লটারি জিতে সিনেমার ভাবনা, ইরানি বংশোদ্ভূতের হাতেই তৈরি দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র

বিংশ শতক সদ্য শুরু হয়েছে। ভারত তখন নানা ঝড়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। মূল সমস্যা ছিল পরাধীনতার। তার মধ্যে দিয়েই নিত্য নতুন কাজের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। এমন সময় এক ভদ্রলোক ভাগ্যের জোরে জিতলেন একটি লটারি। এতে আর আশ্চর্য কী, এরকম তো কতজনই জেতে! সেটা ঠিকই; কিন্তু এখানে এই একটি লটারিই ভারতীয় চলচ্চিত্রের ছবিটা বদলে দিল। আরও ভালো করে বললে, ভারতীয় সিনেমার মুখে শব্দ আর আওয়াজ বসাল। এবং তৈরি করল ‘আলম আরা’ নামের এক কিংবদন্তির…

বলিউড এবং ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে দুটি সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হল ১৯১৩, যে বছর মুক্তি পেয়েছিল দাদাসাহেব ফালকের ‘রাজা হরিশচন্দ্র’। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি এটি। কিন্তু তখনও শব্দ বসেনি সিনেমায়; নির্বাক ছিল সব ছিল। কিন্তু সিনেমা তৈরির একটা রেওয়াজ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তারই ফসল বেরোল ১৯৩১ সালে, আরদেশির ইরানির হাত ধরে। সিনেমার নাম ‘আলম আরা’; ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রথম সবাক সিনেমা।

এর পেছনের গল্পটাও এক অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চারের; সঙ্গে আছেন এক সিনেপাগল মানুষ— আরদেশির ইরানি। ১৮৮৬ সালে পুনেতেই জন্ম তাঁর, মহারাষ্ট্রের বুকেই বেড়ে ওঠা। কিন্তু শিকড় ছিল ইরানে। ১৮৭৯ সালে আরদেশিরের মা-বাবা ইরান থেকে ভারতে চলে আসেন। সেই ছিন্নমূল পরিবারেরই সন্তান তিনি। সাধারণভাবেই বেড়ে উঠছিলেন; মুম্বইয়ে গিয়ে নিজের একটি মিউজিকাল ইনসট্রুমেন্টের দোকান খুলেছিলেন। চলে যাচ্ছিল সংসার, এমন সময় ঘটল অঘটন…

অঘটনই বটে! বা বলতে পারেন ভাগ্যের দরজা খুলে যাওয়া। ১৯০৩ সালে হঠাৎ করেই একটি লটারি জিতে যান আরদেশির ইরানি। এক ধাক্কায় পেয়ে যান ১৪ হাজার টাকা! মনে রাখতে হবে, সালটা ১৯০৩। সেই সময় ১৪ হাজারের দাম ছিল অনেক বেশি। এই টাকা পেয়েই পাগলামির খেয়াল চাপল আরদেশিরের মাথায়। জায়গায় জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে সিনেমা দেখাতে লাগলেন তিনি। হ্যাঁ, সিনেমা। ছোটো থেকেই এই বিষয়টা নিয়ে উৎসাহ ছিল আরদেশিরের। সিনেমা দেখানোর নেশা যেন পেয়ে বসল তাঁকে। এমন সময় বেরোল দাদাসাহেব ফালকের ‘রাজা হরিশচন্দ্র’। বহু তরুণের মতো তিনিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন সিনেমার। সেই স্বপ্নকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেল হলিউডের ‘শো বোট’ সিনেমাটি। না, সিনেমা একটা বানাতেই হবে। টাকা তো আছে, করে ফেলবেন আরদেশির…

শুধু সেই চিন্তাতেই আটকে থাকলেন না তিনি। এমন কিছু একটা করতে হবে যাতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটা বাঁক বদল হয়। কী করবেন? উপায় ছিল হাতের সামনেই। নির্বাক ছবিকে সবাক করার ভাবনাচিন্তা ঘুরতে লাগল আরদেশির ইরানির মাথায়। হিন্দি আর উর্দু মিলে হিন্দুস্তানি ভাষায় তৈরি করবেন নতুন সিনেমা। নাম হল ‘আলম আরা’। প্লট রেডি, গল্প রেডি; রেডি কলাকুশলীরাও। যোগ দিলেন পৃথ্বীরাজ কাপুর, মাস্টার ভিথাল, জুবেইদা, এল ভি প্রসাদরা। প্রথমে ঠিক হয়েছিল প্রধান ভূমিকায় থাকবেন মেহবুব খান (পরে ইনিই পরিচালনা করেন কালজয়ী সিনেমা ‘মাদার ইন্ডিয়া’); কিন্তু কোনো কারণে সেটা হয়নি। তবে এই সিনেমার প্রধান ‘নায়ক’ তো শব্দ! এর আগে সিনেমায় ডায়লগের অস্তিত্ব ছিল না; সবটাই ছিল নির্বাক। সেই পর্দাটাই উঠিয়ে দিলেন আরদেশির ইরানি। আজকের অত্যাধুনিক ব্যবস্থা তখন ছিল না। বড়ো বড়ো মাইক থাকত অভিনেতার সঙ্গে। কখনও জামার ভেতর লোকানো, কখনও আশেপাশের প্রপের সঙ্গে। হারমোনিয়াম, তবলার মতো বাদ্যযন্ত্র থাকত গাছের আড়ালে, যাতে ক্যামেরা ধরতে না পারে।

১৯৩১ সাল। তৈরি হল একটি ইতিহাস। মুক্তি পেল ‘আলম আরা’। উল্লেখ্য, এই সিনেমার হাত ধরেই প্লেব্যাক মিউজিক ঢোকে ভারতীয় সিনেমায়। সমস্ত জায়গায় হইচই পড়ে গেল। সিনেমায় লোকেরা নড়াচড়া করছে, এমনকি কথাও বলছে! এতদিন তো শোনা যেত না সেসব! বদলে গেল ছবিটা। আরদেশির ইরানি ও তাঁর সিনেমা কালজয়ী হয়ে রইল। আক্ষেপ, আজ আর ‘আলম আরা’র সিনেমাটার কোনো অস্তিত্ব নেই। সংরক্ষণ করা যায়নি রিল। রয়ে গেছে কয়েকটা ফটোগ্রাফ। তার মাধ্যমেই ইতিহাস আঁকড়ে ধরা। আরদেশির ইরানি এরপরেও ১৯৩৭ সালে প্রযোজনা করেন ‘কিষাণ কন্যা’ ছবির, যা ভারতের প্রথম হিন্দি রঙিন সিনেমা। ইতিহাস যেন ছাড়েনি ইরানি সাহেবকে শেষদিন পর্যন্ত। আমরা মনে রেখেছি কি?…    

আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম মহিলা কমব্যাট ট্রেনার সীমা, হাত পাকিয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালনাতেও

Powered by Froala Editor

More From Author See More