অলোক সরকারের জন্ম ১৯৯৪ সালে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাসন্তী থানার ভাঙ্গনখালী গ্রামে। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত। পূর্বপ্রকাশিত দুটি কবিতার বই ‘ছায়াশিকার অথবা রূপকথার বালিশ’ ও ‘যুবাপুরুষের শীত’। সম্পাদনা করেন ‘তাবিক’ নামের একটি পত্রিকাও। বর্তমান কথোপকথনটি আবর্তিত হয়েছে তাঁর ‘শ্মশান: মিথ পুরাণ ইতিহাস’ (প্রকাশ – ২০২২) গ্রন্থটিকে কেন্দ্র করে। কথোপকথনে অলোকের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
(প্রথম পর্বের পর)
তন্ময়— আপনার বইয়ের যে দুটো অংশ আমার সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে, সেগুলো ক্ষেত্রসমীক্ষার ফলে উঠে আসা— একটা শ্মশানের দেওয়াল, অলঙ্করণ ইত্যাদি, আর অন্যটা শ্মশানের স্মৃতিমন্দির, স্মৃতিসৌধ এবং অনুদান ফলক। এগুলোয় জীবিত বা মৃত মানুষের মনের যে টানাপড়েন—শ্মশান মানুষকে যেভাবে একটা বৈরাগ্যের দিকে ঠেলে দেয়, শূন্যতার মুখোমুখি দাঁড় করায়, বা একটা বৃহৎ উপলব্ধির সামনে নিয়ে যায়, তার প্রতিফলন রয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি আমাদের বাংলায়, বিশেষ করে গ্রাম বাংলার দিকে, মফস্সলে শ্মশানকে কেন্দ্র করে কালী বা শিব ছাড়াও বিভিন্ন দেবদেবীর অধিষ্ঠান দেখা যায়। আপনার বইয়ের পরবর্তী খণ্ডে কি সেই দিকটা উঠে আসবে?
অলোক সরকার— আমি শিব, কালী ছাড়াও কোথাও ছিন্নমস্তার মন্দির দেখেছি, কোথাও ষষ্ঠীঠাকুর দেখেছি। এগুলোর কথা যথাসম্ভব লিখেছি। যদি সে-ধরনের তথ্য আরও পাই, যে-কোনো আঞ্চলিক দেব-দেবীই হোক না কেন, তাঁরা যদি শ্মশানে পূজিত হন, তবে নিঃসন্দেহে শ্মশানের দেবতা অংশে আমি গ্রহণ করব।
আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: অলোক সরকার — প্রথম পর্ব
তন্ময়— বিভিন্ন শ্মশানে ঘুরতে গিয়ে আমরা এমন সব চরিত্রের মুখোমুখি হই, যাঁদের হয়তো আমাদের চটজলদি শহুরে মানসিকতায় বা স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে খাপ খাওয়াতে পারি না। আপনিও নিশ্চয়ই শ্মশানে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে এমন অনেককে দেখেছেন। সেই অভিজ্ঞতা কীরকম?
অলোক সরকার— শ্মশানে তিন শ্রেণির মানুষ বেশি পাওয়া যায়। এক হচ্ছে, আমাদের দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা উত্তর ২৪ পরগনা জেলার শ্মশানে নেই, কিন্তু হাওড়া-হুগলি-বাঁকুড়া-বীরভূম— এই অঞ্চলের শ্মশানে, বেশিরভাগ শ্মশানেই একজন বা একাধিক সাধক আছেন। এবং এই সাধকরা মূলত তিন রকমের। একদল হচ্ছেন সরল সাধক। এঁদেরকে যদি জলকে মাটি বলি, তিনি তাই বিশ্বাস করবেন, আবার হাওয়াকে যদি গাছ বলি, তিনি সেটাও বিশ্বাস করবেন। এবং তাই বিশ্বাস করেই দিনের পর দিন তাঁরা কালীসেবা করে থাকেন। দ্বিতীয় ধরনের মানুষ ঠক, প্রবঞ্চক। এঁদের প্রতিদিনের কাজ হচ্ছে কীভাবে মানুষকে ঠকিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়া যায়, সে-সমস্ত কাজ করা। তারাপীঠের নাম উচিত কিনা জানি না। তবে তারাপীঠ শ্মশানে এমন অনেক মানুষ দেখেছি। যাঁরা শ্মশান সাধক হন তাঁদেরকে নিজের পিণ্ড নিজেকে দিতে হয়। যখন তুমি নিজের পিণ্ড দিচ্ছ, তখন তো তোমার জাগতিক লোভ, মায়া, মোহ— কিচ্ছু থাকার কথা নয়। কিন্তু তাঁরা শ্মশানে থেকেই দু-তিনটে লজের মালিক। তাঁদের নাগরিক প্রেমিকা রয়েছে। এটা গেল সাধকের ভিতরে। আর তৃতীয়ধরনের সাধক হল উচ্চমার্গের সাধক। তাঁদের সঙ্গে মিশলে সমীহ আসে। সেরকম সাধকের দেখা হয়তো আমি পাইনি এখনও পর্যন্ত। আরেক হচ্ছে মাতাল…
তন্ময়— এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলে রাখি বা জিজ্ঞেস করি। বাংলায় এমন নির্দিষ্ট বেশ কিছু শ্মশান আছে, যেমন উদাহরণ হিসাবে বলতে পারি, কল্যাণী ঘোষপাড়ার শ্মশান, যে শ্মশানগুলোয় বিশেষ বিশেষ তিথি বা উৎসব উপলক্ষে জনসমাগম হয়, এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে সাধুরা বা অঘোরীরা— বিভিন্ন শ্রেণির সাধুরা এসে হাজির হন। সেটা তাঁদের স্থির অধিষ্ঠানের ক্ষেত্র নয়। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা আসেন। সেরকম কোনো ভ্রাম্যমাণ সাধকের দর্শন পেয়েছেন?
অলোক সরকার— না, আমি ভ্রাম্যমাণ সাধকের গল্প শুনেছি। কিন্তু তাঁদের দর্শন পাইনি।
আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: বিশ্বজিৎ রায় — প্রথম পর্ব
তন্ময়— আপনি বললেন, এক সাধুসন্ত, আরেক হচ্ছে মাতাল। এই দুইধরনের লোকই শ্মশানে মূলত দেখা যায়…
অলোক সরকার— আরেকধরনের লোকও দেখা যায়। যাঁরা গান করেন। অর্থাৎ যাঁরা হচ্ছেন গাইয়ে। মানে এঁরা হয়তো সবসময় থাকেন না শ্মশানে।
তন্ময়— এটা হয়তো কলকাতার শ্মশানগুলোয় দেখা যায় না ততটা।
অলোক সরকার— হ্যাঁ, এটা কলকাতার শ্মশানে দেখা যায় না। গ্রাম বাংলায় দেখা যায়। এবং তাঁরা কাছে খবর পৌঁছালেই হবে যে মানুষ মারা গেছে। কে মারা গেছে, কোথায় মারা গেছে, কিচ্ছু লাগবে না। তাঁরা খোল-করতাল নিয়ে চলে যাবেন। মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গে গান গাইতে গাইতে যাবেন। এবং মৃতদেহ যতক্ষণ না দাহ হচ্ছে, তাঁরা ততক্ষণ পর্যন্ত গান গাইবেন। সে পরীক্ষিত বালা হোক বা কিশোরকুমারের ‘চিতাতেই সব শেষ’ হোক, কি হরিনাম কীর্তন হোক— তাঁরা গান গাইতেই থাকবেন।
আরেকটা শ্রেণির মানুষও আমি দেখেছি। ডোম। আপনি বললেন বলে মনে পড়ছে। আমি হয়তো ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না। ডোম সম্প্রদায়ের মানুষেরা কিন্তু শ্মশানেই থাকেন। হয়তো তাঁদের চুল্লিতে, যে কাঠে ভাত ফুটছে, ডাল ফুটছে, সেগুলো হয়তো চিতার চুল্লির কাঠ। অধিকাংশ ডোম বাড়ির রান্না কিন্তু চিতার কাঠ দিয়েই হয়। দেখেছি যে, যাঁরা শ্মশানে থাকেন, তাঁদের শ্মশানই কিন্তু সব। শ্মশানেই ওদের খেলা, আনন্দ, বাড়ি, বিয়ে— সব।
আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: বিশ্বজিৎ রায় — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— শ্মশানের নেশা ব্যাপারটিও এড়ানোর মতো নয়। মাতালের পাশাপাশি গেঁজেলের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। আধুনিককালে নির্জনতার সুযোগ নিয়ে শুধু মদ বা গাঁজাই নয়, আরও অন্যান্য নেশা ডেনড্রাইট, চরস— ইত্যাদির দিকেও পৌঁছেছে। এবং শ্মশানে নেশা করলে যেহেতু সচরাচর কেউ বাধা দিতে আসে না, সে-জন্য একটা সাধারণ ধারণা জন্মেছে যে, শ্মশান হল নেশার একটা অবাধ বিচরণক্ষেত্র। এ-ব্যাপারে আপনার কী পর্যবেক্ষণ?
অলোক সরকার— আমি গাঁজা এবং মদ— এই দুটিই দেখেছি। এর বাইরে আমি আর কিছু দেখিনি। প্রথমত, আমার এই বিস্তৃত ক্ষেত্রসমীক্ষায় এই বিষয়টি আমার মাথায় ছিল। আরও দু-তিনটি বিষয় আছে, সেগুলো যেমন হচ্ছে তন্ত্র— তন্ত্র শ্মশানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তো তন্ত্র, নেশা এবং সাহিত্য— মানে সাহিত্যে শ্মশান। সাহিত্যে শ্মশানটা আমার লেখাই ছিল। তবে আমার মনে হয়েছে এই বিষয়টা নিয়ে আরও বিস্তারে কাজ করার অবকাশ রয়েছে। ফলে, আমি এই বইটার সঙ্গে জুড়িনি। তাছাড়া শ্মশানে তন্ত্র এবং নেশা— এই দুটো বিষয় যদি আমি যোগ করতে পারতাম, তাহলে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হত যে বইটা সম্পূর্ণ করতে পেরেছি। ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে কখনও কখনও এই দুটো নিয়ে কাজ করব এবং বইয়ের ভিতরে ইনক্লুড করব।
তন্ময়— শ্মশানের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। মানুষ পোড়ার গন্ধ, কাঠ পোড়ার গন্ধ, পচা ফুল-বেলপাতা-মালসার গন্ধ, ডোমের ঘামের গন্ধ, পার্শ্ববর্তী নদী থাকলে নদীর সোঁদা গন্ধ, পশুদের গন্ধ, চায়ের দোকান, বিড়ির গন্ধ, হালকা মদের গন্ধ— সবমিলিয়ে একটা অদ্ভুত ভৌতিক পরিবেশ। যেটা হয়তো আর পাঁচটা জায়গার থেকে আলাদা।
অলোক সরকার— অবশ্যই। ভীষণরকম। যদি কাউকে চোখ বন্ধ করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়, সে বলে দিতে পারবে এটা শ্মশানের গন্ধ। যদি তার সামান্যতম অভিজ্ঞতা থেকে থাকে। কারণ, ওই যে মড়া, এবং মড়া সঙ্গে সঙ্গে ঘনিয়ে ওঠা আবহ— ভয়ঙ্ক ররকমের গন্ধ-স্পর্শময় একটা জিনিস। এই অনুভূতিটা বলে প্রকাশ করা যাবে না। আমার রোম খাড়া হয়ে উঠছে। শিহরণ দিচ্ছে। এই অনুভূতিটা আমি কী করে বলি? এই গন্ধটা আদতে অনুভব করার।
আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — প্রথম পর্ব
তন্ময়— একদমই তাই। আরেক দৃশ্য হচ্ছে দেখার, কাঠের চুল্লিতে যখন মড়াকে ডোম লাঠি দিয়ে উল্টে দিচ্ছে…
অলোক সরকার— একদম একদম। এবং ওই দৃশ্যটা যদি রাতে দেখা যায়। দাউ দাউ করে চিতা জ্বলছে, এবং চিতার চারদিকে কেউ খোল-করতাল বাজিয়ে গান গাইছেন। ছাড়া-ছড়াভাবে কিছুটা দূরে প্রিয়জনেরা বসে। কেউ বিলাপ করছেন, কেউ গল্প করছেন, মৃদু গুঞ্জনধ্বনি উঠছে। আর এতকিছুর মাঝখানে দুজন বা তিনজন ডোম, সেই দেহটাকে একটু একটু করে উল্টে দিচ্ছে, কয়লা ছড়িয়ে দিচ্ছে, লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে দিচ্ছে। এবং তার চারপাশে কিছু উদগ্রীব জনতা সেটা দেখছে। এটা যখন দেখা যায়, অন্ধকারের মাঝখানে যখন আগুনের ফুলকিগুলো ওঠে, তখন যেন মনে হয় কোন মহাশিল্পী তাঁর অপূর্ব তুলির টানে এই চিতাকে এঁকেছেন। এ সামান্য আগুন নয় যে, মানুষকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষের সঙ্গে তার সময়, তাঁর সঙ্গে জুড়ে থাকা স্মৃতি, আবেগ— একটা কালখণ্ডকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে ওই যে অনুভূতি— সেটা কী করে ভাষায় বোঝাই?
আরও একটা জিনিস… আমাদের ওখানে আমজোড়া শ্মশান বলে একটি শ্মশান আছে। পুরো মাটির চিতা। সেই চিতার পাশ দিয়ে মাতলা নদী চলে গেছে। এবং শ্মশানে কয়েকটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে, একটি পুকুর রয়েছে, আর রয়েছে গাছ। ফলে, জঙ্গলের ভিতরে শ্মশানটিকে এমন দেখায় যেন প্রাগৈতিহাসিক কোনো উনুন, যে-উনুনে মানুষের মাংস রান্না হয়। এবং রান্নার শেষে শ্মশানবন্ধুরা ফিরে যায়। আমি যখন দেখি, জনবিরল একটা জায়গা, অধিকাংশ সময়ই জায়গাটা নির্জন থাকে, সেখানকার দেওয়ালে একটা জীবিত মানুষ যখন মারা গেছে, দাহ হয়ে গেছে, তখন তার নামের সামনে একটা ওঁ চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ওই মানুষটা মৃত। শ্মশানের দেওয়ালে, কাঠঘরের দরজায়, চিতার গায়ে— সমস্ত জায়গায় ওইধরনের নাম লেখা। ফলে আমি যখন শ্মশানভূমিতে যাচ্ছি, তখন আমার মনের ভিতর একটা পরিবর্তন আসে। কোথাও না কোথাও মনে হয়, জীবন থেকে আমি যেখানে জীবনের অন্তিম— সেখানে এসে দাঁড়ালাম। এসে দেখি, গাছের গায়ে ঝুলছে নামাবলি। দেখি, সেই মানুষের ব্যবহার করা বালিশ-কাঁথা-কম্বল। আধপোড়া কাঠ, কয়লা ছড়িয়ে আছে। মালসা, ফুল, কড়ি ছড়িয়ে আছে। কয়লার ভেতরে মানুষের অস্থির টুকরো। আমি সেই টুকরোগুলোকে হাতে করে নিই। নিয়ে তার মুখশ্রী কল্পনার চেষ্টা করি। ভাবি, এই মানুষটি কেমন ছিল। পুরুষ ছিল না মহিলা ছিল? সুন্দর ছিল নাকি অসুন্দর ছিল? লম্বা ছিল না বেঁটে ছিল? কোন বয়সে মারা গেছে? কুড়ি বছর বয়সে, সত্তর বছর বয়সে, নাকি শিশু বয়সে? এর তো নিশ্চয়ই কোনো গল্প ছিল। এই হাড় কি সেই গল্প বলবে? আরেকটু যদি নিচে যাই নদীর পাড় ধরে, কয়লাগুলোকে তো টেনে নদীতে ফেলে দেওয়া হয় আগুন নেভানোর জন্য, তখন দেখি ওই নদীর জলের সঙ্গে ওই কয়লাগুলো, ওই পোড়া কাঠগুলো মিশে যাচ্ছে। হালকা হালকা বাতাস দিচ্ছে আর নদীর জল তিরতির করে কাঁপছে, আর ওই কাঁপনের সঙ্গে সঙ্গে ওই কয়লাগুলো, ওই পোড়া কাঠগুলো, যারা অর্ধেক জলে, অর্ধেক ডাঙায়, তারাও কাঁপে। আমার মনে হয়, এখানে কান পাতলে কি শোনা যাবে, যাঁদের পোড়ানো হয়েছে, যাঁদের দাহ করা হয়েছে, তাঁদের গল্পগুলো? যে গল্পগুলো ওঁরা কারোর কাছে বলেছিলেন বা যে গল্পগুলো ওঁরা কাউকে বলেননি— যেগুলো গোপনে মনের মধ্যে এসেছিল, আবার গোপনেই চলে গেছে— সেই মানুষগুলো এখন কোথায় আছে, কী ভাবছে এখন? এই জলের ভেতরে মৃদু কম্পনে কি শোনা যাবে তাঁদের স্বর?
আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— আমি শ্মশান নিয়ে খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে কাজ করেছিলাম বছর ছয়েক আগে। তখন মৃতদেহের সামনে বসে থাকা, দাহকর্ম দেখা কিংবা স্বজনদের কান্না, বিধবা নারীর সিঁদুর মুছে, রঙিন শাড়ি ছেড়ে বৈধব্যবেশ ধারণ, একইসঙ্গে পাশাপাশি একাধিক মৃতদেহ শোয়ানো, কান্না-শোকপ্রকাশের তারতম্য— ইত্যাদি দেখেছি। আমার কাজ ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে, কিন্তু ওই কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, দূরত্বের থেকে শ্মশানকে অবলোকন করা মানুষের মধ্যেও একটা অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। সেটা কখনও বৈরাগ্য, কখনও জগৎ-সংসারের সাড়-অসাড়তা সম্পর্কে প্রশ্ন, কখনও জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা ইত্যাদি মানুষের অন্তর্জগতেও, এই কাজটা করতে করতে খানিকটা বদল এনে দেয়। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে কাজটা করতে গিয়েও আমার মধ্যে বদল এনেছিল। তুমি যে এই বিশাল আকারে শ্মশানকে ধরার চেষ্টা করলে, গ্রন্থ অধ্যয়নের মাধ্যমে এবং ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে, ব্যক্তি অলোক সরকারের মধ্যে কী পরিবর্তন এল?
অলোক সরকার— সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তন যেটা এসেছে, আমি আগে মড়া দেখে ভয় পেতাম, আর এখন আমার মড়া নেশা হয়ে গেছে। আমি এখন রাত দুটো-তিনটে-চারটের সময়ও শ্মশানে যাই। একা একা। হয়তো তখনও একটা মড়া আছে। দুটো-তিনটের সময় তো গ্রাম্য শ্মশানে যাওয়া সম্ভব নয়। তখনই যাওয়া যখন একটা মড়া আসে। আমি এই দুটো-তিনটে বললাম নগরের শ্মশানে। মাঝরাত্রে হঠাৎ ইচ্ছে হল, যাই না শ্মশানে, শ্মশান তো সারারাত খোলা, দেখি না কী হয়। শ্মাশানে যেতে যেতে যেতে যেতে এখন মৃতদেহও আমার নেশা হয়ে গেছে। ফলে, আমার ভেতরে ভয়ঙ্কররকম পরিবর্তন এসেছে যে, ব্যক্তিগত সুখ, আনন্দ, মোহ— মানে রিপুজ মোহ, তার অসাড়তা মাঝে মাঝে অনুভব করি, মানুষ তো… এখনো সাধনা চলছে। চেষ্টা করছি, একটা মৃত মানুষ যেমন রিপুর ঊর্ধ্বে উঠে যায়, তেমন আলাদা করে জীবনে দুঃখবোধ থাকে না, শুধুই আনন্দ— চেষ্টা করছি সাধনার সেই জায়গাটায় পৌঁছানোর। দেখা যাক। এই বইটি যে আমার জীবনের প্রথম গদ্যগ্রন্থ, ফলে এই বইয়ের কাজ করতে করতে যে ভীষণরকম পরিবর্তন আমি বোধ করি, তাতে মনে হয় যে এই কাজ আমাকে ইঁদুরদৌড় থেকে মুক্তি দিয়েছে। সমস্ত কম্পিটিশন থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ফলে এখন আমি নতুন করে ওই দল বেঁধে ছোটায় বিশ্বাসী নই। মানে যেটুকুই আনন্দ পাই, সেটুকুই করি। আর সব দুঃখবোধের ভেতরেও আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করি।
এই কাজটা না করতে গেলে আমি বুঝতে পারতাম না যে, জগৎ আসলে আনন্দময়। এবং দুঃখ আমাদের পীড়িত করে বেশি। আমরা দুঃখ নিয়ে বেশি ভাবি, বেশি মিশে থাকি বলে, সেটা বার বার মনের ভেতরে উচ্চারণ করি বলেই দুঃখ এত প্রবল। কিন্তু আসলে দুঃখও একপ্রকার আনন্দ। সেটা আনন্দ হিসাবে গ্রহণ করলেই আমাদের মধ্যে আর দুঃখবোধ থাকে না। সেটা শ্মশান নিয়ে কাজ করতে না গেলে আমি বুঝতে পারতাম না। কারণ এই জগতে এতরকমের দুঃখ আছে, এত কষ্ঠ আছে, এত বেদনা আছে, তার কাছে আমাদের বেঁচে থাকার মতো কোনো বেদনা নেই।
বেনারসে, একটি খণ্ডের ওপরে, ছোটো ছোটো মাটির জায়গা আছে— সেখানে একইসঙ্গে ১৫-২০টা চিতা জ্বলে, ভয়ঙ্কর আগুন, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে। মণিকর্ণিকা। তো ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মনে হত, একটা জীবন যত দীর্ঘ হয়, সেই জীবনের ভার, ক্লান্তি, ঘাম, বেদনা, অশ্রু তো তত কঠোর হয়, কঠিন হয়— আমি ভাবতাম যে এই মানুষগুলো একটা সময় গোটা জীবন পার করে এসেছে, এরা শুধু মানুষ নয়, মহামানব। জীবনের ভার সহ্য করা সহজ নয়। কিন্তু এই মানুষগুলো জীবনের ভার সহ্য করে, স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু নিয়ে, বয়সের ভারে মৃত্যু নিয়ে দাহ হতে এসেছে। ফলে, সেখান থেকে আমার মনে হয়, আসলে জীবনের ভার বহন করাটাই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড়ো এবং কঠিন কাজ। যদি সেটাকে করা যায়, আর কিছু লাগে না। কারণ, মহাকাল অনন্ত। সেখানে আমি অত্যন্ত ক্ষুদ্র। আজকে আমি কথা বলছি, আজকে ৩০ বছর আগে আমি ছিলাম না। আমার কথাও কিছু ছিল না। এখান থেকে ১০০ বছর পর আমি থাকব না, আমার কথাও থাকবে না। সেখানে তখন আমি নেই। এই ৫০-৬০-৭০ বছর আমরা বাঁচি। এই বাঁচাটুকুর মধ্যেই যত হানাহানি, মারামারি, লোভ, কাটাকাটি, ঘৃণা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা, সুযোগ পেলে কারোর পেটে ছুরিও মেরে দিই। ১০০ বছর পর এসবের আর কোনো গুরুত্ব নেই। কারণ মহাকাল এত বিস্তৃত এবং ব্যাপক। এইগুলোই ভাবতে শিখেছি। এগুলো ভাবতে শিখেছি বলেই শান্ত থাকি, আনন্দ পাই।
আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — প্রথম পর্ব
তন্ময়— এই যে আমাদের দাহের মন্ত্রে মৃত ব্যক্তি বা মৃত ব্যক্তির আত্মাকে প্রেত বলে সম্বোধন করা হয়। প্রেত তো তথাকথিত একটি ঋণাত্মক অনুভূতি। একজন মানুষ মারা গেলে, তাঁকে আমাদের শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থগুলো প্রেত বলে চিহ্নিত করে দিচ্ছে, এই বিষয়টিকে শ্মশান-গবেষক হিসাবে আপনি কীভাবে দেখেন?
অলোক সরকার— আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, আমরা প্রত্যেকেই যখন মৃতদেহ দাহ করি, দাহ করার সময়ই কল্পনা করে নিই আমাদের পিতৃপুরুষ বা পিতৃনারীরা স্বর্গে যাচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ লোকবিশ্বাস অনুযায়ী তাঁরা স্বর্গে ততক্ষণ যান না, যতক্ষণ না তাঁর শ্রাদ্ধ-শান্তি হচ্ছে। ফলে এই যে দাহ করা হচ্ছে এবং শ্রাদ্ধ-শান্তি সমাপ্ত হচ্ছে— এর ভিতরে যে দশ-এগারো-বারোদিন, সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেন যে মৃত মানুষ, তাঁরা তাঁদের স্বজনদের চারপাশে ঘুরে বেড়ান। কারণ, পৃথিবীর প্রতি মোহ তাঁদের শেষ হয় না। তাই শ্রাদ্ধ-শান্তি হয়ে যাওয়ার পরেই বিশ্বাস করা হয় আত্মা মুক্তি পেয়েছে। এবং তাঁর স্বর্গবাস হয়েছে। কখনও নরকবাস হবে না। কারণ, সে যতই পাপী হোক না কেন, প্রিয়জনরা নরকে যাবেন, এটা আমরা কখনোই ভাবি না। ফলে এইটুকু সময়ে আমরা ভেবে নিই, আত্মা, যে প্রিয়জন ছিল, কিন্তু এখন যে মারা গেছে, এবং যে এখন আমাদের ভিতরে নেই, আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এইটুকু সময় আমরা কিন্তু তাকে প্রেত বলে ধরে নিই। কিন্তু যে-মুহূর্তে তার শ্রাদ্ধ-শান্তি হয়ে গেছে, সেই মুহূর্তে সে আর প্রেত নয়। তখন আমরা ধরেই নিই তার স্বর্গবাস হয়েছে। স্বর্গবাসের সমস্ত কাজ শেষ করা হয়েছে। অর্থাৎ মাটির পৃথিবী থেকে সে মুক্তি পেয়ে গেছে। ফলে আমার কাজ করতে করতে এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার মনে হয়েছে এই যে প্রেত, প্রেতসময়, এই ঋণাত্মক সময়টা, দাহ থেকে শ্রাদ্ধ-শান্তি পর্যন্ত কোথাও এগারো দিন, কোথাও তেরো দিন, এই সময়টুকুই ঋণাত্মক শক্তি। তারপরই কিন্তু তা ধনাত্মক শক্তিতে পরিণত হয়ে যায়।
তন্ময়— লোকবিশ্বাস ঠিক আছে। কিন্তু আমি শাস্ত্রে ‘প্রেত’ শব্দের ব্যবহার, এ-ব্যাপারে কবি ও গবেষক অলোক সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চেয়েছি। লোকসংস্কার নয়।
অলোক সরকার— (হাসতে হাসতে) আপনি শেষ প্রশ্নটা এত কঠিন করে দিলেন… এটা তো কখনও ভাবিনি সেভাবে…
তন্ময়— লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার এক জিনিস। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি, যুক্তিনিষ্ঠতা আরেক জিনিস। সেই যুক্তিনিষ্ঠতায় আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠতে পারে। দেহ একটি যন্ত্র। দেহ মারা গেল। তার সঙ্গে সমস্ত শেষ। আমি আত্মা বা সেই সংক্রান্ত বিশ্লেষণে যাচ্ছি না, সে এক বিশাল অধ্যায়। এই যে ‘প্রেত’ শব্দের ব্যবহার, এটাকে কবি ও গবেষক অলোক সরকার কীভাবে দেখেন? তাতে যদি ধর্মগ্রন্থকে সমালোচনা করতে হয়, তাতেও পিছপা হও না।
অলোক সরকার— না, না, না। ধর্মগ্রন্থকে সমর্থন করা বা না-করার মতো কোনো কারণ আমি খুঁজে পাইনি। আমার ব্যক্তিগত মতে, এই প্রশ্নটা আপাততভাবে স্কিপ করে যাওয়া ভালো। কারণ, এটা নিয়ে বলতে গেলে, আমাকে একটু সময় নিয়ে, একটু চর্চা করে এই উত্তরটা দিতে হবে।
আরও পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— আপনার নিজস্ব কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই?
অলোক সরকার— আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিটা আমি লোকবিশ্বাসের আলোকে বলেছি। সত্যি কথা বলতে, মানুষ মারা যাওয়ার পর ‘নেই’ হয়ে যায়। এটুকুই আমাকে ভাবায়। তারপর কোথায় গেল, কি গেল না— সেটা আমাকে টানেনি। সেভাবে আমাকে টানেনি। শুধু মানুষ নেই, এটুকু জানি। নেই মানে সে এই মহাবিশ্বের কোথাও নেই। তাকে যতরকমভাবে হোক, যেভাবে হোক খুঁজলে তাকে পাওয়া যাবে না। এইটুকুই। প্রেত নিয়ে এর বেশি আমার নিজস্ব কোনো ভাবনা-চিন্তা নেই। আর মানুষ মারা যাওয়ার পর কোথায় যায়? আমি উল্লেখ করেছি, এ-নিয়ে তো বিভিন্ন তাত্ত্বিক আলোচনা রয়েছে, আমি সে-বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট উপসংহারের দিকে যাইনি, যে মানুষ স্বর্গে যায় না নরকে যায়, আদৌ মানুষের কিছু থাকে না। আমি তিনটে বিশ্বাসই তুলে ধরে বলেছি, এই তিনটে মানুষের ভাবনা। আমি নির্দিষ্ট কোনো উপসংহারে আসিনি। এবার যে যেভাবে গ্রহণ করবে। আমার যদি ব্যক্তিগত মত চান, তাহলে আমি ‘প্রেত’ বলব না, আমি বলব মৃত্যুর পর মানুষ ‘নেই’ হয়ে যায়। মানুষ যে-জায়গাটা জুড়ে থাকে, সেটা সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যায়। এবং সেই শূন্যস্থানটুকুকে যদি বলো মায়া জমেছে, আর ওই মায়াটুকুকে যদি বলি ‘প্রেত’, ওই মায়াটুকুকে যদি বলি ‘আত্মা’। আমি বলব, হ্যাঁ, তাহলেই আত্মা আছে, প্রেত আছে।
তন্ময়— এই কথাটার পর আর কথা হয় না। এখানেই শেষ হোক তবে...
(সমাপ্ত)
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor