পঞ্চম পর্ব : 'বম্বের হিরোরা শক্তিশালী অভিনেত্রীদের সঙ্গে কাজ করতে ভয় পায়’

ড: সোমা এ চ্যাটার্জি, ভারতবর্ষের ফিল্ম সাংবাদিকতা জগতের এক বিশিষ্ট নাম। প্রায় পঞ্চাশ বছরের কর্মজীবনে সোমা দুবার জাতীয় পুরস্কারে অলংকৃত হয়েছেন। প্রথমটি ১৯৯১ সালে, পেয়েছিলেন ‘ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ক্রিটিক’ পুরস্কার। পরবর্তী সময়ে তাঁর ‘Parama and Other Outsiders: The Cinema of Aparna Sen’ বইটির জন্য ২০০২ সালে পেয়েছেন ‘বেস্ট রাইটিং অন সিনেমা’ পুরস্কার। এখানে এই কথাও বলে রাখা প্রয়োজন যে, সোমাই একমাত্র নারী, যিনি সিনেমা সাংবাদিকতা এবং লেখনীর জন্য দুই ধরনের জাতীয় পুরস্কারেই ভূষিত হয়েছেন। 'ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস'-এর বিষয়ে সোমার পিএইচডি এবং পরবর্তীকালে পোস্টডক্টরেট রয়েছে। এছাড়া প্রমথেশ বড়ুয়া, সুচিত্রা সেন, সত্যজিতের সিনেমায় নারী চরিত্র ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একাধিক জনপ্রিয় বইয়ের লেখিকা সোমা নিজেকে 'ফেমিনিস্ট ইন থিওরি' বলতেও ভালোবাসেন।

তাঁর বড় হয়ে ওঠায় ভারতীয় সংস্কৃতি জগতের মহীরুহদের সান্নিধ্য, ৪৭ বছরের সিনেমা সাংবাদিকতার কেরিয়ার, দেশের পরিস্থিতি, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পরিস্থিতি, এবং ব্যক্তিগত সৃজনশীল যাপন নিয়ে প্রহরের প্রতিনিধি রূপক বর্ধন রায়ের সঙ্গে খোলামেলা আড্ডা দিলেন সোমা। তাঁর নিজের কথায় এ এক 'ম্যারাথন ইন্টারভিউ'। আজ পঞ্চম পর্ব...

রূপক: আপনি তো প্রায় ৫০ বছরের কাছাকাছি ইন্ডাস্ট্রিটাকে দেখছেন, মানে বম্বে আর টলিগঞ্জ নিয়েই বলছি, আর্ট এবং সাহিত্য থেকে এই অ্যালিয়েনেশনটা কোন সময় থেকে শুরু হয়েছে বলে আপনার মনে হয়? মানে সেভাবে সময়টাকে দাগিয়ে দেওয়া যায় কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন বটে!

সোমা: হ্যাঁ ওইভাবে সময়টাকে আলাদা করে পয়েন্ট আউট করাটা একটু অসুবিধার। দেখো ‘দিওয়ার’, ‘শক্তি’র মত সিনেমা পর্যন্তও, কিংবা তার বেশ কিছু বছর পরেও বম্বের সিনেমায় সাহিত্যের একটা মস্ত প্রভাব ছিল। একতু ভাবলে দেখবে যাকে আমরা ভিলেন বলি মানে নেগেটিভ প্রোটাগনিস্ট, সে কেন নেগাটিভ সেটা এক্সপ্লাইন করারও একটা তাগিদ পরিচালকের মনে থাকত। মানে আমি বলতে চাইছি সিনেমা অ্যাজ আ সোশাল এজেন্সি অয়াজ নট আন্ডারলাইনড, ইট ওয়াজ দেয়ার। আমি কিন্তু বলছি না যে সেটাকে জাস্টিফাই করা হচ্ছে, আমি বলছি একজনের জীবনের স্বাভাবিক গতিতে কীভাবে সে একটা নেতিবাচক চরিত্র হয়ে উঠেছে সেটা দেখানো হচ্ছে।

ডঃ কিশোর ভালিচা খুব ভালো বলেছিলেন এই ব্যাপারটা নিয়ে। উনি ওঁর বইয়ের জন্য ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলেন। উনি বলেছিলেন, “অমিতাভ বচ্চন ইজ আ ভিক্টিম অফ হিজ এনভায়ারনমেন্ট। হি ইজ আ মেশিন। হি ইজ নট অ্যান অ্যাক্টর।” এর কারণ ইন্ডাস্ট্রি ওকে তৈরি করেছে ওইভাবে। ও তো নিজেও বলেছে যে, ‘আই অ্যাম আ ক্রিয়েশান অফ সেলিম-জাভেদ। আই অ্যাম নট অ্যান অ্যাক্টর বাই মাইসেলফ।” এবং সেটা সত্যি! পরের দিকে পরের পর ছবি ফ্লপ হওয়ায় যখন বেশ কজন হলওয়ালা সুইসাইড করেন তখন উনি নিজেকে বদলে ম্যাচিওড রোল করে শুরু করেন। তা বলে সেগুলোর সবকটা ভালো নাকি? মোটেই নয়। ওর ‘তিন’ ছবিটার আমি খুব খারাপ রিভিউ করেছিলাম। তো ছবিটার এগজিকিউটিভ প্রোডিউসার সুরেশ নায়ার আমায় একদিন ফেসবুকে মেসেজ করে বলল যে— ম্যাম আমি আপনার ছাত্র, জার্নালিজমের, আমি আপনার কথার সঙ্গে এগ্রি করি না। (হাসি) আমার প্রশ্ন হচ্ছে ওই রোলটার জন্য আপনি অমিতাভকে কেন চুজ করেছেন? যে কেউ করতে পারত রোলটা, একদম হোপলেস!


রূপক: তাহলে এই অর্ধশতাব্দীর কোন সময়টা থেকে আপনি সাহিত্য থেকে ভারতীয় সিনেমার এই এলিয়েনেশনটা দেখতে পেয়েছেন? সেটা কি ধরা যাচ্ছে?

সোমা: আমি তো তোমাকে বললামই, এটা খুব কঠিন প্রশ্ন। দেখো আমির খানও তো লিটরেচার বাদ দিয়ে প্রচুর সাকসেসফুল সিনেমা করেছে। তাই ইট ডিপেন্ডস অন হাউ ইউ ইন্টারপ্রেট দা ল্যাঙ্গুয়েজ অফ সিনেমা। কিন্তু তবুও আমিরের ব্যাপারেও আমি বলব ওই ছবিগুলোতে ও আমিরই থেকে যাচ্ছে। লাল সিং চাড্ডা আমি দেখলাম, এক্কেবারে ভালো লাগেনি আমার। বম্বের হিরোদের আরেকটা সমস্যা হল ওরা শক্তিশালী অ্যাক্ট্রেসদের সঙ্গে কাজ করতে ভয় পায়। তাতে যদিও হিরোইনদের কিছু যায় আসে না। আর তাছাড়া এখন তো ওদের রেমুনারেশান ইকুয়াল করে দিয়েছে! সেটা খুব ভালো ব্যাপার।

রূপক: আমাদের সময়ও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আমি এরপর খানিকটা আপনার ফিল্ম রিভিউয়ের ক্রাফট নিয়ে কথা বলতে চাইব। তবে তার আগে একটা অন্য প্রশ্ন করি। এইযে বিগত ১০ থেকে ১২ বছর ধরে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এত আগ্রাসন। এতে কি আলাদা করে ইন্ডাস্ট্রিকে কোনো সমস্যায় পড়তে দেখছেন?

সোমা: এদের জন্য কিনা জানি না, বিগত দশ বছরে ফিনানশিয়াল স্ট্রেস আর ইনসেকুরিটি বড্ডো বেড়ে গেছে। আমার এখন প্রায় আশি বছর বয়স, আমি এখনও রোজ একটা করে আর্টিকল লিখি, আর সেটা করতে আমার বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি সেই স্ট্রেসটা বুঝতে পারছি। আর সত্যি বলতে কী, এভরি গভর্নমেন্ট হ্যাজ ফেইলড আস। তবে হ্যাঁ, কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভালটার বারোটা গত ১০ বছরেই বেজেছে এটা আমি অন রেকর্ড বলতে পারি। আমার তো হলিউড বা ইউরোপিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সম্বন্ধে বিশেষ ইনসাইডার ধারণা নেই, তবে ইউরোপীয় ছবির থিম, কোয়ালিটি, অ্যাপ্রোচ দেখে বুঝতে পারি আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। সেটা একটা মস্ত খারাপ লাগার জায়গা।


রূপক: বাংলাদেশের সিনারিওটাও কি আপনার মতে একইরকম?

সোমা: না ওদের ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। ওরা মাঝামাঝি ভাগ হয়ে গিয়েছে। কমার্শিয়ালগুলো তুমি বসে দেখতে পারবে না, আর নন-কমার্শিয়ালগুলো দুর্দান্ত!

এখানে একটা কথা বলি। আমাদের এখানের জেলাসিটা তুমি ভাবতে পারবে না। হাওয়া এখানে রিলিজ হল— তো সিনেমাটা খুব ভালো, একটা সুরিয়েলিস্টিক বা ম্যাজিকাল এলিমেন্ট আছে ইত্যাদি— একজন ডিরেক্টর আমায় এসে বলল যে ওটা স্পেন না কোথা থেকে চুরি করা সিনেমা। আমি জানতে চাইলাম তুমি কী করে জানলে কোনটা চুরি করা? (হাসি)


রূপক: বুঝলাম। আপনাকে আমি আর শেষ দুটো কি তিনটে প্রশ্ন করব, কারণ অনেকটা সময় নিয়ে নিয়েছি।

সোমা: না না আই ডোন্ট মাইন্ড, আই হ্যাভ কেপ্ট দা হোল মর্নিং ফর ইউ!

রূপক: প্রথম প্রশ্ন, আপনার কি মনে হয় পশ্চিমবঙ্গে একটা রাজনৈতিক পালাবদল হলে ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা বা দর্শকের সিনেমার প্রতি এ্যাপ্রোচে কোনোরকম পরিবর্তন আসবে?

সোমা: ইট ডিপেন্ডস অন উইচ পার্টি কামজ টু পাওয়ার। সেন্টারে যারা আছে তারা এলে তো আর রক্ষা নেই। কনসিডারিং দা মাস ইজ নট ভেরি এডুকেটেড, সিনেমার সাহায্যে তাদের সহজেই ওদিকে নিয়ে চলে যাওয়া যায়। নন্দনের সিলেকশন প্যানেলে কারা বসবে ভাবতে পারছ? কাজেই পলিটিকালি নিউট্রাল ছবিরও কোনো জায়গা থাকবে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। আর যাই হোক সেটা কিন্তু এখনও হয়নি। আর অন্যদিকে সিপিএম কিন্তু ফেস্টিভাল শুরুর এক-দুদিন ছাড়া কোনোদিন ইন্ডাস্ট্রির কাজে নাক গলায়নি। আরো একটা খুব ভালো স্টেপ যেটা নিয়েছিল সেটা হল— দে গেভ ট্যাক্স এগজেম্পশান টু বেঙ্গলি ফিল্মজ! ভেরি গুড স্টেপ।

এখানে পলিটিক্সের থেকে বেরিয়ে একটা কথা বলি, যেটা খুব জরুরি। আমাদের বেঙ্গলে কিন্তু বেশিরভাগ একজিবিটার্সরাই নাইন পয়েন্ট প্রোজেকশান ব্যবহার করে। ইন্টারন্যাশনাল বেঞ্চমার্ক কিন্তু ফোর্টিন পয়েন্ট অর হায়ার। আমার মনে আছে সুব্রত মিত্র একবার নন্দনের সিঁড়িতে বসে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, আপনারা কেউ সিনেমা দেখতে যাবেন না, বাজে ভাবে সিনেমা দেখাচ্ছে। আমি অরিন্দমকে (শীল) একবার বলেছিলাম কী করো কী তোমরা? এভাবে দেখলে তো তোমার ছবি সম্বন্ধে লিখতেই পারব না। তখন ও বলল, সোমাদি সব জায়গায় সেই একই অবস্থা। যাইহোক এখন রাধাতে আর নন্দনে ফোর্টিন করেছে, তাতে একটু ভালো করে বসে দেখা যাচ্ছে। তা হলেও, এগজিবিটারদের সঙ্গে প্রোডিউসার বা ডিস্ট্রিবিউটারদের কোনো কোলাবোরেশান নেই! তাই লোকজন ওটিটিতে শিফট করছে। তার উপর তো ভালো ভালো হলগুলো উঠে গিয়ে মল কাম মাল্টিপ্লেক্স হয়ে যাচ্ছে। তাতে দামটাও অনেকটা বেড়ে যাচ্ছে। এইভাবে চলতে থাকলে, গভর্নমেন্টের অ্যাপ্রোচ না পাল্টালে থিয়েটার বেসড সিনেমার সার্ভাইভাল উইল বি অ্যাট স্টেক।


রূপক: বেশ এই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হল। এইবার বাংলা টিভি বা সিরিয়ালের বিষয়টা ধরে একটা জেন্ডার রিলেটেড প্রশ্ন করি।

সোমা: আগেই বলে রাখি সিনেমা অ্যান্ড টিভি আর কমপ্লিটলি ডিফারেন্ট কালচার্স। টিভি ইজ ফান্ডামেন্টালিস্ট অ্যান্ড রিয়াকশানারি! (হাসি)


রূপক: হ্যাঁ অবশ্যই। আপনার কি মনে হয় যে, এই সিরিয়ালের রমরমায়, মানে ধরুন দিনের মধ্যে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা চলতে থাকা সিরিয়ালের মাধ্যমে যে রিগ্রেসিভ জিনিসগুলো ফিড করা হচ্ছে, তাতে ইট ইজ অ্যাক্টিং অ্যাজ এ মিডিয়াম অফ ওভারঅল সোশাল রিগ্রেশান?

সোমা: হ্যাঁ তা তো খানিকটা বটেই। বিয়ে করতেই হবে, বরের পিছন পিছন ঘুরতেই হবে, এসব দেখালে এ ছাড়া আর কী হবে?

আরও পড়ুন
চতুর্থ পর্ব : ‘আরেকজন সত্যজিৎ রায় আসবেন না, আমি নিশ্চিত’

রূপক: তা এটা কি দর্শক দেখতে চাইছে বলে দেখানো হচ্ছে, নাকি দেখানো হচ্ছে বলে বাড়ির পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে দেখছে?

সোমা: বোথ! ইট ওয়ার্ক্স বোথ ওয়েজ!


রূপক: তাহলে হোয়াট ইজ দা ওয়ে আউট?

সোমা: ভেরি ডিফিকাল্ট কোশ্চেন টু আন্সার। কিন্তু আমার মনে হয় যে যারা ৪/৫ ঘণ্টা টিভি দেখছেন তাঁদের যা দেখানো হবে তাই দেখবেন। কারণ ওটাই ওঁদের প্রাইমারি সোর্স অফ এন্টারটেনমেন্ট। সেক্ষেত্রে কিছু সিরিয়াল সরিয়ে ভালো সিনেমা ঢোকালে এর একটা হিল্লে হতে পারে। কারণ সেক্ষত্রে দর্শক হয়তো একটা চয়েস পাবেন, যে আমি এটা দেখব না সিনেমাটা দেখব। তখন আরেকটা সিনেমা ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। টু কোট, “ইউ ক্রিয়েট দা কাইন্ড অফ অডিয়েন্স ইউ ওয়ান্ট!” (হাসি) এখানে কিন্তু রুলিং পার্টিও বকাঝকা করতে পারে, যে একটু ভালো জিনিসও দেখাও, সারাদিন কী এসব হাবিজাবি দেখাচ্ছ? (হাসি) ফোকাস হ্যাজ টু বি অন ক্রিয়েটিং র‍্যাদার দ্যান অন গেটিং।

আরও পড়ুন
তৃতীয় পর্ব : ‘রাজনীতি আর টাকা দুটোই বেশি ঢুকে গেছে কলকাতায়’

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় পর্ব : ‘বামপন্থী হওয়ার অর্থ নিজের মূল্যবোধের প্রতি সৎ থাকা’

More From Author See More