কানাইপদ রায়ের জন্ম ১৯৫৩ সালে, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। কর্মসূত্রে উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাকপুরে বসবাস। সেখানকার মহাদেবানন্দ মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন আজীবন। তাঁর দুটি স্মরণীয় কাজ ‘বারাকপুরের সেকাল-একাল’ (২ খণ্ড) ও ‘উত্তর চব্বিশ পরগনার সেকাল-একাল’ (৭ খণ্ড)। এছাড়াও লিখিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টিরও বেশি। বর্তমান কথোপকথনটি ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘উত্তর চব্বিশ পরগনা: কথা ও কাহিনিতে গঙ্গার ঘাট’ গ্রন্থটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। আলোচনায় কানাইপদ রায়ের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
তন্ময়— আমাদের এই উত্তর ২৪ পরগনায় গঙ্গা থেকে বেরোনো বেশ কিছু খাল আছে। যেমন উত্তরে বাগের খাল, তারপর ইছাপুর খাল, মাঝে খড়দহ খাল, এদিকে বেলঘরিয়া আর বরাহনগরের মাঝখানে দেঁতে খাল ইত্যাদি। এই খালগুলো একসময় বাণিজ্য, যাতায়াতের ক্ষেত্রে এবং সেচ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখত। জনপদের ভেতরে প্রবেশের জন্য খালগুলোর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখন এগুলোর অবস্থা কহতব্য নয়। এই খালগুলো সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি, পর্যালোচনা কী?
কানাইপদ রায়— যে খালগুলো বন্ধ হয়েছে, সেখানে সব বসতি গড়ে উঠেছে। বুঝেছেন তো? সুপ্রিম কোর্টে মামলাও হয়েছে। এখন আপনার পক্ষে সম্ভব হবে সেই খাল ফিরিয়ে দেওয়া? আরেকটা ঘটনা বলি। তখন আমার শরীর খারাপ ছিল, নোয়াই খালের দিকে আমি আমার দুই ছাত্রকে পাঠিয়েছিলাম— ‘তোরা যা কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে আয়। আর মানুষের সঙ্গে কথা বলে কয়েকটা ছবি আন’। তারা গিয়েছিল। সেখান থেকে ফোন করে বলল, ‘স্যর আমাদের আটকে রেখে দিয়েছে।’ কেন? বলছে, ‘এখানকার ছবি তুলতে দেবে না আর কোনো কথাও তারা বলবে না এই খালের সম্পর্কে।’ এবার যা করার প্রশাসন করবে। আমরা তো রাজনৈতিক ব্যক্তি নই!
তন্ময়— খালগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব তো কখনোই আমরা অস্বীকার করতে পারব না।
কানাইপদ রায়— কখনোই নয়। এই খালগুলোর নাব্যতা যদি ফিরিয়ে দেওয়া যায়, তবে সেচব্যবস্থা উন্নত হবে, মৎস্যজীবীরাও উপকৃত হবে। কিন্তু সেসব আর হওয়ার নয়। খাল কাটতে গেলে কুমির বেরিয়ে আসবে। সেই কুমিরের পেটে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
তন্ময়— ঘাট-বিষয়ক একটি তথ্য ভাবাচ্ছে অনেকদিন ধরেই। নৈহাটির ফেরিঘাটে একসময় ঘাটবাবুরা বসত, যেখানে কারেন্সি বদল করা হত। চুঁচুড়া থেকে নৈহাটিতে যাতায়াত— চুঁচুড়া ছিল ওলন্দাজদের দখলে, আর নৈহাটিতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির মুদ্রা। দুটো আলাদা কারেন্সির আদলবদল ঘটত। এই কাজটা কেমনভাবে চলত? ওইপারেও ঘাটবাবু ছিল কিনা, এই বিষয়ে আপনি কিছু বলতে পারেন?
কানাইপদ রায়— সেই ব্যাপারে তো ততটাও আমি গুছিয়ে বলতে পারব না। কারণ, আমি যাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেউই গুছিয়ে উত্তর দিতে পারেনি। মুশকিলটা হচ্ছে এখানেই। এই জিনিসগুলো তো হারিয়ে যাচ্ছে। যত দিন যাবে, যেটুকু আছে আজও, সেটুকুও আর হয়তো পাওয়া যাবে না। তবে একটা ঘটনা আমি বলি, যেটা এখনও লুপ্ত হতে হতে বেঁচে আছে। সেটা হল ‘গঙ্গাবাসী ঘর’। গঙ্গাবাসী ঘর জানেন তো? অন্তর্জলী যাত্রার সময় যে ঘর ব্যবহৃত হত। সেই ঘাটের দু-একটি কিন্তু এখনও বেঁচে আছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে নৈহাটিতে। সেটা ‘গঙ্গাবাসী ঘাট’ নামে পরিচিত হয়ে রয়েছে। সেই ঘাটটার আসল নাম ‘ভুলুবাবুর ঘাট’।
(পড়ুন প্রথম পর্ব)
তন্ময়— এবার ঘাটের প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে, আপনার সামগ্রিক কাজের বিষয়ে কয়েকটা প্রশ্ন রাখি। আমাদের কথোপকথনের গোড়াতেই আপনার কথা থেকে আমি আন্দাজ পেলাম, কীভাবে স্থানীয় মানুষের অজ্ঞতার ফলে আপনি ব্যারাকপুরের ইতিহাস সম্পর্কে লিখতে আগ্রহী হলেন। এরপর ব্যারাকপুরের ইতিহাস নিয়ে কাজ করলেন। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যারাকপুরের ওপর আলোকপাত করলেন। তারপর শুধু ব্যারাকপুরই নয়, সমগ্র উত্তর ২৪ পরগনার ইতিহাসচর্চার দিকে পা বাড়ালেন। আঞ্চলিক ইতিহাসের এক বিশাল কাজে ব্রতী হওয়া। কোনো নির্দিষ্ট এলাকার ইতিহাস নিয়ে কাজ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হলেও, সম্পূর্ণ জেলাভিত্তিক ইতিহাসচর্চা যথেষ্ট কঠিন। সেই মহাযজ্ঞের ব্যাপারে যদি বলেন।
কানাইপদ রায়— কঠিন তো বটেই। ওই যে বললাম, নোয়াই খালের ব্যাপারটা করতে গিয়ে কেমন অসহযোগিতার মধ্যে পড়েছিলাম। তারপর গারুলিয়াতে কাজ করতে গিয়ে আমার ছাত্রদের আটকে রেখে দেওয়া হয়েছিল। কোনো একটা বিষয়ে ছবি তুলতে গিয়ে তারা বাধা পেয়েছিল। তারপর সেখানে গিয়ে, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিষ্কৃতি পাওয়া। সেই আটককারীদের দলে আমার এক ছাত্রকেও দেখতে পাই। ছাত্রটিকে বলি, কী করছ এসব? তখন ওরা আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলে, ‘স্যার আসুন, আপনার যা যা দরকার ছবি তুলুন।’ এরকম অনেক হয়েছে। তবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওনা, এমন দুটো ঘটনা আমি বলব।
একটা হচ্ছে, আমি যখন টাকিতে কাজ করতে যেতাম আমার ফটোগ্রাফারকে সঙ্গে নিয়ে, সকালবেলায় বাড়ি থেকে খিচুড়ি বানিয়ে নিয়ে চলে যেতাম। আমার মিসেস তৈরি করে দিতেন। তারপর হাসনাবাদ লোকালে চেপে টাকিতে গিয়ে সারাদিন ভ্যান ভাড়া করে কাজ করতাম। অনেকবার এমন করেছি। কিন্তু একটা ঘটনা আমার জীবনের এত বড়ো প্রাপ্তি হবে, সেটা কোনোদিনও ভাবিনি। সেখানকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখতাম বড়ো-বড়ো ছবি টাঙানো। সেগুলো দেখে মনে হত, সেগুলো কোনো বিশেষ চিত্রশিল্পীর আঁকা। একদিন সেখানকার ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ছবিগুলো কার? জানালেন, যিনি ছবিগুলো এঁকেছেন, তিনি টাকি গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের মাস্টারমশাই ছিলেন। তিনি মারা গেছেন ১৯৮৬ সালে। তিনিই এই ছবিটা এঁকেছেন। তারপর সেখানকার স্কুলে গেলাম, সেখানেও তাই। রাজবাড়িতেও তাঁর আঁকা ছবি। আমার মনে খুব কৌতূহল হল তাঁর বাড়িতে যাওয়ার। খুঁজে খুঁজে তাঁর বাড়িতে গেলাম। তাঁর ছেলের সঙ্গে আলাপ হল। আলাপ হওয়ার পর, তাঁর বাবার সমস্ত কাজ তিনি আমাদের দেখালেন। তারপর তিনি আমাকে দেখালেন একটি ছবি। সান ফ্রান্সিসকোতে একটা পোস্টার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সেখানে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নাম সেভাবে প্রচারিত হয়নি। আমার একসময় ব্যারাকপুর থেকে কলকাতা পর্যন্ত আমার এক বন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন চিত্রপ্রদর্শনী দেখার খুব নেশা ছিল। ফলে একটা চোখ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমি বললাম, এই ছবিগুলো আপনি একটু যত্ন করে রাখবেন এবং যদি সম্ভব হয়, কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
কিছুদিন পর আমাকে ফোন করেন তাঁর বাড়ির ছেলে।‘ স্যার, আপনার কথা মতো, আমরা যোগাযোগ করেছি ভারতীয় জাদুঘরের সঙ্গে। ভারতীয় জাদুঘর থেকে আমাদের একটা ডেট দেয়। তারা এখানে এসে, বাবার যা কিছু ছবি ছিল এবং বাবার যে-সমস্ত বাসনকোসন, তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ— সব লিখিতভাবে নিয়ে গেছে। এবং আপনি যে বই-এ লিখেছিলেন বাবার সম্পর্কে, সেটাও একটা ম্যাগাজিন হিসাবে নিয়ে গেছে আমাদের কাছ থেকে।’ একটা মানুষ সম্পর্কে লেখালিখি করার পর, তাঁর সমস্ত কাজগুলোর একটা মূল্যায়ন হল, ভারতীয় জাদুঘরের মতো জায়গায় পৌঁছে দিতে পারলাম, এটা একটা বড়ো প্রাপ্তি।
আরেকটা প্রাপ্তির কথা বলি। খড়দহে শ্যামসুন্দর ঘাটের পাশে রবীন্দ্রনাথ বহুদিন ছিলেন। বহু কবিতা তিনি লিখেছিলেন যেখানে। কত ছবিও তিনি এঁকেছেন, সেখান একটা দোতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে। কিন্তু সেই বাড়িটি গঙ্গায় তলিয়ে গেছে। একদিনে যায়নি। বহুদিন ধরে গঙ্গা ভাঙতে ভাঙতে, একটু-একটু করে তলিয়ে গেছে। বাড়িটা যখন ভেঙে যাচ্ছে, সেই সময়কার ছবি শান্তিনিকেতনে আছে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, একটা কমপ্লিট ছবি উদ্ধার করার। আমি লিফলেট দিই গোটা খড়দহ এলাকায়। তারপর শিবনাথ হাইস্কুলে একটা আলোচনা সভা হয়। সেখানে ছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য অমলেন্দু দে। আমিও আমন্ত্রিত হিসাবে ছিলাম। সেখানে বক্তৃতা বলার সময় আমি যখন উঠি, তখন হঠাৎ এক বয়স্ক ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আপনি তো ব্যারাকপুরের মানুষ, খড়দহ সম্পর্কে আপনি কী জানেন, যে, এখানে বলতে এসেছেন?’ একদম সরাসরি। হলভর্তি মানুষ, হলের বাইরেও মানুষকে বসতে হয়েছে। শিবনাথ হাইস্কুলের হল। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, যদি কিছু প্রশ্ন করার থাকে আপনি আমাকে করবেন, কিন্তু তার আগে একটি কথা আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি।’ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘রবীন্দ্রনাথ যে বাড়িতে থাকতেন, সেই বাড়ি আপনি দেখেছেন?’ উনি বললেন, ‘শুধু দেখিইনি। খেলাধুলাও করেছি।’ ‘বাড়িটি কি একদিনেই ভেঙে গেছে?’ বললেন, ‘না, অনেকদিন ধরেই আস্তে আস্তে জলের তলায় চলে গেছে।’ এবার তাঁকে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি আঞ্চলিক ইতিহাসকে এত ভালোবাসেন, যে বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ বসে এত কবিতা লিখেছেন, বিখ্যাত বিখ্যাত কবিতা, বহু ছবি এঁকেছেন, অজস্র চিঠি লিখেছেন, যে বাড়িতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এসেছেন, নীলরতন সরকার এসেছেন তাঁকে দেখতে। তা সেই বাড়িটি যখন ভেঙে যাচ্ছে, তখন একটু চেষ্টা করেননি আপনারা পাড়ার লোকজন মিলে, বাড়িটাকে বাঁচানোর জন্য? অথচ, আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রতি আপনার এত দরদ?’ মুহূর্তের মধ্যে ভদ্রলোক হল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি বললাম, বসুন আপনি, আপনার প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করে যান।
সেখানেই এক ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি হচ্ছেন কামদেব পণ্ডিতের বংশধর। তিনি বললেন, ‘কানাইবাবু আপনার লিফলেট আমি পেয়েছি। আপনাকে আমি এই বাড়ির ছবি সংগ্রহ করে দেব। খুব ছোটোবেলায় আমি একটা ক্যামেরা নিয়ে সেই ছবি তুলেছিলাম। কিন্তু ছবিটা খুব ছোটো, পাসপোর্ট সাইজের। কিন্তু ছবিটা আমার কাছে নেই, এটা রয়েছে বোম্বেতে আমাদের এক পরিবারের সদস্য— সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি আমাদেরই পরিবারের। কামদেব পরিবারের বংশধর।’ ভদ্রলোক কিছুদিন পরে আমাকে ফোন করলেন, ‘কানাইবাবু আপনি আসুন, আমি ছবিটা আপনাকে দিচ্ছি।’ তারপর ছবিটাকে নানা প্রসেসে বড়ো করে, ছবিটা আমি ফেরত দিয়ে দিয়েছি। অমূল্য ছবি। ওই ছবিটা দেখেই খড়দাহের ইতিহাস রচনা করা যায়। সেই ছবিটাতে কী রয়েছে? ছাব্বিশ শিবমন্দিরের ছবিটা রয়েছে। যে ছাব্বিশ শিবমন্দির পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখন হেরিটেজ ঘোষণা করেছে। রামকৃষ্ণ বিশ্বাস যে ছাব্বিশ শিবমন্দির তৈরি করে গেছেন। রয়েছে সেখানকার বীরঘাটের ছবিও। সঙ্গে অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের বাড়ির ছবি। সেই ছবিটি আমি বই-এ ছাপাই। ‘ব্যারাকপুর মহকুমা ও রবীন্দ্রনাথ’ বইটির পিছনে ছবিটা দেওয়া রয়েছে।
এছাড়াও বহু ঘটনা রয়েছে। তবে এই ঘটনা দুটো আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
(পড়ুন প্রথম পর্ব)
তন্ময়— আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে, তথ্যসংগ্রহ ও ক্ষেত্রসমীক্ষা অনতিক্রম্য দুই কাজ। অন্যদিকে, লোকমুখে প্রচারিত অনেক কথা, যা হয়তো কোথাও ডকুমেন্টেড নেই, সেসবও উঠে আসে হাতে। সে-সমস্ত কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য, আপনার মতে?
কানাইপদ রায়— অসম্ভব জরুরি। খুবই বিশ্বাসযোগ্য হিসাবে গ্রহণ করি। একটা ঘটনা বলব। ব্যারাকপুরের সদরবাজার অঞ্চলটা ইংরেজদের তৈরি। যেহেতু এখানে ক্যান্টনমেন্ট তৈরি হয়, তাদের বাজার-হাটের জন্য বাজারটা তৈরি করা হয়েছিল। তো সদরবাজার অঞ্চলে প্রাচীন মানুষ যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের কাছে ওই অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানোর সময় শুনতাম, ‘স্যার, জানেন তো এখানে বিন্দাবাবা নামের একটা ভূত ঘুরে বেড়ায়।’ আমি জিজ্ঞেস করতাম, বিন্দাবাবার ভূত? সেটা আবার কী? বলতেন, ‘তা তো আমরা বলতে পারব না।’ কিন্তু এখানে একটা প্রচার আছে। আমি অনেকের মুখেই বিন্দাবাবার ভূতের কথা শুনেছি। তারপর বহু বছর চলে গেছে। তারপর ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে আমি যাই। সেখানে দেখি ছোট্ট একটা মন্দির। হনুমান মন্দির। সেখানে একটা কাল্পনিক মূর্তি রয়েছে বিন্দাবাবার নামে। এবং এই মূর্তিটা সিপাহীরা পুজো করে আসছে। বিন্দা তিওয়ারি। ১৮২৪ সালে যে বিদ্রোহ হয়েছিল, ২ নভেম্বর। সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিন্দা তিওয়ারি। তাঁকে একটি অশ্বত্থ গাছে নৃশংসভাবে বেঁধে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। কয়েকদিন পর ফাঁসিকাঠ থেকে, লোহার চেন থেকে তাঁকে নামিয়ে রাখা হয় এবং সেখানে একটা চারাগাছ রোপণ করা হয়েছিল। এছাড়াও, ১৮২৪ সালের ইংলিশম্যান পত্রিকায় একটি খবর বেরিয়েছিল। সেই খবরে বলা হয়েছে, সেখানে এক ব্রাহ্মণকে নৃশংসভাবে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল এবং একটি চারাগাছ পোঁতা হয়েছিল। এবং সেই চারাগাছটা এখনও রয়েছে। সত্যি। ১৮২৪ সালের সেই চারাগাছ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। যে ১৪ জনের ফাঁসি হয়েছিল, সেই ফাঁসির তালিকায় একজনের নাম বিন্দা তিওয়ারি।
তন্ময়— আমার মূল প্রশ্ন হল, সামগ্রিকভাবে আঞ্চলিক ইতিহাসের একজন গবেষক, লোকমুখ থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর কতটা আস্থা রাখতে পারেন?
কানাইপদ রায়— শুনুন, শ্রুতি আঞ্চলিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রসমীক্ষার মতোই কাজ করে। হয়তো সঙ্গে সঙ্গে আমরা এটাকে পাচ্ছি না। কিন্তু কিছুদিন পর হয়তো আমরা সেটাকে পাব। কেন-না দেখুন, একসময় তো দে-গঙ্গার ঢিবির(চন্দ্রকেতুগড়) খননকার্য হয়নি। সেইসময় লোকমুখে নানারকম কথা শোনা গিয়েছিল। নানারকম লোকমুখের কথা শুনে খননকার্যের ফলে সেখানে দেখা গেল কী বিরাট একটা ঐতিহাসিক ঘটনার প্রমাণ মিলল। সেটা তো আগে ছিল গল্পকথা থেকেই পরবর্তীকালে ক্ষেত্রসমীক্ষা হল। আর সেই ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকেই উঠে এল সেখানকার এক অজানা ইতিহাস। সুতরাং ক্ষেত্রসমীক্ষা, অজানা গল্প, কাহিনি— এগুলোকে ইতিহাসের একটা উৎসমুখ আমাদের ধরে নিতেই হবে। তা না-হলে কখনও আঞ্চলিক ইতিহাস গড়ে উঠবে না।
তন্ময়— সাধারণত যাঁরা আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে নন-অ্যাকাডেমিক পথে গবেষণা করেন, তাঁদের কাজের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অ্যাকাডেমিক জগতে প্রশ্ন ওঠে এবং তাঁদের প্রতি একটা অবহেলাও কাজ করে অনেকসময়; যেহেতু অনেকেই অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের নন। এই দৃষ্টিভঙ্গিটার প্রতি আপনার কী মতামত?
কানাইপদ রায়— অ্যাকাডেমিক বলতে সেই বিষয়ে?
তন্ময়— মানে ইতিহাস কিংবা সাহিত্যের ছাত্র নন, অথচ ইতিহাস নিয়ে কাজ…
কানাইপদ রায়— খুব ভালো। খুব ভালো প্রশ্ন করেছেন এটা। আমার জীবনেরই ঘটনা। একবার পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের একটা অধিবেশন হয় পলতা কলেজে। ঠিক আছে? তা সেখানে আমাকে আঞ্চলিক ইতিহাসের ওপরে বলার জন্য সময় দেওয়া হয়। আগে অনেকেই বলে গেছেন। প্রত্যেকের জন্য প্রচুর সময় দেওয়া হল। আমার জন্য ৭ মিনিট সময় দেওয়া হল। আমি প্রথমেই বললাম, বলব না। আমাকে ৭ মিনিট সময় দেওয়া হলে আমি বলব না। আমাকে যদি নিজের মতো করে বলতে দেন, তবে আমি বলব। না-হলে আমি মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছি। সেখানে যিনি মঞ্চ পরিচালনায় ছিলেন, নামকরা লোক একজন। আমি তাঁর সম্পর্কে কিছু বলব না। তিনি তখন আমার সম্পর্কে কিছু জানতেনও না। তারপর আমি একের পর এক ক্ষেত্রসমীক্ষা, ছবি দেখিয়ে বলতে শুরু করলাম। শেষ হলে তিনি বললেন, ‘কানাইবাবু, আমরা খুবই দুঃখিত। আপনি যে-সমস্ত কাজ করেছেন, আমরা তা জানতাম না। আপনাকে আরও সময় দেওয়া উচিত ছিল আমাদের। আপনি আঞ্চলিক ইতিহাসে নিয়ে যে কাজ করেছেন, সেটা আমি ভাষায় বলে বোঝাতে পারছি না। এত সমস্ত মূল্যবান কাজ হাতের সামনেই আপনি করে গেছে, তার বিন্দুবিসর্গও আমরা জানি না।’
তন্ময়— আঞ্চলিক ইতিহাসকারদের প্রতি অ্যাকাডেমিক জগতের যে অবহেলা বা দুচ্ছাই করার মনোভাব— এই বিষয়টা বদলানো উচিত দ্রুত।তাই নয় কি?
কানাইপদ রায়— অবশ্য বদলানোউচিত। দুই জগতের মধ্যে স্পষ্ট ফারাক রয়েছে। একবার, সিপাহি বিদ্রোহের দেড়শো বছর তখন, মঙ্গল পাণ্ডে সম্পর্কে অক্সফোর্ড-ফেরত এক ঐতিহাসিক এমন মন্তব্য করলেন, আমি তো অবাক। একটা স্টেটমেন্ট দিয়ে মঙ্গল পাণ্ডের গোটা বিদ্রোহটাকে নস্যাৎ করে দিলেন! আমি তৎকালীন পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করে, তার রিপোর্টগুলো জোগাড় করলাম। সেখান থেকে দেখালাম, মঙ্গল পাণ্ডে সচেতনভাবে তাঁর বিদ্রোহ করেছেন। হঠাৎ একদিন বেলা তিনটের সময়, ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ তিনি বিদ্রোহ করতে নামেননি। মঙ্গল পাণ্ডে বিদ্রোহ করতে যখন এসেছিলেন, তিনি একাই, আর-কেউ এগিয়ে আসেনি। তিনি প্রথম কথা যেটা বললেন, সেটা হচ্ছে— ‘তোমরাই তো আমাকে পাঠিয়েছ! এখন কেন আমার সঙ্গে বিদ্রোহে যুক্ত হচ্ছ না?’ আমি এই লাইনটাকে তুলে ধরে দেখালাম যে, বাকিদের সঙ্গেও তাঁর একটা শলাপরামর্শ হয়েছে। কিন্তু তারা চাকরি বাঁচাতে কিংবা কোর্টমার্শালের ভয়ে মঙ্গল পাণ্ডের পাশে দাঁড়াতে পারছে না। কিন্তু পূর্বপরিকল্পনা ছিল। সেটা আমি ঐতিহাসিক তথ্য দিয়ে, তৎকালীন পত্রপত্রিকা দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছি। সুতরাং, আমার মতো যাঁরা মাঠে-ঘাটে গিয়ে আঞ্চলিক-ইতিহাস সংক্রান্ত কাজ করেন, আর যাঁরা পুঁথিগত বিদ্যা নিয়ে কাজ করেন, উভয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ।
তন্ময়— আপনার সত্তর ছুঁইছুঁই বয়স এখন। আপনার যাবতীয় লেখালিখির সিংহভাগই আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে এবং একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের আঞ্চলিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে আপনি মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সেখানেও জনসাধারণ এবং বৃহৎ পাঠকমহলের কাছে কানাইপদরায় নামটি হয়তো সুপরিচিত নয়। আপনার কি কোনো অভিমান বা অপ্রাপ্তির বেদনা জাগে?
কানাইপদ রায়— দেখুন, আমি একটা কথা বলি। প্রত্যেক মানুষই একটা কাজের স্বীকৃতি পায়। কিন্তু আমি আমার এই ছোটোখাটো অনুষ্ঠান, বিভিন্ন জায়গায় মানুষের যা উৎসাহ পেয়েছি, সে-সম্পর্কে একটি ঘটনা আমাকে বলতেই হবে। খড়দহে কল্যাণনগরী হাইস্কুলে আমাকে ঐতিহ্য বিষয়ে বলার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগে। বহু হাইস্কুল থেকে মাস্টারমশাইরা এসেছিলেন, বহু ছাত্রছাত্রী। স্কুলের মাঠ ভরে গেছে। প্রত্যেক মাস্টারমশাই বক্তব্য রেখে গেলেন। আমি প্রধান অতিথি। আমাকে বলতে হবে। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম, আগের মাস্টারমশাইরা যখন বলছিলেন, ছাত্রছাত্রীদের চেঁচামিচি-গণ্ডগোলের অন্ত ছিল না। এবার আমার সময়, আমাকে বলার সুযোগ দেওয়া হল। আমি ছাত্রদের বললাম, তোরা সবাই বই নিয়ে এসেছিস? বলল, ‘হ্যাঁ।’ সবার ব্যাগে বই। বললাম, তোদের বই খুলে দেখ, সব বই-এ সংবিধান প্রস্তাবনার একটা কথা আছে। সেখানে দেখবি ঐতিহ্য বিষয়ে কিছু কথা বলা আছে। বলল, ‘হ্যাঁ।’ ওরা পড়েছে জায়গাটা। ওগুলো জানে। তো আমি বললাম, ‘দেখ আমাদের যে আলোচনাটা সেটা ঐতিহ্য বিষয়ে। ভারতের। তবে আমি তো তোদের অতদূরে নিয়ে যাব না। তোদের কাছাকাছি জায়গা, তোরা যেসব জায়গা থেকে এখানে এসেছিস, তার সম্পর্কে দু-একটা কথা বলব। খুব মজার কথা। তোরা কার কথা শুনতে ভালোবাসিস?’ একবাক্যে, ‘হ্যারি পটার।’ তখন হ্যারি পটার খুব চলছে। আমি বললাম, ‘তোদের হ্যারি পটার আমি শোনাব। কিন্তু আমাকে একটা কথা দে, যে আমার কথা তোরা শুনবি আর আমি যা প্রশ্ন করব তোরা তার উত্তর দিবি।’ বলল, ‘হ্যাঁ।’ খড়দায় রবীন্দ্রানাথের বাড়ি, সোদপুরে মহাত্মা গান্ধীর বাড়ি ওদের বাড়ির কাছাকাছিই। কেউ একটু একটু বলতে পারছে, কেউ বলতে পারছে না। শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, আমি প্রায় ৪০ মিনিট তাদের সঙ্গে কথা বললাম। একটা টু-শব্দও তারা করেনি। একদম পিনড্রপ সাইলেন্ট যাকে বলে, তাই। তারপরই মাস্টারমশাইরা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘এ তো দেখি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ব্যাপার।’ আমিও অভিভূত। আমি বললাম, এদের জন্য একটা বই লিখতে হবে। কীভাবে এদেরকে আঞ্চলিক ইতিহাসে ঢোকানো যায়। তখন আমি শুরু করলাম, ‘কথায় কথায় ব্যারাকপুর’, ‘কথায় কথায় খড়দহ’, ‘কথায় কথায় বহরমপুর’, ‘কথায় কথায় নদিয়া’। প্রত্যেকটি বই ছোটোদের জন্য। কীভাবে? আমি নিজেকে একটা চরিত্র দিলাম— কাহিনিকাকু। আর ওরা হচ্ছে আমার ছাত্রছাত্রীরা। ওদের দিয়ে প্রশ্ন করাচ্ছি, আমি উত্তর দিচ্ছি। আমি প্রশ্ন করছি, ওরাও উত্তর দিচ্ছে। যাতে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চাটা ছোটোদের মধ্যে আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
(পড়ুন প্রথম পর্ব)
তন্ময়— আমার প্রশ্নের উত্তরটা, কানাইবাবু, এখনো পেলাম না। ঐতিহাসিক কানাইপদ রায়, আমরা যাঁরা এই বিষয় নিয়ে আগ্রহী এবং এই বিষয় নিয়ে যাঁরা চর্চা করি, পড়াশোনা করি, লেখালিখি করি, তাঁদের কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি কি অপ্রাপ্তির বেদনায় ভোগেন কখনো?
কানাইপদ রায়— না, না, আপনিও গুরুত্বপূর্ণ। আপনিও বেলঘরিয়া নিয়ে ভালো কাজ করেছেন। আমি পড়েছি বইটা। এবং আপনার বই-এর একটা রেফারেন্স কোনো একটা বই-এ আমি ব্যবহারও করেছি। যাঁরা যতটুকু কাজ করেন আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে, প্রত্যেকেই প্রণম্য। শুনুন, আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে একটা শেষ কথা বলি আমি…
তন্ময়— না, আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে আমার মূল কাজ নয়। আমি মূলত কবিতা, গদ্যের মানুষ।
কানাইপদ রায়— আমি সেদিক থেকে বলছি না। আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে, আপনি অন্যান্য কাজের সঙ্গে আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়েও তো কাজটা করেছেন। সেটাও তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটাও তো মানুষকে একটা উৎসাহ দেবে।
তন্ময়— সেইদিক থেকেই আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রতি একটা অমলিন আকর্ষণ থেকেই, আপনার প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, ঐতিহাসিক কানাইপদ রায় ব্যারাকপুর ও উত্তর চব্বিশ পরগনার ইতিহাস নিয়ে অফুরন্ত পরিশ্রম করলেন, অথচ সেই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই তাঁকে চিনল না বা তাঁর সম্পর্কে যথেষ্ট জানল না। এই কষ্ট বা অভিমানটা কতটা পীড়িত করে?
কানাইপদ রায়— সেটা তো পীড়িত করবেই। সরকারি তরফে কোনো সাহায্য পাইনি। নিজের থেকে যতটা পেরেছি গবেষণার কাজ চালিয়ে গিয়েছি এবং প্রশাসনেরও কিন্তু সেটা কাজে লাগছে। এখানে পীযূষবাবু বলে যিনি জেলাশাসক ছিলেন, নদীর ঘাটের বইটা পড়ার পরে হঠাৎ একদিন ফোন করে বললেন, ‘কানাইবাবু, আপনি এক্ষুনি আসুন’। বলি, কেন? বললেন, ‘নবান্নে এই ঘাটগুলো নিয়ে আমাকে একটা রিপোর্ট দিতে হবে। কিন্তু আমার এই রিপোর্টগুলোকে যেন কেমন একটা মনে হচ্ছে।’ আমি সঙ্গে সঙ্গেই গেলাম। রিপোর্টটা দেখে আমি বললাম, এ কী করেছেন? এত ঘাট এখানে, আর মাত্র এই কয়েকটা ঘাট রিপোর্টে রয়েছে! উনি বললেন, ‘আপনি আমার সঙ্গে বসেই ঠিক করে দিন।’ তো আমি সেগুলো ঠিক করে দিই। অর্থাৎ, প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও সেগুলো কাজে লেগেছে। ব্যারাকপুর পুরসভা, তাদের একশো বছরে বলল, ‘কানাইবাবু আপনি ছাড়া এই কাজটা আর কেউ পারবেন না। আপনি আমাদের একশো বছরের ইতিহাসটা আপনি করে দিন যেমন করে হোক।’ বিশ্বাস করবেন না, একশো বছরের পুরনো ফাইল ঘেঁটে সেই ধুলো ঝেড়ে-ঘেঁটে তারাও সাহায্য করেছে। যে কাজটা করে দিয়েছি আমি, তারা যে-কোনো অনুষ্ঠানে একবাক্যে এখনও বলে, ‘কানাইবাবু একটা দলিল তৈরি করে দিয়ে গেছেন আমাদের। তা না-হলে এই কাজটা আমরা কখনও করতে পারতাম না। আগামী প্রজন্ম এটা মনে রাখবে।’ এবার আপনার কথাতে ফিরে আসি। দুঃখ আছে। কিন্তু আমি প্রাপ্তির কাঙাল নই। আমি যেটুকু করেছি, সেটার জন্য হয়তো আমার আলাদা একটা মূল্যায়ন করা উচিত ছিল। আমার মতো আরো অনেকেই আছেন। তাঁদেরও একটা মূল্যায়ন হওয়া দরকার। স্বাভাবিক, এই কষ্টটা থাকবেই।
(পড়ুন প্রথম পর্ব)
তন্ময়— আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে যাঁরা কাজ করতে এগিয়ে আসেন, তাঁদের বেশিরভাগই পরিণত বয়সের। কিন্তু গত পাঁচ-ছ’বছরে আমি দেখেছি কুড়ির কোঠায় বয়স, এমন অনেক ছেলেমেয়ে আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে লিখতে এবং গবেষণা করতে উদ্যোগী হয়েছে। সেইসব তরুণ আঞ্চলিক ইতিহাসকারদের একজন প্রবীণ এবং অগ্রজ হিসাবে আপনি কী পরামর্শ দেবেন? কোন পথে তাঁদের এগোনো উচিত?
কানাইপদ রায়— আমার পরামর্শ, আঞ্চলিক ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধরে রাখে। ঐতিহ্য গাছের শিকড়। শিকড় যদি নড়ে যায়, শিকড় যদি ভঙ্গুর হয়ে যায়, সেই গাছ তবে নষ্ট হয়ে যায়। ঐতিহ্যকেও আমাদের ধরে রাখতে হবে। কারণ, আঞ্চলিক ইতিহাসে রয়েছে একটা মাটির গন্ধ। সেই গন্ধটা যেন ম্লান না হয়। সেটা মাথায় রেখেই, আজকে যাঁরা কাজ করছেন, সেই কাজে তাঁরা এগিয়ে যান। অবশ্যই আমাদের ঐতিহ্য তাতে ধরা থাকবে, মাটির গন্ধ তারা আঞ্চলিক ইতিহাস থেকে পাবে, আমরাও পাব, আগামী প্রজন্মও পাবে।
তন্ময়— এবার শেষ প্রশ্ন। অতীতে যা যা ঘটেছে, সেগুলো তুলে আনার জন্য বইপত্র, ডকুমেন্টেশন, লোকমুখ থেকে সংগৃহীত তথ্য ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু বর্তমানে এখনও যা-যা চিহ্ন বা ধ্বংসাবশেষ আছে, সেগুলোও খুব-একটা কম নয়। আপনি দীর্ঘসময় ধরে যখন কাজ করেছেন, ডকুমেন্টেশনের একমাত্র সহজ মাধ্যম ছিল ছবি তুলে রাখা, ছবি তুলে সংরক্ষণ করা। কিন্তু বর্তমানে ভিডিও, ছোটো ছোটো ডকুমেন্টারি ছাড়াও মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটা নতুন জিনিস শুরু হয়েছে, সেটা হচ্ছে ভ্লগিং। সেই ভ্লগিং-এর মাধ্যমে ভিডিও-তে ইতিহাস সংরক্ষণ বা ঐতিহাসিক জায়গাগুলো ধরে রাখা। আপনার কি মনে হয়, ডকুমেন্টেশনের ক্ষেত্র বা মাধ্যম হিসাবে লেখা জিনিসটা অবলুপ্ত হয়ে ভবিষ্যতে ভিডিও মাধ্যমটা গ্রাস করে নেবে?
কানাইপদ রায়— এই প্রবণতাটা আমি দেখছি। একটা ভ্লগ তৈরি করছেন অনেকে। কিন্তু সেখানে অনেক খামতি থেকে যাচ্ছে। তথ্যের খামতি থাকছে। মানুষের প্রাণের একটা খামতি থাকছে। এই খামতিটা যদি পূরণ করতে পারে তবে ভালো। কেন-না মাটির সঙ্গে প্রাণের যে স্পন্দন, সেটা আমি সেখানে পাচ্ছি না।
তন্ময়— আমি ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। ভবিষ্যতে কি লিখিত মাধ্যমের তুলনায় ভিডিও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে না? আপনি যদি পঞ্চাশ বছর পরে এই কাজগুলো করতেন, তবে কি ভিডিও-তে আপনার মুখেই কথাগুলো শুনতে পেতাম? প্রযুক্তি কি সেইদিকেই এগোচ্ছে? মানে ভিডিও-নির্ভরতা কি সংরক্ষণের অন্যতম একটা মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে?
কানাইপদ রায়— নিশ্চয়ই পারে।
তন্ময়— সেখানে কি লিখিত মাধ্যমটা ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাবে? কারণ সমীক্ষা বলছে, পড়ার তুলনায় মানুষের দেখা বা শোনার প্রবণতা বাড়ছে।
কানাইপদ রায়— সেই প্রবণতা বাড়লে আমি বলব, পড়া এবং লেখার কোনো বিকল্প হয় না। ভিডিও করলেও, তাকে তো একটা লেখার মাধ্যমে, পড়ার মাধ্যমে আনতে হবে। সুতরাং ভিত্তিটা কিন্তু পড়াশোনা-লেখা— এর ওপর ভিত্তি না করে যদি কোনো ভিডিও গড়ে ওঠে, তাহলে বলব সেটা কার্যকরী হবে না এবং সেখানে মাটির গন্ধটুকুও পাওয়া যাবে না। সুতরাং, লেখা মাস্ট। পড়াশোনা অবশ্যই। এটা মানতেই হবে আমাদের।
(সমাপ্ত)
অনুলিখন – শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
স্কেচ – অমর্ত্য খামরুই
Powered by Froala Editor