সত্তরের দশকের শেষ দিক। খোদ কলকাতার বুকে বসেই ‘টেস্ট-টিউব বেবি’র আবিষ্কার করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তবে, এই আবিষ্কারের পর চরম লাঞ্ছনায় পড়তে হয় তাঁকে। আত্মহত্যা করেন ডঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সেই ঘটনার প্রেক্ষাপটেই সাহিত্যিক করেই রমাপদ চৌধুরী লিখলেন ‘অভিমন্যু’। তপন সিংহ পরিচালিত ‘এক ডক্টর কি মওত’-এর গল্প এই উপন্যাস থেকেই নেওয়া।
সিনেমাটিতে ডাঃ দীপঙ্কর রায়ের ভূমিকায় ছিলেন পঙ্কজ কাপুর এবং তাঁর স্ত্রী সীমার ভূমিকায় শাবানা আজমি। সেখানে দিব্যি জায়গা করে নিয়েছিলেন ঋজু মেরুদণ্ডের ‘অমূল্য’। এই অমূল্যের চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন ইরফান খান। পঙ্কজ কাপুর, শাবানা আজমি, অনিল চট্টোপাধ্যায়দের মতো অভিনয়শিল্পীদের পাশে এতটুকু ম্লান দেখায়নি প্রায়-নতুন তেইশ বছরের ইরফানকে। তপন সিংহ যে খাঁটি রত্নটিকে চিনতে পেরেছিলেন, তার প্রমাণ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তাঁকে নির্বাচন করার মধ্যে দিয়েই প্রমাণিত।
ছবিতে দেখা যায়, বিজ্ঞান-গবেষণার পথ থেকে সরে আসায় অমূল্যকে খুব বেশি পছন্দ করছেন না দীপঙ্কর। বিজ্ঞানের এমন পাবলিসিটি করা তাঁর বিশেষ অপছন্দ। গবেষণার প্রকৃত ফলাফলকে বিকৃত করে দেন সাংবাদিকরা, এই নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে তাঁর। এমনকি, তিনি ‘সামান্য’ এমবিবিএস ডাক্তার, সেখানে অমূল্য পিএইচডি হয়েও কেন তাঁকে এত সম্মান করছে, তার পিছনে কোনো অভিসন্ধি আছে কিনা, সে বিষয়েও তিনি অমূল্যের প্রতি সরাসরি সন্দেহপোষণ করেন। কিন্তু আবার এই তরুণ সাংবাদিকটির প্রতি কোথাও যেন দাদা-সুলভ ভালবাসা রয়েছে আপাত-কঠিন কাজ-পাগল বিজ্ঞানীর। তাই সময়ে সময়ে তাকে কপট তিরস্কার করেন। অমূল্য দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করে নেন, দীপঙ্কর অন্য ধাতুতে গড়া, যে ধাতু বহু ডিগ্রিধারী গবেষকের মধ্যে নেই, তাঁর নিজের মধ্যে তো নয়ই। তাও তিনি বিজ্ঞানকে কিছু দিতে চান বলে, বিজ্ঞানের প্রচারের কাজটি বেছে নিয়েছেন।
মুক্তিপ্রাপ্তির পর ছবিটি দ্বিতীয় সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরস্কার তো লাভ করেই, পাশাপাশি পরিচালনার জন্য তপন সিংহ এবং স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ডের পুরস্কারটি পান পঙ্কজ কাপুর। একটি ছবি সর্বতোভাবেই পরিপূর্ণ ছবি হয়ে ওঠে, যখন তার প্রতিটি বিভাগে থাকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ডিটেলিং, কাজের মুন্সিয়ানা। সেখানে প্রযোজক, পরিচালক থেকে শুরু করে অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক থেকে শুরু করে চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, এমনকি অসংখ্য টেকনিসিয়ান যাঁরা ছবি বানানোর ‘মহাযজ্ঞে’ সামিল থাকেন, প্রত্যেকের কাজই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছবিটিতে ক্যামেরার পিছনে ছিলেন কিংবদন্তি চিত্রগ্রাহক সৌম্যেন্দু রায়। ক্যামেরার সামনে প্রতিটি অভিনেতা-অভিনেত্রীর দক্ষতা, দুর্বলতা, ক্যামেরার পিছনে তাঁদের চলাফেরা, চরিত্র-ভাবনা সবকিছুই অত্যন্ত সামনে থেকে দেখেছেন তিনি। দীর্ঘ ছয় দশকের সিনেম্যাটোগ্রাফির কেরিয়ারে সেই তালিকাটা স্বাভাবিকভাবেই অসীম।
আরও পড়ুন
ইরফান-সুশান্ত-ঋষিকে শ্রদ্ধার্ঘ অস্কার কমিটির, স্মরণে ভানু আথাইয়াও
উঠতি ইরফানকে তিনি যখন দেখছেন, তখনই সাড়ে তিন দশক অতিবাহিত। কৌতূহলবশত ফোনে ধরা হল নব্বই ছুঁই ছুঁই সৌম্যেন্দু রায়কে। সিনেমার সোনালি দিনের স্মৃতি এখনও তাঁর মনে টাটকা। জানালেন ইরফানকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণা – ‘ইরফান খুবই ভালোমানুষ ছিলেন। আমি অবশ্য ওই একটা ছবিতেই কাজ করেছিলাম। উনি জার্নালিস্টের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তখন একেবারেই তরুণ, সবে কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু তখনই দেখতাম, খুব কম কথা বলেন উনি। সিরিয়াস অভিনয় করতেন। ক্যামেরার পিছনেও দেখতাম, অভিনয় নিয়ে চিন্তা করছেন।’
আরও পড়ুন
মৃত্যুর পরেও কমেনি জনপ্রিয়তা, নতুন বছরেই পর্দায় ফিরছে ইরফানের ছবি
শাবানা আজমি, অনিল চট্টোপাধ্যায়দের মতো তারকা শিল্পীদের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করতে অসুবিধা হয়নি? এ প্রশ্নের উত্তরে সৌম্যেন্দু রায় বললেন – ‘না, না। ওসব নিয়ে উনি খুব একটা চিন্তিত ছিলেন না। নিজের কাজটা নিয়েই মগ্ন থাকতেন। ওই অত কম বয়সেই যা মনোযোগ দেখেছিলাম, অভাবনীয়। অভিনয়টাও করতেন খুব সাবলীলভাবে। সমস্ত কাজটা যাতে ভালোভাবে হয়, সে ব্যাপারে খুব চেষ্টা ছিল। নিজের মতো থাকতেন। আরও একটা বিষয়, ইরফান মূলত মঞ্চাভিনয়ের ছাত্র ছিলেন। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে পাশ করেছিলেন। সেখান থেকে চলচ্চিত্রে আসেন। মঞ্চের অভিনয় আর ক্যামেরার সামনের অভিনয়ের তো একটা বিরাট ফারাক থাকে। মঞ্চে যেমন অভিনয় আর স্টেজক্রাফটই সব, ক্যামেরার সামনে আবার অত্যন্ত সংযত অভিনয় করতে হয়। আর ‘এক ডক্টর কি মওত’-এ বেশিরভাগটাই ছিল ইনডোরে, অন্তত উনি যেসব দৃশ্যে ছিলেন। সেখানে সংযত অভিনয় দরকার। কিন্তু ক্যামেরার পিছনে থেকে আমার কখনোই অসুবিধায় পড়তে হয়নি। ক্যামেরাটা অসম্ভব ভালো নিতে জানতেন। আমার সঙ্গে তো খুবই সহযোগিতা করতেন। যতটুকু দরকার, ততটুকুই অভিনয় করার দক্ষতাটা দারুণভাবে রপ্ত করেছিলেন। বোঝা যেত, অভিনয়ের ছাত্র হিসেবে খুবই ভালো ছিলেন।’
আরও পড়ুন
ইরফানের সমাধি ঘিরে বেড়ে উঠছে সবুজ, দেখে এলেন সহ-অভিনেতা
বাংলায় তুলসী চক্রবর্তী, ছবি বিশ্বাস থেকে শুরু করে জহর রায়, উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বোম্বাইয়ের সঞ্জীবকুমার, আমজাদ খান থেকে শাবানা আজমি, স্মিতা পাটিলদের যিনি ক্যামেরায় ধরেছেন, তাঁর চোখে তরুণ ইরফানের এহেন সার্টিফিকেটই বুঝি বলে দেয়, ছবির অমূল্য অন্য ধাতুতে গড়া না হলেও বাস্তবের শাহাবজাদে ইরফান আলি খান আসলে অন্য ধাতুতেই গড়া ছিলেন।
Powered by Froala Editor