অঞ্জন সেনের জন্ম ১৯৫১ সালে, কলকাতায়। কবি ও প্রাবন্ধিক। ‘গাঙ্গেয়পত্র’ পত্রিকার সম্পাদক। বর্তমান ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘মধ্যযুগের বাংলার পুঁথিপাটার চিত্র’ (প্রকাশসাল ২০২১) বইটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে অঞ্জনের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব...
(প্রথম পর্বের পর...)
তন্ময়— ফিল্ড-ওয়ার্কে গিয়ে কখনো কি কোনো দুর্লভ পুথি বা চিত্রিত পুথির সন্ধান পেয়েছেন?
অঞ্জন সেন— সংগ্রহশালার বাইরে সেরকম চিত্রিত পুথি আমি পাইনি। এক-আধটা পাতা আমি দেখেছি বিভিন্ন কালেক্টারের কাছে। সেগুলোতে এক একটা পাতাই ইলাস্ট্রেটেড রয়েছে। কয়েকটা পুথির কথা যেগুলো আমি বললাম, সেগুলো সবই সংগ্রহশালাতে দেখেছি। আর আসলে একশো বছর আগে— দীনেশচন্দ্র সেন, বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ প্রমুখ একটা বৃহৎ কাজ করে গেছেন। এঁরা অনেক জিনিস সংগ্রহ করে গেছেন। তারপর অনেক পুথি নষ্ট হয়ে গেছে। আমি শুনেছি রামপ্রসাদের হাতে লেখা একটা ওরকম পুথি ছিল। সেটা ছিল হালিশহরের কারোর বাড়িতে। সেটার ওপর ওই ফুল-চন্দন পড়ে, পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। তো এরকম বহু পুথি পুজো করতে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। আর উইতে খেয়েছে প্রচুর পুথি। তার সংরক্ষণেরও উপায় ছিল। সেই কারণে আবার অনেকগুলো পুথি বেঁচে গেছে। আপনি দেখবেন যে, পালযুগের পুথি— কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির মিউজিয়ামে আছে— সেটা বেশ ভালো অবস্থাতেই আছে। আটশো, ন-শো, হাজার বছরের পুরনো কিন্তু সেগুলোর হাল খারাপ নয়।
তবে, মোদ্দায় কত পুথি যে নষ্ট হয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। আবার অনেকগুলো চিত্রিত পুথি বেহাত হয়ে গেছে, আমি জানি। যেমন আরেকটা পুথির কথা বলি। মহাভাগবতপুরাণ। এটাও ইলাস্ট্রেটেড। ছিল সরসীকুমার সরস্বতীর কাছে। প্রতিটি পাতা চিত্রিত। তো এইটা আমি খোঁজ করে পাইনি। আমি তাঁর মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলাম। কিন্তু কয়েকটা পাতার ছবি পেয়েছি কেবল। এটা আগাগোড়া ইলাস্ট্রেটেড এবং ষোলো শতকের বাংলা অক্ষরে লেখা। এইরকম পুথি কতটা কী নষ্ট হয়েছে বলা মুশকিল। নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি, বিদেশে কোনো কালেকটরের কাছে পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— প্রথম পর্ব
তন্ময়— আমি পুষ্পিকা ধরে ধরে মিলিয়ে দেখেছি, এখনও অবধি যে-সব পুথি পাওয়া গেছে, সেগুলির অর্ধেক যদি অষ্টাদশ শতক ও তার পূর্ববর্তী হয়, তাহলে বাকি অর্ধেক উনিশ শতকের। উনিশ শতক যেহেতু সাম্প্রতিককালের, তাই উনিশ শতকে লেখা প্রচুর পুথি অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং সেগুলো সংগ্রহশালায় রয়েছে। কিন্তু এখন আপনার লেখায় যে-সব চিত্রিত পুথির কথা উল্লিখিত হয়েছে, তাতে উনিশ শতকের পুথি প্রায় নেই বললেই চলে। উনিশ শতকে কি উডকাট, লিথোগ্রাফ ইত্যাদি ছাপা ছবির প্রবণতা চলে আসায় আস্তে আস্তে পুথির মধ্যে ছবি আঁকার শিল্পটা অবলুপ্ত হল?
অঞ্জন সেন— খুব ভালো প্রশ্ন করেছেন। আমি যেটা বললাম, পদ্মাপুরাণ, সম্ভবত ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দের— তো ওইরকম সময়ে আরও কিছু পুথি চিত্রিত হয়েছে। এর পরেই ছাপাখানা এল, বাংলা বই ছাপা হল। আপনি জানেন তখন পুথির স্টাইলে বই ছাপা হত। এবং খুব সম্ভবত ১৮১৮-তে ‘বিদ্যাসুন্দর’ ইলাস্ট্রেটেড হয়ে বেরোল।
তন্ময়— বাংলার প্রথম চিত্রিত বই।
অঞ্জন সেন— ঠিক। তখন পুথির থেকে এই ধরনের বই বেশি প্রচলিত হল। এবং সেগুলোর প্রচুর সার্কুলেশন হল। বিক্রিও ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করল। এর কিছুদিন পরে লিথোগ্রাফ এল এবং সেগুলোর আলাদা করে ছবি বেরোল। কালীঘাটের পটটা অন্য ব্যাপার, কিন্তু শাস্ত্রীয় যে ছবি—ঠাকুর-দেবতার ছবি—সেগুলোর ক্ষেত্রে একদম প্রথমে লিথোগ্রাফ এল, পরে ওলিওগ্রাফ হল, তারপর তো প্রিন্ট চলে এল। ইলাস্ট্রেশনে এগুলো তো অবশ্যই ক্ষতি করেছে। কারণ, তখন আর লোকে পুথি সেভাবে লেখাত না। তাও যা লেখানো হত, সেগুলো সাম্প্রদায়িক। সাম্প্রদায়িক মানে—ধরুন সহজিয়া সম্প্রদায়, আপনি একটু আগেই বলছিলেন যে-কথা। এরকম সম্প্রদায়ের বিশেষে পুথিগুলো ছিল। সেখানে কোনো ইলাস্ট্রেশনের কথা আমরা জানি না।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— এবং আমরা অনুমান করে নিতে পারি, উনিশ শতকে ছাপা বইয়ের তুলনায় হাতে লেখা ধর্মীয় পুথি পূজা-অর্চনার ক্ষেত্রে পুণ্যবস্তু বলে বিবেচিত হত। তার ফলে ছাপা বই চলে আসার পরেও হাতে লেখা পুথির ধারা উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। কিন্তু ছবি যেহেতু খুব অত্যাবশ্যকীয় জিনিস নয়, শখের— ফলে ছবির অংশটা আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল উনিশ শতকে পৌঁছে।
অঞ্জন সেন— হ্যাঁ, সেটাও ঠিক। আবার কিছু কিছু বইতে— যেমন তন্ত্রের পুথিতে নানারকম আসন, প্রতীক এগুলো কিন্তু থাকত। এরকম পুথি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে আছে, এশিয়াটিক সোসাইটিতেও বোধহয় আছে একটা। আমি যেটার কথা বলছিলাম শুরুতে, সেটাতে তো দেবদেবীদের সমস্ত ছবি রয়েছে। তার পাশে পাশে সংস্কৃত শ্লোক বঙ্গাক্ষরে লেখা রয়েছে বর্ণনা-সহ। যাই হোক, এইধরনের পুথিতে ক্ষেত্রে চক্র, আসন ইত্যাদি প্রতীকে আঁকা হত। এ-ধরনের বহু পুথি আছে। কিন্তু সেগুলোকে ফুললি ইলাস্ট্রেটেড পুথি হয়তো বলা যাবে না। কারণ, একটা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে, সিম্বলিক বিষয় নিয়েই এইসব প্রতীকী ছবি আঁকা হত।
তন্ময়— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথিশালায় যে পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গলের পুথি রয়েছে তার অনেকগুলো পাতা চিত্রিত। মূলত লাল, নীল আর কালো রং-এর প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায় সেখানে। আমরা অচিন্ত্য বিশ্বাস এবং অন্যদের লেখার থেকে কালো কালি মানে লেখার কালি তৈরির উপকরণ হিসাবে কী কী ব্যবহৃত হত, সেগুলো জানতে পেরেছি। কিন্তু পুথিতে আঁকার জন্য লাল, নীল— এইধরনের রংগুলো কীভাবে বানানো হত?
অঞ্জন সেন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌজন্যে আমি পুরো পুথিটা কপি করতে পেরেছিলাম। মানে ওঁরা কপি করে দিয়েছিলেন।
তন্ময়— তার কয়েকটা পাতা আপনি ছাপিয়েওছেন, বাকিগুলো কি আপনার সংগ্রহে আছে?
অঞ্জন সেন— হ্যাঁ, আমার কাছে আছে। পাতা মানে আসলে পাতার ছবি। ডিজিট্যাল।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সোমা মুখোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব
তন্ময়— যেটা আমার জিজ্ঞাস্য হল, পুথি আঁকার রংগুলো কীভাবে নির্মিত হত তবে সে-আমলে?
অঞ্জন সেন— আচ্ছা। এই অন্যান্য রঙের ব্যাপারেও বর্ণনা আছে। যাই হোক, আপনাকে বলি। আমাদের তুঁত থেকে হত ওই নীল রং। হরিদ্রা থেকে হলদে রং হত। লাল হত সিঁদুর থেকে। সাদা রং-এ অন্যান্য ভেষজ ব্যবহার করা হত। অবশ্য সাদা রং দু-রকমের হত। একটা হচ্ছে খড়িমাটির সাদা। শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি থেকে আরেকটা সাদা রং তৈরি করা হত। ফাইন সাদা। কালারটা দেখলে সেটা বোঝা যায়। সবুজ ভেষজ রং হত। তাছাড়া খয়েরি আছে। এগুলো মূলত ভেষজ রং হত। মৃত্তিকাজাত রং-ও ছিল। এগুলোর উপাদান ছিল খড়িমাটি, বিটমাটি, বেলেমাটি, এলা মাটি— হলুদ। এই রংগুলোই ব্যবহৃত হত। পরবর্তীকালে কালীঘাটের পটেরও যে বিবরণ পাচ্ছি, সেই রংটাও একদম দেশীয় বস্তুতে, মানে ভেষজ এবং ভূমিজ উপাদান থেকেই নেওয়া যেত। এবং কালো কালিটা ল্যাম্পের, লম্ফের থেকে নেওয়া হত। কাজলও ব্যবহৃত হত। এভাবে কালোর দু-তিনটে ভ্যারাইটি ছিল। আর আলতার রং-ও ব্যবহার করা হয়েছে অনেকক্ষেত্রে। কালীঘাটের পটে তুলির বদলে ‘আলতানুটি’ বলে একটা জিনিস ব্যবহার করা হত। তুলির ব্যবহার সেভাবে হত না। আলতানুটি-টাই ওঁরা ব্যবহার করতেন। সেই ট্র্যাডিশনটা ছিলই। ওঁরা যে সবসময় তুলি দিয়ে রং করেছেন, এমনটা নয়। অনেকভাবেই রং করা হয়েছে। তো এই সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়া যায়, আবার অনেক তথ্য পাওয়াও যায় না। আমরা জানি না। এখন তো সবাই বাজার থেকে কেনা রং ব্যবহার করেন। তবে পটুয়ারা পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও ভেষজ ও ভূমিজ রং ব্যবহার করতেন। পুঁইমেটুলি, খড়ি—এইসমস্ত নানারকমের রং আছে। তাদের বিবরণও আছে। একটা লেখায় বোধ হয় আমি তার কথা উল্লেখও করেছি।
তন্ময়— বাংলা ভাষায় যে-সমস্ত পুথি আঁকা হয়েছে, তার মধ্যে কাংড়া চিত্রশৈলী, রাজস্থানী চিত্রশৈলী ইত্যাদি বিভিন্ন ধারার ছাপ পাওয়া গেছে। বাংলার নিজস্ব কোনো চিত্রশৈলীর উদ্ভব ঘটেছিল কি? তার ছাপ পাওয়া যায় পুথির মধ্যে?
অঞ্জন সেন— হ্যাঁ, সেটা তো পাওয়া যায়ই। সেটা সবচেয়ে বেশি দেখা যাবে আমাদের বিষ্ণুপুর বা এইসব অঞ্চলে। বিষ্ণুপুরে মনে হয় ৫৮টা পাটাচিত্র আছে।
তন্ময়— বিষ্ণুপুরে তো রাজস্থানি শৈলীর প্রাধান্য?
অঞ্জন সেন— ওখানে আপনি যদি দেখেন, তাহলে দেখতে পাবেন, বেশ কিছু একদম দেশি শৈলীর ছবি আছে। এরকম আশুতোষ মিউজিয়ামেও কিছু আছে। আরেকটা জায়গা তো বন্ধই হয়ে গেল বোধ হয়। গুরুসদয় মিউজিয়াম। ওখানেও বেশ কিছু সংগ্রহ ছিল। এখন তো বন্ধ রয়েছে বহুদিন। বাংলার শিল্প এবং শিল্পকলার চর্চার একটা প্রধান কেন্দ্রই আমাদের হাতের বাইরে চলে গেল। আমরা ওখানে যেতে পারছি না, ব্যবহারও করতে পারছি না।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সোমা মুখোপাধ্যায়— দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— এই বঙ্গীয় চিত্রশৈলীর বৈশিষ্ট্যটা কী? কী দিয়ে পুথির এই বঙ্গীয় চিত্রশৈলীকে চিহ্নিত করা যায়?
অঞ্জন সেন— আমাদের চিত্রকলার প্রধান বিষয়টা কী? সেটা হচ্ছে রেখা। ভারতীয় চিত্রটা, অজন্তার থেকে যেটা এসেছে, সেটা হচ্ছে রেখার ওপর জোর দেওয়া। এটা ইউরোপীয় চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য নয়। এটাই ভারতীয় চিত্রকলার সঙ্গে ইউরোপীয় চিত্রকলার প্রধান পার্থক্য। এই রেখার প্রভাব যেটা সেই অজন্তা থেকে আসছে— এটা কালীঘাটের পটেই বলুন আর পুথিতে, সব জায়গায় পাওয়া যায়। তো রেখাটা স্থানবিশেষে পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলায় এটা আরও বেশি আঞ্চলিকতা পেয়ে যায়। কিন্তু মূল ব্যাপারটা আসছে কিন্তু ওইখান থেকেই। আবার আরেকটা দেখা যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে লোকশিল্প। লোকশিল্পের স্টাইলটা কিন্তু অন্যরকম।
তন্ময়— সেটাও পুথির মধ্যে ঢুকে পড়ছে?
অঞ্জন সেন— একদম। সেটাও পুথির মধ্যে ঢুকে পড়ছে। আর সূত্রধর সম্প্রদায়— এঁরা তো বহুযুগ ধরে ছবি আঁকছেন, কাঠের কাজ করছে্ন, আবার টেরাকোটার কাজও করছেন। টেরাকোটা মন্দির অধিকাংশই এঁদের করা। সূত্রধর ছাড়াও আরও কিছু সম্প্রদায় রয়েছে— যেমন, কুমোর সম্প্রদায়— এঁরাও প্রচুর কাজ করেছেন। ছবি তো এঁকেছেনই, টেরাকোটার কাজও করেছেন তাঁরা। তো এই সব সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা বংশানুক্রমিক শিক্ষা ছিল। এই শিক্ষাটা সময়বিশেষে একটু করে পাল্টেছে। ওই ধারাটা এবং তার সঙ্গে আঞ্চলিক শিল্পের যোগাযোগে যে-ধারাটা তৈরি হল, সেটাকেই বাংলা-কলম বলা হচ্ছে। বাংলা-কলম মানে একদম পিওর বাঙালি— সেরকম কিছু ব্যাপার নয়। কারণ বাংলা-কলমের মধ্যেও অনেক বিন্যাস রয়েছে।
তন্ময়— পরবর্তীকালে যে বেঙ্গল আর্টস স্কুল গড়ে উঠল, বাংলা-কলমকে তারই পূর্বসূরি বলা যেতে পারে?
অঞ্জন সেন— হ্যাঁ, সেটা বলা যায়।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব
তন্ময়— এই বাংলা-কলমটা কবে থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করল? মানে কোন শতাব্দী থেকে?
অঞ্জন সেন— বাংলা-কলমটা ধরুন… আমরা বলতে পারি যেটা, সরসীকুমার সরস্বতীর লেখায় ছিল—ওই পুথিটা ষোড়শ শতকের। ওইখান থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলা-কলম। আর পালযুগের চিত্রশৈলী তো অজন্তার থেকে চলে আসছে। সেখান থেকেই এই শৈলীর একটা রূপ ষোড়শ শতকের যে দু-একটা পুথি পাওয়া গেছে, সেখানে দেখতে পাচ্ছি। পালযুগের যে-চিত্রগুলো, তারই একটা অন্যরকমের রূপ।
তন্ময়— ষোড়শ শতক বললেন, তার মানে কি চৈতন্যের একটা প্রভাবও এই বঙ্গীকরণে খানিকটা সাহায্য করেছে?
অঞ্জন সেন— অবশ্যই সাহায্য করেছে। আমি তো আপনাকে বলছিলামই যে চৈতন্যদেব আসার পর আমাদের সংস্কৃতিতে, শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত এবং চিত্রকলায় একটা বদল আসে। ছবির অন্তর্ভুক্তিই নয়, ছবির ধারাতেও বৈশিষ্ট্য ঢুকে পড়ল তখন। লোকায়ত এবং ধ্রুপদী— দুটো একেবারে মিশে গিয়ে একটা নতুন ধারা তৈরি হয়ে গেল।
তন্ময়— প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে চিত্রকলার—বাংলায় তো চিত্রকলার বিভিন্ন উপাদান আছে— যেমন, মন্দিরের দেওয়ালে আঁকা হত, পটের ওপর আঁকা হত— সেখানে পুথি জিনিসটার মুখ্য উপাদান ছবি নয়। মুখ্য উপাদান হচ্ছে তার টেক্সট। সেখানে আমাদের প্রাচীন বাংলার চিত্রকলার ঐতিহ্য বুঝতে পুথিপাটা বা পুথিকে আপনার কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়?
অঞ্জন সেন— আমাদের কাছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পুথির পাটা ছাড়া... ধরুন ষোড়শ শতক থেকে সতেরো-আঠেরো শতক পর্যন্ত চিত্রকলার আর কোনো উপাদান নেই। মন্দিরগাত্রের চিত্র দু-একটা রয়েছে আর রথের গায়ের ছবি দু-একটা রয়েছে। তখন পট আঁকা হত। দু-রকমের পট ছিল। একটা হল পটুয়ারা যেটা আঁকতেন। পটুয়া বলে যে-সম্প্রদায় বা যে-জাতিটা আছে, আমি তাঁদের কথা বলছি। এখন বাংলাতে যাঁরাই ছবি আঁকতেন, তাঁদেরই পটুয়া বলা হত। এঁদের মধ্যে আবার ভাগ আছে। একটা হচ্ছে সম্প্রদায়ের পটুয়া। আরেকটা হচ্ছে শিল্পী সম্প্রদায়। চৈতন্যদেবের জীবনীতে যা দেখা যাচ্ছে…
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— আমাদের পুরো আলোচনায় বার বার ‘শিল্পী সম্প্রদায়’-এর কথা উঠে আসছে। ‘শিল্পী সম্প্রদায়’ বলতে কি সামগ্রিকভাবে যাঁরা আঁকতেন তাঁদের বোঝাতে চাইছেন? নাকি ‘শিল্পী’ বলে আলাদা কোনো গোষ্ঠীই ছিল, যাঁরা শুধু আঁকতেন?
অঞ্জন সেন— না, ‘শিল্পী সম্প্রদায়’ আলাদা গোষ্ঠী ছিল। যেমন বলা হচ্ছে, ‘এক ভাস্কর ঠাকুর আসি’ চৈতন্যদেবকে পট দেখাচ্ছেন। আচ্ছা, এই ভাস্কর কাদের বলা হত? ভাস্কর বলতে যাঁরা সূত্রধর সম্প্রদায়ের লোক, তাঁরা যেহেতু ভাস্কর্য করতেন পাথর এবং মাটির, তাই তাঁদেরকে ভাস্কর বলা হত। তো সেইরকম কোনো ভাস্কর এসে চৈতন্যদেবকে কৃষ্ণলীলার ছবি দেখাচ্ছেন। চৈতন্যদেব তাতে ভাবাবিষ্ট হয়েছেন। এরকম বেশ কয়েকটা জায়গায় পাওয়া যায়। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে তখন একরকম ছবি আঁকা হত।
ষোড়শ বা সপ্তদশ শতকে এইরকম ছবি আমরা পাই না পুথিপাটা ছাড়া। তো আমাদের কাছে পুথির পাটা ছাড়া আর কোনো চিত্রশিল্প পাওয়া যায় না। আর মন্দির দেওয়ালচিত্র যেগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো আরও একটু পরে। আর মন্দির দেওয়ালচিত্র আগে হত বলে শুনেছি বা শোনা গেছে এবং পড়া গেছে, কিন্তু সেগুলো আর দেখা যায় না। এরই আরেকটা প্রতিরূপ হচ্ছে আমাদের টেরাকোটা শিল্প। এই দুটোই পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত ছিল।
তন্ময়— আমি এবার শেষ পর্বের প্রশ্নে ঢুকে যাই। আপনি তো একজন কবি। আজীবন কবিতাচর্চার পাশাপাশি ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং শিল্পের চর্চাও করে গেছেন। যার অন্যতম অংশ পুথির ছবি নিয়ে গবেষণা। তা এই জাতীয় গবেষণামূলক কাজ কি কোথাও কবির মনকে পিছনে ঠেলে দেয়? মানে এইধরনের তথ্যভিত্তিক কাজকর্মের মধ্যে সর্বক্ষণ ডুবে থাকার জন্য কবিতা কি কোথাও কমপ্রোমাইজড হয়? কবিতা যে নির্দিষ্ট একটা মননের দাবি করে, সেটাকে কি কোথাও অবহেলা করা হয়ে যায়?
অঞ্জন সেন— এইটার ব্যাপারটা হচ্ছে যে— আমি মনে করি, আমি যে এই কাজটা করছি, এটা কবিতাচর্চারই একটা অঙ্গ। কবিতার আরও যে বৃহত্তর একটা ক্ষেত্র, গান— বাংলার পুরনো গান নিয়েও আমি চর্চা করি, আমি রবীন্দ্রচর্চা করি। এগুলো কবিতারই একটা বৃহত্তর ক্ষেত্র। এইটা হয়তো একদিক থেকে কবিতার ক্ষেত্রেই আমি আরও বেশি উপকৃত হচ্ছি।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কমল চৌধুরী
তন্ময়— প্রশ্নটা আরও নির্দিষ্ট করে করি। এই ধরনের গবেষণামূলক কাজকর্ম কি কোথাও কবিতার মনটাকে আরও বেশি প্রস্তুত করে নাকি কবিতার পথটাকে রুদ্ধ করে দেয়?
অঞ্জন সেন— না, কবিতার পথকে রুদ্ধ করে না। অবশ্যই করে না। বরং, মনটাকে একটু প্রশস্ত করে। আমরা আজকাল বলছি যে, মাল্টি-ডাইমেনশনাল স্টাডি। আর তখনকার দিনে কী হত? এই চৈতন্যদেবের সময়ই ধরুন। একদল লোক কীর্তন করছেন, একদল লোক টেরাকোটার মন্দির করছেন, একদল লোক ছবি আঁকছেন, কেউ নাচছেন— এঁদের মধ্যে একটা পারস্পরিক যোগাযোগ ছিল। আর তখন কবিতাটা তো আলাদা করে কবিতা বলে ছিল না। তাই সমস্ত কবিতাই গান, সমস্ত গানই কবিতা। এতগুলো ফর্ম একসঙ্গে কাজ করে চলেছে। মানে এগুলো এক একটা আঙ্গিক, কিন্তু এদের মধ্যে একটা সম্মেলন হচ্ছে। সম্মেলন হয়ে সেই আঙ্গিকটাই আরও ডেভেলপড হচ্ছে। তো আমি এটাই মনে করি যে, আমি যে-চর্চাটা করি তাতে কবিতাচর্চা উপকৃতই হয়েছে। সার্বিক যে শিল্পবোধ, এই চর্চা তাতে হয়তো আমাকে উন্নত করার চেষ্টা করছে বা আমার চিন্তাভাবনাকে আরও প্রসারিত করে তুলেছে।
তন্ময়— আপনার কবিতার মধ্যে ইতিহাস-চেতনা এবং ঐতিহাসিক ইঙ্গিতের ছাপ বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। সেটা কি ইতিহাসচর্চার ফলেই কবিতার মধ্যে এই প্রতিফলন দেখা দিয়েছে?
অঞ্জন সেন— হয়তো খানিকটা। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, সঙ্গীতে— আমি গান করি না, কিন্তু তাও চর্চার একটা জায়গা আছে, আমি এককালে প্রচুর গান সংগ্রহ করতাম, এখন আর হয় না। তো আমাদের ‘ভ্রমরা’ বলে একটা লোকসঙ্গীতের সংগঠন আছে। আমি তার সঙ্গে যুক্ত। তো এঁদের সঙ্গে কাজ করতে করতে আরেকটা ফর্ম তো খুঁজে পেলাম এর মধ্যে। আর ছবির সঙ্গে আমার সম্পর্ক— আপনি হয়তো জানেন বাংলার অনেক শিল্পীর সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি। তাঁদের ওপর লিখেছি বা তাঁদের সঙ্গে চিঠিপত্র বিনিময় হয়েছে, ছবি বিনিময় হয়েছে। আপনি যে ঐতিহাসিক পক্ষপাত বলছেন, সেটা এইগুলো থেকেই— আমি এটাকে সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পক্ষপাত বলব।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : অঞ্জন সেন— প্রথম পর্ব
তন্ময়— বুঝেছি। আপনার কবিতায় এই ইঙ্গিত বা প্রেক্ষাপট— এগুলো কি সচেতনভাবেই আসে নাকি আবহের মধ্যেই উপস্থিত বলে অবচেতনভাবে আপনার লেখায় চলে আসে?
অঞ্জন সেন— এগুলো চলে আসে। আমাকে আলাদা করে এটার জন্য ভাবতে হয় না। দু-একটা শব্দ হয়তো সচেতনভাবে চলে আসে। কিন্তু মূল ব্যাপারটা একেবারে এই চর্চারই প্রতিফলন সামগ্রিকভাবে। যেমন ধরুন, আমি যখন একটা গান শুনছি, আমি শুধু সুরটা শুনছি। ক্লাসিকালের কথা বলছি। কথায় নয়, আলাপের অংশে। ওখান থেকে একটা আবহ তৈরি হয়ে যায়, একটা শব্দপ্রয়োগ তৈরি হয়ে যায়। ধরুন, ছবি দেখছি, ছবি দেখতে দেখতেও এইরকম একটা ব্যাপার উঠে আসে। এটাকে কী বলব? এটা ভেতরে ঢুকে যায়।
(সমাপ্ত)
অনুলিখন— শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
অলঙ্করণ— অমর্ত্য খামরুই
Powered by Froala Editor