বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, দুর্দশা, ভবিষ্যৎ নিয়ে মুখ খুললেন ভাষাবিদ পবিত্র সরকার। বাংলা কি ক্রমাগত বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে? কী মনে করেন তিনি? কথোপকথনে ঔষ্ণীক ঘোষ সোম...
এখন চারপাশে অনেকে বাংলা ভাষাকে অবহেলা করেন। স্কুলেও ইদানিং ভালো করে বাংলা শেখানো হয় না। এসবে বাংলা ভাষার কি আদৌ ক্ষতি হচ্ছে?
ক্ষতি হচ্ছে অবশ্যই। কারণ বাংলাটা যারা বলত তারা আস্তে-আস্তে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে গিয়ে, বা তাদের ছেলে মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পাঠিয়ে ইংরাজি ভাষার প্রতি ভক্তিটা বেশি করে তৈরি করছে। একটা সমাজে ভাষার ক্ষমতার ওপর-নিচ থাকে। ইংরাজি ভাষার ক্ষমতা এখন অনেক বেশি। বাবা-মা’রা সবাই ভাবছে যে ইংরাজি না জানলে কোনো ভালো চাকরিবাকরি জুটবে না। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ামে গিয়েই সেটা শিখতে হবে এটার মধ্যে একটা ভুল আছে। আমরাও বাংলা মাধ্যম স্কুলে ইংরাজি শিখেছি। তাতে আমাদের দেশ-বিদেশে গিয়ে গবেষণা করতে, পড়াতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ঠিকমতো শেখালে ইংরাজিটা বাংলা মাধ্যম স্কুলেও শেখানো যায়। আবার অন্য দিকে এটা ভাবার যে, গ্রামের ছেলেমেয়েরা… এমনকি বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, আসামের শিলচর, আন্দামানের কিছু অংশ, ঝাড়খণ্ড এইসমস্ত অঞ্চলের সব ছেলেমেয়েরা যে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ার সুযোগ পাবে, তা নয়। ইউনেস্কোর একটা তালিকা বেরিয়েছিল যে কোন ভাষা কত বিপদের মধ্যে আছে, তাতে অনেক আদিবাসী ভাষাই রয়েছে। কিন্তু ইংরাজির কোনো বিপদ নেই। বাংলার হয়তো একটু বিপদ আছে, কিন্তু এখনই তত বড়ো বিপদ নেই। ধ্বংস হয়ে যাবে, শেষ হয়ে যাবে – এমনটা নয়।
কোনো সেমিনারে বা লেকচার দিতে গিয়ে, কেউ যদি বাংলায় তার বক্তব্য রাখেন, লোকে ভাবে যে সেই বক্তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কম। যেহেতু সে ইংরাজির বলছে না। মানুষের এমন ধারণা কেন হচ্ছে? আপনার কী মনে হয়?
ইংরাজি যেহেতু আমাদের কাছে রাজার ভাষা ছিল; কাজেই তার প্রতি ভক্তি একটা এসেছে। তাছাড়াও এখন ইংরাজি হচ্ছে ক্ষমতার ভাষা, আধিপত্যের ভাষা। ফলে ভাবা হয় ইংরাজি যে বলতে পারে সে আমাদের থেকে অনেক উঁচু দরের লোক! যারা বলতে পারে না তারা অশিক্ষিত, কিন্ত মোটেই সেটা নয়। একাধিক ভাষা নিশ্চয়ই শিখবে মানুষ। হয়তো যারা একবিন্দু ইংরাজি জানে না তারা হয়তো সাঁওতালি ভালো জানে, নেপালি ভালো জানে। কিন্তু তাদের সেই সম্মানটা নেই।
এখন প্রায়ই শোনা যায়, বাংলা বই নাকি আর কেউ পড়তে চায় না। আপনার কি এটা সত্যি মনে হয়?
এটা একটু অতিরঞ্জিত কথা। এখনও প্রকাশকেরা প্রচুর বাংলা বই প্রকাশ করছেন। লেখকরা লিখছেন। ছোটদের পত্রিকাগুলো চলছে। বাংলা খবরের কাগজও ভালোই চলছে। খবরের কাগজ যদি পড়ে বইটাও পড়বে তারা। তবে এটাও ঠিক যারা ইংরাজি মাধ্যমে পড়বে তাদের বাংলা বই পড়ার অভ্যেস কমে আসবে। এক যদি বাড়িতে না জোর করা হয় - বাংলাটা পড়, রবীন্দ্রনাথ-সুকুমার-সত্যজিৎ পড়। বাড়ির পরিবেশের ওপর সেটা নির্ভর করছে। সেখানেই যদি অবহেলা করা হয়, তাহলে বাংলা বই পড়ার অভ্যেস অন্তত শহরাঞ্চলে কমে আসবে।
একটা সময় ছিল, যখন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে মেয়েরা বাংলা মাধ্যম স্কুলে যেত। এখন তা প্রায় বিরল। এটার পিছনে কী কারণ থাকতে পারে?
একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে, বাংলা মিডিয়ামে ইংরাজিটা ভালো শেখানো হয় না। আর, বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলো দেখতে শুনতে নাকি ততটা ভালো না। তাদের বেঞ্চি, চেয়ার, দেওয়াল পুরনো, তাদের বাথরুম খারাপ। এখন যারা উচ্চবিত্ত হয়েছেন, তাঁরা ছেলেমেয়েদের হয়তো এয়ার কন্ডিশনড গাড়িতে স্কুলে পাঠান। তাঁরা চান স্কুলের ক্লাসগুলোও সেরকম হোক, সুট-বুট-টাই পরাটা শিখুক ভালো করে। আমরা সবাই চাই আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেক ওপরে পৌঁছোক। কিন্ত তার জন্যে বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতিকে অবহেলা করার কোনো কারণ নেই। ছেলেমেয়েরা দুটো ভাষাই শিখতে পারে। একটা ভাষার জন্য আরেকটা ভাষাকে মেরে ফেলার কোনো দরকার নেই।
এখন মা-বাবাদের দেখা যায় ছেলে বাংলাটা ঠিক জানে না বলতে গর্ববোধ করেন। এতে কি ভাষার অপমান হচ্ছে না?
কাগজপত্রে প্রায়ই বেরোয় এ-ধরণের কথা। ওই একই কারণ, যা আগে বললাম। সেইখানেই গর্বের জায়গাটা এসে দাঁড়ায়। ইংরাজি জানে কিন্তু বাংলাটা জানে না, পড়তে চায় না বা লিখতে চায় না। এটা একটা নির্বুদ্ধিতা বা আত্মসম্মানের অভাব।
একজন মানুষের পক্ষে তার মাতৃভাষা জানা কতটা প্রয়োজন?
১৯৫০ সালে ইউনেস্কোর একটা রিপোর্ট বেরিয়েছিল। তাতে বলেছিল যে, মাতৃভাষার মধ্যে দিয়েই পৃথিবীর প্রথম জ্ঞান ছেলেমেয়েদের মধ্যে আসে। যত সহজে আসে, তত সহজে আর কোনো ভাষার মধ্যে দিয়ে আসে না। এজন্য পৃথিবীর সমস্ত উন্নত দেশে তাদের নিজেদের ভাষাতেই উচ্চশিক্ষা দেওয়া হয়। তা সে জার্মানি হোক, স্পেন হোক বা জাপান। তারা যে অন্য ভাষা শেখে না তা নয়। কিন্তু নিজেদের ভাষাতেও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা তারা করেছে। আমরা পারিনি! আমরা কেউ যত্ন নিইনি যে বাংলা ভাষাটাকে শিক্ষার একেবারে উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে পারি। যাতে ইঞ্জিনিয়ারিং ডাক্তারি ইত্যাদি সবই আমরা শিখতে পারব। চেষ্টা করলে এটা করা যেত। আমাদের এখন তো শিক্ষায় আগ্রহ নেই, আমাদের আগ্রহ নম্বর পাওয়ায় - আমি ফার্স্টক্লাস পেয়েছি! শিক্ষা কতটা পাচ্ছি তার বিবেচনাই নেই।
একটা ভাষার ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়াকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এটা নিয়েও তো আলোচনা হচ্ছে গত শতাব্দীর শেষ কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে। ভাষা মরলে সারা মানব সভ্যতার ক্ষতি! একটা সংস্কৃতি তার ইতিহাস, তার জ্ঞান সমস্ত কিছু লুপ্ত হয়ে যায়। সেই জন্যে গাছপালা চলে গেলে যেমন সভ্যতার ক্ষতি, তেমনই ভাষা চলে গেলেও একটা ক্ষত তৈরি হয়।
আমরা যাঁদেরকে বুদ্ধিজীবী বলে থাকি, তাদের দেখা যায় বাংলা নিয়ে বলতে গেলে আবেগে ভেসে যান। কিন্তু বাংলাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য তাদের সেভাবে উদ্যোগ নিতে কি দেখা যায়?
আমাদের মধ্যে একটা দ্বিচারিতা আছে। আমরা নিজেরা ইংরাজি বানান শেখার জন্য যত চেষ্টা করি, বাংলা বানান শেখার জন্য তত চেষ্টা করি না। ২১শে ফেব্রুয়ারি বা ১৯শে মে-তে আমরা খানিকটা গর্ব করি, তারপর আমাদের ছেলেমেয়েদের ইংরাজি মিডিয়াম স্কুলে পাঠাই। এই দ্বিচারিতা বাঙালির আছে। এই অপবাদ থেকে আমরা আত্মরক্ষা করতে পারি না।
বাংলা ভাষা নতুন প্রজন্মের কাছে কতটা প্রাসঙ্গিক বলে আপনার মনে হয়?
ততটাই প্রাসঙ্গিক যতটা আমরা অভিভাবকেরা তাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলি। কারণ তারা তো জানে না; তারা শিখছে। তাদের ভাষায় কী বিপুল সাহিত্য আছে সঙ্গীত আছে, তাদের ভাষা কী সংস্কৃতি বহন করছে… তারা কিছু জানে না। আমাদের অভিভাবক, শিক্ষক বা যারা শিক্ষার পরিকল্পনা করেন তাদেরই তো জানানোর দায়িত্ব। কিন্তু তাতে যদি আমরাই আগ্রহী না হই, তাহলে ছেলেমেয়েদের দোষ নেই। এটা আমাদের বড়দেরই দোষ। তাদের কাছে বাংলা প্রাসঙ্গিক থাকবে না, একটা অস্পষ্ট অস্তিত্ব হয়ে যাবে।
যেমন ভাবে বাংলা ভাষা থেকে কিছু মানুষ আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে, তেমনই কি পৃথিবীর অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার ক্ষেত্রেও হচ্ছে? সারা পৃথিবী জুড়েই কি কোনো না কোনো ভাবে মাতৃভাষার সংকট দেখা দিচ্ছে?
খানিকটা তাই। এই সময় আমাদের আরো বেশি করে মাতৃভাষার উপর জোর দেওয়া উচিৎ। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিও বলে, ‘থিংক গ্লোবাল অ্যাক্ট লোকাল’। বাংলাদেশে ওষুধের বাক্সে নাম-টাম সমস্ত বাংলায়, টুথপেষ্টের নামও বাংলায়। আমরা তাদের যদি করতে বাধ্য করি, এটা তারা করবেই! কিন্তু আমাদেরই তো সেদিকে কোনো আগ্রহ নেই। বাংলাদেশের আগ্রহ আছে ফলে বাংলাদেশে কোলগেট-টা বাংলায় লেখা থাকে।
ওপার বাংলার মানুষেরাও কি বাংলা ভাষার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে?
এমনিতে ওরা বাংলাকে খুবই ব্যবহার করে এবং অনেক বাংলা শব্দ ব্যবহার করে যা আমরা পশ্চিমবঙ্গে শোনা যায় না। কিন্তু শহরাঞ্চলে উচ্চবিত্তদের বাংলা কথায় ‘সো’, ‘বাট’, ‘অ্যাকচুয়ালি’ এইসমস্ত জগাখিচুড়ি শুনতে পাই। কিন্তু আমার মনে হয় বৃহত্তর বাংলাদেশে এই ব্যাপারটা খুব বেশি বিপজ্জনক নয়।
মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য নতুন প্রজন্মের কী করা উচিত?
প্রথমেই উচিত বাংলা ভাষা নিয়ে ভাবা। বাংলা কবিতা ছড়িয়ে দিতে হবে, বাংলা কুইজও করতে পারে। বাংলা গান শোনাতে হবে। বাংলার একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই পরিবেশের মধ্যে আমাদের সন্তানদের আস্তে আস্তে বড়ো করে তুলতে হবে। আমরা হিন্দিও শিখব, ইংরাজিও শিখব। পৃথিবীতে এখন কারোর একটা ভাষা দিয়ে কাজ চলে না। সঙ্গে সঙ্গে মাতৃভাষাটাও সমান গুরুত্ব দিয়ে যেন শিখি, এটুকুই চাওয়ার।