বিশ্বজিৎ রায়ের জন্ম ১৯৮২ সালে, নদিয়া জেলার রানাঘাটে। কর্মসূত্রে আলিপুরদুয়ার জেলার পীযূষকান্তি মুখার্জি মহাবিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক। পশ্চিমবঙ্গে ভূ-প্রত্নতত্ত্ব চর্চার অন্যতম মুখ। লিখেছেন অসংখ্য গবেষণামূলক প্রবন্ধ। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আনুলিয়া-দেবলগড় প্রত্নক্ষেত্রের ইতিহাস-সন্ধানে রত। বর্তমান কথোপকথনটি আবর্তিত হয়েছে তাঁর ‘দেবলগড় আনুলিয়া প্রত্নক্ষেত্র: হারানো এক ইতিহাসের সন্ধানে’ বইটিকে(প্রকাশ ২০২১) কেন্দ্র করে। কথোপকথনে বিশ্বজিৎ রায়ের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
তন্ময়— আমার পরের প্রশ্ন একটা ইন্টারেস্টিং জায়গা নিয়ে, যার সঙ্গে ইতিহাসও জড়িয়ে আছে। গোরপাড়া বা গুড়পাড়া। ২০০০ সালের বন্যায় ভূমিধ্বসের ফলে এখানের প্রাচীন দুটি কবর থেকে কঙ্কাল উঁকি মারে। যে কঙ্কালগুলো আয়তনে সাধারণ মানুষের তুলনায় দীর্ঘদেহী। গ্রামবাসীদের আনুষঙ্গিক আচার দেখে মনে হয়, ওই দুটি কঙ্কাল ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের। পেশাগতভাবে তারা ছিল সৈন্য। এই অনুমানের স্বপক্ষে আপনার যুক্তি কী? আর, দ্বিতীয় প্রশ্ন, এখানে মুসলিম সৈন্যদল আসার কারণটাই-বা কী?
বিশ্বজিৎ রায়— দুটো অংশ খুব ডিস্টিংক্টিভ। দুটো অংশকে আলাদা আলাদাভাবে বলার চেষ্টা করছি। প্রথমটা, কেন আমি কঙ্কাল দুটোকে ভাবলাম যোদ্ধা শ্রেণির? যুদ্ধ বা এই অনুষঙ্গটা আমাদের মাথায় এল কেন? এবার এই জায়গাটায় আমাদের একটু লজিক্যাল ডিডাকশন করতে হবে। প্রথমত, যে কঙ্কালগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো সবই বলশালী পুরুষের কঙ্কাল। এবং কঙ্কালের যে গড় দৈর্ঘ্য, সেখান থেকে বোঝা যাচ্ছে…
তন্ময়— কটি পাওয়া গিয়েছিল? দুটিই তো মাত্র?
বিশ্বজিৎ রায়— এই সংখ্যাটা অসমর্থিত। কারণ, ২০০০ সালের বন্যার সময়কার ছবি কারো কাছে তোলা নেই। গোরপাড়ার বেশ কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা বলবেন, তাঁরা নিজের চোখে দেখেছেন কঙ্কালগুলি। কিন্তু মুশকিল হল, কারোর কাছে কোনো ছবি তোলা নেই। এক্সাক্টলি সংখ্যায় কটা কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল, সেটা কিন্তু মীমাংসিত নয়। আমি ধরে নিচ্ছি একাধিক। সেটা দুটোও হতে পারে, চারটেও হতে পারে। তো বিষয় হল, যে কঙ্কালটাই পাওয়া গেছে সেটা বলশালী পুরুষের। গড় দৈর্ঘ্য ছ’ফুটের ওপরে। এবং কবজি বা পাঁজরের হাড়— সেগুলো থেকে তো আমরা বুঝতে পারি সেগুলো বলশালী মানুষের ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি কোনো রোগে মারা যেতেন, মহামারীতে মারা যেতেন— তাহলে শুধু পুরুষরা মরবে কেন? মহিলা, শিশু সবাই মরবে। তাদের কঙ্কালও থাকত। নেই তো। শুধুমাত্র বলশালী পুরুষের কঙ্কাল রয়েছে। মহামারীতে মারা গেলে বোধ হয়, অত সুন্দর করে সামাজিকভাবে কবর দেওয়ার পরিস্থিতি থাকে না। কোনো মতে কবর-টবর দিয়ে মানুষ পালাতে পারলেই বাঁচে। তাহলে আমরা লজিক্যাল ডিডাকশনে কী কী পাচ্ছি? এক, একাধিক মানুষ মরেছেন। দুই, যাঁরা মরেছেন, তাঁরা সকলেই বলশালী পুরুষ। এবং মহামারীতে মরেনি। ফলে, একসঙ্গে এতগুলো বলশালী পুরুষ একসঙ্গে মারা যাচ্ছেন এবং তাঁদেরকে সম্মানের সঙ্গে সমাধিস্থ করা হচ্ছে, তাহলে বোধ হয় যুদ্ধ বা সামরিক সংঘর্ষ— এটাই অবস্থান হতে পারে।
এটা তোমার প্রশ্নের প্রথম অনুষঙ্গ, কেন যুদ্ধ ব্যাপারটা আমার মাথায় আসে। এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটায় আসি। মুসলিম অনুষঙ্গটা— কেনই-বা এদের এখানে কবর দেওয়া হল? তাই তো? আগের আলোচনাতেই আমি বলেছি, মোটামুটিভাবে যে প্রত্নপ্রমাণগুলি তার সাহায্যে আমি দেখতে পাচ্ছি, পাল-সেন যুগ থেকেই অন্ততপক্ষে এখানে বাণিজ্যকেন্দ্রিক সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল যা আমাদের পরবর্তীতে সুলতানি শাসন এবং মোঘল শাসন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখানে আমরা বহু বহু প্রত্নপ্রমাণ পেয়েছি যেগুলো সুলতানি আমলের সঙ্গে সংযুক্ত। সুলতানি যুগের, ইসলামি সংস্কৃতির বহু প্রত্নপ্রমাণ পাওয়া গেছে। কেমন? তো এমনটা হওয়া খুবই সম্ভব যে, গোরপাড়া বা গঙ্গার ধারের এই অঞ্চলগুলো— সেখানে মুসলিমদের সামরিক ঘাঁটি ছিল। হতে পারে বাণিজ্যপথের ধারে সুলতানি সৈন্যদের কোনো ঘাঁটি ছিল। সেখানেই কোনো সংঘর্ষে বা যুদ্ধ-বিগ্রহে কিছু সুলতানি সৈন্য বা মুসলিম সৈন্য— তাঁরা মারা যান। তাঁদেরকে কবর দেওয়া হয়েছিল।
তন্ময়— আপনার কাজের অন্যতম উপাদান নদী, নদীখাত, ভূমিরূপ, নাব্যতা কমে আসা নদী ইত্যাদি। নদিয়ার ওই অঞ্চলের প্রাচীন নদী-ব্যবস্থা দেখতে গেলে, গঙ্গা একদিকে। যমুনা সেই সময়ে অত্যন্ত বলশালী একটি নদী। তাছাড়াও হাঙর, মরালী ইত্যাদি ইত্যাদি মিলিয়ে দ্বাদশ শতক অবধি নদী-ব্যবস্থা কেমন ছিল?
বিশ্বজিৎ রায়— এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে, আমি যে বইটির কাছে বা যে লেখার কাছে সবচেয়ে কৃতজ্ঞ, সেটির কথা অবশ্যই উল্লেখ করব। সেটা হচ্ছে, ১৯৯৫ সালে, চাকদার একজন মানুষ, তিনি একটি বই লিখেছিলেন— ‘কাঁদে মরালী, কাঁদে যমুনা’। দুর্ভাগ্যবশত এই বইটির তেমন চর্চা হয়নি। নদিয়ার মানুষের কাছেও হয়তো তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। কিন্তু সীমাবদ্ধ জ্ঞানে, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বইটি ঘরে বসে লেখা নয়। আঞ্চলিক নদী ব্যবস্থার বিবর্তন— সেটা নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে তার সঙ্গে অন্যান্য প্রমাণগুলিকে যুক্ত করে এমন বই বাংলা ভাষায় খুব কমই লেখা হয়েছে।
নদিয়ার নদী সম্পর্কে আরও কয়েকটা বইয়ের কথা বলি। আমাকে তো বই পড়েই জানতে হয়েছে। পাঁচ শতাব্দী আগে আমি তো ছিলাম না। যেমন, নদিয়ার দেওয়ান কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায়, মানে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাবা, তাঁর লেখা একটি অতিচমৎকার বই আছে। ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত’। আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রথমদিকের উদাহরণ। তখন গোটা ভারতের খুব কম লেখা হয়েছে আঞ্চলিক ইতিহাস। ভেবো না, রাজার দেওয়ান ছিলেন বলে রাজপ্রশস্তি লিখেছেন। সেখানে রাজার বহু বহু সমালোচনা তো, এই যে চমৎকার বইগুলো লেখা হল, সেখান থেকে কিন্তু নদিয়ার নদী এবং তাদের বিবর্তন— এগুলো নিয়ে অনেক কথা পাওয়া যায়। আমাদের একটা বহুপ্রচলিত ধারণা আছে যে, চূর্ণি হচ্ছে কাটা খাল।
তন্ময়— অনেক কৃষ্ণনাগরিকেরও তো সপাট বক্তব্য, জলঙ্গি প্রাকৃতিক নদী এবং চূর্ণি একটি কাটা খাল।
বিশ্বজিৎ রায়— আমি তাঁদের কাছে একটা প্রশ্ন শুধু রাখতে চাই। যদি কোনো কাটা খাল, ভূমির ঢালকে অনুসরণ না করে, ভূমিগঠনের স্বাভাবিক নিয়মকে অনুসরণ না করে, তা কি শতাব্দীর পর শতাব্দী থাকতে পারে? যে জলঙ্গিকে তাঁরা প্রাকৃতিক নদী বলছেন, সেই জলঙ্গি তো আজকে মৃতপ্রায়। আর চূর্ণি যদি মানুষের কাটা খালই হবে, তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জীবিত থাকছে কী করে? স্রোতস্বিনী থাকছে কী করে? তাহলে আমাকে বুঝতে হবে, এই নদী কাটা খাল হলেও, তার যে স্বাভাবিক ঢাল, সেই ঢালটা প্রাকৃতিকভাবেই ছিল। ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত’ যদি আমরা পড়ি তাহলে দেখব যে চূর্ণি কাটাখাল মাজদিয়ার কাছে। যখন বর্গি আক্রমণের ভয়ে কৃষ্ণচন্দ্র রায় রেউই থেকে মানে কৃষ্ণনগর থেকে শিবনিবাসে নিয়ে চলে গেলেন, তখন ওই রাজপ্রাসাদটাকে সুরক্ষিত করার জন্য ইছামতীকে টেনে কঙ্কণা দিঘি তৈরি করেছিলেন। আর ইছামতী থেকে ৩ মাইল লম্বা একটি খাল কেটেছিলেন। সেই খালটা কোথায় যুক্ত হয়েছিল? চূর্ণি খাতে। তার কারণ, অঞ্জনার দুটো ধারা ছিল।
তন্ময়— এখন অঞ্জনাও তো মৃতপ্রায়…
বিশ্বজিৎ রায়— অঞ্জনা তো মৃতপ্রায় হবেই, কারণ অঞ্জনাকে কৃষ্ণচন্দ্র নিজেই মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেও ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার। ঠাকুরদা জলঙ্গীর সঙ্গে অঞ্জনার মুখটা বন্ধ করে দিলেন, কারণ সুলতানি সেনাদের সঙ্গে মারপিট হল। আর তাঁর নাতি, কৃষ্ণচন্দ্র মাজদিয়ার সঙ্গে খাল কেটে চূর্ণিকে যুক্ত করে দিলেন। গোটা নদী ব্যবস্থাটার বিবর্তন হয়ে গেল। মূল কথা যেটা, সেটা হচ্ছে, চূর্ণি মোটেই কাটা খাল নয়। এবং যাঁরা বলছেন, তাঁদের রূপেনবাবুর ওই বইটার দুটো কথা বলতে হবে যে, চূর্ণি যদি কাটা খালই হয় তাহলে চূর্ণির ধারে বিআরডব্লু পাওয়া যায় কীভাবে? নিশ্চয়ই বিআরডব্লুর সময় কৃষ্ণচন্দ্র খাল কাটছিলেন না! তাহলে তো অনেক পুরনো নদীই। গঙ্গার প্রাচীন গতিপথে নজর দিলে, গঙ্গার গতিপথ চূর্ণির গতিপথের সঙ্গে অনেক জায়গায় মিলে যায়। এটা মনে করা যেতে পারে যে, চূর্ণি আজ যে জায়গাগুলো দিয়ে বইছে, বেশ কিছু শতাব্দী আগে সেগুলো গঙ্গার ছেড়ে যাওয়া খাত ছিল। সেই ভূমির ঢালটাকে অনুসরণ করেই হয়তো চূর্ণি আজও বইছে। গঙ্গার দূরে যাওয়া, গঙ্গার কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে চূর্ণির দৈর্ঘ্যের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু চূর্ণি কাটা খাল এটা কিছুতেই নয়।
যাই হোক, মূল প্রশ্নে ফিরে আসি। নদিয়ার প্রাচীন নদী কোনটা কোনটা ছিল? নদিয়ার প্রাচীন নদী যদি বলি তবে যমুনা, ইছামতী, চূর্ণি, গঙ্গা— এদের কোনোটার গতিপথই কি আজকে যে গতিপথে প্রবাহিত হচ্ছে, সেটার গতিপথে ছিল? নাকি ছিল না? এগুলো যে ছিল না, তার বেশ কিছু প্রমাণ আমি আমার বইতে দিয়েছি। তার কয়েকটা আমি একটু বলি। যেমন গঙ্গা। যে গঙ্গা আজ ফুলিয়ার পাশ দিয়ে বইছে, সেই গঙ্গা বইত বীরনগরে, উলাইচণ্ডীর পাশ দিয়ে। আজও উলাইচণ্ডীর মেলার ওখানে চাঁদ সদাগরের পাথর পোঁতা আছে। দু-তিন প্রজন্ম আগেও, ডাকাতিয়া খাল বলে, উলাইচণ্ডীতলার পাশে গঙ্গার প্যালিও-চ্যানেলটাকে লোকে চিহ্নিত করত। ওই মিত্র-মুস্তাফিদের যে বই লেখা আছে না, ‘বীরনগরের ইতিহাস’, সেখানে মানুষের স্মৃতিতে আছে যে গঙ্গার ওই খালে জোয়ার-ভাটা খেলত। আজকে আর কিছুই নেই। আজকে বীরনগর থেকে গঙ্গা সরে গেছে ফুলিয়ার কাছে। মঙ্গলকাব্যে বলছে, ‘উলা বাহিয়া যায় খিসমার পাশে’। মানে গঙ্গা কোথায় ছিল? উলায় ছিল। তারপর কোথায় যেত? খিসমায় যেত। খিসমা থেকে কোথায় যেত? আজকের যেটা পাঁচবেড়িয়া। তারপর ওখান থেকে আনুলিয়া হয়ে বইত। এই হচ্ছে প্রাচীন গঙ্গার গতিপথ। তাহলে বুঝতেই পারছ, ব-দ্বীপ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গা কতটা পশ্চিমদিকে সরে গেছে। তো ঠিক এমনিভাবেই যা রাধাকৃষ্ণের স্মৃতিতে অমলিন হয়ে রয়েছে, চিরকাল থাকবেও, বিপ্রদাস পিপলাই যাকে বলছেন ‘যমুনা বিশাল অতি’, আজকে তুমি মদনপুর স্টেশনের দক্ষিণদিকে গেলে দেখবে সেটা পচা ডোবা, পাঁকে ভর্তি। কোথায় সেই যমুনা?
তুমি যদি আজ নহাটা যাও, দেখবে সাতাশি বলে একটা গ্রাম আছে। গোপালনগর, নহাটা, সাতাশি। অসাধারণ অসাধারণ প্রত্ননিদর্শন পেরিয়ে আসছে ওখান থেকে। ওখানেও আমি প্রচুর প্রচুর এলাকা পায়ে হেঁটে ঘুরেছি। ওখানে আছে পার্বতী খাল। ওইখানে আছে গরাই নদী। একদিকে ইছামতী থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে গরাই। যমুনায় গিয়ে মিশছে। আর ওই প্রায় একই জায়গায় ইছামতী থেকে বেরিয়ে আসছে হাঙর। যেটা নোকারি হয়ে বেরিয়ে আসছে। মানে দেবলগড়ের পাশ দিয়ে। আর গোপালনগর, নহাটা হয়ে গরাই নদী বিক্রমপুরের ওই জায়গায় চলে আসছে। তাহলে কি অতি প্রাচীনকালে গঙ্গা এবং ইছামতীর মধ্যে যমুনা ছিল কানেক্টারি? আচ্ছা, তাহলে কি ইছামতী আর যমুনার মধ্যে লিঙ্কেজ হিসাবে গরাই নদী ব্যবহৃত হত? ইছামতি থেকে এই যে হাঙর এটা সোজা কৃষ্ণনগর পর্যন্ত চলে যাওয়া কৃষ্ণচন্দ্রের প্রধান নৌকো—কৃষ্ণচন্দ্র তো নৌকোতে যেতেন, তার জন্যই তো চাকদার কাছে শ্রীনগরে রাজা গড় তৈরি করেছিলেন, বাগানবাড়ি তৈরি করেছিলেন। এবং এই পথেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্র যাওয়ার সময়ই তো, মানে কেমন দুশ্চরিত্র মানুষ, ঘাটে একজন মহিলা স্নান করছেন দেখে তাঁর বিয়ে করতে ইচ্ছে জাগল, আর সে বেচারা মেয়েটাকে বিক্রি করে দিতে হল নটা কড়ি দিয়ে, সেটা থেকেই তো নোকাড়ি। তো কৃষ্ণচন্দ্রের সময়েই, মানে ১৭৮০-তেও এই জায়গাগুলো কিন্তু নেভিগেবল। তাহলে আমি যদি আরও ৫০০ বছর, আরও ১০০০ বছর পিছিয়ে যাই, তাহলে গঙ্গা কোথায় ছিল? তাহলে যমুনাটা কোথায় ছিল? তাহলে ইছামতী কোথায় ছিল? ইছামতী-যমুনাকে কে মেলাত? মরালী কোথা দিয়ে বয়ে যেত? হাঙর কোথা দিয়ে কাকে কানেক্ট করত? এই প্রশ্নগুলো উঠে আসে। এবং এই জন্যই আমি বলছি, আমাদের নদীগুলোকে চিনতে হবে, তবেই আমরা প্রাচীন ভূমিরূপ গঠন, ব-দ্বীপ গঠন, প্রাচীন বাণিজ্য, প্রাচীন সভ্যতার বিকাশ— এগুলোকে চিনতে পারব।
আরও পড়ুন
ঈর্ষাক্ষাৎকার: বিশ্বজিৎ রায় — প্রথম পর্ব
তন্ময়— এতক্ষণ আমরা আনুলিয়াকেন্দ্রিক আলোচনাটা করলাম। এবার আমি দেবলগড়ের প্রসঙ্গে আসি। দেবলগড়ের প্রথম উল্লেখ কোথায় পাওয়া যায়?
বিশ্বজিৎ রায়— প্রথম দেবলগড়ের রেফারেন্স করেছে নাকি এক ইংরেজ। ১৮৯৬ সালে। সে-ব্যাটার নাম পাওয়া যায় না। সেই সাহেব লিস্ট অফ অ্যাংসিয়েন্ট মনুমেন্ট ইন বেঙ্গল লিখলেন। এবং সেই বইতেই আমরা প্রথম দেবলগড়ের কথা পেলাম। এবং ওই দেবলগড়ের যে আর্কিওলজিক্যাল রেসিডিউয়ালস— সেগুলো দেখে সাহেব একদম পরিষ্কার কনক্লুশনে লিখলেন, দিজ আর আনডাউটেডলি প্রি-মহামেডান রুইনস সিন ইন দ্য হার্ট অফ দ্য ডিস্ট্রিক্ট। মানে গোটা নদীয় জেলায়, মুসলিম যুগের আগে, মানে পাল-সেন যুগের প্রত্নক্ষেত্র হচ্ছে দেবলগড়। এটা পরিষ্কারভাবে লিখেছিলেন ওই সাহেব, ১৮৯৬ সালে। এটি ছাড়া আর একটা বাংলা খবরের কাগজ, ‘চাকদা হইতে এত ক্রোশ দূরে একটি ইটের ভাঙা স্তুপ দেখা যায়’, সমাচার দর্পণের লেখা। এছাড়া দেবলগড় নিয়ে আর কেউ কিচ্ছু লেখেননি। দেবলগড় সম্পূর্ণ অনালোচিত, অবহেলিত এক প্রত্নক্ষেত্র ছিল।
তন্ময়— তাহলে দেবলগড়ের এই প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের সম্পর্কে আপনার আগ্রহ জন্মাল কীভাবে? কীভাবেই-বা এর ইতিহাস অনুসন্ধানের সূত্রগুলো উদ্ধার করলেন?
বিশ্বজিৎ রায়— গবেষণার জন্য আমি যখন গোটা নদিয়া জেলা জুড়ে ঘুরছিলাম, তখনই আমার রাণাঘাট থানার চূর্ণি নদীর পাশের আনুলিয়া গ্রাম, গোরপাড়া গ্রাম— সেগুলো নিয়ে আগ্রহ জন্মানো। একইরকমভাবে আজকের গাঙনাপুর থানার পর পর পর পর গ্রামগুলো— দেবগ্রাম, পণ্ডেপাড়া— এগুলো ঘোরা। এবং সেখানে প্রাচীন নদীগুলোকে, নদীর পাশে বিস্তীর্ণ ঢিবি, জঙ্গলের মধ্যে বিশাল উঁচু উঁচু ঢিবিগুলোকে দেখে আকর্ষিত হওয়ায়, সেখানে নানানরকমের ইতিহাসের নিদর্শন বেরিয়ে আসা। এগুলোই আমার আকর্ষণ জাগিয়ে তোলে।
তন্ময়— আপনি আপনার বইয়ে একটি চাঞ্চল্যকর দাবি করেছেন, সেটা নিয়ে হয়তো বিতর্কও হয়েছে। তা হল, নবদ্বীপ বা অন্য-কোনো জনপদ নয়, লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী ছিল রাণাঘাটের অদূরের এই দেবলগড়ে। আপনার এই তথ্যটা বাংলার একটা পর্বের ইতিহাসকে পুরো বদলেও দিতে পারে। কোন কোন প্রমাণ বা সূত্র আপনাকে এই সিদ্ধান্তে এনে দাঁড় করাল?
বিশ্বজিৎ রায়— প্রথমেই একটা কথা স্বীকার করে রাখি। এর কোনো পাথুরে প্রমাণ আমার কাছে নেই। আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, ইতিহাসের ক্ষেত্রে, প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে তো বটেই, শিলালিপির প্রমাণ, তাম্রলিপির প্রমাণ কিংবা আর্কিওলজিক্যাল এক্সক্যাভেশন দ্বারা উদ্ঘাটিত যে সত্য, যেগুলো অপরিহার্য প্রমাণ— সেগুলো আমার কাছে নেই। আমি যার ওপর ভিত্তি করেছি, তাকে আমরা বলতে পারি সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্স বা পরিপার্শ্বগত প্রমাণ। আমার খারাপ লাগার যে জায়গাটা, সেটা হচ্ছে, যাঁরা যাঁরা সমালোচনা করেছেন, সমালোচনা সবসময়ই গ্রহণযোগ্য, সমালোচনাই তো আমাদের পরের ধাপে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দেয়, কিন্তু সমালোচনাটা যদি শুধুমাত্র অস্মিতার কারণে হয়, সেটা যদি শুধুমাত্র বিরোধিতা করার জন্য হয় এবং যুক্তিহীন হয়— তাহলে তা বিদ্যাচর্চাকে বাধা দেয় বলেই আমার মনে হয়। বেশ কিছু মানুষ বিরোধিতা করলেন, যে, আমি নবদ্বীপকে অপমান করে বসেছি। নবদ্বীপকে অপমান করার কোনোরকম যোগ্যতা, ধৃষ্টতা বা পরিকল্পনা— কিছুই আমার নেই। আমি নবদ্বীপকে ছোটো করতে চাইনি, সত্যটাকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম। কিছু মানুষ এইটা বললেন যে, কোনো প্রমাণ ছাড়া এইধরনের কথা বলা যায় না। আমার কথা বলার যে যুক্তিগুলি, সেই যুক্তিগুলিকে যদি তাঁরা বিশ্লেষণ করতেন, সেগুলোকে নিয়ে নাড়াঘাঁটা করতেন, আমার মনে হয় তাহলে তাঁরা স্বপক্ষে বা বিপক্ষে আরও বেশি সমৃদ্ধ হতেন। তাঁরা সেটা করলেন না। এটা আমার একটা খেদের জায়গা। এবং বহু ব্যক্তিগত আক্রমণ, ব্যক্তিগত সমালোচনা হয়েছে— সেটা থেকে হয়তো বোঝা যায়, মানসিকভাবে আমরা এখনও হয়তো পরিণতি পাইনি জাতিসত্তার দিক থেকে।
যাই হোক, তোমার প্রশ্নে ফিরে আসি। আমার সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্সগুলো কী কী? আচ্ছা, আমি কিছু প্রতিপ্রশ্ন করি। প্রতিপ্রশ্নের মধ্যে দিয়ে যুক্তিটাকে স্থাপন করার চেষ্টা করি। সেটা হচ্ছে, বখতিয়ার খিলজির আক্রমণ হয়েছিল লক্ষ্মণ সেনের ওপর। তো বখতিয়ার খিলজি ১৭ বা ১৮ জন সেনা নিয়ে এসেছিলেন। এরকম একটা তথ্য পাওয়া যায়। আমি সংখ্যার দিকে যাচ্ছি না। ধরে নিচ্ছি, ১৭ হতে পারে, ১৮ হতে পারে, ২০-২২-ও হতে পারে। মূল প্রশ্নটা হল, তাঁরা এসেছিলেন অশ্ববিক্রেতার ছদ্মবেশে। এবং যে বইগুলো থেকে এই কথাগুলো লেখা হয়, তবাকৎ-ই-নাসিরি ইত্যাদি, এই বইগুলোর ভাষ্য থেকে মোটামুটি এক জায়গায় আসা যায় যে, লক্ষ্মণ সেন এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কেউ বলছে তিনি প্রাসাদের ভিতরে ছিলেন, কেউ বলছিলেন তিনি দুপুরে খেতে বসেছিলেন সোনা-রুপোর থালায়। মোদ্দা কথা, এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত রাজা, সেনারা প্রস্তুত— এ-কথা কেউ বলছেন না। এবং সবচেয়ে জরুরি যেটা, সেটা হচ্ছে বখতিয়ার খিলজিকে আসতে দেখে, শহরের পথ ধরে অতগুলো ঘোড়া নিয়ে হেঁটে আসতে দেখে, নাগরিকরা কোনোরকম ঔৎসুক্য প্রকাশ করেননি, আগ্রহ প্রকাশ করেননি, তাঁদের মধ্যে কোনোরকম সাড়া পড়েনি, উত্তেজনা ছিল না। এটা তখনই সম্ভব, যখন মানুষের কাছে একদল ভিনদেশের বণিকের আসা-যাওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা হয়। আজকে যদি আমি গ্রামের মাঝখান দিয়ে চারটে ঘোড়া নিয়ে যাই, আজকের দিনেও, ২০২২ সালে দাঁড়িয়েও গ্রামের ছেলে-বুড়ো টিন, ঢোল, টায়ার নিয়ে লম্বা লেজ হয়ে পেছন পেছন যেতে থাকবে। গ্রামে সাড়া পড়ে যাবে। তাই না? কিন্তু শোনপুরের মেলায় যদি আমি দশটা ঘোড়া নিয়ে হাঁটি, দশটা হাতি নিয়ে হাঁটি, তাহলেও মানুষের মধ্যে কোনো সাড়া পড়বে না। কারণ, সেটা নিতান্তই স্বাভাবিক। তাহলে আমাকে বুঝতে হবে, বখতিয়ার খিলজি যে ভিনদেশের অশ্বারোহীর ছদ্মবেশে আসছেন, ওই ছদ্মবেশটা তিনি নিয়েছেন কেন? কারণ, বাণিজ্যটা ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্য ছিল। এবং ওই একই কারণে অশ্ববিক্রেতার ছদ্মবেশে, সেটা ১৭ জন হোক, ১৮ জন হোক কিংবা ২০ জন হোক, সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো সাড়া ফেলেনি। কারণ, রাস্তা দিয়ে ভিনদেশের বণিকেরা পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসা-যাওয়া করেন। তার মানে, যেখানে বখতিয়ার খিলজি আক্রমণ করেছিলেন, যেখানে রায় লখনিয়া দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন, সেটা হচ্ছে একটা অতিপ্রাচীন সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র। শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মের দুশো-আড়াইশো বছর আগে নবদ্বীপ যে একটি প্রাচীন বঙ্গের অত্যন্ত সমৃদ্ধ নগর বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল, এর কোনো প্রমাণ নেই। এই ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন অনিরুদ্ধ রায়। তাঁর বইতে তিনি স্পষ্ট বলছেন, নবদ্বীপ কোনো বাণিজ্যকেন্দ্র হতে পারে না। কারণ এই যে সমৃদ্ধ স্থলবাণিজ্য পথের কথা বলা হচ্ছে, এই বাণিজ্যপথ নবদ্বীপের ওপর দিয়ে বিস্তৃত ছিল এ কোথাও উল্লেখিত নেই। অনিরুদ্ধ রায়, তাঁর ‘মধ্যযুগের ভারতীয় শহর’— বইয়ে পরিষ্কার বলছেন, এই বাণিজ্যকেন্দ্র নবদ্বীপ নয়। তার মানে আক্রমণটা নবদ্বীপে হয়নি, অন্য কোথাও হয়েছে। প্রথম আমি নবদ্বীপকে নেগেট করছি। দ্বিতীয়, বখতিয়ার খিলজি আক্রমণ করলেন ১২০০ বা ১২০১-০২— তার ২৮০ বছর পর বা প্রায় ৩০০ বছর পর জন্মালেন যুগপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব। এবং শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মকে তো আমরা একটা মার্কিং ধরব।
আরও পড়ুন
ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— চৈতন্যদেব এমন এক চরিত্র, যাঁর সময়ের এপাশ আর ওপাশ দিয়ে মানে বাংলার ইতিহাসকে ভাগ করা যায়।
বিশ্বজিৎ রায়— একদম। এবং চৈতন্যদেব কোন রাস্তা দিয়ে টিউশন করতে যেতেন, কোন রাস্তা দিয়ে কাজিদলনে গিয়েছিলেন, বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি কোথায় ছিল— এই সমস্ত লেখা আছে ডিটেইলসে। তাই তো? তাহলে চৈতন্যদেবের দুশো-আড়াইশো বছর আগে যদি নবদ্বীপ প্রাচীন বাংলার রাজধানী হত, তাহলে কেউ না কেউ লিখতেন সে-কথা। কোনো-না-কোনো উল্লেখ থাকত। এই যে প্রাচীন রাজধানী, এই যে প্রাচীন গড়, রাজার রাজপ্রাসাদ— কোথাও লেখা নেই। বরং সব জায়গায় খুঁজলে একটা জিনিসই পাওয়া যায়, ‘নবদ্বীপ হেন গ্রাম ত্রিভুবনে নাই/ যদি অবতীর্ণ হল নিমাই গোঁসাই’। ‘নবদ্বীপ হেন গ্রাম…’ অর্থাৎ, বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের প্রায় তিনশো বছর পরেও নবদ্বীপ কিন্তু গ্রাম। নগর নয়। তাহলে শ্রীচৈতন্যের জন্মের আগে যদি এটা প্রাচীন বঙ্গের রাজধানী হত, কোনো জীবনীকার এই গ্লোরিফিকেশনটা হাতছাড়া করতে চাইতেন? তার মানে এখান থেকেই বোঝা যায়, নবদ্বীপে আক্রমণ হয়নি, নবদ্বীপ প্রাচীন রাজধানী ছিল না। তো এইরকম বহু প্রমাণ আছে, সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্স, সেগুলো দিয়ে আমরা বলতে পারি নবদ্বীপে আক্রমণ হয়নি, নবদ্বীপ প্রাচীন বঙ্গের রাজধানী ছিল না।
তন্ময়— কিন্তু তার পরিবর্তে দেবলগড়ই কেন?
বিশ্বজিৎ রায়— দেবলগড় কেন, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ হচ্ছে, সেন রাজ সভাকবি ধোয়ীর লেখা। তাঁর ‘পবনদূত’। দূত কাব্যগ্রন্থগুলোকে আমরা গুরুত্ব দেব এই কারণে, কেন-না প্রাচীন ভূখণ্ডের—সেটা ভারতের হতে পারে, বাংলার হতে পারে, ম্যাপ— ভৌগোলিক স্থানগুলোকে চেনা-জানার ক্ষেত্রে এই দূতকাব্যগুলোর একটা বড়ো ভূমিকা আছে। মেঘদূত, পবনদূত। এগুলোর সম্পর্কে আমরা জিওগ্রাফিক্যাল লোকেশন আইডেন্টিফাই করতে পারি। সেন রাজধানী এবং স্কন্ধাবার— মানে মিলিটারি হেডকোয়ার্টার কোথায় ছিল সেটা জানতে পারি। কোথায় ছিল? বিজয়পুর। এই বিজয়পুরের কথা ধোয়ী বলছেন। এবং ইম্পর্টেন্টলি আমরা যদি ‘পবনদূত’-টা খুঁটিয়ে পড়ি, তাহলে আমরা রাস্তাটাও চিহ্নিত করতে পারব।
তন্ময়— অনেকেই আজকে বীজপুরকে বিজয়পুর বলে দাবি করেন।
বিশ্বজিৎ রায়— উনি বলছেন, বিজয়পুর ত্রিবেণীর কাছেই। ত্রিবেণী থেকে খুব দূরে নয়। কারণ, পবনদূতে উনি বইলছেন ত্রিবেণী পেরিয়েই ধোয়ী রাজধানীতে উপস্থিত হয়েছিলেন। যেখানে তখন স্বয়ং রাজা অপেক্ষা করছেন। রাজার হাতেই তো দেবেন প্রেমিকার চিঠিটা। তো রাজা অবস্থান করছেন। এবং বিজয়পুর যে-সে জায়গা নয়, একইসঙ্গে রাজধানী এবং মিলিটারি হেড কোয়ার্টার। স্কন্ধাবার। তাই তো? কারণ, লক্ষ্মণ সেন তো বহু আগে থেকেই বখতিয়ার খিলজির আসার কথা জানেন। উনি তো ফ্রন্টিয়ারেই অবস্থান করবেন। তো আমরা আজও যদি ভূগোলটাকে সামনে রাখি, তাহলে দেখব প্রথমেই ত্রিবেণী পেরোলেই চাকদা, তারপরই প্রাচীন বিষ্ণুপুর… এখানে তোমাকে বলে রাখি, আমার এখন যে কাজ চলছে, সেই কাজটা কিন্তু দেবলগড়, সবটাকেই আমি দেবলগড় বলছি— চাকদহের কাছেই কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় প্রত্নপ্রমাণ আবিষ্কৃত হচ্ছে। ফলে, এই পবনদূতের দেখানো যে রাস্তা, সেই রাস্তার গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম।
আরও পড়ুন
ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — প্রথম পর্ব
তন্ময়— যেটা বৃহত্তর দেবলগড় সভ্যতারই অংশ বা অঙ্গ। মানে ওই মানচিত্রের মধ্যেই পড়ছে।
বিশ্বজিৎ রায়— একদম। একদম। রাণাঘাট থানার আনুলিয়া, চাকদা, তারপর গাঙনাপুর থানার দেবলগড়, আঁইশমালি— সবই বৃহত্তর দেবলগড়ের মধ্যেই পড়ছে। তো বিজয়পুরের অবস্থান চিহ্নিত করতে গেলে ‘পবনদূত’-এর সাহায্য নিতেই হবে। এবং দেবলগড় থেকে যে আর্কিওলজিক্যাল এভিডেন্সগুলো পাচ্ছি। দেবলগড়ের মতো এত বিস্তৃত ফর্টিফিকেশন, এক বর্গকিলোমিটারেরও বেশি এলাকা জুড়ে গড়, মাটির উঁচু র্যা মপার্ট, চারদিক পরিখা দিয়ে ঘেরা এবং মাঝখানে হোয়াইট স্যান্ডস্টোন, ল্যাটেরাইট, ফিলাইট— এত এত পাথর দিয়ে বিরাট রাজপ্রাসাদ…
তন্ময়— বর্তমানে তো এর কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই?
বিশ্বজিৎ রায়— ওই রেসিডিউয়ালসগুলো— যেগুলো মিউজিয়ামে এনে রাখা গেছে, সেই প্রমাণগুলো আছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বিরাট বিরাট পাথরের রাজপ্রাসাদ ছিল এখানে। সেগুলো সব আছে রাখা। তো এই রাজপ্রাসাদ আর্লিমেডিয়েভাল পিরিয়ডে বাংলার আর কোত্থাও নেই। দেবলগড়ের মতো এত বিস্তৃত ফর্টিফিকেশন দেবলগড় ছাড়া আর কোত্থাও নেই। এবং তার সঙ্গে অস্ত্রের অবশেষ। নানানরকম। আর্কিটেকচারাল রেসিডিউয়াল, আর্কিওলজিক্যাল এভিডেন্সেস, জিওগ্রাফিক্যাল লোকেশন— এই সমস্ত কিছুকে মেলালে এবং নবদ্বীপকে লোকেট করলে আমরা একটাই সিদ্ধান্তে আসতে পারি, বাংলার প্রাচীন রাজধানী, বা বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের যে স্থান, সেটা নবদ্বীপ ছিল না, অন্য কোথাও ছিল। এবং সেটা এই বিজয়পুরের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে এই দেবলগড় হওয়াই সম্ভব।
এবার ওই যে বললাম। দরকারে উৎখনন, দরকারে আরও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, আরও আরও আরও তথ্যের উন্মোচন। তবে আমরা শেষ কথা বলার জায়গায় যাব। নাহলে শেষ কথা বলার কেউ নেই। সম্ভাবনা নিয়েই আলোচনা চলছে।
তন্ময়— আচ্ছা, বাঙালি ইতিহাসবিস্মৃত জাতি, এই অভিযোগ তো বরাবরের। আপনি প্রত্নতত্ত্বের অনুসন্ধান করতে গিয়ে, স্থানীয় গ্রামবাসীদের যে সহযোগিতা বা অসহযোগিতা পেয়েছেন, সেটা কিছু উল্লেখ করেছেন এর আগে। কিন্তু সাধারণভাবে আমরা দেখতে পাই, সাধারণ মানুষের অসচেতনতা এবং যত্নের অভাবের ফলে বহু প্রত্নবস্তু বিলুপ্তির মুখে চলে যায়। এবং সেগুলো হয়তো অজ্ঞতার বশেই চিরতরে হারিয়ে যায়। এটা শুধু আনুলিয়া, দেবলগড় বলে না, এটা সর্বক্ষেত্রেই আমাদের উপমহাদেশের এটা একটা সাধারণ চরিত্র। এর প্রতিকারের উপায় কি? নাকি এর মধ্যে থেকেই লড়াই করেই আমাদের কাজটুকু বার করে নিতে হবে?
বিশ্বজিৎ রায়— প্রথমত, এর কোনো ওয়ান লাইন সলিউশন নেই। লড়াই করেই বার করে নিতে হবে…
তন্ময়— অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে যেখানে বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্র বা প্রত্নবস্তু উঠে এসেছে, সেখানে পরবর্তীকালে কারোর বাসভূমি, কারোর জমি— সেক্ষেত্রে বাধা আসে যে, তাদের মালিকানাধীন জমিতে অনুসন্ধান বা খনন ইত্যাদির ক্ষেত্রে। এরকম প্রচুর বাধা পেরিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধান কতটা অসুবিধার?
বিশ্বজিৎ রায়— প্রথম কথা যেটা বললাম, লড়াই-ই একমাত্র পথ। এই করে করেই এগোতে হবে। যেটুকু পথ পাওয়া যাবে, সেটুকুর মধ্যে দিয়ে। দ্বিতীয়ত আমি যেটা বলব, আমাদের সভ্যতা, এখানে ‘আমাদের’ শব্দটা ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যবহার করছি, আমাদের সভ্যতা এতটা সুপ্রাচীন এবং ঐতিহ্যশালী, যার তল পাওয়া সত্যিকারেরই ভারি দুষ্কর কাজ। আমি নির্দিষ্ট কোনো জাতির নাম নেব না, প্রত্যেকেই সম্মানীয়। কিন্তু আমাদের ইতিহাস ৩০০ বছরের ইতিহাস নয়। এমন অনেক তথাকথিত সুসভ্য জাতি আছে, যারা ৩০০ বছরের ইতিহাসকে প্রত্নতত্ত্বের আওতায় নিয়ে আসে। কারণ ৩০০ বছর পেরোলে যে ইতিহাসের মুখোমুখি হতে হবে, তারা সেই ইতিহাসের মুখোমুখি হতে চায় না। ৩০০ বছরের ইতিহাসটাই সেইসব সুসভ্য জাতিদের কাছে ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব। আচ্ছা, তারা যে ৩০০ বছরের বেশি পিছোতে চায় না, তারা তবে ইতিহাস-বিস্মৃত জাতি নয়। আমরা না এই প্রশ্নগুলো করার সাহস রাখি না। বাঙালি তো ইতিহাস-বিস্মৃত জাত বলে দিয়েছি। আচ্ছা আমেরিকানরা যে রেড-ইন্ডিয়ান ইতিহাসের সন্ধান করতে চায় না… ইউরোপের একটা বড়ো ইতিহাস যে চাপা দিয়ে রাখা হয়, তারা ইতিহাস-বিস্মৃত নয়? আসলে ব্যাপারটা হল, শাসক গোষ্ঠী বা যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকছেন তাঁরা কোন ইতিহাসটা নির্মাণ করতে চান— সেইটা গুরুত্বপূর্ণ। তো আমাদের প্রশাসনিক স্তরে বা আমাদের বিদ্যাচর্চার স্তরে বা আমাদের সরকারি স্তরে, ইতিহাসের যে চর্চাটুকু করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেই চর্চাটুকু সবাই করেন। বাকি ঢেকে দেওয়া হয়। যেমন যেমন অন্যান্য জায়গাতেও হয়। এতে বাঙালিকে আমি খুব বেশি দোষ দিতে পারি না। বাঙালির আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস আছে। গঙ্গারিডি থেকে শুরু করলে একদম প্রত্নবস্তু-সহ প্রমাণ আড়াই হাজার বছরের। কত বছরের ইতিহাস রাখবে? বিশেষ করে সেই জাত, যে জাতকে ভিটেমাটি ছেড়ে জীবন বাঁচানোর জন্য লড়াই করতে হয়েছে। একটা বড়ো ঢিবি, সে কেটে সমান করে তার ঘর বানাবে? নাকি সেই ঢিবিগুলোকে রক্ষা করবে এক হাজার বছরের পুরাবস্তু বলে?
আরও পড়ুন
ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— একজন ভূ-প্রত্নতত্ত্ববিদ এই কথা বলছেন, এটা খুব ইন্টারেস্টিং।
বিশ্বজিৎ রায়— মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামটা তো অনিবার্য। দেবলগড়ের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র, ’৭১-এর পরে যাঁরা এসেছেন, কেটে সমান করেছেন। মানুষের কাছে বেঁচে থাকাটা তো আগের তাগিদ। সেই যে পেটে খেলে পিঠে সয়, এ যে কভু মিছে নয়। মানুষ যদি বেঁচেই না থাকতে পারে, সভ্যতাটাকে বাঁচিয়েই না রাখতে পারে, তাহলে কী করে সেই সংস্কৃতির রেণুটাকে সংরক্ষণ করবে? যে বাঙালি ছিন্নমূল হয়ে উপমহাদেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ক্রমাগত পরিব্রাজন করে গেছে, সে কী করে ইতিহাসটাকে সংরক্ষণ করবে? আরও একটা বিষয়, সেটা হচ্ছে, আমাদের ইতিহাসচর্চার ধারাটা হচ্ছে শ্রুতি। আমাদের সেই প্রাচীন রীতি থেকেই মাথায় রাখতে পছন্দ করি। লিখে রাখতে নয়। ডকুমেন্টেশনটা আজও অনেকাংশে পরিত্যাজ্য। আমরা মাথায়, স্মৃতিতে রাখতে বেশি গৌরব বোধ করি। লিখিত ইতিহাসচর্চার থেকে জিনিসটা স্মৃতিতে রাখা আমাদের কাছে অনেক বেশি গৌরবের। ‘ও একবার পড়েই গোটা বই মুখস্থ রাখতে পারে রে…’। যেটা ইউরোপীয় ধারা— সাহেব কোনো এক সকালবেলা উঠে চা খেতে খেতে তার বাংলোয় দেখেছিল এক কাঠবেড়ালি ছুটছে। ও কিন্তু চুপ করে গিয়ে খাতায় লিখে রেখেছে। অমুক দিন আমি কাঠবেড়ালি দেখেছি। তার লেজের কাছে তিনটে সোনালি চুল ছিল। দেখা গেল, ওই বিবরণটা ৩০০ বছর পর এশিয়াটিক সোস্যাইটি বা রয়্যাল সোস্যাইটির কোনো একটা সভায় লিপিবদ্ধ হয়ে রইল। বাঙালি বা তথাকথিত ভারতীয় সভ্যতা এই ডকুমেন্টেশনে বিশ্বাসী নয়। সে স্মৃতিতে বিশ্বাসী, মাথায় রাখায় বিশ্বাসী। আমাদের ইতিহাসচর্চার ধারাটাই এমন হয়েছে। বাংলা কেন, ভারতেই তো ইতিহাসচর্চা খুব প্রাচীন নয়। আমরা অনেকেই অনেক সময় না-জেনে মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকাকে ইতিহাস বলি। না, ভুল। আমরা কলহনের রাজতরঙ্গিনীকে ইতিহাস বলি। না, ভুল।
তন্ময়— কিন্তু সেখান থেকে তো সমকালীন ইতিহাসের তথ্য তো পাওয়া যায়।
বিশ্বজিৎ রায়— হ্যাঁ… ঠিক। সমকালীন ইতিহাসের উপাদানগুলো পাওয়া যায়। সেগুলো হচ্ছে বিদ্যাচর্চার ফসল। ইতিহাস নয়। সমস্ত ইতিহাসই বিদ্যাচর্চার ফসল।
তন্ময়— আমাদের মঙ্গলকাব্যও তো তা-ই!
বিশ্বজিৎ রায়— হ্যাঁ, একদম। এই সমস্তগুলিকে তন্ময় আমরা বলব বিদ্যাচর্চার ফসল। ইতিহাস নয়। সমস্ত ইতিহাসই বিদ্যাচর্চার ফসল। কিন্তু সমস্ত বিদ্যাচর্চার ফসলই ইতিহাস নয়। বিদ্যাচর্চা যখন ঐতিহাসিক প্রমাণ দ্বারা, পাথুরে প্রমাণ দ্বারা, শিলালিপি দ্বারা, তাম্রলিপি দ্বারা, হাঁড়ি-কুড়ির মতো প্রত্নপ্রমাণ দ্বারা, উৎখনন দ্বারা উদ্ঘাটিত সত্য দিয়ে তারা সার্টিফায়েড না হবে, অ্যাটাসস্টেটেড না হবে, ততক্ষণ তাদের আমরা ইতিহাস বলতে পারব না। ওই যে আমি বললাম, আপন মনের মাধুরী মিশায়ে উপন্যাস হবে, ইতিহাস হবে না। তো ভারতে তো এই চর্চাটা বড়ো আধুনিক, তাও কিন্তু বাঙালির হাত ধরেই বাংলার বুকেই শ্রীরামপুর থেকেই, কলকাতা থেকেই। তাহলে আমি ফালতু ফালতু বাঙালিকে দোষ দিয়ে যাব যে তুই আত্ম-বিস্মৃত জাত! ও রে ব্যাটা, তুই আমেরিকানকে শেখা রেড-ইন্ডিয়ানদের ইতিহাস বার করতে। তাহলে তাঁরা আত্মবিস্মৃত নয়? বাঙালিকে শুধু আমি দাগিয়ে দেব না। যে মানুষটা ভিটেমাটি ছেড়ে, বউ-বাচ্চাকে ওইপারে পুঁতে রেখে এসেছে, তাঁর কাছে প্রত্নসভ্যতার ডকুমেন্টেশনটা খুব বেশি ফান্ডামেন্টাল নয়, জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখাটা অনেক বেশি ফান্ডামেন্টাল। সেটাই অনেক বেশি জাজমেন্টাল তাঁর কাছে। তো এইটা একটা আমাদের সভ্যতার ক্ষেত্রে হয়েছে। কিন্তু যেটা আমি বলব সেটা হচ্ছে, এটাই শেষ কথা নয়। মানুষ তার জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই করেছে, ভাত বা ফ্যান, যা-হোক একটা কিছু দিয়ে তাঁর সন্তানকে বেচে, বউকে বেচে, বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে নিজেকে। এই নগ্ন জীবন সংগ্রামটাই কিন্তু একমাত্র সত্য নয়। এই নগ্নসত্যটাই কিন্তু একমাত্র সত্য নয়। তার প্রমাণ তারাপদ সাঁতরা, তার প্রমাণ আমাদের আব্দুল জব্বার, তার প্রমাণ দিলীপ মৈতে। এই মানুষগুলো তো কোনোরকম সরকারি আনুকূল্য ছাড়া, সরকারি সাহায্য ছাড়া তাঁদের সারাটা জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে, বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রেখে বাঙালি সংস্কৃতিটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমরা তারাপদ সাঁতরাকে ভুলব কেমন করে? আব্দুল জব্বারকে ভুলব কেমন করে? দিলীপ মৈতেকে ভুলব কেমন করে? আজকে যখন আমরা চন্দ্রকেতুগড়ের ইতিহাস বলব, তখন কি জব্বার আর দিলীপ মৈতেকে ছাড়া বলতে পারব? আজকে যখন আমরা বাংলার মন্দির সংস্কৃতি নিয়ে, টেরাকোটা নিয়ে কথা বলব, তখন কি তারাপদ সাঁতরাকে নিয়ে আলোচনা করতে পারব? তাহলে এই মানুষগুলো তো করেছেন। তো প্রথমে যেটা বললাম, সেই লাইনটাই আবার বলি, সেটা হচ্ছে যে, কোনো ওয়ান লাইনার নেই, কোনো প্যারাসিটামল নেই, লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। যে যেখানে যেভাবে লড়াই করতে পারবে, সে সেখানে সেভাবে লড়াই করবে। নিজের দেশ-কাল-সমাজকে জানবে, চিনবে, সংরক্ষণ করবে এবং এগিয়ে নিয়ে যাবে। কখনো হার হবে, কখনো জিত হবে। চারটে প্রত্নক্ষেত্র উধাও হয়ে যাবে, আবার দুটো প্রত্নক্ষেত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে আমরা চার আনা হলেও সক্ষম হব। এভাবেই এগিয়ে চলবে সভ্যতা।
তন্ময়— আচ্ছা, বাংলার বুকে এএসআই যা যা প্রত্নক্ষেত্র উৎখনন করে বার করেছে, তার বেশ কিছু সম্পূর্ণ বেশ কিছু আংশিক। এএসআই-এর উৎখননের ফলে সেই অঞ্চলের ইতিহাস যতটা উন্মুক্ত হয়েছে, তাতে প্রাতিষ্ঠানিক উৎখননের বিকল্প আজও কল্পনা করা যায় না। আনুলিয়া, দেবলগড় নিয়ে কি এএসআই কোনো উৎসাহ দেখিয়েছে আজ অবধি? তাদের ভূমিকা বা দৃষ্টিভঙ্গি কী?
বিশ্বজিৎ রায়— এই মুহূর্তে কলকাতা সার্কেলের সুপারিটেন্ডেন্ট আর্কিওলজিস্ট ডঃ শুভ মজুমদার, তাঁর সঙ্গে আমি বহুবার যোগাযোগ করেছি। তিনি দেবলগড় প্রত্নক্ষেত্রের কথা খুব ভালোভাবে জানেন। তাঁকে আমি আমার দীর্ঘ কয়েকবছরের সমস্ত গবেষণা, লেখা, ছবি— এগুলো জানিয়েছি, পাঠিয়েছি। ফলে দেবলগড় প্রত্নক্ষেত্রের কথা এখন কিন্তু আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কাছে অজানা নেই। ঠিক যেমনটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে পুরাতত্ত্ব বিভাগ তার কাছেও অজানা নেই। নদিয়া জেলা প্রশাসন, তার কাছেও অজানা নেই। সর্বত্র একাধিকবার এগুলো জানানো হয়েছে। তথ্য আমি যেটুকু বার করতে পেরেছি, ছবি আমি যা তুলতে পেরেছি, লেখা আমার পক্ষে যা সম্ভব হয়ে— সমস্ত আমি তাদেরকে জানিয়েছি, তাদের কাছে পাঠিয়েছি। এবার সরকার বাহাদুরের কবে টনক নড়বে, সেই মতো তারা কাজ করবে। উৎখনন হলে তো অবশ্যই সেটা বহুপ্রতীক্ষিত সত্যের কাছাকাছি আমাদের নিয়ে যাবে। কিন্তু সরকার কবে করবেন, সেই আশায় আমরা আমাদের কাজ বন্ধ করে রেখে দিতে পারব না। ওই যে বললাম, রঞ্জন রঞ্জনের কাজ করে যাবে। ভ্যান চালিয়ে যাবে। হ্যাঁ, আমাকে আমার কাজ করে যেতে হবে। সরকার একদিন না একদিন শুনতে বাধ্য হবে। কিন্তু তার আগে আমাকে পলতেটা পাকিয়ে যেতে হবে।
তন্ময়— আমরা সাধারণভাবে দেখি, কোনো একটা প্রত্নক্ষেত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উৎখননের আগে স্থানীয় গবেষকরা যেসব প্রত্নবস্তু উদ্ধার করেন, সেই জায়গাটার সম্পর্কে অনুমান করেন, সেসব খননের দিকে এক-একটা ধাপ এগিয়ে দেয়। কিন্তু সামগ্রিক খননের পরে ইতিহাসের যে বিশাল একটা বিস্তীর্ণ উন্মোচন ঘটে, সেই তথ্যভাণ্ডারের সামনে আগেকার ধাপগুলো, সেগুলো অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এখন অবধি আনুলিয়া, দেবলগড়ে খনন হয়নি। আপনি এবং আপনার টিম গত এক দশক ধরে অবিরাম প্রচেষ্টা করে দেবলগড়কে স্থানীয় মানুষের বাইরেও একটা বৃহত্তর পাঠক এবং অনুসন্ধিৎসু যাঁরা, তাঁদের কাছে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু আজকে না হলেও কখনো-না-কখনো খনন হবেই। ভবিষ্যৎ দেবলগড় প্রসঙ্গে বিশ্বজিৎ রায়কে কীভাবে মনে রাখবে? আপনার কী মনে হয়?
বিশ্বজিৎ রায়— প্রশ্নটা বড়ো জটিল। ধরো আজকে আমরা কথা বলছি তো। তো বিভূতিভূষণ স্মরণ ছাড়া কথা বলাটা উচিত নয়। তো বিভূতিভূষণের একটা ছোট্ট লেখা, আমি খুব ছোট্টবেলায় পড়েছিলাম। ‘তেলাকুচার জীবনচরিত’। পড়েছো নিশ্চয়ই? তেলাকুচো গাছ, সবুজ গাছ, সতেজ গাছ, লক লক করছে সবুজ পাতা। একটা কচি তেলাকুচো জন্মেছে। তাও সবুজ। মজাটা দেখা গেল, চারটে পাতা সবুজ থেকে হলুদ হল আর সবুজ তেলাকুচোর বোঁটার কাছটা একটু হলুদ হল। দশটা পাতা শুকিয়ে গেল তেলাকুচোটা একটু লাল হল। আর শেষ পাতাটাও যেদিন শুকিয়ে হলুদ হয়ে ঝরে পড়ল, তেলাকুচোটা সেদিন পরিপূর্ণ টুকটুকে লাল হয়ে পেকে গেল। তো ওই যে গোটা গাছটা জন্মেছিল, গোটা গাছটা যে শুকিয়ে গেল, তা কি ব্যর্থ হল? গোটা গাছের জীবনশক্তি, গোটা গাছটা তো ওই তেলাকুচোটাকে পরিপূর্ণ করার মধ্যে দিয়েই পূর্ণতা পেল। তাই নয় কি? দেখো, আমাদের ভারতীয় দর্শন কী বলে? অনেক কথাই বলে, তার মধ্যে একটা ধারায় যদি আমরা আলোচনা করি, তাহলে বলি, ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জিথা...’। ত্যাগ দিয়েই ভোগের আনন্দ। ভোগ দিয়ে জয় করা যাবে না। এটা কুমারসম্ভবেও দেখছি আমরা। যে খুব সেজে-গুজে, আড়ম্বর-টাড়ম্বর করে শিবঠাকুরকে পাওয়া যাবে না, শেষে পার্বতী শুকনো পাতা খেল, তাই অপর্ণা নাম হল। এবং এই যে ত্যাগ, এই ত্যাগ করে সে শিবকে পেল। ত্যাগের মধ্যে দিয়ে যে প্রাপ্তি, সেটাই সর্বোত্তম প্রাপ্তি নয়? আজকে দেবলগড় প্রত্নক্ষেত্র যদি সাধারণ মানুষের কাছে উদ্ভাসিত হয়, গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের গঠন সম্পর্কে রহস্যগুলো যদি উন্মোচিত হয়, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরেও যে ছাত্রছাত্রীরা পড়বে, তাতে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের গঠন, তাতে নদনদীর বিবর্তন এবং সেখানে সভ্যতার বিবর্তন এগুলো যদি পড়তে পারে, দেবলগড়ের প্রত্নক্ষেত্র যদি উন্মোচিত হতে পারে, তাহলে তো আমি বুড়ো তেলাকুচো গাছ, আমার আর সবুজ পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কী প্রয়োজন? পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তো কিছু রেখে যেতে পারলাম। এই ত্যাগটুকুই আমার আনন্দ। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনে রাখার জন্য দেবলগড় রইল, তাদের কাছে ভূ-প্রত্নবিদ্যার চর্চা রইল। সেই চর্চাগুলো তাঁরা চালিয়ে যান। যেখানে যেখানে এই প্রত্নক্ষেত্র ধ্বংসের মুখে যাবে, সেখানে সেখানে যদি সাধারণ মানুষ গণ-প্রত্নবিদ্যা বা পিপলস আর্কিওলজি, ওই যেটা বলেছিলাম শুরুতে, তার চর্চা করেন, জিও-আর্কিওলজির চর্চা করেন ভবিষ্যতের ছাত্র-ছাত্রী, মাস্টারমশাই-দিদিমণিরা— সেটাই আমাকে মনে রাখা হল। আমার নামটা থাকল কিনা সেটা বড়ো কথা নয়, (হাসতে হাসতে) ওই তেলাকুচোটা তো পেকে রইল, পাখিগুলোর খাবারের জন্য। সেটাই যথেষ্ট, আবার কী?
(সমাপ্ত)
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
আরও পড়ুন
ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — প্রথম পর্ব
Powered by Froala Editor