ঈর্ষাক্ষাৎকার: অঞ্জন সেন— প্রথম পর্ব

অঞ্জন সেনের জন্ম ১৯৫১ সালে, কলকাতায়। কবি ও প্রাবন্ধিক। ‘গাঙ্গেয়পত্র’ পত্রিকার সম্পাদক। বর্তমান ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘মধ্যযুগের বাংলার পুঁথিপাটার চিত্র’ (প্রকাশসাল ২০২১) বইটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে অঞ্জনের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ প্রথম পর্ব...


তন্ময়— পুথি নিয়ে যত চর্চা হয়, পুথি-পাটার ছবি বা পুথির ভেতরে আঁকা ছবি নিয়ে আলোচনা বা গবেষণা সেই তুলনায় অনেকটাই কম। এমন একটা ব্যতিক্রমী বিষয় নিয়ে কাজ করার আগ্রহ জন্মাল কীভাবে?

অঞ্জন সেন— ঠিকই বলেছেন, এই বিষয় নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়নি। এ-বিষয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মতো কাজ করে গেছেন সরসীকুমার সরস্বতী। তা অবশ্য পাল-যুগের চিত্রকলা নিয়ে। পরবর্তীতে পুথি-পাটার চিত্র নিয়ে কাজ সেভাবে হয়নি। খুবই ছোটো ছোটো লেখা। এদিকে আমার এটা জানার আগ্রহ জাগে, যে, বাঙালির চিত্রকলার ইতিহাসটা কী? বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আছে, বাংলার সঙ্গীতের ইতিহাস আছে, কিন্তু বাংলার চিত্রকলার ইতিহাস আলাদাভাবে কোথাও নেই। তো তার সূত্রগুলো খুঁজতে খুঁজতে আমি দেখলাম যে, বাংলার পুথিতে অনেক ছবি আঁকা হত। একটা হচ্ছে পুথির পাটায় অর্থাৎ কভারে, আরেকটা পুথির ভেতরে। বহু জায়গায় সচিত্র পুথি পাওয়া গেছে। বিষ্ণুপুর, চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি জায়গাতে এ-ধরনের বহু পুথি পাওয়া গেছে। বাংলার চিত্রকলার একটা শৈল্পিক ধারা আছে। উত্তর ভারতীয় রাজপুত, কোথাও ওড়িশা চিত্রকলার সঙ্গে বাংলার এই ধারা মিশেছে। কিন্তু বাংলার নিজস্ব একটা ধারার চিত্রকলাও আছে। আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রয়াত ভোলানাথ ভট্টাচার্য মহাশয়ের থেকে গভীরে গিয়ে কাজ করার ব্যাপারটা শিখতে পারি। ‘বাংলাকলম’ শব্দটা উনিই প্রথম ব্যবহার করেছিলেন।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— প্রথম পর্ব

তন্ময়— পুথি লেখার পাশাপাশি পুথি-পাটা বা পুথির পাতার ওপর ছবি আঁকা একটা পৃথক কাজ। পাটাচিত্র আঁকতেন মূলত সূত্রধররা। কিন্তু পুথির ভেতরে যে-সমস্ত ছবি, সেগুলো কি লিপিকররাই আঁকতেন, নাকি পৃথক শিল্পীর সাহায্য নেওয়া হত?

অঞ্জন সেন— এখানে বলে রাখি, পাটাশিল্প সূত্রধররা আঁকতেন ঠিকই, কিন্তু সূত্রধর ছাড়াও আরও কিছু শিল্পীর কথা আমরা জানতে পারি, যাঁরা সূত্রধর নয়। যেমন, পটুয়া সম্প্রদায়েরও আঁকা আছে। এইসব নিয়ে গবেষণা আছে। তারাপদ সাঁতরা ও সুধাংশু রায়— এঁদের থেকে কিছু কিছু কথা আমরা জানতে পারি। যাই হোক, মূলত সূত্রধররাই পুথির পাতা আঁকতেন। আর ভেতরের চিত্র যেগুলো পাওয়া গেছে—যেমন ধরুন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে রক্ষিত গীতগোবিন্দের একটা পুথি, বা ধরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত পদ্মাপুরাণের পুথি—এগুলো কিন্তু লৌকিক শিল্পের মধ্যে পড়ে যায়। এই ইলাস্ট্রেশনগুলোর কথা বলছি। আবার চুঁচুড়ায় গীতগোবিন্দের একটা পুথি ছিল, সেই পুথিটা আমি দেখতে পাইনি, এখন আর পাওয়াও যায় না। সেটা যে কোথায় আছে কেউ জানে না। সেই পুথিটা কিন্তু মূলত সূত্রধর এবং কয়েকটা অন্যান্য শিল্পী সম্প্রদায়ের লোকেরাই এঁকেছেন। আবার একটু আগেই আমি পদ্মাপুরাণের পুথিটার কথা বললাম, ওটা লোকায়ত চিত্রকলার পরিচয়। এরকম আরেকটা গীতগোবিন্দর পুথি আছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে, বাংলা হরফে লেখা—এটা এই দুই ধারার মাঝামাঝি একটা জায়গা পড়ে। এটার প্রতিটা পাতাই ইলাস্ট্রেটেড। আরেকটা পুথির কথা বলতে পারি। সেটা একটা তান্ত্রিক পুথি। পুথিটার নাম ‘চক্রাবলী’, এটা সংস্কৃত কলেজের সংগ্রহে আছে। এর প্রতিটা পাতাতে তান্ত্রিক দেবীদের ছবি রয়েছে এবং সে-ছবিগুলো যে-চিত্রকর এঁকেছেন, তিনি ছবি আঁকা জানতেন।

আবার এরকমও দেখা গেছে যে, ডুডলিং করা। ধরুন, খাতার ভেতরে একটা সাপ এঁকে দিল—যেটা পদ্মাপুরাণের পুথিতে দেখা গেছে। সাপটা কিন্তু ভালোই লাগছে দেখতে। টেক্সটের মধ্যে, মানে পুথির পাতার মধ্যেই আছে সেটা।

তো দেখা যাচ্ছে, সূত্রধর ছাড়াও বহু শিল্পী সম্প্রদায় বাংলাতে ছিলেন। লৌকিক শিল্পে তাঁদের কাজকর্মের সম্পর্কে সুধাংশুবাবু লিখেছেন, আমি পুথিটা দেখতে পাইনি। তবে মেদিনীপুর অঞ্চলের দু-একটা পুথিতে তাঁদের ইলাস্ট্রেশন রয়েছে। সেই পুথিগুলো কোথায় আছে, সেগুলোর আমি সন্ধান করতে পারিনি। কিন্তু সুধাংশুবাবুর মতো লোক সেটার ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন। ফলত দেখা যাচ্ছে, এখানে আমাদের বৈচিত্র্য রয়েছে।

আরেকটা জিনিস আমি একটু বলি। আমরা যে পুথির পাটাগুলোর কথা বলছি বা চুঁচুড়ার যে-গীতগোবিন্দের কথা বললাম, এগুলোতে কিন্তু উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় চিত্রকলার প্রভাব বা ছাপ আছে। সেই সময়ের শিল্পীরা এখানে আসা-যাওয়া করতেন, তার অন্য প্রমাণও আছে। বাংলার বিষ্ণুপুরে বা অন্যত্র ছোটো ছোটো যে রাজারা ছিলেন, সেখানে এইসব শিল্পীরা আসতেন। রাজস্থান থেকে বা কাংড়া থেকে, ওড়িশা থেকে তো বটেই—এইসব শিল্পীরা এসেছিলেন। তো এঁদের সঙ্গে বাংলার শিল্পকলার মিশ্রণ— যাকে আমরা বাংলাকলম বলি, সেসবের ছাপ পুথির পাতায় দেখা যায়। বিষ্ণুপুরে যদি যান, যোগেশচন্দ্র পুরাকীর্তি ভবনে যে-পাটাগুলো দেখবেন, সেগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই রাজপুত বা কাংড়ার চিত্রকলার ছাপ রয়েছে।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— পুথির ভেতরে ছবি আঁকার সময়, আগে কি চিত্রকররা আঁকতেন এবং তারপর লিপিকররা লিখতেন? নাকি লেখার পরে ছবি আঁকা হত? এই দুই সম্প্রদায় পেশাজীবীর মধ্যে বোঝাপড়া কেমন ছিল?

অঞ্জন সেন— পুথির পাটায় তো আলাদাভাবেই করা হত। যেমন বৈষ্ণব পদাবলি—তখন বৈষ্ণবীয় চিত্রকলাই হত বেশি, শাক্ত পুথি খুব কমই পাওয়া গেছে। মুশকিল হচ্ছে যে, প্রতিটা ক্ষেত্রেই প্রায় পাতাগুলোকে মূল পুথির থেকে খুলে নেওয়া হয়েছে সংরক্ষণের জন্য। ফলে কোন পুথির কোন পাটা, সেটা আর ঠিকভাবে চেনা যায় না। এগুলো সংগ্রহশালাতে আলাদা আলাদাভাবে আছে। অনেক সময় হয়তো ভেতরটা হারিয়ে গেছে, কিন্তু পাটাটা রয়ে গেছে। যেমন, আশুতোষ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এক পাটাতে ভয়ঙ্করী একটি কালীমূর্তির ছবি আছে। তার সঙ্গে আমাদের বর্তমান কালীর কোনো মিল নেই, কিন্তু এই পাটাটা আছে। ছবিটা ভয়ঙ্করী হলেও সেখানে আঁকার পরিষ্কার শৈলী রয়েছে। এটা কোন পুথির পাটা, জানা যায় না। আরেকটি লোকায়ত পুথির কথা বলছি—মনসামঙ্গলের পুথিটা। ওটায় জায়গা ছাড়া থাকত। মানে আগে লিখছে, তারপরে ছবি আঁকা হয়েছে। এরকম মনে হয়। আর যেগুলো উত্তর-ভারতীয় শৈলীতে গীতগোবিন্দি পুথিটি— এটাতে কিন্তু আলাদাভাবে ছবি আঁকা হয়েছে। আবার কখনও কখনও একইসঙ্গে ছবি আঁকা হয়েছে। সেখানে যিনি চিত্রকর, তিনিই লিখছেন। এই তিনরকম শ্রেণীই দেখতে পাওয়া যায়।


তন্ময়— আমি বিশ্বভারতীর পুথিশালায় বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসামঙ্গল একটা পুথি দেখেছি, যেখানে পুথির ভেতরে কিছু পাতা অন্তর অন্তর শিবলিঙ্গের ছবি আঁকা, টেক্সটের ফাঁকে-ফাঁকেই। রঙিন নয়, কালোতেই। আপনার লেখাতেও অনেক পুথির কথা উঠে এসেছে যেখানে কালো কালিতে ছবি আঁকা। কাজেই আমরা কি অনুমান করে নিতে পারি যে এই জাতীয় ছবিগুলো সরাসরি লিপিকররাই লেখার মধ্যিখানে আঁকতেন?

অঞ্জন সেন— হ্যাঁ, অনেকসময় তাঁরাই আঁকতেন। সুকুমার সেনের সংগ্রহ বা আমাদের যাদবপুরে যে-সংগ্রহশালাটা আছে, সেখানেও বেশ কয়েকটা পুথিতে এ-ধরনের ছবি করা আছে। সেটা লিপিকররাই এঁকেছেন বলে আমার ধারণা। তাঁরা লিখতে লিখতেই হয়তো এঁকেছেন। কারণ সেখানে এই সূত্রধর বা অন্য শিল্পীদের পরিচয়টা পাওয়া যাচ্ছে না। সেটা অনেকটাই দেশজ শৈলী। সুতরাং মনে হয় যাঁরা লিখছেন, তাঁরাই ছবিটা এঁকে দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সোমা মুখোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব

তন্ময়— পুথির ভেতরে ছবি আঁকার উদ্দেশ্য কী ছিল? পুথির সৌন্দর্যায়ন, নাকি পুথির ভেতর লিখিত কাহিনিকে তুলে ধরা? নাকি যে-দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হচ্ছে, পুণ্যলাভের আশায় তাঁদেরই অবয়ব আঁকা?

অঞ্জন সেন— হ্যাঁ, যেমন আমি একটা আগে তান্ত্রিক পুথিটার কথা বলছিলাম। সেখানে যে-সমস্ত তান্ত্রিক দেবীদের আবয়ব রয়েছে, তাঁদের বর্ণনা রয়েছে। অর্থাৎ এগুলো পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। আর কোনো কোনো পুথিতে ঘটনা রয়েছে, সেখানে সেই ঘটনাগুলোই ইলাস্ট্রেট করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো জায়গায় গ্যাপ ভর্তি করতে একটা-দুটো ড্রইং-এর মতো চলে এসেছে। বা একটা ছোটোখাটো রেখাচিত্র করা হয়েছে। এটাও দেখতে পাওয়া যায়। একটা প্ল্যানড ওয়ে-তে করা। যেমন আমরা ওই গীতগোবিন্দের কথা বলতে পারি, ‘চক্রাবলী’ বলে তান্ত্রিক পুথিটির কথা বলতে পারি, তাছাড়া বাংলা অক্ষরে লেখা যে-গীতগোবিন্দ আছে সেখানেও জায়গা ছেড়ে অর্থাৎ পরিকল্পনা করেই আঁকা হয়েছে।


তন্ময়— প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে বাংলা ভাষায় অজস্র পুথি লেখা হয়েছে। সেগুলো বেশিরভাগই ফরমায়েশি। অর্থাৎ, মূল্যের বিনিময়ে লিপিকরকে দিয়ে লেখানো। সেখানে চিত্রকরদেরও নিশ্চয়ই মূল্য দিয়ে ছবি আঁকানো হত? পাশাপাশি, গার্হস্থ্য ব্যবহারের জন্য যে-সব পুথি দেখা যায়, মানে কোনো ব্যক্তি নিজের ব্যবহারের জন্য কাউকে দিয়ে পুথি লেখাচ্ছেন—সেই জাতীয় পুথিতে ছবি আঁকানোর প্রবণতা বেশি নাকি যে-পুথিগুলো কোনো বৃহত্তর উৎসব ও অনুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সেগুলোয়?

অঞ্জন সেন— যেগুলো ঠাকুর বা দেবদেবী সংক্রান্ত, সেই পুথিগুলোতেই বেশি চিত্র রয়েছে। আর গার্হস্থ্য পুথিতেও অবশ্যই ছবি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে সেখানে সেরকম হয়তো নয়। এটা পরিষ্কার যে, তখনকার শিল্প, সাহিত্য সবই ধর্মচর্চার একটা অঙ্গ ছিল। সেই আঙ্গিক থেকেই মূলত ছবিগুলো আঁকা হয়েছে। এটা শুধু বাংলা কেন, ভারতবর্ষের অনেক জায়গাতেই হয়েছে। বাংলার থেকে আসামে চিত্রিত পুথি বেশি পাওয়া গেছে। উত্তর ভারতে তো কথাই নেই। বাংলাতে অনেক পুথি হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা এক-একটা পুথির পাতা দেখেছি, সেটা বাংলায় লেখা এবং ছবিও আঁকা, কিন্তু সম্পূর্ণ পুথিটা পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে প্রিজার্ভেশনের একটা ব্যাপার আছে, ওয়েদারেরও ব্যাপার আছে। এই সমস্ত ব্যাপারগুলো পুথির ওপর প্রভাব ফেলে।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সোমা মুখোপাধ্যায়— দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— আমরা যেটা আগেই বললাম, পুথি লেখানোর বিষয়ে লিপিকরদের মূল্য দিতে হত, আবার চিত্রকরদেরও। সেক্ষেত্রে আপনার অবজার্ভেশন কী বলে? যাঁরা পুথির ভেতর ছবি আঁকাতেন, মানে চিত্রিত পুথি যেগুলো তৈরি হত, সেগুলো কি বেশিরভাগই অর্থবানদের পৃষ্ঠপোষকতায়? নাকি সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থদের কাছেও এ-ধরনের পুথি মিলেছে যথেষ্ট?

অঞ্জন সেন— দেখুন, পুথির ক্ষেত্রে একটা মূল লেখা হত। এবং তার অনেকগুলি অনুলিপি অর্থাৎ কপি হত। কোনো কোনো পুথিতে কপি করা ছবি থাকত। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকত না। ছবির ক্ষেত্রে সূত্রধর শিল্পীদের বলা হত ছবিগুলো এঁকে দিতে। তো, তাঁরা একটা দক্ষিণা অবশ্যই পেতেন। লিপিকররাও দক্ষিণা পেতেন। এবং কোথাও কোথাও লিপিকররাও ছবি আঁকতে পারতেন—এরকম দৃষ্টান্তও পাওয়া গেছে, সে-কথা খানিক আগেই বলছিলাম আপনাকে।


তন্ময়— ফলে যাঁরা একটু সম্পন্ন গৃহস্থ, এই জাতীয় পুথি তাঁদের কাছেই কি দেখা গেছে? কারণ, সপ্তদশ শতক থেকে সহজিয়া সাহিত্যের প্রচুর পুথি পাওয়া গেছে। সেইসব পুথির মধ্যে চিত্রিত পাতা খুব একটা বেশি পাওয়া যায় না, বরং যেগুলো ক্লাসিক পুথি সেগুলোতেই বেশি পাওয়া যায়। ফলে চিত্রিত পুথির সঙ্গে অর্থের যে-একটা প্রাচুর্য সমান্তরালভাবে চলেছে, সেইটা কি আমরা অনুমান করে নিতে পারি?

অঞ্জন সেন— হ্যাঁ, সেটা অনুমান করে নেওয়া যায়। তবে এগুলো—মানে ছবি আঁকাতে হবে, ইলাস্ট্রেট করাতে হবে, তাতে খুব বেশি খরচা হত বলে মনে হয় না। ব্যাপারটা হচ্ছে যে লোকের আগ্রহ। যিনি পুথিটা লেখাচ্ছেন, তাঁর ব্যক্তিগত রুচির ওপর নির্ভর করছে অনেকটা। আবার পুথিচিত্রের সঙ্গে টেরাকোটাকে মেলাতে পারি। টেরাকোটার ফলকের ধরনের সঙ্গে পুথির ধরনটা—মানে আর্টিস্টিক স্টাইলটা পরিষ্কার মেলানো যেতে পারে। যেহেতু বিষ্ণুপুরের দিকটায় পুথি বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে, ফলে এরকম একটা স্টাডি করা যেতেই পারে।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব

তন্ময়— আমরা এ থেকে বোধ করি আরেকটা সিদ্ধান্তেও আসতে পারি যে, পুথির ভেতরে ছবি আঁকা ছাড়াও পুষ্পিকা-সহ অন্যান্য অংশে যে বিভিন্ন অলঙ্করণ দেখা যায়—রেখা-অলঙ্করণ, সেগুলো লিপিকররাই করে নিতেন। নাকি বাইরের চিত্রকরের প্রয়োজন পড়ত?

অঞ্জন সেন— আমি বেশ কিছু দেখেছি এরকম, কপিও করেছি। ওগুলো যতদূর দেখে মনে হয়, লিপিকররাই করতেন। ছোটো ছোটো ডিজাইন যেগুলো— অলঙ্করণ বলে যাকে, সেগুলো লিপিকররাই করতেন। কারণ, ছোটো-খাটো অলঙ্করণের দক্ষতা তাঁদের ছিল। আর লিপিকরদের একটা সম্প্রদায়ই ছিল, তাঁদের বলা হত আঁখরিয়া।


তন্ময়— আচ্ছা। তাঁদের বৈশিষ্ট্য কী?

অঞ্জন সেন— আঁখরিয়ারা হচ্ছেন পেশাদার পুথি লিখিয়ে। এই সম্প্রদায়ের মানুষরাই পুথি-টুথি লিখতেন। আরেকটা জিনিস আপনাকে জানাই, এই যে পুথির পাটাতে—বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ পুথির পাটা, এগুলো আগে ড্রইং করে নেওয়া হত। বিষ্ণুপুরের একটা পাটাতে রংটা উঠে গেছে। কিন্তু নিচের রেখাগুলো পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। তার মানে ড্রইংটা আগে হয়েছে, পরে তার ওপর রংটা চাপানো হয়েছিল।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— দ্বিতীয় পর্ব

তন্ময়— বাংলা পুথি-পাটায় যত ছবি পাওয়া যায়, সেখানে কি শাক্ত বা শৈবের তুলনায় বৈষ্ণব প্রাধান্যই বেশি? এবং এর সঙ্গে চৈতন্যের আগমনের প্রভাব কতখানি?

অঞ্জন সেন— আসলে ব্যাপারটা হল, বৌদ্ধ চিত্রকলা যেটা—পাল যুগের, আস্তে আস্তে সেটা শেষ হয়ে গেল। তারপর বৈষ্ণবীয় চিত্রকলা শুরু হল। এই ব্যাপারটা আরও জোরদার হল চৈতন্যদেব আসার পর। আমাদের সাহিত্যে, শিল্পে—সব জায়গাতেই ওঁর একটা প্রভাব পড়ল। ফলত চৈতন্যদেবের সময় যত পট আঁকা হল, যত পুথি লেখা হল, যত বৈষ্ণবীয় সাহিত্য লেখা হল, তত বৈষ্ণবীয় ছবিও আঁকা হল। বৈষ্ণবীয় চিত্রকলারও বিকাশ হল। সেটা মন্দির স্থাপত্যে হোক, মূর্তিতে হোক। আর পুথির প্রচলন শাক্তদের মধ্যেও ছিল। তবে তখন তন্ত্রচর্চাটা একটু আড়ালে হত।

আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার: কমল চৌধুরী

তন্ময়— তন্ত্রের চক্র, যন্ত্র ইত্যাদি তো আঁকাই হত।

অঞ্জন সেন— হ্যাঁ, ঠিক। তন্ত্রের চিত্রটা একটু আলাদা হত। এবং তান্ত্রিক যে-পুথিগুলো সেগুলো অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি জানি, অনেকেই এই পুথি নষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু এইধরনের পুথি তুলনায় কম পাওয়া গেছে। এই গেল বৈষ্ণব ও শাক্ত পুথির ইতিহাস।

একটা পুথির পাটাতে সহজিয়া বৈষ্ণবের সঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের হাতাহাতি ঘুষোঘুঁষির ছবি আঁকা রয়েছে। তারাপদ সাঁতরা মশায় এইটার বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু খবর নিয়ে দেখলাম এই পুথিটার আর কোনো ট্রেস পাওয়া যায় না। দেখা যাচ্ছে যে, বৈষ্ণব এবং সহজিয়া বৈষ্ণবদের মধ্যে একটা বিরোধ বা মতবিরোধ হয়েছে। আমরা এরকম কিছু সামাজিক ঘটনাও ডকুমেন্টেড পাই। কিন্তু এই সামাজিক ঘটনাগুলো অতটা প্রকট হয়নি, কয়েকটার কথা আমরা জানি। বেশিরভাগটাই নষ্ট হয়ে গেছে। যেমন এটার কথা বললাম। পাশাপাশি, সমাজে শাক্ত ও বৈষ্ণবদেরও একটা প্রবল লড়াই ছিল। কিন্তু ইলাস্ট্রেটেড, সামাজিক ঘটনা দেওয়া শাক্ত পুথি নজরে পড়েনি। দেবীদের ছবি দিয়ে—মানে শিল্পের নিরিখে যেগুলোর বিশেষ মূল্য আছে—এই পুথিগুলো নিয়ে কেন আলোচনা হয়নি আমি জানি না। আর শৈব পুথি কিছু পাওয়া গেছে। শিবের সঙ্গে দুর্গা চলেছেন, এরকম কিছু পুথি মিলেছে।

(চলবে)

অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই 

Powered by Froala Editor