ষষ্ঠ পর্ব : ‘রিভিউ পড়ে তো কাউকে সিনেমা দেখতে যেতে দেখি না!’

ড: সোমা এ চ্যাটার্জি, ভারতবর্ষের ফিল্ম সাংবাদিকতা জগতের এক বিশিষ্ট নাম। প্রায় পঞ্চাশ বছরের কর্মজীবনে সোমা দুবার জাতীয় পুরস্কারে অলংকৃত হয়েছেন। প্রথমটি ১৯৯১ সালে, পেয়েছিলেন ‘ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ক্রিটিক’ পুরস্কার। পরবর্তী সময়ে তাঁর ‘Parama and Other Outsiders: The Cinema of Aparna Sen’ বইটির জন্য ২০০২ সালে পেয়েছেন ‘বেস্ট রাইটিং অন সিনেমা’ পুরস্কার। এখানে এই কথাও বলে রাখা প্রয়োজন যে, সোমাই একমাত্র নারী, যিনি সিনেমা সাংবাদিকতা এবং লেখনীর জন্য দুই ধরনের জাতীয় পুরস্কারেই ভূষিত হয়েছেন। 'ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস'-এর বিষয়ে সোমার পিএইচডি এবং পরবর্তীকালে পোস্টডক্টরেট রয়েছে। এছাড়া প্রমথেশ বড়ুয়া, সুচিত্রা সেন, সত্যজিতের সিনেমায় নারী চরিত্র ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একাধিক জনপ্রিয় বইয়ের লেখিকা সোমা নিজেকে 'ফেমিনিস্ট ইন থিওরি' বলতেও ভালোবাসেন।

তাঁর বড় হয়ে ওঠায় ভারতীয় সংস্কৃতি জগতের মহীরুহদের সান্নিধ্য, ৪৭ বছরের সিনেমা সাংবাদিকতার কেরিয়ার, দেশের পরিস্থিতি, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পরিস্থিতি, এবং ব্যক্তিগত সৃজনশীল যাপন নিয়ে প্রহরের প্রতিনিধি রূপক বর্ধন রায়ের সঙ্গে খোলামেলা আড্ডা দিলেন সোমা। তাঁর নিজের কথায় এ এক 'ম্যারাথন ইন্টারভিউ'। আজ ষষ্ঠ এবং শেষ পর্ব...

রূপক : এবার ক্রাফট অফ ফিল্ম রিভিউয়িং নিয়ে একটা-দুটো কথা জানতে চাইব। একটা থট-এক্সপেরিমেন্ট করা যাক। ধরুন আমি দু-তিনটে নতুন সিনেমা দেখে উঠতে পারিনি সময়ের অভাবে। আমার হাতে অল্প সময়, আমি ঠিক করলাম যে হাতের কাছে অ্যাভেলেবল সোমাদি বা অন্য-কোনো নামকরা রিভিউয়ারের লেখা পড়ে ঠিক করব কোনটায় যাওয়া যায়। কিন্তু পড়তে গিয়ে আমি দেখছি, আরে এখানে তো গল্পের অনেকখানিই বলা হয়ে গেছে! মানে খানিকটা স্পয়লারের মতো, আমার মনের মধ্যেকার গল্প বিষয়ক যে পিপাসাটা, সেটা সিনেমাটা দেখার আগেই নষ্ট হয়ে গেল। আপনার কি মনে হয়, এটা রিভিউ ক্রাফটের একটা সমস্যা?

সোমা : (একটু বিরক্ত হন) আমার এটাকে সমস্যা বলে মনে হয় না, কারণ আমার মনে হয় না একটা রিভিউ কাউকে সিনেমা-হলে নিয়ে যেতে পারে। কতজন রিভিউ পড়ে? রিভিউ পড়ে তো কাউকে সিনেমা দেখতে যেতে দেখি না! বিখ্যাত লোকেদের রিভিউ— রিভিউয়াররা বা ইন্ডাস্ট্রির লোকজন পড়েন, কারণ তাদের ভেস্টেড ইন্টেরেস্ট থাকে। তাছাড়া এখন তো পয়সা দিয়ে তিন-চার পাতার রিভিউ হচ্ছে বলে আমি শুনেছি! (হাসি) সে কারণেই একটা সিনেমার রিভিউয়ে দুজন ক্রিটিকের মধ্যে এত্ত ফারাক! ডাজ ইট মেক এনি সেন্স? (হাসি) আমায় জোয়াকিম আলভা কোনোদিন টার্মস ডিক্টেট করেননি, আর এখন ডিরেক্টররা ফোন করে বলে দেন যে অমুক থাকলে খারাপ লিখবেন না। 

তাছাড়া, সত্যি বলতে, শুরুর দিন থেকেই আমার কখনও মনে হয়নি যে আ গুড অর আ ব্যাড রিভিউ ক্যান মেক অর ব্রেক দা বিজনেস ফিউচার অফ আ ফিল্ম।

রূপক : তাহলে ইন্ডাস্ট্রি অথবা দর্শকের উপর ফিল্ম রিভিউয়ের ইমপ্যাক্টটা কী?

সোমা : আই হ্যাভ নো আইডিয়া। আমি কোনোদিন খোঁজার চেষ্টাই করিনি। আসলে, প্রথম থেকেই, একটা সমালোচনা লেখার পিছনে যে রিসার্চটা লাগে সেটা আমায় খুব ইনট্রিগ করত। তোমায় এ ব্যাপারে আরও একটা কথা বলি। সিনেমা ইজ অ্যাবসোলিউটলি আ সাবজেক্টিভ আর্ট, অ্যান্ড সো ইজ দা আর্ট অফ রিভিউইয়িং। ক্রিয়েটিভ সাহিত্য কিন্তু সেরকম নয়।

রূপক : নতুনদের মধ্যে কাদের লেখা ভালো লাগছে?

সোমা : আজকাল প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্তর রিভিউ আমার খুব ভালো লাগে। আর একজন আছেন, তার নাম হয়ত নাও শুনে থাকতে পারো, দিল্লিতে থাকেন, ন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন, উনি ভীষণ ভালো লেখেন। দেখেছ, নামটা আমারও মনে পড়ছে না! যাই হোক, ভালো লাগে মানে যে আমি ওঁদের সমস্ত কথার সঙ্গে সহমত, তা নয়। অনেকসময়ই উলটোটাই হয়ে থাকে। 

আরও পড়ুন
পঞ্চম পর্ব : 'বম্বের হিরোরা শক্তিশালী অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করতে ভয় পায়’

একান্তে একটা কথা বলি, একটু আউট অফ দা ওয়ে গিয়েই, আমি খুশি যে এই এতগুলো বছরের পরিশ্রম আমার বৃথা যায়নি। পপুলারিটি বলো, এ্যাপ্রিসিয়েশন বলো, পুরস্কারের কথা বলো— তোমায় খোলাখুলি বলি, আই অ্যাম ভেরি প্রাইজ ওরিয়েন্টেড। পুরস্কার পেলে আমার এখনও পুশড-আপ মনে হয়। এখন যদিও আমি আর এলিজিবল নই, নতুনদেরও তো জায়গা করে দিতে হবে, সেটাই জাস্টিফায়েড। কিন্তু খিদেটা এখন যায়নি। 

আরও পড়ুন
চতুর্থ পর্ব : ‘আরেকজন সত্যজিৎ রায় আসবেন না, আমি নিশ্চিত’

এই যে একটা সিনেমা দেখে, তাকে বুঝে, অ্যানালাইজ করে তাকে নিয়ে লেখা আমি এই খিদেটার কথাও বলছি। কাজেই নিজের অতীতের দিকে তাকেলে আমার তো খুব ভালোই লাগে।

আরও পড়ুন
তৃতীয় পর্ব : ‘রাজনীতি আর টাকা দুটোই বেশি ঢুকে গেছে কলকাতায়’

রূপক : আমাদের মত সাধারণ মানুষরা অনেক সময়েই ফিল্ম রিভিউয়ার আর ফিল্ম ক্রিটিকের ফারাকটা বুঝতে পারেন না। আপনি নিজেকে কোন দলে ফেলবেন?

সোমা : না না, ওইরকম করে দলে ভাগ করা যায় না। আমি এবং অন্যরাও কখনও ফিল্ম ক্রিটিক আবার কখনও রিভিউয়ার। এডিটর আমায় কতটা স্পেস দিচ্ছেন তার উপর কাজটা নির্ভর করছে। আমি যদি ৭০০ শব্দ পাই তাহলে সেটা রিভিউই হবে। আর ফ্রি-হ্যান্ড পেলে তখন ক্রিটিক। ক্রিটিক হ্যাজ টু বি মোর অ্যানালিটিকাল, মোর লুকিং ইন্টু দা ফিল্ম। আর রিভিউয়ের ক্ষেত্রে একটু গল্প লিখতেই হবে, কারণ তখন তুমি দর্শক কী দেখতে যাচ্ছেন সেটা বোঝাতে চাইছ। ক্রিটিসিজম বা সমালচনার ক্ষেত্রে আমি সেই ডিরেক্টরের পুরনো কাজকেও ভিজিট করব। ওঁর ভাবনার বা ভাষার পটপরিবর্তনটা সেক্ষেত্রে ধরা পড়বে, যেটা অনেক সময়েই চোখে পড়ে। কাজেই আমি কতটা স্পেস পাচ্ছি তার উপর লেখার ধরনটা নির্ভর করছে। আ ক্রিটিসিজম ক্যান বিকাম আ বুক।

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় পর্ব : ‘বামপন্থী হওয়ার অর্থ নিজের মূল্যবোধের প্রতি সৎ থাকা’

রূপক : বেশ। আমার শেষ প্রশ্ন। এই প্রায় ৫০ বছর কাজ করার পর নিজের অনুজদের মধ্যে কাদেরকে নিজের ক্রিয়েটিভ সাকসেসর বলে মনে হয়?

সোমা : এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা করার জন্য তোমায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ‘সাকসেসর’ কথাটা না রয়াল পরিবার, রাজনৈতিক পরিবারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। আমার মতে ক্রিয়েটিভ ফিল্ডের ক্ষেত্রে এই কথাটা ঠিক খাটে না। তার কারণ প্রত্যেক সৃজনশীল মানুষের নিজের মত করে কিছু কন্ট্রিবিউট করার থাকে, সেটা এক্কেবারে তার নিজস্ব, ইউনিক অ্যান্ড ডিস্টিংক্ট। রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার, এম এফ হুসেইন বা চিদানন্দ দাশগুপ্ত কি কোনো ‘সাকসেসর’ রেখে গেছেন? হ্যাঁ মেন্টর থাকতে পারে।

এক্ষেত্রে আমি তোমায় আরেকটা কথা বলি। আমি নিজেই তো সম্পূর্ণ নই। আমি জানি যে সিনেমার টেকনিকালিটিজ সম্বন্ধে, মূলত এডিটিং সম্বন্ধে তেমন স্পষ্ট ধারণা আমার নেই। সত্যজিৎ রায় একবার বলেছিলেন যে, “এভরি রিভিউয়ার শুড নোএভরি থিং এ্যাবাউট ফিল্ম মেকিং।” বাট আই ডুনট এগ্রি উইথ দ্যাট। তাহলে তো আমিও সেই ফিল্মমেকারই হয়ে গেলাম। সেটা তো আমার কাজ নয়।

তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে এই ‘সাকসেসর’ কথাটা একটু রুড বলেই মনে হয় আমার। আমি কোনো ‘সাকসেসর’-এর জন্ম দিতে পারি না কারণ “আই ডুনট বিলিভ ইন ক্রিয়েটিং আ ‘ঘারানা’ অফ ফিল্ম রাইটার্স। দেয়ার জাস্ট ক্যানট বি ওয়ান! 

আরও পড়ুন
প্রথম পর্ব : ‘আমি নিজেকে এখনো ভারতীয় সিনেমার ছাত্র বলে মনে করি’

পিরিয়ড।”

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More