কাজ করিয়েও টাকা দেননি এডিসন, প্রতিশোধে অল্টারনেটিং কারেন্ট আবিষ্কার টেসলা-র

মঞ্চের উপরে দাঁড়িয়ে একজন লম্বা, সুপুরুষ ব্যক্তি। জাদুকরের ভঙ্গিতে একবার মাথার হ্যাটটা খুলে দর্শকদের অভিবাদন জানালেন। তারপর দুহাতে দুটো তামার গোলক তুলে নিয়ে এগিয়ে গেলেন ইলেকট্রিক ট্রান্সফর্মারের দিকে। দুটি তড়িৎদ্বারে বসিয়ে দিলেন দুটি বল। তখনও মানুষটির শরীর ছুঁয়ে আছে গোলকদুটি। তাঁর শরীর দিয়ে ছুটে গেল ২৫০ কিলোভোল্টের বিদ্যুৎ। হ্যাঁ, ২৫০ কিলোভোল্ট। অর্থাৎ আমাদের বাড়ির বিদ্যুতের লাইনের ৭৮১ গুণ। সংবাদপত্রের বর্ণনায় লেখা হয়েছিল, মানুষটির শরীরের উপর দিয়ে তখন যেন একটা আগুনের শিখা বয়ে গেল। তবে মুহূর্তের জন্যই। তারপর আবার সব আগের মতো।

না, মঞ্চের উপরে সেই মানুষটি কোনো জাদুকর ছিলেন না। তিনি পদার্থবিদ্যার কিংবদন্তি নিকোলা টেসলা। কিন্তু কেন এমন জীবন বাজি রাখা খেলা দেখিয়েছিলেন তিনি? তার কারণ পদার্থবিদ্যার জগতে এক বিখ্যাত যুদ্ধ। দুই কিংবদন্তির যুদ্ধ। একদিকে নিকোলা টেসলা এবং অন্যদিকে টমাস এডিসন। একদিকে এ.সি. অর্থাৎ অল্টারনেটিভ কারেন্ট, আর অন্যদিকে ডি.সি. অর্থাৎ ডিরেক্ট কারেন্ট। অল্টারনেট কারেন্টের প্রচলনে যেন বেশ খানিকটা পিছনে সরে গিয়েছিলেন এডিসন। তখন তিনি এই যুক্তির উপর প্রচার চালাতে থাকেন যে, অল্টারনেটিভ কারেন্ট নিরাপদ নয়। এর থেকে নানা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সেই যুক্তিকে প্রতিহত করতেই জীবন বাজি রেখে মঞ্চে নেমেছিলেন টেসলা।

তবে এই দ্বন্দ্বের শুরু কিন্তু আরও আগে। তখন টেসলা সদ্য পঠনপাঠন শেষ করে গবেষণার কাজে যোগ দিয়েছেন। বিদ্যুৎ সংক্রান্ত গবেষণায় তখন এডিসনের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই। টেসলা যোগ দিলেন এডিসনের কোম্পানিতেই। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা ছিল স্বয়ং এডিসনের সঙ্গে এক ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করবেন তিনি। সেই সুযোগও এসে গেল। ১৮৮৪ সালে টেসলা চললেন আমেরিকা। এডিসন তখন তাঁর জেনারেটর ইঞ্জিন নিয়ে খানিকটা চিন্তিত। একে কীভাবে আরও উন্নত করে তোলা যায়, সেটাই ভাবছেন। টেসলাকে পেয়ে তিনি বললেন, টেসলা যদি এই কাজে সফল হতে পারেন, তাহলে এডিসন তাঁকে ৫০ হাজার ডলার পুরস্কার দেবেন। টেসলাও প্রাণপণ কাজ শুরু করলেন। টাকার জন্য অবশ্য নয়। আবিষ্কারের নেশাতেই সময় কেটে যাচ্ছিল তাঁর। আর অবশেষে মিলল সাফল্যও। কিন্তু না, প্রতিশ্রুতি রাখলেন না এডিসন। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, তিনি তো তখন মজা করেছিলেন। আসলে টেসলা একজন দক্ষ কর্মচারীর কাজ করেছেন। এর ফলে বড়জোর আগামীদিনে তাঁর কাজের স্থায়িত্ব নিয়ে ভাবা যেতে পারে।

সেইদিনই টেসলা ঠিক করে নিয়েছিলেন, আর এখানে নয়। বহু কষ্টে অর্থ সংগ্রহ করে নিজেই তৈরি করে ফেলেছিলেন একটি ল্যাবরেটরি। আর সেখানেই আবিষ্কার করে ফেললেন এ.সি. কারেন্ট। যুদ্ধের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কিছুই হল না যদিও। সব মিলিয়ে ঠিক হল, সস্তা বিদ্যুতের উৎস হিসাবে এ.সি. কারেন্ট ব্যবহার করা হবে। তবে বিপজ্জনক কাজে ডি.সি. কারেন্টই ব্যবহার করা হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত সহজ সহজ বন্টন ব্যবস্থার সুবাদে এ.সি. কারেন্টই জিতে গিয়েছিল। তবে টেসলার আবিষ্কারের অনেক সম্ভাবনাই তখন উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। সত্যিই এক কিংবদন্তিকে যুদ্ধের পরাজিত নায়কের মতোই মনে রেখেছে বিজ্ঞানের ইতিহাস।

Powered by Froala Editor

Latest News See More