টলেক ভূমির মধ্যে কোনো কলোনি অ্যালাউ করা হয়েছিল?

মৌমিতা সাহা— না, না। আমি কিন্তু কলোনির লিস্ট করেছিলাম। বাস্তুহারা যে-সমস্ত সমিতি আছে, তাদের কিছু নথিপত্র আছে, বইও আছে। তাতে আমি সল্টলেকের কোনো কলোনির নাম পাইনি। ভেড়ি বুজিয়ে নগরায়ণ করার ফলে সল্টলেকের যেসব ভূমিপুত্ররা উচ্ছেদ হয়েছিলেন তাঁদের কিছু মানুষকে চিংড়িঘাটার কাছে জমি দেওয়া হয়েছিল আর সল্টলেক গড়ার সময় পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বাঙালি নিম্নবিত্তদের বাসস্থানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।


তন্ময়—যাঁরা সল্টলেকের আসল ভূমিপুত্র ছিলেন, উপনগরী নির্মাণের পর তাঁদের কী হল? তাঁদের তো মূলত জীবিকা ছিল মৎস্যচাষ। তাঁদের শতকরা কতজন পুরনো জীবিকাতেই রয়ে গেলেন?

মৌমিতা সাহা— সে ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। সল্টলেকের আবাসস্থল ছিল মূলত দুটো জায়গায়-দত্তাবাদ এবং মহিষবাথান। মহিষবাথানে এখনও সেই প্রাচীন পরিবারগুলো আছে, দত্তবাদেও কিছু্যাছে। কিন্তু যাঁরা এই দুটো জায়গায় থাকতেন, তাঁরাই তো শুধু এই অঞ্চলে কাজ করতেন না; বাইরে থেকেও প্রচুর লোক আসতেন, আসতেন আশেপাশের গ্রাম থেকেও তাঁদের কী হল, সে-ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। সরকারি নথিতে নেই, খবরের কাগজে নেই, কোথাও নেই। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। তাঁদের একমাত্র খুঁজে পেয়েছিল দত্তাবাদে আর মহিষবাথানে। তাঁরা তবুও অনেক ভালো অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু বাদবাকি যাঁরা জেলে কিংবা শ্রমিক হিসাবে আসতেন, তাঁদর আর খুঁজেই পাওয়া যায়নি। তাহলে এত বড়ো যে মৎস্যজীবীদের সমবায় 'বিদ্যাধরী স্পিল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি', ওদের নথিতে দেখা যাচ্ছে সেটি ছিল এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় মৎস্যজীবী সমবায় তার কোনো ট্রেসই পাওয়া যাচ্ছে না। তার কাগজপত্র আমরা পেয়েছি, কিন্তু ওঁদের কারো কাছে নেই। কারণ ওঁরা তো তখন বিতাড়িত। ওদের মুখে শুনেছি, মানে ওঁদের পরবর্তী জেনারেশন বলছেন যে, ওঁদের ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, জলে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে রাতারাতি জায়গাটা খালি হয়ে যায়। আর প্রথাগত শিক্ষার দিক থেকে ওঁরা তখন অনেকটাই পিছিয়ে, ফলে নথিপত্র সংরক্ষণের ব্যাপারটাও আসেনি। ঘরবাড়িই থাকছে না, তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তখন তাঁরা নথি সংরক্ষণ করবেন না প্রাণ নিয়ে অন্য জায়গায় পালাবেন? তো সে-সময়ের নথি আমরা অনেকটাই খুঁজে পেয়েছি। সেখান থেকে আমরা জানতে পেরেছি ৩৭২০ বিঘা জমি তাঁরা লিজ নিয়ে মাছ চাষ করতেন। সদস্য পরিবার ছিল ২০০ এবং সদস্য নয় এমন ১৪০টা পরিবার এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮০ সালে সমিতির সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৫৭ জন। লবণহ্রদে এরকম সমবায় সমিতি ছিল অনেক। মোট যোগ করলে বোঝা যায় হাজার হাজার মাছচাষি ও শ্রমিক পরিবার কর্মচ্যুত হয়েছিলেন। এখনও সল্টলেকে ১২টার মতন সমবায় সমিতি কাজ করে। তার মানে কী বিপুল কর্ম-সংস্থান সে-সময়ে হত। তাঁরা কোথায় গেলেন, কী হল তার কোনো চিহ্ন নেই। এবং সরকার তাঁদের বলেছিল, দক্ষিণ লবণহ্রদে জলাজমি দেওয়া হবে। পরবর্তী জেনারেশন ওঁদের পরিবারের যে-সব ছেলেমেয়েরা রয়েছে যাঁরা দত্তাবাদ, মহিষবাথান, চিংড়িঘাটায় রয়েছেন, তাঁরা তো মাছ চাষ করতেই চান না। অধিকাংশই এই মৎস্য কালচারটার সঙ্গে জড়িত নেই।


তন্ময়— তাহলে এখন ভেড়িতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা কারা?

মৌমিতা সাহা— খুব কম। মানে পুরোনো দিনের কিছু লোক আছেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরা কেউ আর এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় না। বাইরে থেকে লেবার এনে করাচ্ছে। আর আছে বেসরকারি, যেগুলো কো-অপারেটিভ রয়েছে। এখনও যাঁদের বয়স পঞ্চাশের ওপর— তাঁরাই রয়েছেন। তার তলার ছেলেমেয়ে খুব কম। ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ডে অল্পবয়সি দু-চারজন আছে। তাঁদের সংখ্যা খুব কম, হাতেগোনা। তাঁরা ভালোবেসে কাজটা করেন। হয়তো এই গোটা যে-কর্মকাণ্ড তার মধ্যে ইয়াং জেনেরেশন পাঁচ শতাংশ আছে কিনা আমার সন্দেহ। অথচ, এটাকে একটা বড়ো ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটিতে পরিণত করা যেত। পূর্ব কলকাতার জলাভূমিকে কেন্দ্র করে বিরাট সম্ভাবনা এখনও আছে। কিন্তু ওঁরা তো এখন জলাভূমি বাঁচাতেই ব্যস্ত। রিয়েল এস্টেটের যে-চাপ ওঁদের ওপর পড়ছে, ওঁরা প্রাণ হাতে নিয়ে কাজ করেন। প্রতিদিন ওঁরা উৎখাত হওয়ার ভয় পান। ফলে এটার ওপর ইয়ং জেনারেশন আর ভরসা করতে পারছে না।

(পড়ুন : দ্বিতীয় পর্ব)

অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor

Latest News See More