কলকাতার বুকে একটুকরো ইরানি হাওয়া, আজও ফারসি ভাষা শেখানো হয় এখানে

“‘মীরাৎ উল আখবার'-এর বেশ কয়েকটি অংশ বেরিয়েছিল আমাদের জার্নালে। লাইব্রেরি ঘাঁটলে সেগুলো মিললেও মিলতে পারে।”, ধূমায়িত চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলছিলেন কে জাভেদ ইউসুফ, ইরান সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক। ১২ নম্বর মহম্মদ ঈশাক রোড, বা কিড স্ট্রিটের (Kyd Street) বাগানবাড়িতেই ইরান সোসাইটি (Iran Society)। ফারসি ভাষার (Persian Language) সঙ্গে কলকাতার একমাত্র দৃশ্যমান সূত্র।

১৮২২ সালের ১২ এপ্রিল, রাজা রামমোহন প্রকাশ করেছিলেন ‘মীরাৎ উল আখবার’। পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রতি শুক্রবার গর্জে উঠত তাঁর কলম। তাঁর প্রথম গ্রন্থটিও ফারসিতে লেখা— তুহফাতুল মুহাহহিদিন। শোনা যায় মির্জা গালিবের সঙ্গেও আলাপও ছিল গভীর। তবে শুধু রামমোহন নয়, কথিত আছে, গঙ্গাবক্ষে বজরায় নবাব সিরাজদৌল্লাকে ফারসি গান শুনিয়ে মুগ্ধ করেন রামপ্রসাদ সেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হাফিজপ্রীতি' সর্বজনবিদিত।…

‘সেই নবাবি আমল থেকেই ফারসির সঙ্গে বাংলার নিবিড় যোগাযোগ। আদালত, আইন, পেশকার, মুন্সি---এসব শব্দ তো ফারসি ভাষা থেকে আমদানি।’ জাভেদ সাহেব পেশায় একজন দুঁদে উকিল। নেশা ফারসি ভাষা শিক্ষা। তাই কথা বলতে বলতে যে কোর্টকাছারির লব্জ এসে পড়বে, এমনটাই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন
বইপ্রেমীদের জন্য সুখবর, ৩১ জানুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে কলকাতা বইমেলা

১২ কিড স্ট্রিটের বাগানবাড়ির বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে। জ্বলে উঠেছে আলো। সুবিশাল হলঘরে লাগানো সারি সারি ছবি। এঁরা সবাই ইরান সোসাইটির সদস্য। তাঁদের অনেকের ছবি দেখে চমকে যেতে হয়। যেমন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তবে যাঁরা সুনীতিকুমারের ভক্ত, তাঁদের কাছে অবশ্য এমন কিছু বিস্ময়ের ব্যাপার না। শোনা যায় সুনীতিকুমার ফারসি জানতেন ভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-র থেকেও ভালো। অবশ্য সেই খামতি জনাব শহীদুল্লাহ পুষিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সংস্কৃত'র জ্ঞানে। সুনীতিকুমার ছাড়াও দেওয়ালে জ্বলজ্বল করতে দেখা যাচ্ছে, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী, রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেন, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, পদ্মজা নাইড়ু, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়দের...এঁরা সকলেই ছিলেন পৃষ্ঠপোষক। কেউ কেউ সদস্য। এককোণে ঝুলছে সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা জনাব মহম্মদ ঈশাকের সুবৃহৎ তৈলচিত্র।

আরও পড়ুন
শিল্পী হরেন দাসের আঁকা ছবির প্রদর্শনী দক্ষিণ কলকাতায়

আরও পড়ুন
সমপ্রেমের ছবিতে একাকার যিশু-কৃষ্ণ, কলকাতার বুকে একটুকরো প্রদর্শনী

১৯৩৮ সালে লন্ডনের সোয়াস (স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল আ্যন্ড আ্যফ্রিকান স্টাডিজে) পড়তে গিয়েছিলেন মহম্মদ ঈশাক। সেখানে পরিচিত হন লন্ডনের ইরান সোসাইটির সঙ্গে। ঈশাক ভাবছিলেন ইতিহাসের পরিহাসের কথা। একদিকে মেকলের মানসপুত্ররা ইংরেজ প্রভুদের কথায় বাংলা থেকে ফারসি ভাষাকে নির্মূল করছেন, জেলায় জেলায় ইংরিজি শিক্ষার প্রসার ঘটাচ্ছেন, অন্যদিকে সেই ঔপনিবেশিক প্রভুদের আঁতুড়ঘরেই গড়ে উঠেছে ফারসি ভাষাকেন্দ্র। ঈশাক ফিরলেন বজ্রকঠিন সংকল্প নিয়ে। তারপর ১৯৫০-এর আশেপাশে প্রিয়বন্ধু খান আব্দুল হালিম এবং কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে শুরু করলেন ইরান সোসাইটি। তবে সোসাইটি ১৯৬০ সালে পাকাপাকিভাবে থিতু হল কিড স্ট্রিটের বাগানবাড়িতে। 

হলঘর, আপিসঘর পেরিয়ে লাইব্রেরি ঘর। আর সেখানেই রয়েছে ইরান সোসাইটির ‘আনমোল রতন’। আবেস্তা (জেন্দ আবেস্তা) সম্পর্কিত সাহিত্য, দুষ্প্রাপ্য পুঁথি, ফারসি প্রাইমার— সবই রয়েছে। আর রয়েছে, ‘ইন্দো-ইরানিকা।’ ইরান সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ত্রিমাসিক পত্রিকা। ৭৫ বছর ধরে যা পাতায় পাতায় আগলে রাখছে, ফারসি সাহিত্যের হিরে-জহরৎ। 

‘এখনো পর্যন্ত সরকারি সহায়তার দরকার হয়নি আমাদের। বাগানবাড়ির ভাড়া, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে আমাদের পত্রিকা বিক্রি, ফারসি ক্লাস— ইত্যাদি নানাভাবে খরচ উঠে আসে সোসাইটির। টানাটানি পড়লে অনেক সময় সদস্যদের চাঁদাতেই পুষিয়ে যায়।’ বলছিলেন জাভেদ সাহেব। বর্তমানে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছেন ইরান সোসাইটির প্রায় ১৭০ জন সদস্য। সোসাইটির দুর্দিনে তাঁরাই বল-ভরসা।

কিন্তু ফারসি ভাষা শেখেই বা কতজন? এই জায়গাটা খুঁজে পাওয়াও তো বেশ কঠিন।

প্রশ্নের উত্তরে হেসে ওঠেন জাভেদ সাহেব। ‘বললে বিশ্বাস করবেন না, আমাদের ক্লাসে যাঁরা আসেন তাঁদের অধিকাংশই আপনার মতো অল্পবয়সী… পড়ুয়ার সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছেও।’

কিড স্ট্রিটের ইরান সোসাইটির মতো কত অদৃশ্য রত্নখনি যে পাওয়া যাবে তিলোত্তমার বুকে। হেঁটে দেখতে শিখলে হয়।

Powered by Froala Editor