আউটের নিয়ম জানতেন না ইনজামাম

দীর্ঘদেহী গড়ন, শান্ত ভাবলেশহীন মুখ, অলস ভাবভঙ্গি, খুব বেশি খুচরো রানের ধার ধারেন না। চেহারায় বা স্টাইলে কোনো চটকদারি নেই, খেলার মধ্যে প্রচণ্ডভাবে আছেন কিনা তাও বোঝা যায় না, কিন্তু একবার ক্রিজে জমে গেলেই রীতিমতো ভয় করতে শুরু করবে বোলাররা। কারণ মুখে চুইংগাম নিয়ে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হেলায় বলকে বাউন্ডারি পার করাতে এই ব্যাটসম্যানের জুড়ি মেলা ভার। পাকিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কুড়ি হাজারেরও বেশি রান করা একমাত্র ব্যাটসম্যান। ইমরান খান বলতেন, পেস বোলিংয়ের বিরুদ্ধে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান যদি কেউ হয় তাহলে সে হল ইনজামাম।

১৯৯২ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে জ্বর নিয়ে খেলতে নেমে ৩৭ বলে ৬০ রানের ম্যাচ-জেতানো ইনিংসের অভাবনীয় ঘটনা যেমন আছে ইনজামামকে ঘিরে, তেমনই ক্রিকেট মাঠে তাঁর আউট ঘিরে নানা মজার স্মৃতিও নব্বই ও শূন্য দশকের ক্রিকেট-দর্শকের মনে উজ্জ্বল। ওই ১৯৯২ বিশ্বকাপেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ম্যাচে, ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট থেকে বল তুলে নিয়ে দৌড়ে এসে ‘উড়ন্ত’ জন্টি রোডসের তাঁকে রান-আউট করার দৃশ্য তো প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমীর চোখে আজও ভাসে। একদিনের ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার মারভ্যান আতাপাত্তুর (৪১) পরেই সবচেয়ে বেশিবার রান আউট হয়েছেন ইনজি (৪০), এবং বেশিরভাগ সময়েই সেই রান-আউটের ধরনগুলি ছিল বেশ মজার। যেমন ঘটেছিল ১৯৯৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে গ্রুপ ম্যাচে। ইনজামাম তখন ব্যাট করছেন ৮১ রানে। সাতচল্লিশতম ওভারটি বল করতে এসেছেন ডানহাতি সিমার ড্যামিয়েন ফ্লেমিং। দ্বিতীয় বলটি ছিল ইয়র্কার; লেংথটা ঠিকমতো ধরতে পারেননি ইনজি। বল সোজা গিয়ে লাগল তাঁর বাঁ পায়ের আঙুলে। রান নিতে বেরিয়ে গিয়েও হঠাৎ আঙুলের ব্যথায় ক্রিজের মধ্যেই বসে পড়লেন দীর্ঘদেহী ব্যাটসম্যানটি। ততক্ষণে উল্টোদিকের ব্যাটসম্যান ওয়াসিম আক্রম দৌড়ে চলে গেছেন স্ট্রাইকিং প্রান্তে। ফ্লেমিং বলটা তুলে নিয়ে গিয়ে বেশ সময় নিয়েই ভেঙে দিলেন নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তের স্টাম্প।

পুল শটে বাউন্ডারি মারার সময়ে দুই পা-কে যেরকম অসাধারণভাবে নড়াচড়া করাতে পারতেন তিনি, রান আউট ঠেকাতে সেই পা-ই যেন বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করত তাঁর সঙ্গে

তাঁর বেশিরভাগ রান-আউটের ঘটনাগুলি পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে, চেহারার কারণেই হয়ত দৌড়নোর পথে একবার কোনো কারণে থমকে গেলেই পরে আর রিকভার করতে পারতেন না তিনি। বিশেষত, পিছন ফিরে দৌড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অপটু ছিলেন ইনজামাম। এমনকি এও দেখা গেছে, পুল শটে বাউন্ডারি মারার সময়ে দুই পা-কে যেরকম অসাধারণভাবে নড়াচড়া করাতে পারতেন তিনি, রান আউট ঠেকাতে সেই পা-ই যেন বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করত তাঁর সঙ্গে। এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল ২০০৫ সালের নভেম্বরে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ফয়সালাবাদ টেস্টে। ইংল্যান্ডের পেস বোলার স্টিভ হার্মিসনের একটি বল সোজা বোলারের হাতে পাঠান ইনজামাম। হার্মিসন রান আউটের উদ্দেশ্যে বলটি ধরেই আবার সোজা উইকেটের দিকে ছোঁড়েন। আঘাত ঠেকাতে ডানদিকে সরে যান ইনজামাম। বল লেগ স্টাম্প ভেঙে দিয়ে চলে যায় ডিপ ফাইন লেগে। ওভারথ্রো ধরে নিয়ে দৌড়ে এক রান পূর্ণও করেন দুই পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান। ইংরেজরা আউটের আবেদন করলে থার্ড আম্পায়ারের সাহায্য নেন লেগ আম্পায়ার ডারেল হেয়ার। সেখানে রিপ্লেতে দেখা যায়, সরে যাওয়ার সময় ইনজির ডান পা ক্রিজের ভেতরে থাকলেও তা শূন্যে ছিল। ফলে থার্ড আম্পায়ার আউট ঘোষণা করেন সেঞ্চুরিকারী ইনজামামকে। সিদ্ধান্তটি অবশ্য বিতর্কিত ছিল কারণ ক্রিকেটের নিয়ম অনুযায়ী, বলের আঘাত ঠেকাতে যে-কোনো উপায়েই ছুটন্ত বলকে এড়িয়ে গিয়ে ব্যাটসম্যান নিজেকে রক্ষা করতে পারেন, সেক্ষেত্রে কোনোভাবেই তাঁকে আউট ঘোষণা করা যাবে না।

ফয়সালাবাদে আমি বল ছেড়ে দিয়ে রান আউট হয়েছিলাম, আর আজ বল থামিয়ে আউট হলাম।

এই ঘটনার কয়েক মাস বাদেই আবারও একবার অদ্ভুতভাবে আউট হন ইনজামাম। রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দল তখন খেলতে গেছে পাকিস্তানে। প্রথম একদিনের ম্যাচে ভারতের ৩২৮ রানের জবাবে সমানে সমানে লড়ে গেছে পাকিস্তান। ক্রিজে ইনজামাম ও ইউনিস খান। পেসার শ্রীসন্থের একটি বল মিড-অফে সুরেশ রায়নার হাতে জমা করলেন ইনজি। কোনও রান হয়নি। উইকেট-রক্ষক মহেন্দ্র সিং ধোনির উদ্দেশে রায়না যখন বলটি ছোঁড়েন, তখন বলটি সোজা ইনজামামের শরীরের দিকে নির্দেশিত ছিল। ফয়সালাবাদে বল ছেড়ে দিয়ে রান আউট হয়েছিলেন ইনজি, তাই এবার আর ঝুঁকি না নিয়ে ব্যাট দিয়ে বলটি আটকে দেন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত, তখন নিজের ক্রিজ ছেড়ে অনেকটাই বেরিয়ে ছিলেন পাকিস্তানের অধিনায়ক। ফলে, বল উইকেটে লাগলে রান আউট হতে পারতেন তিনি। ভারতীয় ফিল্ডাররা আউটের আবেদন করলে মাঠের দুই আম্পায়ার আসাদ রউফ ও সাইমন টফেল ‘অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ড’-এর অভিযোগে ইনজামামকে আউট ঘোষণা করেন। ম্যাচটি শেষপর্যন্ত ডাকওয়ার্থ লুইস নিয়মে জিতেছিল পাকিস্তান। পুরস্কার-বিতরণী অনুষ্ঠানে সঞ্চালক ছিলেন রামিজ রাজা, যিনি স্বয়ং ১৯৮৭ সালে করাচিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে নিজের শতরান পূরণ করার জন্য দ্বিতীয় রান নেওয়ার সময় নিশ্চিত রান আউট থেকে বাঁচবার উদ্দেশ্যে ব্যাট দিয়ে থ্রো আটকে একদিনের ক্রিকেটে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে এই একইভাবে আউট হয়েছিলেন। রামিজের পর ইনজামাম হলেন দ্বিতীয় পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান, এই কথা বলে রামিজ তাঁকে মজা করে অভিনন্দন জানালে অত্যন্ত অসহায় মুখ করে ইনজামাম সরল, অকপট স্বীকারোক্তি করেন-‘আমি এই নিয়মটাই ঠিক বুঝতে পারি না। কারণ, ফয়সালাবাদে আমি বল ছেড়ে দিয়ে রান আউট হয়েছিলাম, আর আজ বল থামিয়ে আউট হলাম। আসল নিয়মটা যে ঠিক কী, আমার মাথায় ঢুকছে না।’

ছবি ঋণ - ইয়াহু ক্রিকেট, নিউজ ১৮

More From Author See More