চতুর্থ পর্ব : ‘আরেকজন সত্যজিৎ রায় আসবেন না, আমি নিশ্চিত’

ড: সোমা এ চ্যাটার্জি, ভারতবর্ষের ফিল্ম সাংবাদিকতা জগতের এক বিশিষ্ট নাম। প্রায় পঞ্চাশ বছরের কর্মজীবনে সোমা দুবার জাতীয় পুরস্কারে অলংকৃত হয়েছেন। প্রথমটি ১৯৯১ সালে, পেয়েছিলেন ‘ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ক্রিটিক’ পুরস্কার। পরবর্তী সময়ে তাঁর ‘Parama and Other Outsiders: The Cinema of Aparna Sen’ বইটির জন্য ২০০২ সালে পেয়েছেন ‘বেস্ট রাইটিং অন সিনেমা’ পুরস্কার। এখানে এই কথাও বলে রাখা প্রয়োজন যে, সোমাই একমাত্র নারী, যিনি সিনেমা সাংবাদিকতা এবং লেখনীর জন্য দুই ধরনের জাতীয় পুরস্কারেই ভূষিত হয়েছেন। 'ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস'-এর বিষয়ে সোমার পিএইচডি এবং পরবর্তীকালে পোস্টডক্টরেট রয়েছে। এছাড়া প্রমথেশ বড়ুয়া, সুচিত্রা সেন, সত্যজিতের সিনেমায় নারী চরিত্র ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একাধিক জনপ্রিয় বইয়ের লেখিকা সোমা নিজেকে 'ফেমিনিস্ট ইন থিওরি' বলতেও ভালোবাসেন।

তাঁর বড় হয়ে ওঠায় ভারতীয় সংস্কৃতি জগতের মহীরুহদের সান্নিধ্য, ৪৭ বছরের সিনেমা সাংবাদিকতার কেরিয়ার, দেশের পরিস্থিতি, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পরিস্থিতি, এবং ব্যক্তিগত সৃজনশীল যাপন নিয়ে প্রহরের প্রতিনিধি রূপক বর্ধন রায়ের সঙ্গে খোলামেলা আড্ডা দিলেন সোমা। তাঁর নিজের কথায় এ এক 'ম্যারাথন ইন্টারভিউ'। আজ চতুর্থ পর্ব...


সোমা : …এই তো কদিন আগে ‘প্রেসিডেন্সি এ্যালুমনাই এসোসিয়েশন’ সত্যজিৎ রায়ের উপর একটা আলোচনা সভা করেছিল। যারা ছিলেন তাদের প্রায় সকলেই প্রেসিডেন্সির এক্স-স্টুডেন্টস। একসেপ্ট মি। গৌতম ঘোষ ছিলেন। অপর্ণা (সেন) ছিল, সৌরভ সারেঙ্গী নামের একজন খুব পাওয়ারফুল ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার ছিলেন— তিন বছরে একটা ছবি বানান কিন্তু যেটা বানান সেটা দেখবার মতো।


রূপক : কান ফিল্ম ফেস্টে নেওয়া ইন্টারভিউতে শৌনক সেন-ও একই কথা বলছিলেন।

সোমা : ওঁর ছবিটা আমার দেখা হয়নি। (একটু অন্যমনস্ক হয়ে যান, খানিকটা মনমরাও) তোমার কাছে লিংক থাকলে পাঠিও তো।


রূপক : আচ্ছা।

সোমা : তো যাই হোক। এই তিনজন আর আমি ছিলাম, আর একজন মডারেটর।

তো আমি একটু ঝগড়া করলাম। প্রায় প্রত্যেকেই ডিপ্লোম্যাটিক ছিলেন, বললেন যে বাংলায় খুব ভালো ভালো ছবি হচ্ছে। সৃজিত, কৌশিক গাঙ্গুলি খুব ভালো কাজ করছেন। আমি পাবলিকলি বললাম যে হ্যাঁ, তবে কনসিস্টেন্সি খুব ল্যাকিং! পাবলিক খুব এ্যাপ্রিশিয়েট করল। আমি সত্যজিত রায় সম্বন্ধে কী বলেছি না-ধরে ওই কথাটাই ধরে নিয়ে খুব প্রশংসা করল। জানতে চাইল, আমি সাহস করে বললাম কীভাবে কথাটা। আমি বললাম, ‘আমি তো ফিল্ম মেকার নই!’ সৃজিত আমার ক্রিটিসিজম খুব স্পোর্টিংলি নেয়। সবসময়। ওঁর ‘এক্স ইজ ইকুয়াল টু প্রেম’ ছবিটা আমার খুব ভালো লেগেছে। ও আইডিয়াগুলো অন্যান্য জায়গা থেকে নিয়ে একদম নতুন কিছু একটা তৈরি করতে পেরেছে। তাছাড়া ব্ল্যাক এ্যান্ড ওয়াই আর এ্যাক্টর্স আর অল নিউ। আমি এই ব্যাপারটার ফেভারে চিরকাল ছিলাম, থাকব। দে ক্যান গিভ আ নিউ ফ্লেভার এ্যান্ড নিউ টেক্সচার টু দা ফিল্ম। অতনুর সিনেমা আমার খুব ভালো লাগে। ও ঠিক ‘ঢপিফাই’ করার ছেলে নয়, অ্যাজ ফার অ্যাজ আই নো হিম।

আমি বম্বের কথা জানি না তবে এখানকার ডিরেক্টররা ভীষণ অ্যারোগ্যান্ট। বম্বের ক্ষেত্রে ইটস প্রাইমারিলি মানি। টালিগঞ্জে মোটেই টাকা নেই। তুমি ভাবো, আমি শুনেছি বম্বেতে নাকি সাতজনের প্লেন আছে! (হাসি) যদিও তারা নাকি কেউই সেগুলো ব্যবহার করে না।


রূপক : তাই যদি হবে তাহলে বম্বের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম মেকিং-এর অবস্থা এমন কেন?

সোমা : হ্যাঁ, (ভাবলেন কিছুক্ষণ) সেটা তুমি ঠিকই বলেছ। দে আরে স্টাক অন ফান্ডজ। এই তো কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখা হল অনেকের সঙ্গে। ওরা ওই বন্ধু-বান্ধবদের কাছে হ্যাট পাস করে কিছু-কিছু করে জোগাড় করে, খানিকটা বানায়, সেটা আমার বন্ধ হয়ে যায়। আবার খানিকটা বানানোর পর যেই-কে-সেই, বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ ছবিগুলোই বেশ ভালো হয়।

আনাদার থিং দ্যাট হ্যাজ আফেকটেড দা গ্লোবাল ইন্ডাট্রি ইজ ডিজিটাইজেশন! মোবাইল ফোন হাতে এভরি বডি ইজ আ ফিল্ম মেকার! কারোরই টেকনিক, সিস্টেম নিয়ে জানবার কোনো আগ্রহ নেই। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! (হাসি) তার উপর অ্যাসিট্যান্ট ডিরেক্টরের কাজ বা ইন জেনেরাল অ্যাসিস্ট করার কাজ তো এখন ফোকোটিয়া! তাই কারো অ্যাসিস্ট করার কোনো ইচ্ছাও নেই (হাসি)


রূপক : কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভালের অবস্থা কেমন দেখলেন এবার?

সোমা : কমপ্লিটলি পলিটিসাইজড! কারণ পলিটিক্সকে তেল মারা মানে তো টাকাকে তেল মারা তাই না? ইফ ইউ আর ইন পাওয়ার টুডে, সো আই এ্যাম আফটার ইউ। টুমোরো সাম ওয়ান এলসে উইল বি ইন পাওয়ার, তখন আমি তার পিছনে যাব। এই তো! দশ বছর আগে আমি শুধুমাত্র সংস্কৃতি মন্ত্রীকে ফিল্ম ফেস্টিভালে দেখা যেত। আর এখন সব মন্ত্রীরাই ওখানে। কনফারেন্স রুমটা ওঁদের দিয়ে আমরা মানে সাংবাদিকরা আর থ্রোন আউট! আমাদের একটা ভি আই পি লাউঞ্জ দেওয়া হয় ঠিকই তবে সেটা করা হয়েছেই যাতে ভি আই পি-দের কনফারেন্স রুমটা দেওয়া যায়! এইটাই আমার এবারের শিক্ষা। বম্বেতে এতটা করতে পারে না কারণ ওখানে মিনিস্টারদের থেকে ইন্ডাস্ট্রির লোকেদের টাকা বেশি। এখানে তা নয়! এখানে রাজনীতিবিদরা চুরির টাকায় দশজন তারকাকে কিনে নিতে পারে।


রূপক : তা সেটা কি ইন্ডাস্ট্রির মানুষ এখনও বুঝতে পারছে না যে এতে ফেস্টিভালের কোয়ালিটি আর নাম দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?

সোমা : ওতে ওদের কিছু যায় আসে না। দে আর বদার্ড ওনলি অ্যাবাউট দেয়ার ওন পকেটস! টালিগঞ্জের এলাকার একজন বিরাট মন্ত্রী কনফারেন্স রুমে ঢুকছেন দেখে সবাইকে নাকি দাঁড়াতে হবে। আমি বলেছি আমি কেন দাঁড়াব, আমি কি ওঁর চাকরি করি নাকি? বরং ওঁরই দাঁড়ানো উচিত কারণ আমি বয়সে অনেক বড়ো! (হাসি) তাই কেউ দাঁড়াবে কেউ দাঁড়াবে না ভেবে, আমাদের ঢোকাই বন্ধ করে দিয়েছে। (হাসি)


রূপক : ওয়্যার ডু ইউ সি দা ইন্ডাস্ট্রি গোইং ইন দা নেক্সট টোয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স?

সোমা : এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। ভেরি ডিফিকাল্ট আই মাস্ট সে!

আরেকজন সত্যজিৎ রায় যে আসবেন না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আরেকজন ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিংহও আসবেন না। এর কারণ সিনেমার প্রতি, মানে সিনেমা অ্যাজ অ্যান আর্ট ফর্ম অ্যান্ড অ্যাজ এ সোশাল এজেন্সির প্রতি ডেডিকেটেড আর দায়বদ্ধ ছিলেন। এটাই মূল ব্যাপার। আজ আর তুমি সেটা পাবে না। এখন সিনেমা শুধুই ভাত রুটির প্রশ্ন! আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে। মানে ডিরেক্টরদের বাদ দিলে, আমার তো মনে হয় না বেশিরভাগ তারকাদের জাতীয় পুরস্কারের প্রতিও কোনো আগ্রহ আছে! আর তাছাড়া ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডের ভ্যালুও এখন প্রায় নেই বললেই চলে কারণ সেটা সেন্টারের রুলিং পার্টি নিজেদের মতো করে চালায়। আমি নিজেও তো পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছি। আগে অ্যাপ্লিকেশনটা ফ্রি ছিল। এখন ১০০০০ টাকা দিতে হবে, ৫টা বই দিতে হবে, হাজারো ব্যাপার! এসব করেও আমি আর প্রাইজ পাব না আমি জানি। তাই অনেকদিন বন্ধ করে দিয়েছি! (হাসি) তাছাড়া আমি আগে দুবার পেয়েছি, তাই তৃতীয়বার একই লোককে না দেওয়াটা ফেয়ারও বটে।


রূপক : তাহলে আপনি বলতে চাইছেন যে সিনেমা অ্যাজ অ্যান আর্ট ফর্মের সোশাল পার্সস্পেকটিভটা বম্বে এবং কলকাতায় প্রায় নেই বললেই চলে?

সোমা : হ্যাঁ। আরে আমার নাসিরুদ্দিন শাহকেই আর ভালো লাগে না। কারণ উনি সবসময়েই নাসিরুদ্দিন শাহ! অমিতাভেরও তেমনই অবস্থা। আমি ‘প্লিজ স্টপ অ্যাক্টিং’ বলে একটা আর্টিকল লিখেওছি এই ব্যাপারে, (হাসি) নামটা হয়তো ভুল হতে পারে।


রূপক : তাহলে কি এই ‘পার্সোনা’ ক্রাইসিসটাই মেইনস্ট্রিম আর প্যারালাল এই আন-ন্যাচেরাল ভাগটার জন্য কিছুটা হলেও দায়ী? মানে আর্ট ইজ আর্ট, তার আবার কমার্শিয়াল, প্যারালাল কী!

সোমা : ওটা এখন আর এগজিস্ট করে না। কারণ যারা ‘আর্টফিল্ম’ করছে বলে দাবি করছে, তারা সেই পথটা নিয়েছে ফিল্ম ফেস্টিভালের ব্যান্ড-ওয়াগনে চড়বে বলে। কিন্তু তারা এইটা জানে না যে ফেস্টিভালগুলোও ফেক! (হাসি) একজন ধরো একটা ছবি বানিয়ে আমায় পাঠিয়ে বলল রিভিউ করতে। তার সঙ্গে এটাও জানাল যে অমুক ফেস্টিভালে গেছে। আরে, কীসের ফেস্টিভাল? টাকা নিয়ে ছবি দেখায়! ফেস্টিভাল করলেই হল? আজ এখানে ফেস্টিভাল, কাল ওখানে ফেস্টিভাল, পরশু অন্য কোথাও! (বেশ উত্তেজিত হন) মোস্ট অফ দেম আর ফেক, আমি তো বলছিই!


রূপক : আমাদের দেশের কোন ফেস্টিভালগুলোকে আপনি কাউন্ট করবেন?

সোমা : গোয়া কাউন্টস…


রূপক : কেরালা…

সোমা : কেরালা ইজ এক্সট্রিমলি গুড! কলকাতা ইউজড টু কাউন্ট। এখনকার অবস্থা তোমাকে বললামই। আরও একটা দুটো আছে ঠিকই।

আরে এরা দু-একবার বিদেশ-টিদেশ যাচ্ছে, নিজের টাকাতেই যাচ্ছে কিন্তু সেটা রিয়েলাইজ করছে না। গিয়ে ভাবছে বিরাট কিছু একটা করে ফেললাম!


রূপক : আপনার কথাটা আমি সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারছি। আগের বছর কান-এ বেশ কিছু বাঙালি পরিচালকের সঙ্গে আলাপ হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বেশিরভাগই নিজের টাকা খরচা করে নিজের সিনেমা ফিল্ম বাজারে দেখাতে এনেছিলেন, ওই মার্শে দু ফিল্মের ১৫ জনের মত বসার ছোট্ট তাঁবুর হলগুলোয়। সেসব নিয়েও তো কলকাতায় সে সময়ে ‘বেঙ্গলি সিনেমা ইন কান’ বলে বিরাট বিরাট ব্যানার পড়েছিল। হাস্যকর!

সোমা : হ্যাঁ আমাদেরকেও তো ওরকম করেই দেখায়, যে এটা কান-এ যাচ্ছে? আমি জানতে চাই কান-এ কোথায় যাচ্ছে? বলে ফিল্ম মারকেট-এ। আমি চাইলে ওখানে তো আমার ছবিও দেখিয়ে দেবে। আমি আমার মোবাইলে পাঁচ মিনিটে একটা ছবি তুলে নিয়ে যাব, পয়সা দেব, দেখিয়ে দেবে কী আছে?


রূপক : এগজ্যাক্টলি! আচ্ছা আপনার মতে চারপাশের সিচুয়েশন এমনই দমবন্ধ করা হয়ে থাকে, তাহলে মানুষ সিনেমা দেখতে যাচ্ছে কেন?

সোমা : এন্টারটেনমেন্ট! একটা রিলিফ তো চাই।


রূপক : তাহলে কি আপনি বলতে চাইছেন যে, ইন ইন্ডিয়া সিনেমা ইস জাস্ট ফর এন্টারটেনমেন্ট এ্যান্ড নট এ আর্টফর্ম এনিমোর?

সোমা : ইয়েস, আমার তো তাই মনে হয়। মানে হয়ত ডিরেকশান, সিনেমাটোগ্রাফিতে আর্ট রয়েছে, কিন্তু এডিটিং-এর সময় প্রোডাকশান হাউজ থেকে বলে দক্ষিণী হিট ছবির ফরমুলায় ফেলা হয় বাজারে কাটবে বলে। তাতে বেশিরভাগ সময়েই ভালো কাজগুলো বাদ চলে যায়। আমি এটাও শুনেছি আমাদের টালিগঞ্জের একটা প্রোডাকশান হাউজ একটা সময়ে নাকি ডিরেক্টরদের দক্ষিণের একটা ছবি দেখতে বলত, তারপর শট টু শট তুলে দিত ছবিতে। সেগুলো কিন্তু সুপার ডুপার হিট হয়েছে বাংলায়! আমি একবার সেটা ধরিয়ে দেওয়ায় একজন আমায় ফোন করে বলেছিল, ‘সোমাদি আমরা কিন্তু লিগালি কপি করেছি।’ এখন বোধহয় সেটা আর করছে না। তাছাড়া পলিটিসাইজিং-এর সমস্যাটা তো রয়েইছে। কোথাও দেখেছ ফিল্ম ফেস্টিভালের চতুর্দিকে চিফ মিনিস্টারের ছবি থাকে? (হাসি)

Powered by Froala Editor

More From Author See More