ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — প্রথম পর্ব

কানাইপদ রায়ের জন্ম ১৯৫৩ সালে, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। কর্মসূত্রে উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাকপুরে বসবাস। সেখানকার মহাদেবানন্দ মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর দুটি স্মরণীয় কাজ ‘বারাকপুরের সেকাল-একাল’ (২ খণ্ড) ও ‘উত্তর চব্বিশ পরগনার সেকাল-একাল’ (৭ খণ্ড)। এছাড়াও লিখিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টিরও বেশি। বর্তমান কথোপকথন ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘উত্তর চব্বিশ পরগনা: কথা ও কাহিনিতে গঙ্গার ঘাট’ গ্রন্থটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। আলোচনায় কানাইপদ রায়ের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ প্রথম পর্ব।


তন্ময়— ‘ঈর্ষাক্ষাৎকার’ সিরিজটি আপনাকে দিয়ে শুরু করার একটা নির্দিষ্ট কারণ আছে। আপনার বিভিন্ন কাজের প্রতি আমি দীর্ঘদিন ধরেই ঈর্ষাকাতর। তবে আজকের কথোপকথনটির উদ্দেশ্য অন্য। ২০২১ সালে আমি উত্তর চব্বিশ পরগনার গঙ্গার ঘাটগুলো নিয়ে একটা সার্বিক কাজ শুরু করেছিলাম। এগিয়েওছিলাম বেশ কিছুটা। তারপরই হঠাৎ একদিন আপনার একটি বই হাতে আসে। দেখি, আমি যা করতে চাইছি, মোটামুটি সেই একই কাজ আপনি কয়েক বছর আগেই করে ফেলেছেন। তৎক্ষণাৎ আমার কাজটা থামিয়ে দিই। তবে, হয়তো অসম্পূর্ণতার দুঃখেই, প্রশ্ন ও কৌতূহলগুলো ভুলতে পারিনি। সেখান থেকেই এই কথোপকথনের ইচ্ছা। উত্তর ২৪ পরগনার ঘাট নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনাটা আপনার মাথায় কবে ও কীভাবে এল? 

কানাইপদ রায়— ছেড়ে দিলেন কেন! আপনিও করতেই পারতেন! সমস্যা তো ছিল না কিছু! আমার কাজের ইতিহাস বলতে গেলে একটু পিছিয়ে যেতে হয়। প্রথমত, আমি যখন বারাকপুর অঞ্চলে চাকরিতে যোগদান করি, স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আঞ্চলিক ইতিহাসের অজ্ঞতা দেখে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। বারাকপুরের মণিরামপুর অঞ্চলেই রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাড়ি। কলকাতায় জন্মগ্রহণ করলেও, ১৮৮০ সালের পর থেকেই আমাদের এই মণিরামপুরের বাড়িতে বসবাস করেছেন। মৃত্যুও এখানেই। কিন্তু এখানকার পথচলতি মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এই যে অট্টালিকাসম বসতবাড়ি, এটা কার? বেশিরভাগ লোকই উত্তর দিত, এটা হল সিভিল ডিফেন্সের অফিস। তার কারণ, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিভিল ডিফেন্সের অফিস ছিল এটা, যদিও এখন এটা মহাদেবানন্দ মহাবিদ্যালয়কে দেওয়া হয়েছে। আমি দেখলাম, এই বাড়িতে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী এসেছেন সুরেন্দ্রনাথকে দেখতে। সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগে একবার, মৃত্যুর পরেও একবার এসেছেন। বহু প্রশংসা করে গেছেন। দুজনের মুখোমুখি কথা হয়েছে। এইরকম একটা বাড়ির সম্পর্কে আশেপাশের লোকেরা বলছে সিভিল ডিফেন্সের অফিস! এই অজ্ঞতাটা আমাকে খুব পীড়া দিয়েছিল। তখন আমি ঠিক করি, আঞ্চলিক ইতিহাসের কিছু কাজ করতে হবে।

আঞ্চলিক ইতিহাসের কাজ শুরু করার সময়ই নদীর ঘাটগুলো দেখতাম। কিন্তু নদীর ঘাট নিয়ে কাজ করব, সেরকম মনে হয়নি। এসব প্রায় ২৫ বছর আগেকার কথা। দেখতাম, ঘাটগুলোর যা অবস্থা! এত নামিদামি সমস্ত ঘাট! কোনো-কোনোটা আবার লুপ্ত হয়ে গেছে, আমি দেখার সুযোগও পাইনি। সম্বল বলতে পুরনো দিনের ছবি। সেইসব ছবিতে ঘাটগুলোর ভাঙাচোরা অবস্থা দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। তখনই আমার মাথায় ভাবনা এসেছিল, এই ঘাটগুলো নিয়ে আমি ভবিষ্যতে একটা কাজ করব। তারপর ২০১৫-১৬ সালে শুধুমাত্র ঘাটেই মনোনিবেশ। সুতরাং আমার কাজের শুরু আঞ্চলিক ইতিহাসের অজ্ঞতা দেখেই, আর ঘাটগুলোর ভগ্নাবস্থা যে পীড়া দিয়েছিল আমাকে, সেটাই আমার ঘাট নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা।


তন্ময়— ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় দেখেছিলাম, হালিশহর-কাঁচরাপাড়া অঞ্চলের ভূগোলটা যথেষ্ট গোলমেলে। বাগের খালের দক্ষিণ থেকে উত্তর ২৪ পরগনার শুরু এবং উত্তরে নদিয়া। কিন্তু বাগের খালের দক্ষিণেও বেশ কিছু ঘাট পেয়েছি, যেগুলো নদিয়া জেলার অন্তর্গত। আবার স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে কথা বলেও জানা যায়, কিছু কিছু গঙ্গার ঘাট আবার হুগলি জেলার! সে-অঞ্চলে ভৌগোলিক অবস্থান বা সরকারি জরিপই এমন যে, নদীর জল পেরিয়ে এ-পাড় পর্যন্ত হুগলি জেলার বিস্তৃতি।

কানাইপদ রায়— এই কাঁচরাপাড়া তখন ‘কাঞ্চনপল্লী’ নামে পরিচিত ছিল। এই কাঞ্চনপল্লীর সঙ্গে আমাদের বহু ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। এখানেই ঈশ্বর গুপ্তের জন্মস্থান। এখনও প্রতিবছর সেখানে নানা উৎসব পালন করা হয় তাঁর জন্মদিনে। কাঞ্চনপল্লীতে এককালে একটি ঘাট ছিল। খুবই বিখ্যাত ঘাট। গঙ্গা সরে আসার ফলে সেটা লুপ্ত হয়ে যায়। যদিও কিছুটা অংশ উত্তর ২৪ পরগনার মধ্যে পড়েছে, কিন্তু কাঁচরাপাড়ায় কোনো ঘাট এখন আর নেই। সুতরাং উত্তর ২৪ পরগনার ঘাট বলতে গেলে আমাদের হালিশহরের ঘাট থেকেই ধরতে হবে।


তন্ময়— আমি উত্তর ২৪ পরগনার প্রথম গঙ্গার ঘাট হিসাবে যে ঘাটটি দেখে এসেছিলাম, সেটি ‘রানি রাসমণি ঘাট’। এখন কয়েকটি সিঁড়ি আছে। আপনিও সেটিকেই প্রথম ঘাট হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

কানাইপদ রায়— হ্যাঁ, চিহ্নিত করেছি। কিন্তু সেটাও বহুকাল হল গঙ্গার পাড়ে নেই। এখন নদীর চিহ্নমাত্র পাবেন না। ওই নামকরণটাই রয়েছে খালি। হ্যাঁ, কয়েকটা সিঁড়ির অবয়ব এখনও আছে। ম্লান অবস্থায়।


তন্ময়— এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথাও পাঠকদের জন্য বলে রাখি, ‘রানি রাসমণির ঘাট’ হিসাবে আজকাল যেটিকে প্রচার করা হয়, গঙ্গার পাড়ে বিশাল মন্দির-সংলগ্ন, সেটি কিন্তু আসল ‘রাসমণি ঘাট’ নয়। ওখানে যে ঘাটটি অবস্থিত, সেটি আবার নদিয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত; উত্তর ২৪ পরগনারও নয়। প্রাচীন যে রাসমণির ঘাট, সেখান থেকে গঙ্গা সরে গেছে। সেই ঘাটটি এখন ছোট্ট এক শিবমন্দির ও কালীমন্দিরের পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।

কানাইপদ রায়— ঠিক।


তন্ময়— অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন এবং আপনার কাজগুলো অনেকক্ষেত্রেই আমাদের কাছে পাথেয় হিসাবে ধরা দিয়েছে। হালিশহর থেকে বরাহনগর অবধি—হালিশহরের রানি রাসমণির ঘাট থেকে শুরু করে বরাহনগরের প্রামাণিক ঘাট— রতনবাবুর ঘাটের আগে পর্যন্ত উত্তর ২৪ পরগনার গঙ্গার ঘাটের বিস্তৃতি। আমরা যদিও গঙ্গা বলে বলছি, এটা আসলে হুগলি নদী। হালিশহর থেকে বরাহনগর— এই দীর্ঘ এলাকার গঙ্গার ঘাটে-ঘাটে ভ্রমণ ও তথ্য সংগ্রহ কতটা কঠিন ও পরিশ্রমসাপেক্ষ ছিল?

কানাইপদ রায়— খুব কঠিন। খুবই কঠিন ছিল কাজ। আমি প্রায় ছ-মাস ধরে ঘুরেছি। হালিশহরেই কতবার গিয়েছি আমি। গিয়ে-গিয়ে ছবি তুলেছি। কখনো-কখনো এই ঘাটগুলো— বরাহনগর থেকে কাজ করতে গিয়ে অনেক বিপদের সম্মুখীনও হয়েছি। সে-কথা আমি বলব না, নানা কারণে। সেগুলো কাটিয়েও আমি কিন্তু পিছপা হইনি। ঘাটগুলোকে স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, হালিশহর থেকে বরাহনগরের মধ্যে যে-সমস্ত ঘাট রয়েছে— সে স্নানের ঘাট বলুন, খেয়াঘাট বলুন, শ্মশানঘাট বা বিসর্জনের ঘাট বলুন— এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘাট ভারতের আর কোথাও নেই। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এত পৌরাণিক কথা, এত পৌরাণিক কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে এইসমস্ত ঘাটের সঙ্গে! বৈচিত্র্যের দিক থেকেও তাই।


তন্ময়— আপনার এই বক্তব্যের সঙ্গে আমার সামান্য দ্বিমত আছে। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।

কানাইপদ রায়— হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।


তন্ময়— ঘাটের নামকরণ সাধারণত ব্যক্তিনাম বা দেবদেবীর নাম বা স্থাননামের অনুসারে হয়। এগুলির সঙ্গে জড়িত যে ইতিহাস, তার তথ্য সংগ্রহের জন্য ক্ষেত্রসমীক্ষাও নেহাত কম করতে হয়নি নিশ্চয়ই! সেই অলিখিত অধ্যায়ের কথা যদি একটু বলেন!

কানাইপদ রায়— আমি তো প্রথমে এলাকায় যেতাম। সঙ্গে ফটোগ্রাফার থাকত। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেই মূলত কাজগুলো করতে হত। দেখেছি যে, ব্যক্তিনাম, নামের পদবি, পেশা, দেব-দেবী, কারখানা এমনকী ঘাট-সংলগ্ন কোনো বৃক্ষের নামেও এই ঘাটগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। কখনো সতীদাহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সতীঘাট— যেটা বরাহনগরের ওদিকে রয়েছে। আমাদের এখানে(বারাকপুর) দাসপাড়া ঘাট— বোঝা যাচ্ছে, পদবির সঙ্গে জড়িত। বটতলা ঘাট— এখানে গাছের নাম জড়িত। শ্যামাসুন্দর ঘাট— দেবতার নামের সঙ্গে। একসময় খড়দার কাছে বাণিজ্যঘাট বলে একটা ঘাট ছিল, সেটা একটা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মনীষীদের নামের সঙ্গে জড়িত বহু ঘাটও রয়েছে।

এমন কিছু ঘাট, যেগুলোর কোনো বিশেষ ইতিহাস নেই, সেখানেও খুব মজার-মজার ঘটনা শুনতে পেয়েছি। একটি ঘটনা বলি। একদিন আড়িয়াদহে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে লোকমুখে শুনতে পেলাম, পিটুরি ঘাটের কাছে নাকি একটা শ্মশান ছিল। পিটুরি ঘাটে গেলাম। দেখলাম, সুন্দর বাঁধানো ঘাট দুদিকে। কয়েকজন মহিলা একটা ছোট্ট কুয়োর চাতালে বসে জামাকাপড় কাচাকাচি করছেন। সেই চাতালের ওপরে দাঁড়িয়ে বললাম— ‘এই অঞ্চলে অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম, পাড়ার কিছু মানুষ আমাকে ঢোকার মুখে বললেন, ওখানে একটা শ্মশান ঘাটও ছিল। কিন্তু এত খুঁজেও আমি তো কোনো শ্মশানঘাট দেখতে পাচ্ছি না!’ তখন ওই মহিলারা বললেন, ‘আপনি ঠিক যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছেন, এটাই হচ্ছে শ্মশানঘাট।’ সেকি! আমি তো আঁতকে উঠেছি! ওঁরা আরও বললেন, ‘এখনো মাসে দু-একটা আসে। আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ওখানেই চিতা জ্বালানো হয়, পোড়ানো হয়।’ এইসমস্ত জিনিসগুলো তো আর লিপিবদ্ধ নেই! কিন্তু লোকমুখে শুনতে পেলাম, প্রমাণ পেলাম। এককালে যেটা শ্মশানঘাট ছিল, এখন তার এই অবস্থা হয়েছে। এগুলো খুব অদ্ভুত লেগেছে আমার।


তন্ময়— এবার আপনার আগের একটা কথায় ফিরি। আপনি বললেন যে, উত্তর ২৪ পরগনার ঘাটগুলির মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘাট ভারতে খুব কম আছে। এই প্রসঙ্গেই আমার একটা নিরীক্ষণ ও সেই সম্পর্কে আপনার মত জানতে চাই। হালিশহর থেকে বরাহনগর পর্যন্ত যত ঘাট— বরাহনগরে ওলন্দাজদের প্রভাব ছিল, ইছাপুরে ফ্লেমিশদেরও— তাছাড়া মোটামুটি প্রায় সব ঘাটই হয় ইংরেজদের আনুকূল্যে নয়তো স্থানীয় মানুষদের উদ্যোগে গড়ে তোলা, ঔপনিবেশিক যুগে। কিন্তু এর সমান্তরালভাবে হুগলিতে যে ঘাটগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলি স্থানীয় মানুষ এবং ইংরেজ ছাড়াও ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ফরাসি, দিনেমারদের তৈরি। যেহেতু তাদের উপনিবেশ ছিল হুগলির বিভিন্ন অঞ্চলে, ফলে ঘাটগুলিকে কেন্দ্র করেও বিচিত্র ইতিহাস জন্ম নিয়েছে। আপনার কি এটা মনে হয় না যে, উত্তর ২৪ পরগনার তুলনায় হুগলির গঙ্গার ঘাটগুলি অনেক বেশি আকর্ষণীয়?

কানাইপদ রায়— সে তো বটেই! কিন্তু আমার ওদিককার ঘাটগুলো নিয়ে সেভাবে আর কাজ করা হয়ে ওঠেনি। আমাদের এখানেও তো আকর্ষণীয় ঘাট কম নয়! বরাহনগরের লালকুঠি ঘাট; আমাদের বারাকপুর, মানে খাস বারাকপুর, যেটাকে নাম দেওয়া হয়েছে চানক-বারাকপুর, সেখানে ফ্ল্যাগস্টাফ ঘাট— এগুলো তো ইংরেজদের নামের সঙ্গে যুক্ত। যেদিন মঙ্গল পাণ্ডে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু করেন বারাকপুরে, তার আগের দিনে এই ফ্ল্যাগস্টাফ ঘাটে এসেছিল গোরা সৈন্যরা। এটা মঙ্গল পাণ্ডে তাঁর ট্রায়ালের সময় উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এই ফ্ল্যাগস্টাফ ঘাটের সঙ্গে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের একটা সম্পর্ক রয়েছে।


তন্ময়— গঙ্গার ঘাট, বিশেষত মফস্‌সলের ঘাট বলতে বলতে আমাদের চোখে সাধারণভাবে যে দৃশ্য উঠে আসে— শ্মশান, পরিত্যক্ত মূর্তি, নোংরা আবর্জনা, ফুল, মালসা, বেলপাতা ইত্যাদি। আপনার পঁচিশ-তিরিশ বছরের যে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা এবং ঘাট নিয়ে নিরীক্ষণ, তাতে ঘাটের চরিত্র আপনার কাছে কীভাবে ধরা দেয়?

কানাইপদ রায়— পঁচিশ-তিরিশ বছর আগের ঘটনা মানে নব্বই দশকের কথা। আর ঘাট নিয়ে বইটা বেরিয়েছে ২০১৬ সালে। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু নোংরা করার ঐতিহ্যও সমানে চলেছে। আমার বইয়ে অনেক ছবি দেওয়া রয়েছে, যেখানে ঘাটের পাশেই বড়ো বড়ো বিজ্ঞাপন— ‘এখানে আবর্জনা ফেলবেন না’। ঠিক বিজ্ঞাপনের তলাতেই জমা হচ্ছে আবর্জনা। বড়ো ঘাটে যে রেলিংগুলো সৌন্দর্যায়নের জন্য বসানো হয়েছে, সেই রেলিং-এর ওপরে সমস্ত জামাকাপড় মেলে দেওয়া হচ্ছে। ইছাপুরের কয়েকটি ঘাটে শ্রাদ্ধশান্তির জন্য আলাদা ঘাট করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তবু সেখানে নোংরা করা হচ্ছে। শ্রাদ্ধশান্তির জন্য আলাদা ঘাট, আবর্জনা ফেলার জন্য আলাদা ঘাট করা হয়েছে— কিন্তু মানুষের সেই এমন একটা চরিত্র তৈরি হয়ে রয়েছে যে, এতকিছুর পরেও নতুন শৌচালয় ও ঘাট তারা কেন ব্যবহার করে না, জানি না। একটা কথা আছে যে, সবচেয়ে বড়ো শৌচাগার ভারতবর্ষ। এত বড়ো উন্মুক্ত শৌচাগার পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। আমি বারাকপুরের এই নদীর কাজগুলো করতে গিয়ে দেখেছি সৌন্দর্যায়ন করা হচ্ছে, গঙ্গার ধারে শৌচাগার করে দেওয়া হয়েছে, তা সত্ত্বেও মানুষ গঙ্গার পাড়ই ব্যবহার করবে, শৌচালয়ে না গিয়ে।


তন্ময় এই বিষয়টি হয়তো সরাসরি ঘাটের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, কিন্তু আপনার মতামত জানতে চাইছি। এই যে ভাগীরথী ও হুগলি নদীর নাব্যতা দিন-দিন কমে আসা ও নদীর বুকে চর পড়া— এর সঙ্গে ঘাটের সম্পর্ক কতটুকু?

কানাইপদ রায়— ওরেব্বাবা। শুনুন, এই প্রসঙ্গে তাহলে একটা কথা বলি। আগে কলকাতার যত জল, সল্টলেকের যত জল, সব তো আমার বাড়ির পাশ থেকেই যেত! পলতা ওয়াটার সাপ্লাই— বর্তমানে নাম হয়েছে ইন্দিরা গান্ধী ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। ইংরেজরা যখন এখানে এটা তৈরি করেছিল, তখন তারা সার্ভে করেছিল। সার্ভে রিপোর্টে বলা ছিল, কলকাতা থেকে ক্রমশ উত্তরের দিকে আসতে আসতে তারা দেখে পলতা এবং মণিরামপুরের মাঝখানে যে গঙ্গাটা রয়েছে, সেটা এত গভীর যে, এখানে কোনোদিন চর জমবে না। সুতরাং এখানেই ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটা হোক। যেটা এখনও রয়েছে, আপনারা জানেন। যেখান থেকে জল এখনো আমরা পাচ্ছি। কলকাতা, সল্টলেকে কিছু ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হওয়ায় এখানকার জল আর সেখানে পৌঁছোয় না, কিন্তু এখনো লক্ষ লক্ষ মানুষের জল এখান থেকেই যায়। কিছুদিন আগে পলতা-মণিরামপুর অঞ্চলেও কিন্তু বালি জমতে শুরু করেছে। এর কারণ আর কিছুই নয়, আমাদের যে কাজগুলো করণীয়, সেগুলো আমরা কিছুই করিনি। নদীর নাব্যতা তো আমাদের রাখতেই হবে। নদী যাতে বহমান থাকে, সেটা তো আমাদের দেখতেই হবে। নাহলে তো নদী মৃতপ্রায় হবে!

গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাস বহু বছর আগে একটা কথা বলে গেছিলেন, সেটা হচ্ছে ‘উই ক্যাননট স্টেপ ইনটু দি সেম ওয়াটার টোয়াইস’। একই নদীতে আমরা দুবার অবগাহন করতে পারি না। নদী প্রতিমুহূর্তে বয়ে চলেছে। এই মুহূর্তে যে নদীতে পা দিলাম, যেটা আর থাকল না, সেটা বয়ে চলে গেল। আমাদের কবির ভাষাতেও আমরা দেখেছি, ‘যে নদী হারায় স্রোত চলিতে না পারে/ সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে’। এই স্রোতটা যদি না থাকে, তাহলে তো নদী মরে যাবে। আপনি যে চরের কথা বললেন, চরের সঙ্গেও আমাদের এই সম্পর্ক রয়েছে। বালি যাতে না জমে, সেগুলোর জন্য আমাদের প্রচুর টাকাপয়সা খরচ করতে হবে। আর নদী যদি নাব্যতা হারিয়ে ফেলে, সেই নদী মৃতপ্রায়। বহু জায়গায় দেখবেন সেই ঘটনাই ঘটেছে। চর আমাদের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বহু জায়গায় জমেছে।


তন্ময়— প্রাচীন অনেক ঘাটই লুপ্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত। বেশ কিছু সংস্কারও হয়েছে; কিন্তু প্রশাসনের তরফে কি ঘাট ও তার ইতিহাস সম্পর্কে আরও যত্নশীল হওয়া উচিত?

কানাইপদ রায়— অবশ্যই। আমাদের উত্তর ২৪ পরগনার ঘাটগুলোর সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে কারখানা। কারখানা রাখতেই হবে মানুষের জীবিকার জন্য। পাশাপাশি কারখানার আবর্জনা যাতে জলকে দূষিত না করে, তার ব্যবস্থাও করতে হবে। নদীতে কারখানার জল মেশা আটকাতে অনেকগুলো প্ল্যান্ট করা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অনেক প্ল্যান্টই কিছুদিন পর আবার অকেজো হয়ে পড়েছে। সেগুলোর দিকে তো নজর রাখতেই হবে! নইলে এত কল-কারখানা, ইটভাঁটার দরুন জল দূষিত হয়ে যাবে। হতে বাধ্য।

নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র একটি সতর্কবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন— ‘যাঁরা গভীর শ্রদ্ধায় গঙ্গায় প্রতিদিন স্নান করেন, তাঁরা অনেকেই জানেন না এই নদীর জল বিষাক্ত। স্নানের অযোগ্য।’ তিনি দূষণ মাপার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন— ‘কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের নির্ধারিত মান অনুসারে যদি এক লিটার জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি হয়, জৈব রাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা ৩ মিলিগ্রাম বা তার কম হয় এবং ১০০ মিলিলিটার জলে কলিফ্রম ব্যাকটেরিয়ার সর্বোচ্চ সংখ্যা ৫০০ হয়, তবে সেই জল স্নানের যোগ্য। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অনেক নদীর জলই এই নির্ধারিত মাত্রার তুলনায় খারাপ।’ আর কল্যাণ রুদ্রের মতে, পলতা এবং দক্ষিণেশ্বর— এই দুটি অঞ্চলের জলও কিন্তু এই দূষিত জলের মধ্যেই পড়ছে। সুতরাং এটা আমাদের খেয়াল রাখতেই হবে।


তন্ময়— আবার ঘাটের আলোচনায় ফিরি। গুনে দেখেছিলাম, বর্তমানে উত্তর চব্বিশ পরগনায় দেড়শোরও বেশি গঙ্গার ঘাট রয়েছে। এর মধ্যে বহু ঘাটকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত। কখনো চৈতন্য, কখনো রবীন্দ্রনাথ এসে হাজির হন এইসব ঘাটের সূত্রে। ইউরোপীয় বণিকদের কথা বাদই দিলাম। আপনি দীর্ঘ তিন দশক ধরে উত্তর চব্বিশ পরগনা নিয়ে কাজ করে চলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই, ঘাট-কেন্দ্রিক বিভিন্ন কাহিনিও আপনার ইতিহাসচর্চারই অঙ্গ। আঞ্চলিক ইতিহাসের সঙ্গে ঘাটের সম্পর্ক আপনি কীভাবে দেখেন?

কানাইপদ রায়— এর উত্তর অল্প কথায় দেওয়া মুশকিল। বেশ-কয়েকটা তথ্যের উল্লেখ করতে হয়। আমাদের এই বারাকপুর মহকুমায় একটি ঘাট রয়েছে, যার নাম ‘কাঙালি ঘাট’। এই ঘাটটিতে এখনও কিন্তু পুরসভা কোনোরকম ট্যাক্স নেয় না। কারণ, বলা হয়, একটা নির্দিষ্ট পাটনি-পরিবার সনদ পেয়েছে ইংরেজদের কাছ থেকে, যার জোরে বংশপরম্পরায় এই ঘাটে তারা খেয়া পারাপার করবে, কিন্তু কোনো কর দিতে হবে না। এটা একটা ব্যতিক্রমী ঘাট। আরেকটি ঘাটের কথা এবার বলি। সেটি আমাদের জাতীয় ঘাট, গান্ধীঘাট। এখানে রাজা গোপালাচারী মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর কদিন পরে তাঁর অস্থি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, এটা হচ্ছে আমাদের মহাতীর্থস্থান। আমি দাবি রাখছি, এই ঘাট যেন ঐতিহ্যের ঘাট হয়ে দাঁড়ায়। রাজ্য ও কেন্দ্রের হেরিটেজ কমিটি যেন এটিকে একটি ‘হেরিটেজ ঘাট’ হিসাবে স্মরণ করে।

গান্ধীঘাটের পাশেই আরেকটা ঘাট রয়েছে, রানি রাসমণির নামে। তার পাশেই রানি রাসমণির মেয়ে জগদম্বাদেবী একটা মন্দির করে দিয়েছিলেন। অন্নপূর্ণা মন্দির। দেখলে মনে হবে, দ্বিতীয় দক্ষিণেশ্বর। সেই ঘাটের সঙ্গে একটি শ্মশানঘাটও রয়েছে। কেন এটার কথা বলছি? এই ঘাটের সঙ্গে এমন একটা ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে, যা আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে দেয়। তখন কার্গিলের রাজৌরি সেক্টরে যুদ্ধ চলছে। আমাদের বারাকপুরের বীর সন্তান, শেখর ঘোষ, রাজৌরি সেক্টরে লড়াই করছেন। কয়েকদিন পরেই রাখি উৎসব। তাঁর বোন এখান থেকে রাখি তৈরি করে পাঠিয়ে দেয়, যাতে দাদা কোনো একসময় রাখিটা হাতে বেঁধে নেয়। কিন্তু বোনের রাখি পরা তাঁর আর হয়নি। পাক হানাদারদের গুলিতে তিনি নিহত হন। তারপর তাঁর দেহ আসা হয় রানি রাসমণি শ্মশানঘাটে। সেখানেই তাঁর বোন আরেকটি রাখি বেঁধে দেয় এই শ্মশানঘাটে এসে। এবার ভেবে দেখুন তো দৃশ্যটা!

আমাদের এই ঘাটগুলোর কী অদ্ভুত জিনিস জানেন? চাঁদ সদাগর আমাদের এই বারাকপুরের ঘাট ধরেই কিন্তু গেছেন বাণিজ্যযাত্রায়, নৈহাটি থেকে শুরু করে বরাহনগরের পুরো পথটাই চাঁদ সদাগরের যাত্রার মধ্যে পড়ে। শুধু তাই নয়, শ্রীচৈতন্য— তিনিও কিন্তু এই ঘাট ধরেই তাঁর যাত্রা করেছেন। কাজেই এই ঘাটগুলো— প্রত্যেকটি ঘাটই আমি বলব— প্রত্যেকটি স্রোতের সঙ্গেই যেন চৈতন্যের নাম, চাঁদ সদাগরের নাম, প্রাচীন লোককথা ও কাহিনি জড়িয়ে আছে। আমাদের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্য এটাই। সেজন্যেই বলছিলাম, এরকম ঘাট পাওয়া কিন্তু খুব মুশকিল ভারতে।

আরেকটা ঘাটের কথা বলতেই হয়— পানিহাটির। বালক রবীন্দ্রনাথ পানিহাটি গঙ্গার ঘাটের সিঁড়িতে বসে থাকতেন। এই গঙ্গার ঘাট নিয়ে ‘পুনর্মিলন’ নামে তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন বহু বছর আগে। তিনি বলেছিলেন, এই গঙ্গার ঘাট থেকে আমি অখণ্ড ভারতের ছবি দেখেছি। ভাবুন তো, আমাদের বারাকপুর মহকুমার পানিহাটি ঘাট থেকে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, অখণ্ড ভারতের ছবি আমি দেখেছি! নিজে লিখেই গেছেন এ-সমস্ত কথা তাঁর বইয়ে। এও তো বড়ো পাওনা আমাদের!

(পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব)

অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
স্কেচ - অমর্ত্য খামরুই

Powered by Froala Editor