আমরা বলেছিলাম যাব

এক অসমসাহসী ইরানীয় (Iran) তরুণীর নিজের হাতে কেটে ফেলা খোলা চুল উড়ছে নিশান হয়ে। সেই পতাকা হয়ে উঠছে দেশজোড়া মুক্তমনা মানুষদের বিপ্লবের প্রতীক। বলতে দ্বিধা নেই, এ দৃশ্য আমাদের সুদূর ভাবনাতেও আসেনি কখনো। কল্পনা কি কখনো বাস্তবের সাথে পাল্লা দিতে পারে?  

দর্শনের ‘পপ-কালচারে’ কান পাতলে আজকাল ‘অ্যাবসার্ড ট্রলি প্রবলেম’ বলে একটি আলোচনা শোনা যায়। একটি ট্রেনের স্বাভাবিক গতিপথে চার-পাঁচজন মানুষ বাঁধা রয়েছে লাইনের ওপর। পাশের লাইনে বাঁধা আছে একটিমাত্র মানুষ। হাতল টানলে ট্রেন তার স্বাভাবিক গতিপথ ছেড়ে পাশের লাইনে চলে যাবে, কিন্তু এই হাতল টানার এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে উত্তরদাতাকে। সমস্যাটা শুনতে স্রেফ ‘পাঁচের বদলে এক’ মনে হলেও ভাবা দরকার যে ওই একজনের কিন্তু আদতে মারা যাওয়ার কথাই নয়। কাজেই উত্তরদাতা নিরপেক্ষ থাকলে পাঁচজন মারা যাবে ‘স্বাভাবিক’ নিয়তিতে এবং হাতল টানলেই সে হয়ে দাঁড়াবে এক সচেতন হত্যাকারী।   

ইরানের জনসাধারণ ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তা উচ্ছেদ করার এবং প্রজাতন্ত্র কায়েম করার সিদ্ধান্ত। আমরা হয়তো অনেকেই মনে রাখি না, আমাদের বঙ্গভঙ্গের সমকালে, ইরানে ১৯০৬ সালে এক উল্লেখযোগ্য পট-পরিবর্তন হয় যা ‘কন্সটিটিউশনাল রেভোলিউশন অফ ইরান’ হিসেবে পরিচিত। ‘কাজার’ রাজবংশের পঞ্চম শাসকের হাত ধরে ইরানের প্রথম আধুনিক সংবিধান রচিত হয়, স্থাপিত হয় পার্লামেন্ট বা ‘মজলিশ’। সারা বিশ্বের মতো স্বাভাবিক নিয়মেই সেই সংবিধানে মেয়েদের ভোটাধিকার ছিল না। মাত্র দু’বছরের মধ্যে, ১৯০৮-এ রাশিয়ান/পারসি-কসাক নেতার হস্তক্ষেপে ওই পার্লামেন্ট বা ‘মজলিশ’ বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ১৯০৬-এর সেই সংবিধানটিকে সরিয়ে ফেলেন পরবর্তী শাসক। এই ষষ্ঠ শাসককে সরিয়ে দিয়ে আবারও আন্দোলন হয় ব্যাপক আকারে এবং সেই দাবিতে সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১১-তে। ১৯০৬ এবং ১৯৭৯ -এই দুই বিপ্লবের মধ্যবর্তী পঞ্চাশ বছর মূলত ‘পহলভি’ রাজবংশের শাসনকাল (১৯২৫-১৯৭৯)। একথা সকলেরই প্রায় জানা যে, এই বংশের তথা ইরানের শেষ শাহ, মহম্মদ রেজা পহলভিকে ১৯৭৯-এর ফেব্রুয়ারির বিপ্লবের প্রায় মাসখানেক আগেই দেশ ছেড়ে পালাতে হয় এবং তাঁর নিষেধাজ্ঞায় প্রায় পনেরো বছর বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরে আসেন রুহুল্লাহ খোমেইনি । এই ‘ফিরে আসা’ এক বিপ্লব-কাব্যের মাদকতা সৃষ্টি করে, (যদিও) প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান খোমেইনি জনমানসে ‘ঈশ্বরের চিহ্নস্বরূপ’ আয়াতোল্লাহ (আক্ষরিক অর্থ) আখ্যায়িত হন ১৯৫০-এর দশক থেকেই। ১৯৬০-এর পর থেকেই শাহ রেজার দ্রুত (র‍্যাডিকাল) আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা মানুষ ভালোভাবে নেননি বলে ধরে নেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে ‘শ্বেত বিপ্লব’ নামে পরিচিত এই সংস্কারের ফলেই ইরানে মেয়েরা প্রথম ভোটাধিকার পান ১৯৬৩ সালে। ঐতিহাসিক আব্রাহামিয়ান এরভান্ড জানাচ্ছেন, এই বিপ্লবের ফলস্বরূপ বহুবিবাহ ও লিঙ্গবৈষম্য দৃশ্যত কমে আসে, শিক্ষায় অসংখ্য উন্নয়নশীল বদল আসে, মেয়েদের শিক্ষার, কর্মক্ষেত্রের ও ব্যক্তিগত অধিকার দৃঢ়তর হয়। অন্যদিকে, তেলের ব্যবসার জাতীয়করণ, ইরানের বিদেশ-নীতি, বাণিজ্যনীতি ও অর্থনীতিতে আমেরিকান শক্তির অতিরিক্ত ‘নাক-গলানো’ বাড়তে থাকে। তুলনামূলক প্রাচীনপন্থী সমাজব্যবস্থার মধ্যেই এক অসম্ভব জটিল রাজনৈতিক তন্তুজাল তৈরি হয় এবং সেই পরিস্থিতিতে খোমেইনির ফিরে আসার সম্ভাবনা আগে থেকেই দেবদূতসুলভ এক ইতিবাচক বার্তা বহন করে আনে জনগণের কাছে। ঐতিহাসিক আব্রাহামিয়ান এরভান্ড তাঁর লেখায় (দুটি প্রামাণ্য বইঃ “Iran Between Two” এবং “A History of Modern Iran”) জানিয়েছেন, খোমেইনির নিয়োগ করা ইরানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ‘বাজারগান’ চেয়েছিলেন ইরানের নতুন নামে থাকুক ডেমোক্র্যাটিক শব্দটিও। কিন্তু খোমেইনি এই ‘ইসলামিক রিপাব্লিক অফ ইরান’ নামকরণ বিষয়ে স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন একটিও বাড়তি শব্দ নয়, একটি শব্দ কমও নয়— রিপাব্লিক অফ ইরান নয়, ডেমোক্র্যাটিক রিপাব্লিক নয়,  ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক রিপাব্লিক নয়— অর্থাৎ রাজার প্রতিস্থাপনে প্রজা, এইটুকুই এবং ধর্মানুসারী শাসন ব্যবস্থা। ভাবতে অবাক লাগবে, এই বাজারগান আদতে ১৯৭৯-এর অন্তিম ধর্মভিত্তিক সংবিধানটি নয়, বরং তাঁদের বিপ্লবের প্রস্তুতিকালে লেখা “নন-থিওক্র্যাটিক” খসড়া-সংবিধানটিকেই সমর্থন করেছিলেন । 

আসলে যে-সমস্ত দেশে প্রায় নিরঙ্কুশভাবে শাসক ও প্রজাদের ধর্ম কখনোই আলাদা হয়নি, আমাদের মতো দেড়শো বছর ইউরোপীয় শাসনে থাকা দেশে একবিংশ শতাব্দীতে বসে তাকে বোঝা একেবারেই সহজ নয়। প্রথমেই মনে রাখা দরকার সেখানে জনগণ ও সরকার ধর্মনৈতিক বিশ্বাসে বিভাজিত নয়। বরং একাধারে পশ্চিমী সংস্কৃতির কুপ্রভাবকে আটকানো এবং অন্যদিকে পারস্যের মতো ঐতিহ্যশালী দেশের নিজস্ব সংস্কার ও ধর্মীয় সমমনস্কতা সাধারণ মানুষের কাছে অবশ্যকাম্য বলেই ভাবা যায়। আমরা কিন্তু এখনও বলতে পারি না, ইংরেজ শাসন ও আধুনিক আইনি ব্যবস্থার সাহায্য না থাকলে, সতীদাহের মতো প্রথা আমরা অত বছর আগে প্রায় নিশ্চিহ্ন করতে পারতাম কিনা। বলতে পারি না, বিধবা বিবাহের মতো ‘ভয়ানক পাপ কাজকে’ সমাজে আইনিভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতো কিনা, যা আজও মানুষের ভুরু অল্প কুঁচকে দেয় অজান্তেই; বলতে পারি না কেন ২০০৫ সালেও দীপা মেহতার ‘জল’-এর মতো সিনেমা নিষিদ্ধ হয়! সিনেমার কথায় অবশ্যই মনে পড়বে ইরানের সেন্সরশিপের মুখে দাঁড়িয়ে একের পর এক যুগান্তকারী চলচ্চিত্র তৈরির কথা, মনে পড়বে জাফর পানাহীর ‘অফসাইডের’ কথা, যে জাফর পানাহী রাষ্ট্রীয় রোষে গত এক দশক ইরানের মাটিতে প্রায় গৃহবন্দি, ২০১০ থেকে কুড়ি বছরের জন্য যাঁর সিনেমা বানানোর সব কাজে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা, এবং মাথায় ঝুলছে ছ’বছরের জেলের খাঁড়া।

আমাদের মনে পড়বে, ১৯৮০-র দশকে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান বন্ধ করতে চেয়েছিলেন মেয়েদের শাড়ী পরা, নিষিদ্ধ করেছিলেন কবি ফৈয়াজ আহমেদ ফয়েজের মুক্তকণ্ঠ। খোলা চুলের এই নিশানের দিকে দেখতে দেখতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে আরও একটা ছবি— ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬— কালো শাড়ি পরা এক নারীমূর্তি, এসে দাঁড়াচ্ছেন কানায় কানায় ভরা লাহোর স্টেডিয়ামে (Alhamra Arts Council, Gaddafi Stadium, Lahore), পঞ্চাশ হাজার মানুষের ভিড়ে। ইকবাল বানো, যিনি শুধুমাত্র গান গাইতে উঠে রচনা করেছিলেন প্রতিবাদের ইতিহাস। রাষ্ট্রযন্ত্রের সৈন্য পরিবেষ্টিত লাহোর স্টেডিয়ামের গেটগুলি আর ভিতরে ইকবাল বানো গাইছেন ফয়েজের সেই কাব্য-গান ‘হাম দেখেঙ্গে’; আর যাঁরা শুনছেন, লাহোরের সেই প্রায় পঞ্চাশ হাজার দর্শক, যাঁরা তাঁর সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর ছিলেন সেদিন, তাঁরা বারবার বারবার সমবেত সমর্থনে, হাততালিতে, ‘ইনকিলাবের’ স্লোগানে ফেটে পড়ছেন, ফেটে পড়ছে লাহোর স্টেডিয়াম। সঙ্গীতের আলো ছিন্ন করতে চাইছে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্ধত্বের পর্দা!  

ধীরে ধীরে ট্রলি প্রবলেমের খেলাটি গভীরতর বা গুরুতর হয়ে ওঠে। একসময় উত্তরদাতা (হত্যাকারী)-র নির্বাচন এসে দাঁড়াতে পারে স্বাভাবিক ট্রেন লাইনে পাঁচজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বনাম অন্য ট্রেন লাইনে প্রেমিকার মধ্যে; অথবা একটি লাইনে অ্যাডলফ হিটলার বনাম অন্য লাইনে পাঁচজন যুদ্ধাপরাধী অফিসারের মধ্যে। এইখানে ট্রলি প্রবলেম আমাদের এবার জানাচ্ছে যে উত্তরদাতার অজান্তেই খেলা ঘুরে যেতে পারে ‘চয়েস অফ ইভিলের’ দিকে। 

আমরা জানি ১৯৭৬-৭৭ সাল অর্থাৎ বিপ্লবের দু’তিন বছর আগেও ইরান শান্তিপূর্ণ ছিল না, বরং রাজতন্ত্রের আত্মরক্ষার্থেই সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও দমনমূলক নীতি ছিল তেহরান, সিরাজ এবং পূর্ব ইরানের ইরাক-সংলগ্ন কুর্দিশ এলাকায় নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা। অসংখ্য রাজনৈতিক বিবাদ ও হিংসা তেহরান, সিরাজের মতো শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘটতে থাকে এবং তা সাধারণ দৃশ্য ছিল। এক বাঙালি তরুণী তাঁর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গুরুর সঙ্গে ইরানের এই সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্রে গান করতে গিয়ে ১৯৭৬-এ দেখতে পান, দিনের বেলা প্রকাশ্য রাস্তায় বেরিয়ে ফেরিওয়ালার থেকে জিনিস কিনতে গিয়ে পায়ের কাছে হঠাৎ কারুর দেহ লুটিয়ে পড়া অর্থাৎ খুন হওয়ার ঘটনা। কাজেই ‘স্বাভাবিক’ নিয়মেই, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ ও রাজতন্ত্রের ছায়া যখন সারা বিশ্ব ত্যাগ করেছে, তখন ‘অ-পশ্চিমা মূল্যবোধের’ ওপর ভিত্তি করে একাধারে বামপন্থী সমর্থন এবং অন্যধারে ধর্মীয় সমর্থনে ঘটে ইরানের যুগান্তকারী এই ‘বিপ্লব’। 

আজ ২০২২ এর সেপ্টেম্বরে, ইরান থেকে বন্ধুরা জানাচ্ছেন, তাঁদের আশা ও আশংকার কথা। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায় জনসংযোগের অভাবের কথা, সেই সমস্যাকে কাটিয়ে ওঠার কথা, বলছেন পাশে থাকার কথা। একের পর এক নারী প্রায় জেনেশুনেই যেন আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছেন, নামছেন রাজপথে, যা আদতে অগ্নিকুণ্ড। অবিশ্বাস্য কিছু দৃশ্য রচিত হচ্ছে। যেমন, কুড়ি বছরের একটি মেয়ে ইরানের সবচেয়ে প্রাচীনপন্থী শহরগুলির একটিতে, রাস্তার মাঝখানে গাড়ির মাথায় চড়ে স্বৈরাচারীর পতনের কামনায় চিৎকার করছেন ‘ডেথ টু দ্য ডিক্টেটর’। কিছু শহরে মেয়েরা দল তৈরি করে বনফায়ারের মতো আগুন জ্বেলে তাতে ফেলে দিয়েছেন তাঁদের হিজাব। ইরানের এক ডাক্তার তথা সেতারশিল্পী জানাচ্ছেন- “সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষ একান্তভাবে নিজেরাই নিজেদের গরজে ‘রেফারেন্ডাম’ তৈরি করেছেন এবং ছড়িয়ে দিতে চাইছেন সমর্থন।“  

ইরান থেকে এক বন্ধু জানাচ্ছেন, আলাদা আলাদা স্তরের সরকারি সেনাবাহিনী ও সুরক্ষাবাহিনী রাস্তায় অত্যন্ত সক্রিয় এবং রক্তপাতে উদ্যত; অথচ মানুষ এতই মরিয়া যে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, রাস্তায় না নামলে আর উপায় নেই। দুঃখের কথা এই যে আজকের দিনে যখন, ইরানের মেয়েদের হাত ধরে এই অবিশ্বাস্য সাহসের প্রতিমূর্তিগুলি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, তখনও কিছু অতি-বামপন্থী মুখপত্রগুলি ‘ডেথ অফ আমেরিকা’ স্লোগান তোলা সেই সাধের ১৯৭৯-এর বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ফলাফলটুকুও স্বীকার করতে পারল না, বরং উল্টে এই মেয়েদেরকেই দোষী ও পথভ্রষ্ট অবমাননাকারী সাজাতে চাইল পাশ্চাত্য-বিরোধিতার আড়ালে। তাঁরা ভুলে যান, সেই ১৯৭৯-এর আন্তর্জাতিক নারী দিবসেই (মার্চ ৮, ১৯৭৯) ইরানের মেয়েরা বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন হাজারে হাজারে, যা শাহ রেজার আমলে ১৯৩৬-এ বন্ধ করা হয় আইনিভাবে (কাশ্ফ-এ-হিজাব) ।

আসলে ‘ধর্মপ্রাণ আস্তিকদের’ সঙ্গে কট্টর ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের’ যে বিস্তর ফারাক— তা ইরানে বোধ করি সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠেছিল বিপ্লবের পরবর্তী এক দশকে। যাদের সমর্থনে ইরানে বিপ্লব আসে, অথচ যারা খোমেইনির শাসনপন্থার বিরোধী, সেই সমস্ত কণ্ঠকে প্রায় অচিরে স্তব্ধ করার ব্যবস্থা করা হয় (https://www.cbc.ca/radio/sunday/the-sunday-edition-for-february-10-2019-1.5011120)। অসংখ্য দেশত্যাগ, গা-ঢাকা দেওয়া, সন্ত্রাস ও হত্যার সম্মুখীন হয় ইরানের যে-কোনো মুক্তচিন্তার ‘বিপ্লব-সঙ্গীরা’ সেই ১৯৭৯-৮০ সালেই। জোটসঙ্গীদের নিকেশ করে ফেলার এই পদ্ধতি বিশ্ব-ইতিহাসে অজানা নয়, নতুন তো নয়ই। এর এক দশক পর ১৯৮৮ সালে, অসংখ্য (হাজার-হাজার) রাজনৈতিক বিরোধীদের গ্রেপ্তার করা হয়, গুম-খুন করা হয়, অজস্র মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলা হয়, গোটা বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে আলোচনার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং আত্মীয়-পরিজন ও দেশের জনগণ কোনো খবর পান না কাকে ঠিক কী হয়েছিল। (https://www.amnesty.org/en/documents/mde13/9421/2018/en/)। এর মধ্যেই নতুন শতাব্দীতে গত কুড়ি বছরে ইরানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ গণ-আন্দোলন বন্দুকের গুলি দিয়েই থামিয়ে দেওয়া হয়, প্রাণ হারান ও জখম হন প্রায় সহস্রাধিক মানুষ। অথচ এত হত্যা-প্রকরণ সত্ত্বেও, বর্তমান রাষ্ট্রপতি ‘হার্ডলাইনার’ ইব্রাহিম রাইসির আমলেই তেহরান ঘুরতে আসা মাহসা ‘জিনা’ আমিনি নামের একটি বাইশ বছরের কুর্দিশ মেয়ের চুল দেখা যাওয়ার কারণে পুলিশ-জিম্মায় অকালমৃত্যু যে হঠাৎ একেবারে একটা গোটা দেশের সাধারণ মহিলা এবং সেই সঙ্গে জনগণকে নাড়িয়ে দিতে পারে, রাস্তায় টেনে আনতে নেতৃত্বহীন বিপ্লবে, সারা বিশ্বের রাজনৈতিক ‘হিরো কালচারের’ যুগে তা মানা বোধ হয় খুব কঠিন। আসলে, সভ্যতার একেবারে আদিম পর্বের কিছু পর থেকেই ‘মানুষ’ ও ‘নারী’ শব্দার্থে আলাদা হয়ে গেছে। তাই হয়তো আমাদের নারীবাদী সাহিত্য এবং ‘ফেমিনিস্ট রিডিং’ অফ ‘অমুক’ বলে আলাদা বিভাগ খুলতে হয়। যে রাজস্থান আমাদের দেশে কন্যাভ্রূণ হত্যার এক ‘যজ্ঞশালা’, সেখানেও বিদেশি টুরিস্ট এসে, প্রাসাদোপম হোটেলে থেকে, রাজস্থানের ‘মানুষের’ প্রশংসা করে যান— যেন মানুষের সাধারণ ব্যবহার আর নারীর প্রতি ব্যবহার সবসময় আলাদাভাবেই বিচার্য— যেন এটাই স্বাভাবিক, এটাই হয়ে এসেছে এবং হবে। এই আপাত-শান্ত পুরুষতন্ত্রের মধ্যেই আমরা সকলে কম-বেশি বেঁচে আছি ও থাকব। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন মহিলাদের প্রাণের মূল্যও আপেক্ষিক হয়ে পড়ে, হাত পড়ে মৌলিক মানবাধিকারে, বেঁচে থাকার অধিকারে। আমাদের মনে পড়বে, ইরানের মেয়েরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে অধিকারের নতুন লড়াই শুরু করেছিলেন ‘ওয়ান মিলিয়ন সিগ্নেচার’ ক্যাম্পেনের মাধ্যমে ২০০৬-২০০৮ সালেই। তাঁরা বলেছিলেন, সম্পূর্ণ ধর্মমত মেনেই তাদের এই লড়াই আসলে সেই চিরন্তন পুরুষতান্ত্রিক শাসক বনাম সংখ্যালঘু জনতার।

আসলে এই দূর দেশে বসে আমরা কেউ কীকরে বুঝবো নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মানুষ কীভাবে রাস্তায় নামে? ইরান থেকে এক বন্ধু জানাচ্ছেন, নিশ্চিতভাবে আর হারানোর কিছু নেই বলেই মনে হচ্ছে তাঁদের! আমরা কীভাবে বুঝব কালো পোশাকে বাইকে বসা রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী এগিয়ে এলে একটি কুড়ি-বাইশ বছরের মেয়ে কেন পালিয়ে না গিয়ে, লুকিয়ে না পড়ে, সোজা এগিয়ে যেতে পারে তাদের দিকেই (বিবিসি নিউজ ক্লিপ)? ভেবে দেখতে হয়, আমেরিকার মতো দেশ, যারা লিখিতভাবে সংবিধান ও ধর্মকে আলাদা রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেখানেও অ্যান্টি-অ্যাবর্শনের মতো ভয়ানক ধর্মীয়, নারীমুক্তি-বিরোধী মতামত জায়গা করে নিল আইনিভাবে, এই ২০২২ সালেই। মেয়েদের শরীরের ভিতর কী হবে না হবে, সে বিষয়েও মেয়েদের মতামত গ্রাহ্য হল না, লঙ্ঘন করা হল স্বাস্থ্যের ও সুস্থতার অধিকার। তবু আমেরিকা এমন অচল হল না, আমাদের কি সবই সয়ে গেছে আসলে? 

শরীরের বাইরের ও ভিতরের অধিকার নিয়ে লড়তে থাকা পৃথিবীর সমস্ত দেশের মেয়েরাই ইকবাল বানোর গলার সঙ্গে, ফয়েজের কবিতার শব্দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে পারে— ‘লাজিম হ্যায় কে হাম ভি দেখেঙ্গে/ য়ো দিনকে জিসকা ওয়াদা হ্যায়’ (অবশ্যই আমরাও দেখবো, সেই দিন, যার প্রতিশ্রুতি পাওয়া আছে)। আশ্চর্য নয় যে আমাদের দেশে, দিল্লীতে ২০২০ সালেও ফয়েজের এই গানকে নিষিদ্ধ করতে চাওয়া হয়েছিল। আবার এও আশ্চর্য নয়, যে সেই একই গান, পাকিস্তানেও বন্ধ করতে চাওয়া হয়েছিল জিয়ার একনায়কতন্ত্রের আমলে। পাকিস্তানের মানুষের প্রাণের কবি ফয়েজ গানটি ব্যবহার করেছিলেন নিহিতার্থে, ঈশ্বরের নামে অন্যায় করা রাষ্ট্রনেতাদের বিরুদ্ধে, ঈশ্বরের বদলে ক্ষমতার পূজারীদের বিরুদ্ধে। গানের শেষের দিকের বাক্যগুলি ছিল—“অউর রাজ করেগি খল্ক্-এ-খুদা; যো ম্যায় ভি হু অউর তুম ভি হো” অর্থাৎ “আর রাজত্ব করবে সেই সমস্ত খোদার জীব বা ঈশ্বরের সন্তানেরা /যা আসলে, তুমি, আমি এবং আমরা সকলেই।” আসলে পুরুষতন্ত্র যেমন কখনো নারীবাদী স্বরকে মেনে নেয় না, তেমনই রাষ্ট্রযন্ত্র মেনে নেয় না মুক্তাঞ্চল, মেনে নেয় না মুক্তস্বর, মেনে নেয় না ‘আমরা সবাই রাজা’-র গান ।

এই সপ্তাহে তেহরানে, সিরাজে ও ইরানের আরও সমস্ত শহর ছড়িয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রতিবাদ মিছিলে, সেনাবাহিনী প্রকাশ্য রাস্তায় খুন, জখম ও গ্রেপ্তার করে চলেছে। যতজন রাস্তায় আছেন, তাঁদের কতজন বাঁচবেন আমরা জানি না (https://www.amnesty.org/en/documents/mde13/6070/2022/en/)। প্রতিবাদে সামিল হওয়ায় ইরাকের কুর্দিশ অঞ্চলে ইরান মিসাইল আক্রমণ করেছে এই সপ্তাহেই। এর মধ্যেই হঠাৎ কিছু নাবালক-বাহিনী রাস্তায় দেখা যাচ্ছে, যারা বিপ্লবের বিরোধিতা করতে নেমেছে সরকারের পক্ষে! এস্ফাহান শহরের এক বন্ধু ২৯ তারিখ জানিয়েছেন, চিন্তার বিষয় এই যে, এখনও মানবাধিকার অথবা আন্তর্জাতিক/বহুজাতিক কোনো চাপ আসেনি সরকারের ওপর। কাগজের বুলি ছাড়া দেশের বাইরে থেকে সরকারি সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে না সেইভাবে। গত ১ অক্টোবর বিশ্বের দেড়শোটি বড় শহরে ইরানীয়রা প্রতিবাদ মিছিল আয়োজন করেছেন, দাবি ‘শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন’। তবু ফ্রান্সে বসবাসকারী ইরানিয় লেখিকা চৌরা মাকারেমি (যাঁর মা মারা গিয়েছিলেন ১৯৮৮-র সেই অন্ধকার দমনকালে) জানাচ্ছেন, ইরানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ রাখা হচ্ছে প্রতিবাদে। ইরানের ‘সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস’ দেখাচ্ছে, এক শিক্ষক শাস্তি ও গ্রেপ্তারির ভয় উপেক্ষা করে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের বোঝাচ্ছেন কেন কিছু সহপাঠী ক্লাসে নেই এবং তাদের মুক্তি না হওয়া অবধি কেন ক্লাস নেবেন না তিনি। তেল-ব্যবসার কর্মীরা ঘর্মঘটের ডাক দিচ্ছেন প্রতিবাদীদের উপর অত্যাচার বন্ধ করার দাবি জানিয়ে (https://www.rferl.org/a/iran-oil-workers-threaten-strike-crackdown-amini/32054705.html)। এই তেল ব্যবসার অর্থনীতি ১৯৭৯-এর সরকারের সাফল্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বলে আমরা জানি এবং পূর্ব ইউরোপের অবস্থার কারণে এই বছর জ্বালানি তেল কোনো দেশের অর্থনীতিতে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তাও আমরা জানি। সাধারণ মেয়েদের আবেগের পাশাপাশি এমন সার্বিক সমর্থন জড়ো হতে থাকলে হয়তো এই প্রতিবাদ শুধুই একতরফা মার খাওয়া হয়ে থেকে যাবে না। বরং আকাশের গায়ে ওই খোলা চুলের ছবিটা থাকবে - এবারের ইরানের গণঅভ্যুত্থান যদি সফল হয় অথবা যদি আবারও বন্দুকের নলের সামনে হেরে যায় সাধারণ মানুষের বাঁচার লড়াই, তবু উড়তে থাকবে। 

(লেখক কলকাতার নাগরিক, বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণারত। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।)

Powered by Froala Editor