চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৫৫ সালে, কলকাতায়। অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা। নব্বইয়ের দশক থেকে সংগ্রহ করছেন পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের গোয়ালপাড়া-শিলচর এলাকার মেয়েদের বিভিন্ন গান। কথা ও সুর সংরক্ষণ করছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে। বর্তমান ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর প্রথম বই ‘নারীর গান শ্রমের গান’-কে (প্রকাশসাল ২০২২) কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে চন্দ্রার সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ প্রথম পর্ব...
তন্ময়— নারীদের গান নিয়ে এই যে আপনার কাজ—অদ্যবধি প্রায় ছ-হাজার গান সংগ্রহ করেছেন—কবে ও কীভাবে এই খোঁজ শুরু হল? কোন পরিকল্পনা ছিল এর আড়ালে?
চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়— প্রথমে কোনো পরিকল্পনা আমার প্রাথমিকভাবে ছিল না, কারণ এরকম জিনিস আছে বলে আমরা কেউ-ই জানতাম না সম্ভবত। এমনি গান শেখা বলতে যেটা বোঝায়, ছোটোবেলা থেকে ইচ্ছে থাকলেও সেটার সুযোগ হয়নি। অনেক পরে, বড়ো হয়ে আমি গান শিখতে শুরু করেছি। যেমন প্রথাগতভাবে সবাই শেখে, সেভাবেই প্রথমে মার্গসঙ্গীত এবং পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীত। এসবই চলছিল। কিন্তু অন্যান্য পড়াশোনা থেকে মনে হচ্ছিল যে-গানের চর্চা আমরা সাধারণভাবে করি, সেখানে সাধারণ মানুষের সাধারণ কথাগুলো প্রতিফলিত হয় না। পঞ্চকবির গানে তো আমরা পাই-ই না সেভাবে। আমার ছোটোবেলা, মানে একটু বড়ো হচ্ছি যখন, সেটা সত্তরের দশক। সেই সময়টায় এত বেশি রাজনৈতিক উথালপাথাল চলেছে, একইসঙ্গে নানানরকম প্রশ্ন আসছে আমাদের মধ্যে। সেইসঙ্গে যখন নাটকগুলো দেখছি—বিজন ভট্টাচার্যের নাটক, বা অন্যান্য পড়াশোনা করছি, সেখান দেখছি একটা অন্য জীবন। গ্রাম জীবন আসছে, তার সংস্কৃতি আসছে, কিন্তু সেভাবে তার গান আমরা জানছি না। তো অন্যান্য পড়াশোনাগুলো যখন করছি, তখন একটি বই বলা যেতে পারে আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। সেটা হচ্ছে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোকায়ত দর্শন’। সেখানে দেবীপ্রসাদ লিখছেন, উপনিষদেরও আগের যুগে মানুষ অন্নের জন্য গান গাইত। অন্ন বলতে ভাত। যার জন্য কিন্তু উপনিষদে অন্ন নিয়ে অনেক শ্লোক আছে। যেগুলো পরে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় আমরা পেয়েছি যে ‘অন্ন বাক্য, অন্ন প্রাণ, অন্নই চেতনা।’ যখন আমি এগুলো পড়ছি, তখন আমার মনে হয়, এই পরম্পরার কোনো অবশেষ কি এখনও কোথাও আছে? সেইটা থেকেই ওপর ওপর একটা ধারণা নিয়ে আমি খোঁজ শুরু করি এবং আমি সরাসরি না-গেলেও আমরা বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করি যে, এ-ধরনের গান কি আছে?
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — প্রথম পর্ব
তন্ময়— এটা কি সত্তরের দশকেই?
চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ, সত্তরের দশকেই। এটা ধরুন ’৭৫ সাল নাগাদ। এই সময়েই আমরা এই খোঁজগুলো শুরু করি। আর ওই বইগুলো পড়াও সেই সময়েই। ’৭৪-’৭৫-এর শুরুতেই। আর তার আগে রবীন্দ্রনাথ পড়ে একটা অন্য একটা ভাবনার গতি তৈরি হয়েছিল। যেমন ধরুন, ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ পড়েছি, যখন আমরা ক্লাস নাইনে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন আমরা নৃতত্ত্ব পড়ি, কিন্তু আমাদের চারপাশে যে-সকল জনগোষ্ঠী আছে, আমরা তাদের খোঁজ করি না। ম্যালেরিয়া আক্রান্ত যে-শিশুটিকে নিয়ে মা বসে আছে, আমরা কিন্তু তার খোঁজ করি না। পল্লি-সংস্কার, পল্লি-সংস্কৃতি— এগুলো নিয়ে তো রবীন্দ্রনাথের লেখা আছেই। তার ওপর দেবীপ্রসাদের বইটা পড়ে আমার মনে হয়েছিল যে দেখি, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিটা কী এবং কেন?
বিজনবাবু বলেছিলেন, তোমরা যদি এটাকে ভালো করে জানতে চাও, তবে খালেদের কাছে যাও। মানে খালেদ চৌধুরী। প্রচ্ছদশিল্পী এবং মঞ্চশিল্পী হিসাবে যাঁর খ্যাতি। তো আমরা যখন খালেদদার কাছে গেলাম, তখন জানলাম উনি সুরের জগতেরও একজন বিশারদ। উনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতটা খুব ভালো জানতেন। এর পাশাপাশি আমাদের পল্লি-সংস্কৃতি বা লোকসংস্কৃতি—সেইটা যে হারিয়ে যাচ্ছে, প্রচুর ভেজাল আসছে—এটার জন্য ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, খালেদ চৌধুরী এবং নীহার বড়ুয়া— এই তিনজন মূলত এবং এর সঙ্গে আরও কিছু গুণীজন মিলে ‘ফোকলোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ তৈরি করেন। যাঁরা অবিকৃতভাবে সুরগুলোকে ধরে রাখার চেষ্টা করতেন। খালেদদা আমাদের অনেককিছু বোঝালেন। ওঁর সঙ্গে কথা বলে অনেক কিছু জানতে পারলাম। কিন্তু গান শেখার সুযোগ ছিল না। আইপিটিএ-এর সময় বৃষ্টির মধ্যে গান গাইতে গাইতে খালেদদার গলাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বললেন, ‘আমি তো গাইতে পারি না, তুমি যদি শিখতে চাও তবে মৃণালের কাছে যাও।’ মৃণাল বড়ুয়া পেশাগতভাবে একজন মনোচিকিৎসক। গৌরীপুর গোয়ালপাড়ার প্রমথেশ বড়ুয়ার নাম তো আমরা সবাই জানি, উনি ওই একই পরিবারের মানুষ। সারা সপ্তাহ ডাক্তারি করতেন এবং রবিবার রবিবার যে-ই আসেন, তাঁকে তিনি গোয়ালপাড়িয়া গান শেখান, দেশের গানটা থাকবে বলে, সবাই জানবে বলে। তো একদিন উনি একটা গান শিখিয়ে বললেন, এটা মুসলমান মেয়েদের বিয়ের গান। সেই গানটা ভাবগত দিক থেকে সুরগত দিক থেকে, মেয়েদের যে-চিত্র আমরা শুনি—সেখান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এবং মুসলমান মেয়েরা আরও রক্ষণশীল, তাঁদের গান গাওয়াতেও নিষেধ—তো এগুলো নিয়ে যখন আমি ওঁকে প্রশ্ন করি, উনি বলেন, ‘দেখো আমি শুধু গানটা জানি। এত কিছু জানি না। যদি তুমি এগুলো জানতে চাও, তাহলে আমার মায়ের কাছে যাও।’ এই বলেই উনি আমাকে পাঠালেন নীহার বড়ুয়ার কাছে, যিনি হেমাঙ্গ বিশ্বাস, খালেদ চৌধুরীর সঙ্গে ইনস্টিটিউটটা তৈরি করেছিলেন।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — দ্বিতীয় পর্ব
নীহারদির কাছে যেতে শুরু করলাম। বিকালে ওঁর থেকে ভাওয়াইয়া, চটকা ইত্যাদি গোয়ালপাড়িয়া গান শিখতাম আর দুপুরবেলায় মাসিমার কাছে যেতাম, মেয়েদের গান শিখতে। তো আমার এই কর্মকাণ্ডে নীহারদির একটা বড়ো ভূমিকা আছে বলা যেতে পারে। কারণ, নীহারদি হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি রাজপরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও এই গানগুলো ছোটোবেলা থেকে শুনেছেন, ভালোবেসেছেন এবং লুকিয়ে লুকিয়ে বা খানিকটা শাসনকে উপেক্ষা করেও বাড়ির পরিচারিকা যাঁরা, তাঁদের থেকে গানগুলো শিখতেন, নাচতেন তাঁদের সঙ্গে এবং গানগুলো লিখে রাখতেন। ফলে ১৯২০-এর দশকে, যখন এগুলো নিয়ে কোনো চর্চাই হয়নি, তখন থেকে নীহারদির সংগ্রহ। পরে ওঁর বাবা, প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়া— তাঁকে বলেছিলেন নিম্নবর্গের এই গানগুলো শুনে দেখতে। মানে আমরা যে আজকে ভাওয়াইয়া গান শুনতে পাচ্ছি, সেগুলোর পিছনে নীহার বড়ুয়ার একটা বড়ো ভূমিকা আছে। করিদুল্লাহ শেখ এবং বয়ান শেখ নামের দুজনকে ডেকে এনে উনি ওঁর জমিদার বাবাকে এই গানগুলো শুনিয়েছিলেন। এবং তিনিও খুবই সঙ্গীতজ্ঞ মানুষ ছিলেন। বলেছিলেন, তোমার এই গানের চর্চা করো। ফলে আজকে যে ভাওয়াইয়া আসছে, শুনছে যে গান, তার পিছনে বড়ুয়া পরিবারের কিন্তু একটা বিশাল ভূমিকা আছে।
যাই হোক, আমি যখন নীহারদির কাছে গিয়ে বললাম যে মেয়েদের গান—এই ব্যাপারটা কী? বললেন, ‘হ্যাঁ, মেয়েদের গান তো আছে আমাদের ওখানে। শুধু মুসলমান নয়, হিন্দুদের মধ্যে আছে, মাছুয়া, রাজবংশীদের মধ্যেও আছে। ওখানকার যত জনগোষ্ঠী আছে, সেখানে মেয়েদের মধ্যে গান গাওয়ার একটা প্রচলন আছে। যেটাকে আমরা বলি ‘বেটি-ছাওয়ালি গান’। মানে মেয়েলি গান। তখন তো ক্যাসেট রেকর্ডার বা এইসব প্রযুক্তি ছিল না। আমি নীহারদির কাছে গিয়ে বসে বসে গান শিখতে শুরু করলাম। দেখেছি, নারী ইতিহাস বলতে আমরা যা বোঝাই, আমরা যা কিছু পড়াশোনা করছি—তখন ‘এক্ষণ’-এ বিভিন্ন আত্মজীবনীগুলো বেরোতে শুরু করেছে—উনিশ শতাব্দীর পর থেকে যাঁরা ডায়েরি লিখেছিলেন, বই লিখেছিলেন—তাঁদের লেখায় আমরা যে-নারীত্বের বিবরণ পড়ছি, পরবর্তীতেও কল্যাণী দত্তের লেখা ‘থোড়-বড়ি-খাড়া’, ‘পিঞ্জরে বসিয়া’ যখন পড়ছি— সেখানে যে-সব মেয়েদের দেখছি তাঁরা নিপীড়িত, বঞ্চিত, মুখ ফুটে কথা বেরোয় না, পরনির্ভর, অত্যাচারিত। কিন্তু আমি দেখলাম, এই মেয়েরা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। তারা তাদের যে-কোনো কথা স্পষ্টভাবে বলে। প্রায় স্বাধীনভাবেই জীবন কাটায়, রোজগার করে, বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত— হাটে যাচ্ছে, বাজারে যাচ্ছে, কোনো পর্দাপ্রথা কোথাও নেই। ফলে গানগুলো শিখতে শিখতে আমার এই বিষয়ে একটা আগ্রহ তৈরি হল। কিন্তু শিখতে শিখতে বছর তিন-চারেক পরে নীহারদি ফিরে গেলেন ওঁর অসমের বাড়িতে। ফলে আমার গান শেখা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু ব্যাপারটা আমার ভেতরে ঢুকে গেছে তখন। এই গানটা যে অন্যরকম এবং এর একটা অন্যরকম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, সেটা আমি বুঝেছি। কিন্তু কী করব, কোথায় যাব, সারা বাংলায় পাব কিনা—এসব কিছুই জানি না। আমি শুধু জানি গোয়ালপাড়ায় আছে। তারপরে গানটা যখন একটু একটু চালাচ্ছি, তখন মৃণালদার সূত্রেই আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রণেন রায়চৌধুরীর। ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে যাঁর প্রচুর গান আছে। রণেনদার কাছে আমার গান শেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। ওঁকে আলাদা করে বলিনি যে মেয়েদের গান শিখতে চাই, কিন্তু ওঁর কাছে যে-সব গান শিখছিলাম, তার মধ্যে একটা-দুটো জল-ধামাইল আছে, ‘বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না’ আছে— তখন কেউ জানত না আমি রণেনদার কাছ থেকে পরে বীণাপাণি রায়চৌধুরী— আরেক দিদি, তাঁর কাছেও ভজন শিখতাম। কিন্তু সেখানেও একটা-দুটো করে গান শিখেছি। বলতাম, ‘এরকম কোনো গান আছে দিদি? আপনাদের সময় বিয়ের অনুষ্ঠানে গান হত দিদি?’ এভাবেই দু-একটা গান শিখেছি।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: বিশ্বজিৎ রায় — প্রথম পর্ব
তারপর আমি যে-স্কুলটায় চাকরি পেলাম, নব্বইয়ের দশকের একদম শুরুতে, সেই স্কুলটা ছিল একটা উদ্বাস্তু পল্লিতে। স্কুলটার নামটা একটু অদ্ভুত। খলিসাকোটা আদর্শ বিদ্যালয়। তো আমি পড়ানোর সূত্রেই প্রথমে যেটা করি—অঞ্চলটাকে বোঝা, মেয়েদের বোঝা—এর জন্য ওদের জিজ্ঞাস করি বা দিদিদের জিজ্ঞেস করি ‘খলিসাকোটা’ নামটা কেন? তো সেটা ওরাও বলতে পারল না, দিদিরা বলতে পারলেন না। তারপর ওদের বাড়িতে গিয়ে গুরুজন বা বয়সে বড়ো যাঁরা আছেন তাঁদের জিজ্ঞেস করতে বললাম বিষয়টা জানেন কিনা। সেখান থেকে উঠে এল, খলিসাকোটা বরিশালের একটা গ্রাম। বরিশালের যে-মানুষজন উঠে এসেছিলেন এখানে, তাঁরা তাঁদের স্মৃতিটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এমন নামকরণ করেছেন জায়গাটার।
তন্ময়— স্কুলটা কোন জায়গায়?
চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়— এটা বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাশেই। বিরাটির কাছে। যাইহোক, এই প্রথম আমি জানলাম উদ্বাস্তু কলোনিটার সম্বন্ধে। তখনো আমি গানের ব্যাপারটা জানি না। এর আরও ৪-৫ বছর পরে, প্রায় ’৯৬ সাল নাগাদ, আমি পড়াতে পড়াতে—আমি দোতলায় পড়াচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি ঢোল বাজছে আর একটা সুর আসছে। আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম কী হচ্ছে। তো আমাকে বলল, ‘দিদি ওদের বাড়িতে একটা বিয়া ছিল, তাই জল নেওয়ার জন্য গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে।’ তখনই মনে হল, আরে এই জিনিসই তো আমি শুনেছি। জল আনতে যাওয়ার জন্য গান গাইতে গাইতে যায়। তাহলে এখানে এটা পাওয়া যাবে। আমি মেয়েদের বললাম, বিয়েটা মিটে গেলে যাঁদের বাড়িতে বিয়ে ওখানে আমাকে একটু নিয়ে যাবি। তো আমি স্কুলের ছাত্রীদের মাধ্যমে এবং এই এলাকার মাধ্যমে আমি সেখানে গিয়ে প্রথমে আমি ঢাকার মহিলাদের পেলাম, পাল পরিবার, মৃৎশিল্পী তাঁরা। দেশ ছেড়ে তো এসেছেন সকলেই। সকলে চর্চাটা রাখেন না। তবে এঁরা কেউ কেউ তখনো এই গানগুলোর চর্চাটা রেখেছেন। সেখান থেকেই আমার নিজস্ব সংগ্রহ শুরু হল এবং সেটা সম্পদ বলে মনে হল। মনে হল, শিক্ষকতার পাশাপাশি যদি আমি এই কাজটা করতে পারি, তাহলে একটা মেয়েদের ইতিহাস বলুন, সমাজের ইতিহাস বলুন, সুরের ইতিহাস বলুন— প্রত্যেকটা জায়গায় এগুলো দরকার হবে। নীহারদির পর্বটা যদি আমার প্রথম পর্ব হয়, তবে ওই ’৯৬-’৯৭ সাল থেকে আমার দ্বিতীয় পর্বের শুরু। স্বাধীনভাবে কাজ করার শুরু।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: বিশ্বজিৎ রায় — দ্বিতীয় পর্ব
ওখানে ঢাকার পরিবার পেলাম। তারপর তাঁদের আত্মীয় ফরিদপুরের পরিবার। সেখানে গেলাম। এই করতে করতে গোটা বাংলাটাই ঘোরা হয়ে গেছে। অবশ্য সেটা পশ্চিমবঙ্গ। আমি বাংলাদেশে যাইনি। এবং এই উদ্বাস্তু যে-পরিবারগুলোকে পেয়েছি, তাঁদের পরিজনেদের পেয়েছি, সেটা থেকে বলা যায় বাংলাদেশের প্রায় সব জেলার গান এখন আমার কাছে আছে। এবং এই গানের সূত্রতেই কিছু ফারাক আমি পাচ্ছিলাম। যেমন, সিলেটের গান নিয়ে। নবাদর্শ বলে একটা কলোনি আছে এখানে, ওখানে শুধু সিলেটিরাই থাকেন। ওখানে এক মাসিমাকে পেয়েছিলাম যিনি তখনো সূর্যব্রত করেন। সিলেটিদের সূর্যব্রত মানে কিন্তু ভোরবেলায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত—ভোরবেলায় একবার সূর্যকে আরতি করা হবে, আর সন্ধ্যার সময় আরেকবার আরতি করা হবে। আর এই গোটা সময় ধরে যে সূর্যের ব্রতটা হবে, তখন কিন্তু মেয়েরা বসবেন না। তাঁরা কী করবেন? ওই ধামাইল নাচ আর গান। কৃষ্ণের জন্ম থেকে শুরু করে কৃষ্ণের বড়ো হওয়া—পুরোটা তাঁরা নাচে-গানে ফুটিয়ে তোলেন। সেইগুলো আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল, সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই সবকিছুই আমার সংগ্রহে আছে। তারপর যেটা হয়েছে, এপার বাংলার এবং ওপার বাংলার এবং ওই সিলেটের গানের মধ্যে কিছু কিছু জটিলতা দেখা দিচ্ছিল। আসলে যাঁদের পেয়েছিলাম তাঁরা সকলেই প্রায় উচ্চবর্ণের মানুষজন এখানে। পুরুষরা লিখে দিয়েছেন, কিছু এমন গানও আছে। তো আমি তখন বললাম যে গ্রামের মেয়েদের কোথাও পাব? আমাকে ওঁরা বললেন, শিলচর ছাড়া সিলেটের গ্রামের মেয়েদের আমি পাব না। তো শিলচর যতদিন আমি না-গিয়েছি—সেটা ২০১৮ সাল হয়ে গেছে আমার শিলচরে ঠিক ঠিক জায়গায় পৌঁছাতে—সেইটা দিয়ে আমার বৃত্তটা শেষ হয়েছে। গোটা বাংলাটাকে আমি জানি এটা বলতে পারব আজকে।
শিলচরে যাওয়ার পর কিন্তু আমি গান প্রকাশ্যে আনতে শুরু করেছি। আমি প্রথম ইউটিউব চ্যানেল খুলি। লেখার দিকে যাইনি কখনো তার কারণ গান মানে সুর-সহ গান। প্রচুর বই বেরোয়, যেখানে টেক্সটটা শুধু তুলে দেওয়া হয়, সুরের কোনো ব্যাপার থাকে না। কিন্তু সুর তো ভাবটা প্রকাশ করে না? সুর, তাল—এগুলো না-থাকলে গানটা গানই নয়। প্রথমে আমি যে-চ্যানেলটা খুলি, সেটা আমার ছাত্রীরাই খুলে দিয়েছিল। ওরাই ভিডিও করেছিল। ওরাই আপলোড করে দিয়েছিল। আমার প্রথম ভিডিওটা হচ্ছে একটা ১ ঘণ্টার ভিডিও। যেটাতে আমি পুরো ব্যাপারটার একটা নির্যাস তৈরি করে দিয়েছিলাম। বিভিন্ন অঞ্চলের গান, বিভিন্ন ধরনের গানের কথা নিয়েই এই ভিডিওটা যখন দিই, তখন মানুষ বিষয়টা সম্পর্কে জানতে পারেন। বহু মানুষের কাছ থেকে সাড়া পাই এবং তাঁরাই আমাকে বলেন লিখুন দিদি। তারপর আমি পত্রপত্রিকায় লিখি, ‘এইসময়’, ‘রবিবাসরীয়’-তে অনেক লেখা বেরিয়েছে, ‘প্রতিদিন’, ‘অনুষ্টুপ’-এ বেরিয়েছে। কিন্তু লেখা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলে তো বেশিদিন থাকবে না। অনেকেই অনুরোধ করলেন, দিদি একটা বই করো। তো সেই হিসাবেই আমার প্রথম বইটা এসেছে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: অলোক সরকার — প্রথম পর্ব
তন্ময়— সাম্প্রতিক অতীতে ভাইফোঁটা নিয়ে একটা কাজ করেছিলাম। সেই সূত্রে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় প্রচলিত মন্ত্র উদ্ধার করেছি, এ-পারে চলে আসা মানুষদের কাছ থেকেই। যে-সমস্ত প্রজন্ম এপারে এসেছিলেন, তাঁদের স্মৃতি অক্ষুণ্ণ হলেও, আস্তে আস্তে যত প্রজন্ম এগোচ্ছে, কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের ভাষাভঙ্গি ও আচার মিশে যাচ্ছে। ওপার থেকে নিয়ে আসা রীতিনীতি, মন্ত্র, এমনকী উচ্চারণও হারিয়ে যাচ্ছে। আপনিও কি কাজ করতে গিয়ে এই প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন? প্রশ্নটা অন্যভাবেও করা যায়। আপনি নব্বইয়ের দশক থেকে সংগ্রহ শুরু করেছেন। এখনই, বা আরও ১০-২০ বছরের মধ্যে আরও একাধিক প্রজন্ম শেষ হয়ে যাবে, যারা হয়তো ওই সংস্কৃতির শেষ ধারক। তখন এই জিনিসগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে? এগুলো কি আর পাওয়া সম্ভব হবে তখন?
চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়— প্রথমত, বেশিরভাগটাই আর পাওয়া যাবে না—এমনই একটা সম্ভাবনা রয়েছে। কেন-না, আমি যে প্রভা মাসিমার কথা বললাম, যিনি সূর্যপুজো করতেন, তিনি তো এখন আর নেই। আর তো কেউ করে না ওখানে। ফলে পরবর্তী যে-প্রজন্ম আসছে তারা এইগুলোতে খুব একটা আগ্রহী নয়। এই সংস্কৃতিগুলোকে ধরে রাখতে আগ্রহী নয়। এবং তাদের পক্ষে এটাকে ধরে রাখাটা সম্ভবও নয়। কারণ, এই যে-সংস্কৃতি, তার সঙ্গে জল-মাটি-বাতাস এত বেশি মিশে আছে—সেই জল-মাটি-বাতাস যদি বদলে যায়, তাহলে কেউ প্রাণের ধন হিসাবে আগলে রাখতে পারে, কিন্তু পরের প্রজন্মের কাছে তো সেটা প্রাণের ধন থাকছে না। কারণ তারা ওই জল-মাটি-বাতাসে বড়ো হয়নি। ফলে এটা এদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে। যাঁরা এখনও বাংলাদেশে আছেন, আমি জানি না তাঁরা কতটা কী রাখছেন। কিন্তু এখানে যাঁরা চলে এসেছেন তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম কিন্তু রাখছে না।
আরও একটা কথা বলার। আমার যা সংগ্রহ, সেটা তো শুধু ও-পারের গান নয়, এ-পারের গানও আছে। এ-পারের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকমভাবে নানা পুজো, উৎসব নিয়ে বহু গান আছে। সেগুলোও কিছুটা কিছুটা থাকবে, কিছুটা আবার থাকবেও না। এই কারণে বলছি, কেন-না বাঁকুড়ার শুশুনিয়া আমার পাঁচবার-ছবার ধরে গেছি, এবং বারে বারে আঁচল ভরে নিয়ে এসেছি জিনিসপত্র। কিন্তু এবারে—শেষ গিয়েছিলাম ’১৪-’১৫ সাল নাগাদ—তারপর আবার দীর্ঘদিন বাদে তিন মাস আগেই গিয়েছিলাম আবার। তো সেই দিদিরা বিগত ৮-১০ বছরে আরও একটু বয়স্ক হয়েছেন, ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তো এবারে গিয়ে দেখলাম, যাঁর কাছে মূলত যাই—ঝর্নাদিদি, তিনি ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, বৌমা গান-টান করে? বললেন, এখন আর কেউ করে না। এখন সবাই মোবাইল দেখে। ব্যাপারটা হচ্ছে, যেটা ওপারের নয়, এপারেরই জিনিস, সেটাও যে পুরোটা থাকবে তার সম্পূর্ণ বৈভব নিয়ে— সেটা কিন্তু বলা যায় না। তবে নিশ্চয়ই আরও কিছুদিন থাকবে। যদি জ্ঞানচর্চার দিকে এটা কোনো মূল্য থাকে, সেই জন্যই সংগ্রহ করে রাখাটা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: অলোক সরকার — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— দীর্ঘদিন ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, নারীর শ্রমকে অস্বীকার করার একটা ট্র্যাডিশন চলেছেই। এই বই তার বিপরীতে অবস্থান করে। এ-বই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, প্রান্তিক সমাজের নারীরা কীভাবে শ্রমের মধ্যে প্রবলভাবে নিয়োজিত রয়েছেন। নারীর শ্রমের জয়গানের বিষয়টি কতটা তাৎপর্যপূর্ণ? আমাদের সমাজের যে পুরুষতান্ত্রিক ঐতিহ্য—হয়তো শহরকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলালেও, গ্রামগঞ্জে এখনো মুক্তচিন্তাটা আসেনি— সেখানে এই অন্তঃসলিল সংস্কৃতি এবং কর্মের স্রোত কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়— এইটা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলেই প্রথমে এই বিষয়টা নিয়ে বই করার কথা ভাবলাম। এবং বইটা করতে গিয়ে দেখলাম, আমরা ভাবছি আমরা মুক্তচিন্তার মানুষ। কিন্তু মোটেই সেটা না। জ্ঞানচর্চায় যাঁরা খুব এগিয়ে আছেন—ধরুন, আমার বইয়ের ইন্ট্রোডাকশনে সেটা আছে যে, অ্যামেরিকান ন্যাশনাল লাইবেরি বা লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস যেটাকে বলে, ওয়ার্ক-ফ্রম-হোমের কারণে বিভিন্ন সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে বলে, সেগুলো প্রিজার্ভ করার জন্য তাঁরা বিভিন্ন সংগ্রাহকদের পাঠাচ্ছেন। তাঁরা মেয়েদের কাছে যাচ্ছেন না। মেয়েদের লেবারকে কি লেবার বলা যায়? মেয়েদের ওয়ার্ককে কি ওয়ার্ক বলা যাবে? অর্থাৎ, এই সমস্যা পৃথিবী জুড়েই। শুধু আমাদের দেশে নয়। মেয়েদের কাছে যাওয়া হল না, তাই মেয়েদের কণ্ঠস্বরটা নেই। এবার আমরা বলব মেয়েদের তো কোনো সৃজনক্ষমতাই নেই! এটা বলাটা খুব সোজা। কারণ দৃশ্যমান নয় তারা। কিন্তু দৃশ্যমান করতে যাওয়ার পথেই যদি বাধা দেওয়া হয়, তারা তাদের কথা বলতেই পারে না—এটা হচ্ছে কিন্তু শহুরে সংস্কৃতি। মুক্তমন আদৌ নয়। এখানে শুধু পুরুষতন্ত্র বলব না, আমার কাছে আরও অনেক তন্ত্র কাজ করে। সেখানে নগরতন্ত্র রয়েছে, পুথিগত বিদ্যার আধিপত্যতন্ত্র—সেটাও আছে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — প্রথম পর্ব
আমি আমার ক্ষোভের জায়গা থেকে বলছি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীবিদ্যাচর্চার কেন্দ্র শুরু হয়ে গেছে তিরিশ বছর আগে। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীবিদ্যাচর্চা করেন যাঁরা, তাঁরাও তো এই কাজটা করেননি! আমাদের যে ঔপনিবেশিকতার মনোভাব, তা আজকেও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কে বলেছে শহরে মুক্তচিন্তা রয়েছে? নেই। মুক্তচিন্তার পরিসর নেই। বরং গ্রামে আছে। কেন-না মায়েদের এই শ্রমের মূল্য তাঁদের পাশাপাশি পুরুষেরা দেন। না-হলে সংসারটা চলবে না, সেটা তাঁরা খুব ভালো করে জানেন। এবং এখানে একটা লেখার কথা আমি আপনাকে বলি, অমর্ত্য সেন এবং জঁ দ্রেজের একটা প্রবন্ধ পড়ছিলাম। প্রবন্ধটার নামই হচ্ছে, ‘জেন্ডার ইনইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড উইমেনস এজেন্সি’। সেখানে সরাসরি স্ট্যাটিস্টিক্স দিয়ে দেখাচ্ছেন, সম্পদ যেখানে কম, সম্পর্ক সেখানে নিবিড়। দুজন না-থাকলে, সংসারটা সেখানে চলে না। ফলে তাদের মধ্যে সম্পর্ক অনেকটাই বন্ধুত্বের।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: স্বপনকুমার ঠাকুর — দ্বিতীয় পর্ব
এটাকে আমি বারে বারে বলেছি, দেখিয়েছি। স্বামীর সঙ্গে নারীর সম্পর্কটা অনেক সময়—‘কোলের স্বামী’, ‘আদরের স্বামী’। অগ্রণী সমাজে যখন স্বামীকে বিয়ের সময় জিজ্ঞেস করা হয় কোথায় যাচ্ছ, তখন বলে ‘দাসী আনতে যাচ্ছি’। এটাকেই যদি প্রান্তিক সমাজের যদি গানের মধ্যে দেখি, ‘কোথায় যাচ্ছ?’— বরকে জিজ্ঞেস হচ্ছে, সে বলছে, ‘বিছানার দোসর নাই, কথারও দোসর নাই।’ দোসর, বন্ধুত্ব। বন্ধু আনতে যাচ্ছি। কথা বলার দোসর এবং বিছানার দোসর। এই সম-মনস্কতা। কারণ, অনেক কিছুর ক্ষেত্রে মেয়েদের ওপর নির্ভর করে এখনও কৃষি সমাজ। কৃষি সমাজে মেয়েদের ভূমিকা অনেকটা আলাদা। যেটা বই এবং ইতিহাসও কিন্তু স্বীকার করে। ‘আর্যাসপ্তশতী’ কিন্তু সেই লক্ষ্মণ সেনের আমলে লেখা। সেখানে কিন্তু বলছে, কৃষক রমণীরা স্বাধীন। যে-কথাটা তাঁরা বলেন, যে-সিদ্ধান্ত তাঁরা নেন, সেটা একান্তই নিজস্ব। তাঁরা যেটা বোঝেন, সেটা করেন।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — প্রথম পর্ব
ফলে পুরুষতন্ত্র বলতে শুধু পুরুষতন্ত্র নয়, এখানে আরও অনেকগুলো তন্ত্র কাজ করে। এখানে পুথিবিদ্যার আধিপত্য বোধ কাজ করে, যে আমার ডিগ্রি আছে। আমরা পাশ্চাত্য দর্শনের খোঁজ রাখব কিন্তু আমার পাশের ঘরে ঠাকুমা কী করছেন তার খোঁজ রাখব না। এখানে শহুরে তন্ত্রও একটা আছে, নাগরিক তন্ত্রও আছে। ধরুন নিম্নবর্গের ইতিহাস যে লেখা হয়েছে, সেখানে নারীকণ্ঠ কোথায় আছে? এত তো বড়ো বড়ো ঐতিহাসিকরা কাজ করলেন, ক-জন নারীকণ্ঠ সেখান থেকে বেরিয়ে এল? আর গায়ত্রী চক্রবর্তী প্রশ্ন তুললেন, ‘ক্যান দ্য সাব-অলটার্ন স্পিক?’ ইয়েস। তারা তো কথা বলে। আমাদের শোনার সময় নেই। কে বলেছে তারা কথা বলতে পারে না? আমরা তো মিশিইনি তাদের সঙ্গে সে-কাজে। রাজনীতিটাও কিন্তু তলার দিকে ঠিক মতো যায়নি। সঙ্গে অন্য তন্ত্রগুলো তো আছেই! আমরা তাদের হিসাবের মধ্যেই আনিনি। আমি সেটা পাশ্চাত্য শিক্ষারই প্রভাব বলব। এবং সেই প্রভাব কুপ্রভাব— যেটা আমার নিজের ঘরকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। ফলে এই বইয়ের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। কেন-না জাতিসংঘ যে-রিপোর্ট বার করে, সেখানে বারে বারে বলছে, ইনভিজিবল গিফট ওয়ার্ক— সেটার দাম কত হতে পারে? ১০% + ৩৯%, যদি জিডিপিতে যোগ হত। এর মধ্যে রয়েছে মেয়েদের ঘরের সেবা এবং কাজ। সেটা ম্যানুফ্যাকচারিং-এর থেকে, ট্রান্সপোর্টের থেকে, কমার্সের থেকেও বেশি। এটা একটু একটু করে তো আমরা করছি। নারীশ্রমকে উপেক্ষা করা কতটা ভুল, সেটা কোনো-একদিন সমাজ বুঝবে। যার জন্যই আমি প্রথম বইটা নারীশ্রমের ওপর করেছি। কারণ, এত কাজ করছে তারা। এবং এখনকার যা রিপোর্ট আসছে—পুরুষরা যদি সংসারের কাজ ২৫ মিনিট করে, মেয়েরা করে ২৪৫ মিনিট। ফারাকটা যেখানে এতটাই, সেখানে সেই কাজের একটা গুরুত্ব তো থাকা উচিত। এবং মেয়েরা সেই কাজের গুরুত্ব দিয়েছেন বলে, তাঁরা কিন্তু গান বেঁধে গেছেন।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— আপনার যে নারীর শ্রমের গানগুলো প্রায় সবই গ্রামাঞ্চলের। কলকাতা, অন্য শহর বা শহরতলিতে কি এরকম গান কখনও রচিত হয়নি? যদি হয়ে থাকে, তার রূপ কেমন?
চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়— প্রথমত, কলকাতা বা শহরতলি—এগুলো অনেক পরে এসেছে। আমাদের ঐতিহ্যের মধ্যে শহর তো খুব কম। এগুলো গ্রামবাংলার মেয়েদের গান। আমি গ্রামবাংলা নিয়েই কাজ করেছি। ফলে আমি শহরের কথা বলতে পারব না। শহরের কিছু গান আছে অবশ্যই। ছাদ পেটানি গানকে তো আমি শহরের গানই বলব। যদিও ছাদ পেটানি গানকে থিওরিটিক্যালি মেয়েদের গান বলা হয় না। কিন্তু সেখানে অনেক সময় সর্দার একজন থাকেন। মেয়েরা তাঁর অধীনে কাজ করে। আমি ছাদ পেটানি গান যাঁদের কাছ থেকে নিয়েছি, যাঁরা এসেছিলেন আমাদের বাড়ি ছাদ পেটাতে, ২০০০ সালের শুরুতে, তাঁরা কিন্তু সকলেই মহিলা ছিলেন। এবং তাঁদের কাছ থেকে যে-গান আমি পেয়েছি, সেখানে দেখেছি কিছু শহুরে প্রভাব আছে। আর কিছু আছে মেলানো-মেশানো। যেহেতু তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে কাজ করেন, তাই তাঁদের গানের মধ্যে একইসঙ্গে মনসা ভাসান পাচ্ছি, একইসঙ্গে বিয়ের গান পাচ্ছি, আবার মহরমের মাতম জারি পাচ্ছি। একই মানুষ কিন্তু গেয়ে চলেছেন, হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদটা চলে যাচ্ছে এবং শহুরে প্রভাব সেখানে এসে গেছে। বর্ধমানে আমি একজনকে পেয়েছিলাম, যাঁর গানে দেখেছি নগরসভ্যতার কিছু প্রভাব ও ছাপ আছে। তবে শহরের ইঁট-কাঠ যে কর্মসংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, সেখানে এ-জাতীয় সুর-কথার উপস্থিতি খুব বেশি পাইনি।
(পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব)
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
Powered by Froala Editor