অলোক সরকারের জন্ম ১৯৯৪ সালে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাসন্তী থানার ভাঙ্গনখালী গ্রামে। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত। পূর্বপ্রকাশিত দুটি কবিতার বই ‘ছায়াশিকার অথবা রূপকথার বালিশ’ ও ‘যুবাপুরুষের শীত’। সম্পাদনা করেন ‘তাবিক’ নামের একটি পত্রিকাও। বর্তমান কথোপকথনটি আবর্তিত হয়েছে তাঁর ‘শ্মশান: মিথ পুরাণ ইতিহাস’ (প্রকাশ – ২০২২) গ্রন্থটিকে কেন্দ্র করে। কথোপকথনে অলোকের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ প্রথম পর্ব।
তন্ময়— আপনি বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, শ্মশান নিয়ে চিন্তা আপনার মনের মধ্যে কীভাবে জন্মাল ও ধীরে ধীরে দানা বাঁধল। কিন্তু এই কথোপকথনের যাঁরা পাঠক, তাঁরা হয়তো অনেকেই বইটা পড়ে ওঠেননি এখনো। ফলে, তাঁদের জন্য যদি বলেন, শ্মশান সম্পর্কিত এমন একটা বিষয়ে এত বিস্তৃত আকারে কাজ করার ইচ্ছে কীভাবে জন্মাল?
অলোক সরকার— শ্মশান নিয়ে কাজ করব, এমনটা কখনো ভাবিনি। কাজ করাটা যেন আমার ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ, আমি যখন লিখতে বসছি, তখন দেখলাম, শ্মশানটা আমার ভেতরে ছিল। বাইরে থেকে আনতে হয়নি। আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালে। আমি যখন ইদানিং কবিতার বইটা নিয়ে মাঝেমাঝে বসি, তখন দেখি কবিতার ভিতরে— তিন ফর্মার কবিতার বই, ৪৮ পৃষ্ঠার বই— তা এই ৪৮ পাতার বইয়ের মধ্যেই প্রায় ২০টিরও বেশি জায়গায় শ্মশান শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সে-সময় আমি কিন্তু সচেতনভাবে শ্মশান শব্দটা ব্যবহার করিনি। ছোটোবেলা থেকে আমার সঙ্গে মৃত্যুপ্রসঙ্গ এবং শ্মশান-প্রসঙ্গ এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল— এই কাজটা আমাকে করিয়ে নিয়েছে। এগুলো যা ছিল সব প্রচ্ছন্নভাবে ছিল। এবং প্রকটভাবে কীভাবে? আমাদের বাড়ি, বর্তমান বাড়ি হচ্ছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। এবং সেই গ্রামের বেশ কিছু দূরে দূরে কিছু মাটির শ্মশান রয়েছে। সেখানে বেশ কিছু দাহ হয়, কিন্তু নিয়মিত নয়। ফলে সেই শ্মশানগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যেতে যেতে— আশেপাশের গ্রামের কেউ মারা গেলে বা আমার বাড়ির আত্মীয়-স্বজন মারা গেলে আমরা শ্মশানবন্ধু হিসাবে যেতাম। ওই যে স্মৃতি জমেছিল, সেসবই...
একটা জিনিস আমাকে খুব ভাবায়, যে-মানুষটি আজ হাসছে, কাঁদছে, কথা বলছে, ঝগড়া করছে, মারামারি করছে— সে মারা গেল, তাকে আমরা কাঁধে করে নিয়ে গেলাম এবং নিয়ে গিয়ে তাকে দাহ করে দিলাম। শুধু মানুষটা নয়, সেই মানুষটার সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত স্মৃতি ও সময়ও পুড়ে গেল। এগুলো আমাকে ভাবাত। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কী মনে হল, ২০২০ নাগাদ আমি ঠিক করলাম এই কাজটা করব। এবং খুব সিরিয়াসভাবে। তার আগে পড়াশোনা চলছিল। বেদ, উপনিষদ পড়াশোনা চলছিল, কিন্তু ক্ষেত্রসমীক্ষার বিষয়টা কাজটা শুরু হয়েছিল মূলত ’২০ সালের প্রথম থেকে। দুটো জিনিসে ভরসা পেয়েছিলাম। সে-সময় আমি সৌভাগ্যক্রমে ভারত সরকারের ইউজিসির ফেলোশিপটা পেয়েছিলাম। ফলে আমি জানতাম, এই বইটা করার পিছনে আমার একটা বিশাল পরিমাণে পয়সা খরচ হবে। এবং সেই সাপোর্ট যদি আমার না থাকে, তাহলে আমি কাজটা করে উঠতে পারব না। আমি ফেলোশিপটা পেয়ে গেলাম এবং কাকতালীয়ভাবে ওইসময় লকডাউন পড়ে গেল। পুরো লকডাউনটা আমি সাইকেলে, বাইকে কিংবা পায়ে হেঁটে বিভিন্ন গ্রাম, প্রত্যন্ত গ্রামের শ্মশানে, পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও আমি গেছি, ক্ষেত্রসমীক্ষাগুলো করেছি। আস্তে আস্তে ব্যাপারগুলো হয়ে গেছে আরকি।
পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: বিশ্বজিৎ রায় — প্রথম পর্ব
তন্ময়— পুরো বইটা পড়লেই বোঝা যায়, এটা শুধু একটা শুষ্ক প্রবন্ধের বই নয়, আপনি সেটা করতেও চাননি। তথ্য তো রয়েইছে, তবে তথ্যের পাশে পাশে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ যেভাবে পরিবেশিত হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় যে, আপনার নিজের গদ্যচর্চার একটা ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। কাজেই এই প্রেক্ষিতে যদি আপনার অন্যান্য লেখালিখির কথাও যদি একটু বলেন।
অলোক সরকার— কবিতার বইয়ের কথা আগেই বললাম। কিন্তু এই ‘শ্মশান: মিথ পুরাণ ইতিহাস’-এর আগে আমার কোনো গদ্যের বই নেই। কিছু বিক্ষিপ্ত ইতস্তত প্রবন্ধ লিখেছি মাত্র। কিন্তু সেগুলো নিতান্তই অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ ছিল। তাত্ত্বিক কোনো বই আমার কাছে খুব কঠিন লাগে। আমার মনে হয়, তত্ত্বের থেকে মানুষের সহজ জীবনবিশ্বাসের সঙ্গে যদি মিশে যাওয়া যায়, তাহলে বোধ হয় তত্ত্বের থেকে আরও বেশি কিছু পাওয়া সম্ভব। কেন-না, তত্ত্ব একটা দর্শন দেয় বটে, তত্ত্ব একটা টু-দ্য-পয়েন্ট উত্তর দেয় বটে, কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষ আসলে তো এক একটি বই, ফলে সেই মানুষের সঙ্গে যদি মিশে যাওয়া যায়, সেই মানুষের অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, বিশ্বাস, সংস্কার, আচার— এগুলো তো স্পন্দনহীন নয়। বৃহত্তর দৃষ্টিতে হয়তো প্রত্যেকটা মানুষের ব্যক্তি-অনুভূতি আলাদা, ব্যক্তি-উপলব্দি আলাদা, কিন্তু যখন আমরা সম্মিলিতভাবে ধরব, তখন কোথাও না কোথাও সেই অনুভব-উপলব্ধিগুলো মিশে যায়।
এই বইটা লেখার সময়— শ্মশান শব্দটা তো একটা দার্শনিক জায়গা, আমি সেই দর্শনটাকে ধরতে চেয়েছি, কিন্তু তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধরিনি। এর পিছনে আমার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। এক হচ্ছে, শ্মশানকে আমি সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে চেয়েছি। শুধুমাত্র যাঁরা পণ্ডিত এবং শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ— তাঁদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইনি। তার ফলও পেয়েছি। যেমন এই বইটি পাঠ করে কোনো বিদগ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মতামত জানিয়েছেন, তেমনই যে-মানুষটি হয়তো সারা জীবনে দুটি কি তিনটি বই পড়েছেন, সে-মানুষও এই বই পড়ে মতামত হয়েছি। এবং অবাক হয়েছি। যে-মানুষটি বই পড়তে পারেন হয়তো, কিন্তু বানান করে-করে পড়েন। আমি হয়তো ধরে নিতাম যে তিনি বইটা পড়েননি, কিন্তু বইয়ের ভিতর থেকে এমন ঘটনা, এমন অনুষঙ্গ তিনি বলে দিচ্ছেন, যা বই না পড়া হলে সম্ভব নয়। ফলে আমি প্রথম থেকে চেষ্টা করেছিলাম, শ্মশান বলতে কোনো তাত্ত্বিক ব্যাপারকে আমি ধরব না। আমি শাস্ত্রগ্রন্থের সাহায্য নেব বটে, কিন্তু আমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, শ্মশানে মানুষ মারা যাওয়ার পরে যে নির্জন স্মৃতি বাতাসে লেগে থাকে, সেই জায়গাটা ধরা। আর সেই জায়গাটা ধরতে গেলে আমাকে সাধারণ মানুষের উপলব্ধির সঙ্গে, সাধারণ মানুষের অনুভূতির সঙ্গে মিশে যেতে হবে। যেমন আমি বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি নিয়েছি, বিভিন্ন পণ্ডিতমহলের মতামত নিয়েছি, একই সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব দিয়েছি একদম প্রান্তিক স্তরের মানুষের লোকসংস্কার, তাদের বিশ্বাস, রীতিনীতি, সমস্ত কিছুতে। এবং সমস্ত ব্যাপারটাই আমি গ্রহণ করেছি অত্যন্ত সম্মানজনকভাবে।
পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: বিশ্বজিৎ রায় — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— এই বই অনেকটাই ক্ষেত্রসমীক্ষার ওপর নির্ভরশীল। তার বাইরেও একটা বিস্তৃত অংশ আছে, যেটা যেটা অধ্যয়নভিত্তিক। বেদ, পুরাণ, উপনিষদ থেকে শুরু করে কখনো শাক্তগান, কখনো লোকসঙ্গীত, কখনো বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তিদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ইত্যাদি। আপনার বইপত্র পড়ার যে প্রস্তুতিপর্ব— এটা তো মূলত শ্মশান-কেন্দ্রিক হিন্দু দাহরীতি, তার মর্মে প্রবেশের পথটি কেমন?
অলোক সরকার— আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে যে, প্রথম যখন আমি শ্মশান নিয়ে কাজ করব বলে মনস্থির করেছি, তখন আমার কাছে খুব বেশি বই ছিল না, শাস্ত্রগ্রন্থ-ব্যতীত। এবং বাংলা ভাষায় শ্মশান নিয়ে চর্চা হয়েছে কিন্তু সেভাবে চর্চা হয়নি, দু-একটি পত্রিকা ছাড়া। কোনো একক গ্রন্থ আমি পাইনি, কিছু বিক্ষিপ্ত প্রবন্ধ পেয়েছিলাম। কিন্তু যে দুটো পত্রিকা আমি পেয়েছিলাম, সেটা হচ্ছে ‘স্বদেশ লোকচর্চা’-র দুটো সংখ্যা পেয়েছিলাম। দুটো সংখ্যাই অত্যন্ত পুরনো। দুটি সংখ্যায় তাঁরা শ্মশান এবং গোরস্থানকে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। তো এই বই দুটো আমি ভালোভাবে দেখেছি এবং পড়েছি। কৃতজ্ঞতায় তাঁদের নামটাও রেখেছি। তাঁরা যেভাবে আলোচনা করেছেন জেলা ধরে ধরে, বিভিন্ন মানুষকে নিয়ে লিখেছেন, আমি সেইদিকে যাইনি। আমি চেষ্টা করেছি একটা থিমেটিক বিষয় ধরতে। জেলাভিত্তিক না গিয়ে, শ্মশানকে কেন্দ্রে রেখে বিভিন্ন পথে তার কাছে পৌঁছানোর। হয়তো কিছু কিছু জায়গায় দু-তিনটি পথ আবিষ্কার করার অবকাশ রয়েছে, তা সত্ত্বেও বইটি যেটি দাঁড়িয়েছে, তার জন্য আমাকে শুধুমাত্র বই পড়তে হয়নি, আমি পূর্বেই বলেছি যে আমাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। কারণ, ঘুরে না বেড়ালে এই ব্যপ্তি আমি ধরতে পারতাম না। আমি যখন প্রথম এই বিষয়ে বই পড়ছি, লকডাউনের প্রথম দিকে, তখন আমার মনে হচ্ছে শুধু বই পড়ে কী হবে? আসলে তো মানুষের সেই উপলব্ধির জায়গাতেই আমি পৌঁছাতে পারব না। শ্মশান নিয়ে সাধারণ মানুষ কী ভাবেন, তাঁরা কীধরনের চিন্তা-ভাবনা করেন? কারোর হয়তো বাবা মারা গেছেন, কারোর মা মারা গেছেন, কারো সন্তান মারা গেছে— এই মারা যাওয়াটা তো আমি বই পড়ে বুঝতে পারব না। এটা বুঝতে গেলে আমাকে তাঁদের সামনে যেতে হবে। তাঁদের কান্নার ভিতরে আমাকে বসে থাকতে হবে। সেই থেকে শুরু হল আমার ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ। এবং ইতিপূর্ব যে-শ্মশানযাত্রার সঙ্গী হয়েছিলাম, সেই স্মৃতিগুলো আমার কাছে ফিরে ফিরে আসতে থাকল। ফিরে আসতে থাকল আমার ছেলেবেলার বিভিন্ন মৃত্যুর অনুষঙ্গ, শ্মশানের অনুষঙ্গ। তখন দেখলাম যে বিভিন্ন ঘটনাক্রম, বিভিন্ন মৃত্যুদৃশ্য এত গভীরভাবে আমার ভিতরে প্রোথিত ছিল, হয়তো আমি কোনোদিন ভাবিনি। তবে সেটা সুপ্ত অবস্থায় ছিল। যখন লিখতে বসছি, তখন হুবহু সেসব মনে পড়ে যেতে থাকল। বইটি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে এগিয়েছি। যে সূচিপত্রটা তৈরি হয়েছে, সেই সূচিপত্র আমি একদিনে তৈরি করে উঠতে পারিনি। বিশেষত আমার আগের কোনো অভিজ্ঞতা নেই কাজ করার। এই বইটির পিছনে কিছু মানুষ সাহায্য করতে পারতেন। এবং তাঁদের সাহায্য পেলে হয়তো বইটি আরও উচ্চ মাত্রায় যেতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেভাবে কারোর সাহায্য পাইনি। তো আমি ভাবলাম, নিজেই চেষ্টা করি না, দেখা যাক কতদূর কী হয়! ফলে ছোটো ছোটো করে বিক্ষিপ্ত বিক্ষিপ্তভাবে লেখা এগিয়েছি। কিন্তু যত লেখা এগোতে থেকেছে, আমার কাছে একটার পর একটা করে দরজা খুলে গেছে। এবং এই দরজা খোলার পর আমার মনে হল, এই দিকটা একটু দেখি তো…
পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — প্রথম পর্ব
তন্ময়— এর সূত্র ধরেই পরের প্রশ্নে যাই। আপনার বইয়ের সূচিপত্রে আমরা দেখতে পাই, কীভাবে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন বিষয় ধরে শ্মশানের ওপর আলো ফেলেছেন। শ্মশান একটি বিষয়। একটি স্থান তো বটেই। শ্মশান এবং দাহকর্মকে ভিন্ন ভিন্ন বঙ্গীয় আলোকে দেখার চেষ্টা করেছেন আপনি। যেখানে শ্মশানযাত্রার প্রসঙ্গ আছে, পুরাণের ইতিহাস যেমন আছে, তেমনই শ্মশানের উৎসব, প্রাচীন-মধ্যযুগের শ্মশান, শ্মশানের গান, শ্মশানের দেওয়াল অলঙ্করণ, স্মৃতি-মন্দির, স্মৃতি-সৌধ, সতীর চিতা— ইত্যাদি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এত শ্মশান, প্রত্যেক শ্মশানের নিজস্ব কিছু মৌলিক গল্পও রয়েছে। আপনার ক্ষেত্রসমীক্ষার জায়গাটা যদি আরও বিস্তৃত হত, তাহলে আরও অনেক নতুন তথ্য এক-একটি শ্মশানকে কেন্দ্র করে উঠে আসত। বইটির ৪০ শতাংশ শ্মশানের অভিজ্ঞতা হচ্ছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা কেন্দ্রিক, যেখানে আপনার বসবাস। আর বাকি ৬০ শতাংশ— কখনো পুরুলিয়ায়, কখনো উত্তর ২৪ পরগনায়, কখনো আবার বারাণসীতে— বিক্ষিপ্তভাবে কোনো জেলার একটি বা দুটি শ্মশানের কথা। সার্বিকভাবে বিভিন্ন শ্মশানকে কেন্দ্র করে যে স্থানীয়, লৌকিক ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য— সেই ব্যাপারগুলো ইন ডিটেইলস ধরা পড়েনি। সেই দিকটায় এগোলেন না কেন?
অলোক সরকার— প্রথম উত্তরটা আগে আমি দিই। এই বইটায় সূচিপত্র দেখলে বুঝতে পারবেন, মূলত তিনটি জায়গা আমি ধরতে চেয়েছি। এক, আমাদের বর্তমান সময়ের শ্মশান। দুই হচ্ছে, প্রাচীন-মধ্যযুগের শ্মশান। আর হচ্ছে, শ্মশানের লোকাচার, লোকবিশ্বাস, সংস্কারের ইতিহাস এবং কমন যে বৈশিষ্ট্যগুলো— শ্মশানে দেবপূজা হয়, শ্মশানে উৎসব হয়, শ্মশানের গান ও দেওয়াল অলঙ্করণ— এগুলো হচ্ছে সাধারণ জিনিস, কমন বিষয়। সব শ্মশানেই দেখা যায়। ফলে, আমি যখন দেখলাম, আমাকে বর্তমানের শ্মশান জানতে গেলে আমাকে এখনকার শ্মশানের কাছে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু আজ থেকে ২০০-৩০০-৪০০ বছর আগের শ্মশানের কাছে যখন পৌঁছাব, তখন আমি তো ফিজিক্যালি পৌঁছাতে পারব না। তবে আমাকে কী করতে হবে? বাংলা সাহিত্যের মধ্য এবং প্রাচীন যুগের যে কাব্যগ্রন্থগুলো আছে, সেগুলো পাঠ করতে হবে…
পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: সুপ্রিয় চৌধুরী — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— সেগুলো আপনি অত্যন্ত সুচারুভাবে লিখেছেন। গভীরে গিয়ে প্রাচীন যত পুথি, সাহিত্য, লোকগান ইত্যাদি জায়গা থেকে তুলে এনেছেন উদাহরণ। তবে আমার প্রশ্নটি নির্দিষ্ট— বাংলায় যে এত শ্মশান এবং শ্মশান বৈচিত্র— তার মধ্যে থেকে আপনার কাছে কিছু তথাকথিত বিখ্যাত, কিছু নিজের অঞ্চলের এবং কিছু অন্যান্য অঞ্চলের নির্বাচিত শ্মশান উঠে এসেছে। কাজটাকে কেন আরও গভীরতর জায়গায় নেওয়া গেল না?
অলোক সরকার— আচ্ছা। আসলে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় যেহেতু ক্ষেত্রসমীক্ষাটা ভীষণভাবে করার সুযোগ পেয়েছিলাম, অন্যান্য জায়গায় ক্ষেত্রসমীক্ষাটা ততটা ভালোভাবে করার সুযোগ পাইনি। প্রথমত, লকডাউনের কারণে বাধা এসেছিল বিভিন্নরকমভাবে। তা সত্ত্বেও আমি চেষ্টা করেছি। এবং আপনি যে বললেন, শ্মশানের নিজস্ব কিছু ইতিহাস, পুরাণ, লোকস্মৃতি, মিথ, গল্প আছে— এ-প্রসঙ্গে আপনাকে আরও একটি কথা জানিয়ে রাখি, আমার কাছে যে ছবিগুলো ও তথ্যগুলো ব্যবহৃত হয়েছে এই গ্রন্থে, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও তাছাড়া অন্যান্য জেলার— সেগুলো খুব সীমিত তথ্য। আমার কাছে প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি ছবি আছে বিভিন্ন শ্মশানের। এবং অদ্ভুতভাবে এই শ্মশানগুলোর, অধিকাংশ শ্মশানের ভিতরে এমনকিছু ইউনিক গল্প লুকিয়ে আছে, যে গল্পগুলো শুধু সেই শ্মশান এবং শ্মশানকে ঘিরে থাকা মানুষের মধ্যে প্রচলিত। কিন্তু সেই গল্পগুলো কোনো মতে ফেলে দেওয়ার নয়। ইতিহাসের বিচারেও অমূল্য এবং অনুভবের বিচারেও অমূল্য। তাকে কোনো মূল্যেই ফেলা দেওয়া যায় না। আমি এই ছবিগুলো নিয়ে, স্মৃতিগুলো নিয়ে, চলে যাওয়া মানুষগুলো নিয়ে, সেই অখ্যাত শ্মশানগুলো নিয়ে আমি আমার দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করছি। ফলে, আপনি যে প্রসঙ্গটা বললে, আশা করি আমি আমার দ্বিতীয় বইতে সেই উত্তরটা দিয়ে দিতে পারব।
তন্ময়— খুব ভালো। আমার পরের প্রশ্নও ছিল যে, শ্মশান-কেন্দ্রিক আপনার কাজ একটা অভিমুখ অবধি এগিয়েছে, তারপরেও একটা বিশাল অভিমুখ পড়ে আছে। সেইটা নিয়ে পরের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা। সেইটা নিয়ে আপনি বলে দিলেন। তাতে ক্ষেত্রসমীক্ষাটা যদি আরও বিস্তৃত হয়, তবে আরও ভালো হয়।
অলোক সরকার— এখানে যেমন কিছু শাস্ত্রগ্রন্থের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে, ওই গ্রন্থে তেমন কোনো শাস্ত্রগ্রন্থের স্পর্শ নেই। বরং, সেই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রচলিত সংস্কার ও গল্পগুলোকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এবং সেই নির্দিষ্ট শ্মশানের নিজস্ব গল্পগুলোই দেওয়া হয়েছে।
একটা গল্প বলি। পুরুলিয়ার বিভিন্ন শ্মশানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমি তো একটা গ্রাফ তৈরি করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে তো লক্ষ লক্ষ শ্মশান। এক-একটা গ্রামে দু-তিনটে করে শ্মশান আছে। কারো আবার পারিবারিক শ্মশান আছে। গ্রামের ৮০ শতাংশ পরিবারের বাড়িতেই শ্মশান আছে। ফলে একজন গবেষকের পক্ষে প্রত্যেকটি শ্মশানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। আমি আমার চারপাশে যতটা শ্মশান পেয়েছি, আমি নিবিষ্টভাবে সেগুলোতে ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছি। আমার জেলা বা আমার আসেপাশের জেলা থেকে যত দূরে এগিয়েছি, তত নির্দিষ্ট কিছু বড়ো শ্মশান বেছে নিয়েছি। এবং শুধুমাত্র বড়ো শ্মশান নয়, সেখানকার কিছু কিছু অখ্যাত শ্মশানও বেছে নিয়েছি। এবং আমার যাওয়ার পথে, যাওয়ার রুটে যতগুলো শ্মশান পড়েছে, আমি সবগুলোই কভার করার চেষ্টা করেছি, যতটা সম্ভব আমার দ্বারা হয়েছে। প্রায় ১৫-২০ দিন আমি রাস্তায় শুধুমাত্র বাইক নিয়ে ছিলাম। এমনও হয়েছে, রাস্তায় বাইক রেখে চলে গিয়েছিলাম। এই গল্পটা বলি। অযোধ্যা পাহাড়ে ওঠার মুখে একটা জায়গা আছে, ওখানে বাইক নিয়ে গেছি। বাইকে একটা ব্যাগ। ব্যাগে আমার জামা-কাপড় রয়েছে। আমার কাছে একটা ক্যামেরা রয়েছে, রেকর্ড করার একটা মাইক্রোফোন রয়েছে। আমাকে ওখানকার লোকেরা পুরো জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেল। প্রায় দেড় থেকে দু-কিলোমিটার। কখনও ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, কখনও শালবনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি— তাদের শ্মশানে নিয়ে গেল তারা। সেই শ্মশানের আবার নিজস্ব গল্প আছে। ওখানে ওরা আমাদের সাধারণ মানুষের মতো দাহ করায় না। তাদের নিজস্ব রীতিনীতি, রিচ্যুয়াল মেনে দাহ করে।
পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — প্রথম পর্ব
তন্ময়— এটা খানিকটা লিখেওছেন বইয়ে।
অলোক সরকার— হ্যাঁ, খানিকটা লিখেছি। খানিকটা দ্বিতীয় বইয়ে আসবে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন, কখনো কোথাওই আমাকে কোনোরকম অস্বস্তির মুখে পড়তে হয়নি। আরেকটা জিনিস লক্ষ করেছি। একাধিক শ্মশানে মৃত পিতা-মাতা বা প্রিয়জনদের উদ্দেশ্যে চা, শিঙারা, মাংস দিয়ে আসে লোকজন। নিজের চোখে দেখা। মানে বাবা মারা গেছেন, মা মারা গেছেন— তাবলে কি সেই লোকটা নেই! আমরা খাচ্ছি, আর তাঁদের দেব না? এবং এটা একদিন, দু’দিন নয়। নিয়মিত দেওয়া হয়।
তন্ময়— এটা কি কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে না রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়?
অলোক সরকার— নির্দিষ্ট অঞ্চলে বলব না। বিভিন্ন জায়গায়। আমি পুরুলিয়ায় দেখেছি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবনে দেখেছি। তবে খুব বেশি জায়গায় দেখা যায়নি। আবার আরও একটি শ্মশান, আরও একধরনের শ্মশান— শ্মশান বলতে আমরা জানি যোনি-আকৃতির একটি ভূমিখণ্ড। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, পশ্চিম হুগলি এবং পূর্ব বাঁকুড়া— এখানকার একধরনের বিশেষ শ্মশানের প্রকৃতি হচ্ছে, এখানকার শ্মশান চতুর্ভুজাকৃতি এবং সমান। সেখানে কোনো মাটির কুণ্ড নেই। এবং এটাও আমি আর-কোথাও দেখিনি, যখন মানুষ মারা যায়, তখন তাকে দাহ করার পর যে কয়লা পড়ে থাকে, সেই কয়লাগুলো দিয়ে মনুষ্য-অবয়ব তৈরি করে ফুলমালা দিয়ে পুজো করা হয়।
পড়ুন - ঈর্ষাক্ষাৎকার: কানাইপদ রায় — দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— ২০১৬ সালে আমি কলকাতার চারটে শ্মশান নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছিলাম। তাছাড়াও বিভিন্ন সময়ে কখনো হাওড়ায়, কখনো হুগলিতে বিভিন্ন শ্মশান পর্যবেক্ষণ করেছি। কলকাতার শ্মশানগুলোর যে চরিত্র—শ্মশান বলতে আমাদের মনের মধ্যে যে আধিভৌতিক একটা পরিবেশ ফুটে ওঠে, সেটা কলকাতার শ্মশানগুলোয় খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। যদি পুরীতেও দেখি, বছর তিন-চারেক আগে স্বর্গদ্বারে একটা ভূমিখণ্ডের মধ্যে টুকরো টুকরোভাবে একসঙ্গে অনেক চিতা জ্বলত। এখন স্বর্গদ্বারে ‘উন্নয়ন’ ঘটে মেঝে বাঁধাই হয়ে পুরো ভোল বদলে গেছে। শ্মশানের এই যে বিবর্তন— আপনার লেখাতেও বার বার উঠে এসেছে, প্রাচীন শ্মশান চলে গিয়ে, চুল্লি ঢুকে আসছে। আর্বানাইজেশন যে জরুরি, সেটা আপনিও অস্বীকার করবেন না। কিন্তু তাতে যে ঐতিহ্যের বিবর্তনটা হচ্ছে, একজন গবেষক হিসাবে সেটাকে আপনি কী চোখে দেখেন?
অলোক সরকার— প্রথম কথা হচ্ছে, সময়কে মেনে নেব না, এমন কথা তো আমি বলতে পারি না। তবে আমার কোথাও না কোথাও মনে হয়, শ্মশানের পরিবর্তনটা ততটা জরুরি ছিল না। সেটা মানিয়ে নেওয়া যেত। আমরা তো পুরোটাই নগর সভ্যতার দাসত্বে চলে এসেছি। মৃত্যু হচ্ছে মানুষকে আবার প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়া। হ্যাঁ, পরিবেশ দূষণ বাঁচানোর জন্য চুল্লি প্রয়োজনীয়। চিতায় পোড়ানো হলে নানা সমস্যা হত, কাঠ লাগত, দেখতে ভালো লাগত না। চুল্লিতে সে-সবের বালাই নেই। তাড়াতাড়ি হয়ে যায়, সময়ও অনেকটা বাঁচে। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগে যখন ভাবি, একজন মানুষ সারাজীবন সম্পাদিত হয়ে এসেছে এবং মৃত্যুতেও তাঁকে সম্পাদিত হতে হচ্ছে। কারণ, মানুষ তো হচ্ছে পঞ্চভূতে গঠিত, এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হচ্ছে আমাদের সেই পঞ্চভূতটাতে সেই উপাদানগুলো ফিরিয়ে দেওয়া। আমরা একটা সময় মাতৃযোনি দিয়ে জন্মগ্রহণ করতাম। এখন কেউ মাতৃযোনি দিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, সিজারে সন্তানপ্রসব হচ্ছে। কেউ বলাটা ভুল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিজারে জন্ম নেয় সন্তান। পথও পাল্টে গেছে, তেমনই মৃত্যুদর্শনও পাল্টে যাচ্ছে। ফলে মাটির চিতার যে দার্শনিক আবহ ছিল, ইলেকট্রিক চুল্লিতে সেই দার্শনিক আবহ নেই। ইলেকট্রিক চুল্লি ঝকঝকে, তকতকে। মদ্যপান কমে গেছে। দূষণ কমে গেছে। কোনো সমস্যা নেই। ডোমের হাতে তুলে দিয়েই নিশ্চিন্ত। আসলে আমরা চিতা বলতে যা বুঝি, সেইটা মনে হয় না যে ঠিক পরিবর্তন হয়েছে।
আরও একটি জিনিস আমি ঋকবেদের শ্লোকে পেয়েছি। ঋকবেদে বলা হচ্ছে, মৃতকে এখানে দাহ করা হয়েছে, এখানে প্রচুর পরিমাণ জল ঢালা হোক। এখানে সবুজ দুর্বা উঠবে। অর্থাৎ মৃত্যুর ওপরে সজীব প্রাণের একটা ইশারা পাওয়া যাচ্ছে। ইলেকট্রিক চুল্লিতে কিন্তু সেটা সহজে সম্ভব নয়। সম্ভব তখন, যখন ইলেকট্রিক চুল্লিটি বন্ধ করে দেওয়া হবে বা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হবে। তখন হয়তো সেখানে কোনো সজীব প্রাণের ইশারা পাওয়া যাবে। মাটির চিতায় কিন্তু কিন্তু ঘাস গজায়, চিতার ওপরেও শ্যাওলা গজায়। শ্যাওলা বা ঘাস— এগুলো কিন্তু প্রাণ। ইলেকট্রিক চুল্লিতে হয়তো সেই প্রাণ জন্মানোর প্রক্রিয়াটা নেই। ফলে কোথাও না কোথাও মনে হয়, যা হয়েছে ভালো হয়েছে, তবে না হলেও পারত। আলাদা করে বলার কিছু নেই আমার। তবে এটা ঠিক যে, আগামী ১৫-২০-৩০ বছর মাটির চিতাও অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হবে। কারণ, গ্রামের মানুষও এখন চান, তাঁদের গ্রামেও ইলেকট্রিক চুল্লি হোক।
(পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব)
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor