Cannes-এর দরজা ঠেলে: মুখোমুখি লাল গালিচার চিত্রকর

প্রথম দিন থেকেই ভদ্রলোককে খেয়াল করেছি। প্রায় সারাটা দিনই সাংবাদিকদের জন্য বরাদ্দ ক্যাফেতে বসে ফটোশপে নানান তারকার ঝকমারি ছবি এডিট করেন, আর, সময় হলে দু-হাতে দুটো বিরাট বিরাট ক্যামেরা আর পিঠে ইয়া বিরাট একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে ছোটেন লুমিয়ে প্রেক্ষাগৃহের প্রবেশদ্বারের বিশ্বখ্যাত লাল গালিচার দিকে। কালো কুচকুচে টাক্সেডো আর পাট করে কাটা সাদা দাড়িই ওঁর এই হপ্তাদুয়েকের রোজকার ড্রেসকোড। নাহলে ও-অঞ্চলে ফটোগ্রাফাররা ঢুকতে পাবেন না।

৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপ্তি ঘনিয়ে এল প্রায়। তাই সাহস করে আলাপটা জমিয়ে ফেললাম। 

'আপনার সঙ্গে মিনিট দশেক কথা বলা যেতে পারে?' 

প্রথমে ইতস্তত করলেও আমার নাম আর প্রেসকার্ড দেখে এক গাল হাসি নিয়ে বললেন, 'বলুন না, কী ব্যাপার?'

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ইউক্রেনের পরিচালক মাক্সিম নাকোনেশনি-র সাক্ষাৎকার

'আসলে আপনাকে আমি খেয়াল করছি প্রথম দিন থেকেই। আপনি তো এই ফেস্টিভালে রেড কার্পেট ফটোগ্রাফি করছেন, তাই না? টম ক্রুজের যে ছবিটা ভাইরাল হয়েছে, সে-ছবিটায় আমার পাশে বসেই আপনাকে কাজ করতে দেখেছি আমি।' মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন ভদ্রলোক। আমরা এক কাপ করে এক্সপ্রেসো নিয়ে ক্যাফের ম্যাজেনাইনের সোফায় এসে বসলাম। পৃথিবী ওলটপালট করে দেওয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তোলা তারকাদের ছবির জলজ্যান্ত কারিগরকে হাতের কাছে পেয়েই গেছি যখন, তখন ইনসাইডার ইন্টারভিউ নেওয়ার এই সুযোগ কিছুতেই ছাড়া চলে না। 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ভারতের একমাত্র অফিশিয়াল মনোনয়নপ্রাপ্ত পরিচালকের সাক্ষাৎকার

ফরাসি-সিরিয়ান চিত্রকর আমার আবদ রাব্বো (Ammar Abd Rabbo) জানালেন, এই উৎসবে তিনি লেবাননের এক বিশিষ্ট সিনেমা পত্রিকার জন্য কানের (Cannes Film Festival) রেড কার্পেট কভার করছেন। আমিও আমার প্রশ্নপর্ব শুরু করলাম।

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীরা, আর্তি সিনেমা দেখার

আমি : ফটোগ্রাফিই কি আপনার পেশা?

আমার : হ্যাঁ অবশ্যই। আমি মূলত প্রেস ফটোগ্রাফি করি। 

আমি : এন্টারটেইনমেন্ট?

আমার : না না, শুধু এন্টারটেইনমেন্ট নয়। সিরিয়াস নিউজ, রাজনীতি, সবরকমই। হালেই আমি প্যারিসে ফরাসি রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা কভার করেছি। এছাড়া সিরিয়া, ইরাক এমনকি ২০১১ সালে লিবিয়াতেও কাজ করেছি। ২০১৩ সালের একটা সপ্তাহের কথা আমি কখনও ভুলব না। সেই সপ্তাহে সোমবার আমি আলেপ্পোয় (সিরিয়া) শ্যুট করি। এরপরের দিন, মানে মঙ্গলবার তুরস্কের গাজিয়ানতেপ-এ কাজ করে ইস্তানবুল-প্যারিস হয়ে বুধবার সকাল সকাল ব্যাজ নিয়ে স্যুটেড বুটেড হয়ে রেড কার্পেটের ময়দানে নেমে পড়ি! (হাসি)

আমি : দুর্দান্ত! কত বছর হল এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন? 

আমার : ৩১ বছর! আমি প্রথমবার কান-এ এসেছিলাম ২০ বছর আগে, ২০০২ সালে। তখন পার্টি, ছোটো ছোটো প্রেস কনফারেন্স এইসব কভার করতাম। এরপর ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতার সঙ্গে সরাসরি রেড কার্পেটে কাজ করার ছাড়পত্র পাই। ১৫ বছর ধরে টানা এই কাজটা করে আসছি।

আমি : কাজটা এগজস্টিং নয়?

আমার : অবশ্যই প্রচণ্ড টায়ারিং! তবে মজাও আছে। আর তার থেকেও জরুরি হল, যুদ্ধ বা রায়টের মতো প্রাণহানির ভয় নেই। এখানে তারকাদের জামাকাপড় ঠিকঠাক থাকছে কিনা, সেটাই সবথেকে বড় সমস্যা হতে পারে(হাসি)। সব মিলিয়ে বেশ এঞ্জয়েবল কাজ। আর তার সঙ্গে উৎসব কমিটি তার ফটোগ্রাফারদের অনেক সুবিধা এবং স্বাধীনতা দেয়, সে-কথা বলতেই হবে।

আমি : আপনি তো বললেন, পনেরো বছর ধরে কান-এ রেড কার্পেট ফটোগ্রাফি করছেন। আপনার মতে গত দেড় দশকে ফেস্টিভালের চরিত্রে এবং আপনার কাজের ধরন ও পদ্ধতিতে কতটা পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয়?

আমার : আমার মতে মোবাইল-টেলিফোন-ক্যামেরাই মূল পরিবর্তনের কারণ। আমি যখন শুরু করেছিলাম, তখন এই সমস্যাটা ছিল না। মোবাইল ক্যামেরাজ হ্যাভ চেঞ্জড দা রিলেশনশিপ বিটুইন হিউম্যান অ্যান্ড ফটোগ্রাফস।

সে কথা খেয়াল রেখে কমিটিও নিজের কাজের পদ্ধতি পাল্টেছে। রেড কার্পেট অঞ্চলে সেলফি নেওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এটা খুবই আশার কথা। কাজেই তারকাদের ছবির জন্য মানুষকে আমাদের কাছ থেকেই ছবি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তাতে আমাদের কাজের মূল্য থাকছে।

আরও একটা জরুরি ব্যাপার হল, সোশাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তে তারকাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক পুরোপুরি বদলে গেছে বলা যায়। আমি যখন কাজ শুরু করি, মানে ওই ২০০২ সালে, তখনও রাস্তাঘাটে, রেস্তোরাঁয় পরিচালক, অভিনেতা অভিনেত্রীদের দেখা যেত। আপনি গিয়ে 'হ্যালো' বললে ওঁরাও ভদ্রভাবে আপনার সঙ্গে কথা বলতেন। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। চটজলদি সেলফি আর ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় চলে গেলে ওঁদের ব্যক্তিগত জীবন বিপন্ন হতে পারে। সে কারণেই প্রেস অ্যাটাচি, প্রেস এ্যাডভাইজারদের গুরুত্বও অনেকটা বেড়েছে বিগত কয়েক বছরে। তারকারা কোথায় যেতে পারেন, কোথায় গেলেই-বা নিরাপদ থাকতে পারেন, তা ওঁরাই ঠিক করে দেন। 

আমি তো তাও অনেকটা পরে এই কাজে এসেছি। আমার সিনিয়র, যারা ৭০-৮০র দশক থেকে কাজ করছেন, তাঁদের একজনের কাছে শুনেছি যে, একবার এমনই ঘুরতে ঘুরতে এক রেস্তোরাঁয় রবার্ট ডি নিরোর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এরপর একসঙ্গে বসে লাঞ্চ এমনকি ঝগড়া করারও সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। 

আমি : সিনিয়রের মতো আপনার জীবনে এমন কোনো ঘটনা নেই? 

আমার : (হাসি) আমাদের তো ওঁদের হোটলেও অ্যাক্সেস থাকে, তাই এমন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েই যায়। মনে পড়ে, একবার জুলি গেইয়ে (Julie Gayet)-র সঙ্গে হোটেলের লবিতে জমিয়ে আড্ডা হয়েছিল। এরকমই আরো নানা ফরাসি তারকাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। আমেরিকানদের সঙ্গে তেমন একটা নেই।

আমি : আচ্ছা, এই পোস্ট-কোভিড সময়ে দাঁড়িয়ে আপনার কাজের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা কী?

আমার : যেটা আগেই বললাম, অনেকেই ফোন ক্যামেরা বা ভালো ক্যামেরা কিনে দূর থেকে ছবি তুলে সস্তা পাবলিসিটির জন্য নানা ম্যাগাজিন বা খবরের কাগজকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আর ব্যাজ থাকলে তো কথাই নেই। সমস্যা হল, প্রেস কনফারেন্সে মানা থাকা সত্ত্বেও এই ঘটনা ঘটছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে বেশিরভাগ কাগজ বা ম্যাগাজিনেরই বিশেষ একটা বাজেট নেই। বাজার মন্দা। কাজেই ১ ইউরোর জলের বোতোল ফ্রি-তে পাওয়া গেলে লোকে সেটাই নেবে, যেখানে বাজেটের এত অভাব। আমরা যাব কোথায়? আমার মনে হয় এটাই মূল সমস্যা। 

ইট ইজ আ চ্যালেঞ্জ নাউ আ ডেজ টু হ্যাভ পিপল কন্সিডারিং মাই জব অ্যাজ আ জব, অ্যান্ড দ্যাট উই নিড টু বি পেইড!

দ্বিতীয়ত, ভালো ছবি পাওয়াটাও একটা যুদ্ধ। কারণ আমরা সকলেই মোটামুটি একই জায়গা থেকে একই ছবি তুলছি। সেক্ষেত্রে আমার ছবি অন্য চিত্রকরের থেকে আলাদা করতে হবে। তবেই তো সম্পাদকেরা কিনতে চাইবেন, তাই না? (ব্যাজ দেখিয়ে) এই যে রেড কার্পেটের পাশে গোল গোল করে এই ধরনের নম্বর দেওয়া থাকে। আমার পোজিশন নম্বর ৪২।

আমি : সেক্ষেত্রে আপনারা এই সমস্যার মোকাবিলা করেন কীভাবে? 

আমার : এইসব ক্ষেত্রে পি-আর স্কিল আর কন্ট্যাক্ট খুব কাজে দেয়। যেমন ধরুন, আপনার ব্যবহার দিয়ে আপনি যদি তারকাদের অ্যাটাচিদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক রাখেন, সেক্ষেত্রে ওঁরা আপনাকে গোপন কিছু খবর এনে দিতে পারেন। যেমন অমুক তারকা মিনিট দশেকের জন্য তমুক বিচে যাচ্ছেন। তখন আমাদের তড়িঘড়ি ছুটতে হয়। এক্সক্লুসিভ কিছু পাওয়া গেলে আপনি অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে গেলেন!

আবার অন্যদিকে আমি যেহেতু মিডল ইস্টের, আরব তারকা, পরিচালক, অভিনেতা অভিনেত্রী মহলে আমার ভালো পরিচিতি আছে। তাই সেই সুযোগটা আমি পাই। আমার মতোই যদি অন্য কেউ দক্ষিণ আমেরিকা, বা আফ্রিকা এমনকি হলিউড থেকে আসেন, তিনিও কিছু সুযোগ পাবেন বৈকি।

কান-এর ক্ষেত্রে একটা কথা বলি। কান ইজ ভেরি মাচ রিলেটেড টু ফটোজ! রেড কার্পেটে গেলে দেখবেন ইতালিয়ান, ব্রিটিশ, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান সমস্ত দেশের ফোটগ্রাফাররা ছুটোছুটি করছেন, ঝগড়া করছেন, চেঁচামেচি করছেন। সে এক কর্মকাণ্ড। অস্কারও গুরুত্বপূর্ণ, তবে সে তো মাত্র এক রাতের ব্যাপার, কান তো ১২ দিনের উৎসব। কোনোদিন যদি ফেস্টিভাল কমিটি ফটোগ্রাফি ব্যান করে দেয়, কান আর কান থাকবে না।

ইফ দেয়ার আর নো ফটোজ, দেয়ার ইজ নো কান!

Powered by Froala Editor

More From Author See More