ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীকে ‘রিমোট কন্ট্রোলে’ হত্যা! গল্পকেও হার মানায় যে ঘটনা

ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল ২৭ নভেম্বর। কর্মক্ষেত্র থেকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়ে স্ত্রীয়ের সঙ্গে ক্যাসপিয়ান সাগরের দিকে পাড়ি দিয়েছিলেন ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী ডঃ মহসিন ফাকরিজাদেহ। তবে গন্তব্য পৌঁছানো হল না আর। তেহরানের নিকটবর্তী দামাভান্দ কাউন্টির কাছেই ঘটে গেল অঘটন। ফাকরিজাদেহর গাড়ির ওপর আকস্মিক নেমে এল গুলির বৃষ্টি। তারপরই ভয়াবহ বিস্ফোরণ। জরুরি তৎপরতায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও, মৃত্যু হয় ইরানের অন্যতম পরামাণু গবেষকের। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, কোনো আততায়ী কিংবা সন্ত্রাসবাদীর চিহ্নটুকুও খুঁজে পাওয়া যায়নি ঘটনাস্থলে। তবে কারা গুলিবর্ষণ করল তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে? কেই বা দায়ী ছিল এই ঘটনার পিছনে? সম্প্রতি সমাধান মিলল সেই রহস্যেরই।

না, কোনো আততায়ী নয়। বরং, রিমোট নিয়ন্ত্রিত রোবটের মাধ্যমেই খুন করা হয়েছিল ডঃ ফাকরেজাদেহকে। এমনই চাঞ্চল্যকর দাবি ইরানের গোয়েন্দা সংস্থার। আর তার পিছনে দায়ী ইজরায়েলের কুখ্যাত নিরাপত্তা সংস্থা ‘মোসাদ’। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন জানাচ্ছে এমনটাই।

দু’-এক দিনের পরিকল্পনা নয়। ডঃ ফাকরেজাদেহকে হত্যার জন্য দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে নজরদারি চালিয়েছিল ইজরায়েলের গুপ্ত সংস্থাটি। তাঁর বিরুদ্ধে যে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে, সে ব্যাপারে আগে থেকেই সতর্ক করেছিল ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা। তবে সমস্ত বারণ উপেক্ষা করেই সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ি ছেড়ে নিজের সেডানে করেই অ্যাবসাড শহরে পাড়ি দিয়েছিলেন কিংবদন্তি পরমাণু গবেষক। আর সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগায় মোসাদ।

ইরানের দাবি, রাস্তার ধারে দাঁড় করানো একটি গাড়ির মধ্যেই বন্দোবস্ত করা ছিল রিমোট নিয়ন্ত্রিত রোবট মারণাস্ত্রের। সেই রোবটের সঙ্গেই সংযুক্ত ছিল অত্যাধুনিক বেলজিয়ান টেকনোলজির এফএন মেশিন গান। যা মিনিটে ৬০০ রাউন্ড গুলি চালাতে সক্ষম। কৃতিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত এই রোবট নিজেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে গুলিবর্ষণ করে ডঃ ফাকরেজাদেহর গাড়িতে। সেই হামলাতেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় কিংবদন্তি পরমাণু গবেষকের দেহ। তবে বিস্ফোরণ? ইরানের গোয়ান্দাদের অভিমত, প্রমাণ লোপাটের জন্যই পরিকল্পনামাফিক বিস্ফোরণ ঘটানো হয় পরবর্তী পর্যায়ে। ইরানের সীমান্তের ঠিক বাইরে বসেই স্যাটেলাইট সিগনালের মাধ্যমে এই গোটা অপারেশনটা চালিয়েছিল মোসাদ।

তদন্তে উঠে আসছে রিমোট নিয়ন্ত্রিত রোবটটির আনুমানিক ওজন প্রায় ১ টন। প্রশ্ন থেকে যায়, এত বড়ো এবং ভারি যন্ত্র নিয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে কীভাবে ইরানে প্রবেশ করল মোসাদ? না, বাইরে থেকে নয়। বরং ইরানেই তৈরি হয়েছিল এই মারণযন্ত্র। ছোটো ছোটো অংশ ভাগ করে তার যন্ত্রংশগুলিকে পৃথক পৃথক পথে নিয়ে আসা হয় ইজরায়েল থেকে। অনেকটা কম্পিউটারের মতোই ইরানে বসে তা অ্যাসেম্বল করে মোসাদের একটি দল। নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছিল অন্য একটি দলের ওপর। 

আর এই হত্যার কারণ? সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের পরমাণু শক্তি গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন ডঃ ফাকরেজাদেহ। তাঁর তত্ত্বাবধানেই চলছিল একাধিক পরামাণু অস্ত্র নির্মাণ এবং শক্তি উৎপাদন প্রকল্পের কাজ। বলাই বাহুল্য, এই প্রকল্পগুলি সফল হলে মধ্যপ্রাচের অন্যতম পরমাণু শক্তিধর দেশ হয়ে উঠবে ইরান। আর সেই সমস্যাকেই গোড়া থেকে ছেঁটে ফেলতে চেয়েছিল মোসাদ।

তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও দুই ইরানিয় বিজ্ঞানীর হত্যার অভিযোগ উঠেছিল ইজরায়েলের এই গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। বিশ্বের প্রথম পত্রবোমা হামলার নেপথ্যেও ছিল তারাই। সেই কুখ্যাতিরই তালিকায় নবতম সংযোজন হল রোবট মারণাস্ত্র। মোসাদের এই কল্পনাতীত হত্যাকাণ্ড যেন হার মানায় আমেরিকার সিআইএ কিংবা রাশিয়ার কেজিবির অপারেশনকেও…

Powered by Froala Editor

More From Author See More