আবিষ্কার করেছেন একের পর এক যন্ত্র, নিয়েছেন পেটেন্ট; বিস্মৃতির আড়ালে বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার

বাঙালির জগৎ বলতে আমাদের মনের মধ্যে প্রথমেই ভেসে ওঠে সংস্কৃতি জগতের কথা। বাঙালি মানেই সে কবিতা লিখবে, নাটক-থিয়েটার করবে। বড়জোর একটু বিজ্ঞান বা গণিতের চর্চা করবে। মানে যাকে ওই 'থিওরিটিক্যাল সায়েন্স' বলা হয়। নতুন কারখানা তৈরি বা ব্যবসার দিকে বাঙালিদের খুব একটা আগ্রহ যেন দেখা যায় না। কিন্তু ইতিহাস কি সেই কথাই বলে? উত্তর হল, না। রীতিমতো ঝুঁকি নিয়ে বাংলার বুকেই গড়ে উঠেছিল অসংখ্য কারখানা। আর সেইসব কারখানার যন্ত্রপাতিও বাঙালিই তৈরি করেছিলেন। মানে যাকে বলে 'ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প'। এখানেও বাঙালিদের উদ্ভাবনী বুদ্ধির অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় বৈকি।


আমাদের দেশে আধুনিকতার সূত্রপাত ব্রিটিশদের হাতেই। আর আধুনিকতা মানে তো শুধুই কিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন নয়। পরিবর্তন সম্পূর্ণ জীবনযাত্রার। আর সেইসঙ্গে অবশ্যই উৎপাদন ব্যবস্থার। প্রাচীন ঘরোয়া পদ্ধতিতে উৎপাদন আর চলবে না। এবার দরকার কারখানা। এদেশে কারখানার বিকাশও ব্রিটিশদের হাতেই। আর বাংলায় প্রথম ভারী শিল্প বলতে পাট শিল্প। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গাতেই যে ধানের চাষ হয়। তার কী হবে? সেই পুরনো পদ্ধতিতে ঢেঁকিতে ধান ভানতে হবে? ব্রিটিশরা সেদিকে তেমন নজর দেননি। হয়তো নজর দেওয়ার প্রয়োজনও ছিল না। তাছাড়া ইউরোপের মাটিতে ধান ভানার কোনো যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি। কিন্তু বাঙালিদের তো ধানই জীবন। অতএব এই উদ্যোগ নিলেন একজন বাঙালিই।


১৮৯৬ সালের স্টেটসম্যান পত্রিকা থেকে জানা যায়, জগদীশ্বর ঘটক নামে এক ব্যক্তি 'রাইস হাস্কিং মেশিন' তৈরি করেছেন। এই জগদীশ্বর চেতলার বিখ্যাত উকিল কাশীশ্বর ঘটকের পুত্র। ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে তাঁর পারদর্শিতার উদাহরণ অবশ্য এই প্রথম নয়। ১৮৮৫ সাল নাগাদ তিনি একটি তিনচাকার জলচর সাইকেল তৈরি করেছিলেন। এই জলচর সাইকেল কি এখনকার প্যাডেল বোটের মতো কিছু? সেকথা জানা যায় না। তবে ধনী বাঙালিদের কাছে বেশ আদরণীয় হয়ে উঠেছিল এই জলযান। শোনা যায় জ্যোতির্ময় ঠাকুর, শাজাহানপুরের রাজা এবং বর্ধমানের মহারাজা তাঁর আবিষ্কৃত এই সাইকেল কিনেছিলেন। এই আবিষ্কারের জন্য অবশ্য তিনি পেটেন্ট পাননি। সেই প্রথম কীর্তি, তাই ব্যবসায়িক লাভ-লোকসানের কথা খুব একটা ভাবেননি। তবে ১৮৯৬ সালে ধান ভানার যন্ত্রের সঙ্গেই তিনি তৈরি করেছিলেন 'পাংখা-পুলিং মেশিন'। আর স্টেটসম্যানের সংবাদ অনুযায়ী দ্বিতীয় যন্ত্রটির জন্য তিনি পেটেন্টের আবেদন করেছিলেন।


জগদীশ্বরের রাইস হাস্কিং মেশিন কিন্তু বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১৮৯৮-এর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এগজিবিশনে এই মেশিনটির জন্য স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন জগদীশ্বর। তবে তাঁর কীর্তি এখানেই শেষ নয়। ওই বছর, অর্থাৎ ১৮৯৮ সালে তিনি আরেকটি যন্ত্রের জন্য পেটেন্ট পান। সেই যন্ত্রের নাম 'বয়েল্ড রাইস কুকিং অ্যাপারেটাস'। ১৯০২ এবং ১৯০৪ সালে পেটেন্ট পান আরও দুটি আবিষ্কারের জন্য। প্রথমটি হল, 'প্যাডি হাস্কিং অ্যান্ড ক্লিনিং মিল'। আর দ্বিতীয়টি 'মেশিনারি ফর ট্রিটিং প্যাডি উইথ স্টিম, হট অ্যান্ড কোল্ড এয়ার'।

বাংলার, বিশেষ করে রাঢ বাংলার গ্রামগুলোকে ঘিরে দেখতে দেখতে বেশ কিছু শিল্প উদ্যোগ গড়ে উঠতে লাগলো। যেগুলোকে বলা হয় 'রাইস মিল'। বদলে গেল গ্রামবাংলার অর্থনীতিও। এদেশের চালের যে এত দাম, সেকথা আর তার আগে কে জানত! আর এই সবকিছুই কিন্তু হয়েছিল জগদীশ্বর ঘটকের জন্যই। একের পর এক যন্ত্র তিনি শুধু আবিষ্কারই করেননি, সেইসঙ্গে পেটেন্টের ব্যবস্থাও করেছিলেন। এইসব আবিষ্কারের অর্থনৈতিক মূল্য তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়নি। বাংলার ইতিহাসে এও এক নবজাগরণ বৈকি! কিন্তু বাঙালি তাঁকে কতটুকুই বা মনে রেখেছে? জগদীশ্বর ঘটক নামটা আজও তাই অধিকাংশের কাছেই না শোনা।


তথ্যসূত্র: কলের শহর কলকাতা, সিদ্ধার্থ ঘোষ

Powered by Froala Editor