বড়োপর্দার মতো ওটিটি-তেও স্বাধীন পরিচালকদের লড়েই জায়গা করে নিতে হবে: রঞ্জন ঘোষ

আত্মপ্রকাশেই অপর্ণা সেনের সঙ্গে যুগলবন্দি। ‘ইতি মৃণালিনী’ ছবির চিত্রনাট্যকার এবং সহকারী পরিচালক। তারপর একে একে হৃদ মাঝারে’, ‘রং বেরঙের কড়ি’, ‘আহা রে... বাংলা চলচ্চিত্রে নিজস্ব ভাষাকে পোক্তভাবে গেঁথে দিতে পেরেছেন রঞ্জন ঘোষ, টলিউডের তরুণ মুখদের অন্যতম। কিছুদিন আগেই তাঁর শেষ সিনেমা আহা রে’ এশিয়ার সেরা পঁচিশটি ফুড মুভির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল। সম্প্রতি ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটিস অফ ইন্ডিয়াকেরালামের অনলাইন ফিল্ম ফেস্টিভাল এবং নিউ ইয়র্ক ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভাল থেকেও আমন্ত্রণ পেয়েছে এই সিনেমা দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি মিললেও ‘বাণিজ্য-সফল’ পরিচালকের তকমা এখনো জোটেনি। এই রাজ্যের দর্শক-সমালোচকদের নিয়ে কি অভিমান জন্মেছে কোথাও? করোনা আবহে নতুন বাংলা ছবির ভবিষ্যতই বা কেমন? অনিতেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথোপকথনে অকপট পরিচালক-চিত্রনাট্যকার রঞ্জন ঘোষ। 

আহা রে’ তো ফের কেরালাম ফিল্ম ফেস্টিভালে দেখানো হচ্ছে। কয়েকদিন আগেই এশিয়ার সেরা পঁচিশটি ফুড মুভির তালিকায় জায়গা করে নেওয়াতারপর এমন ফিল্ম ফেস্টিভাল থেকে আমন্ত্রণ— ‘আহা রে’-র এই সাফল্যে খুশি তো নিশ্চয়ই?    

ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটিস অফ ইন্ডিয়ার কেরালা শাখাটি এমনিতেই খুব স্পেশ্যাল। সেখানকার ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন বেশ মজবুত। এখন কোভিড পরিস্থিতির জন্য অনলাইনে এই ফিল্ম ফেস্টিভালটা আয়োজিত হচ্ছে। বেশ কিছু ভালো ভালো মালয়ালম আর তামিল ছবি দেখানো হচ্ছে এখানে। তার মধ্যে একমাত্র বাংলা ছবি হিসেবে ‘আহা রে’-র জায়গা করে নেওয়াটা সত্যিই খুব বড়ো প্রাপ্তি। ভালো তো লাগছেই।  

 

আরও পড়ুন
‘কে কী বলল ভাবা অনর্থক, লেখা খারাপ হলে ১০ লাখ টাকা উঠতই না’ – অভীক দত্তের সাক্ষাৎকার

‘আহা রে’ দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্র সমালোচক-দর্শকদের থেকে প্রশংসা পাচ্ছে। অথচ এই রাজ্যে ছবিটি নিয়ে বিশেষ সাড়া পড়েনি। এর কারণ কী বলে মনে হয় আপনার? 

আরও পড়ুন
‘শর্মিলার সঙ্গে ইয়ার্কির পরিকল্পনা ভেস্তে দিলেন মানিকদা’ – আলাপচারিতায় বরুণ চন্দ

আমি খুব অবাক হয়েছিলাম যখন ‘আহা রে’ মুক্তি পেয়েছিল। এখন এত সমাদৃত হচ্ছে যে সিনেমাটা, তখন মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল। আমার যে ছবিটা খুব সহজ লেগেছে, সেই ছবিটা কেন অনেকে ধরতে পারলেন না সেইটা আমাকে ভাবিয়েছিল। যারা চলচ্চিত্র বোঝেন, চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন, আমি তাঁদের কথাই মূলত বলছি। যখন কলকাতার বাইরে বেরোল, তখন দেখলাম ছবিটা সমাদর পেতে শুরু করল। তখন ছবিটার বক্তব্যের সঙ্গে দর্শক নিজেকে এক করে নিতে পারলেন। ‘আহা রে’-র ভিতরে তো একটা মানবতাবাদের কথা বলা হয়েছে। জাতি, ধর্ম, বয়স অতিক্রম করে একটা গন্তব্যের কথা, মিলের কথা। এই সহজ, সরল বার্তাটা কেন জানি না পশ্চিমবঙ্গের দর্শক বা সমালোচকেরা বুঝতে পারলেন না। কিন্তু দেশের অন্যান্য জায়গার বা আন্তর্জাতিক দর্শকরা কিন্তু বুঝতে পারলেন সহজেই। 

আরও পড়ুন
বহুদিন পাশে থাকার মধ্যে যে স্বস্তি, তাই দিতেন ইরফান: নুসরাত ইমরোজ তিশা

আরও পড়ুন
“বরুণবাবুর মতো ঋজু না হলেও, আমার অনেকটাই ‘বরুণবাবু’-তে আছে”: অকপট অনীক দত্ত

শুধু ‘আহা রে’-ই নয়, আপনার অন্যান্য ছবিগুলোও কিন্তু বাংলা দর্শকদের কাছে কাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি পায়নি। সেটা হৃদ মাঝারেই হোক কিংবা ‘রং বেরঙের কড়ি’ অথচ আপনার গল্প বলার স্টাইল জটিল নয়। ছবিতে বাঙালিয়ানাও যথেষ্ট। ‘হৃদ মাঝারে’ ছবিতে আবির-রাইমা, ‘রং বেরঙের কড়ি’-তেও জমাটি স্টারকাস্ট। সোহম, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, ঋত্বিক চক্রবর্তীর মতো নাম! ছবিতে অরুণিমার দাপুটে অভিনয়! তারপরেও বাঙালি দর্শকদের থেকেও আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছেই আপনার ছবি সমাদর পেয়েছে বেশি। এটা কেন?       

‘হৃদমাঝারে’ যখন মুক্তি পেয়েছিল, তখন কিছু লোক জানত যে এই নামে একটি ছবি মুক্তি পাচ্ছে কিন্তু অনেকেই জানত না। ‘রং বেরঙের কড়ি’র ক্ষেত্রে আরও বেশি সত্যি। এমনকি, আমি যে ‘‘রং বেরঙের কড়ি’ নামে কোনো সিনেমা বানিয়েছি, সেটা এখনও অনেকে জানে না। কেন জানে না, সত্যি বলতে তার কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। প্রথম সপ্তাহে না চললে তো এখন অনেক হল সিনেমা নামিয়ে দেয়। এখানে দর্শকরা জানতে জানতেই হয়ত দ্বিতীয় সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। ততদিনে ছবিও উঠে গেছে হল থেকে। আমি তো যতটা সহজভাবে পেরেছি গল্প বলার চেষ্টা করেছি। সমস্ত পরিচালকই নিজেদের মতো করে সেটাই বলার চেষ্টা করেন। মুশকিলটা হল, প্রচার না হলে লোকজন ছবির কথা জানতেই পারেন না। যতক্ষণে জানেন, ততদিনে দেরি হয়ে যায়। আরও বড়ো ছবি চলে আসে।

‘আহা রে’-র ক্ষেত্রেই যেমন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন বিখ্যাত পরিচালকের ছবির সঙ্গে ডেট ক্ল্যাশ করে গেছিল। তবে তারপরেও নন্দনে ছবিটা চলেছিল বেশ কয়েক সপ্তাহ। আরেকটা ব্যাপারও আছে। বাঙালি দর্শকরা একটু বেশি টাকা খরচ করে মাল্টিপ্লেক্সে হিন্দি সিনেমা দেখতে যেতে পারেন, কিন্তু তার থেকে কম খরচে ভালো বাংলা সিনেমা দেখতে যেতে পারেন না। রুঢ় হলেও কথাটা সত্যি। অনেকেই হাতে গোনা কিছু পরিচালকের ছবি দেখতে যান। সেটাও ব্যানার দেখে, নাম দেখে। আমাদের মতো পরিচালকের ছবি, নতুন উঠতি পরিচালক যাঁরা ভালো কাজ করছেন তাঁদের কাজ সহজে দেখতে যান না। হয়তো বারবার ঠকেছেন বলেই...  

আপনি শুরু করেছিলেন ‘ইতি মৃণালিনী’ ছবিতে অপর্ণা সেনের সঙ্গে এক অর্থে জুটি বেঁধেই। সেটা বড়ো ব্যানারের ছবিই ছিল। অপর্ণা সেনের মতো নাম, ছবিতে কঙ্কনা সেন শর্মা, রজত কাপুরের মতো অভিনেতা। আপনি পরে এই ‘ব্রেক’-টাকে ক্যারি করতে পারলেন না। এর কারণ কী? আপনার পিআর খারাপ? নাকি প্রথম ছবিতেই অপর্ণা সেনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায়, সেই ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়ল? নাকি অন্য কিছু?   

বেশ জটিল প্রশ্ন। আমার কাছে উত্তরগুলো অবশ্য পরিষ্কার। আমার মতে, এর কোনোটাই ঠিক নয়। অপর্ণা সেনের সঙ্গে আমার পরিচয় ‘অন্তহীন’-এর সেটে। আমি একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে ওঁকে অ্যাপ্রোচ করি। সেটা একেবারেই একাডেমিক জায়গা থেকে। তখন আমি স্ক্রিপ্ট রাইটিং নিয়ে পড়ছিলাম। আমাদের সিলেবাসে দুটো স্ক্রিপ্ট লিখতে হত— অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট আর অ্যাসাইনড স্ক্রিপ্ট। অরিজিনালটা ছিল ‘হৃদ মাঝারে’। আর অ্যাসাইনডটা বাইরে থেকে কেউ আমাকে নিয়োগ করবেন। এটা আমারই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেই সূত্রেই যোগাযোগ। তারপর অনেকদিনের মিটিং, যোগাযোগের পর স্ক্রিপ্টের ব্যাপারে কিছু কথা এগোয়। এবং ওই স্ক্রিপ্টটা নিয়েই আমরা পরে ‘ইতি মৃণালিনী’ করি। ‘ইতি মৃণালিনী’ আমার কাছে বিরাট শিক্ষার জায়গা ছিল। এখনও সেই জায়গাতেই আছে, এখনও সেভাবেই দেখি। এটাকে ভাঙিয়ে খাব, এমন মানসিকতা নিয়ে আমি কখনও দেখিনি। এমনকি যখন ‘হৃদ মাঝারে’-র শ্যুটিং চলছে, তখনও রীণাদি (অপর্ণা সেন) জানতেন না ছবিটির কথা। আমি শুধু প্রিমিয়ারে ডেকেছিলাম তাঁকে। যাতে কখনও কারোর মনে না হয় আমি ওঁকে ব্যবহার করছি। 

‘ইতি মৃণালিনী’র পর আমি মুম্বইতে চলে যাই কাজের অফার পেয়ে। প্রকাশ ঝা তখন ‘গঙ্গাজল’ সিনেমার বাংলা ভার্সন তৈরি করবেন ভেবেছিলেন। তার একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করার জন্য আমায় ডেকেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত সেই ছবিটা হয়নি। কিন্তু মুম্বইতে চলে যাওয়ার পর আমার কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। টানা আড়াই বছর ছিলাম সেখানে। ফলে যোগাযোগ সব মুছে যায়। ‘হৃদ মাঝারে’ করার জন্য তারপর আবার কলকাতায় ফেরা। কিন্তু ততদিনে আমি তো নিজেই জায়গা হারিয়ে ফেলেছি… ‘ইতি মৃণালিনী’-র পরে আমায় নিয়ে যেটুকু চর্চা হচ্ছিল, সেটাকে ব্যবহার করে কাজ পাওয়ার সুযোগ আমিই হারিয়েছি বলা চলে।  

বুঝলাম। আচ্ছা, করোনা আবহে ‘বড়োপর্দা’ বনাম ‘ওটিটি প্ল্যাটফর্ম’ নিয়ে একটা বড়ো বিতর্ক দানা পেকেছে। ঘটনাচক্রে আপনার ছবিগুলো বড়োপর্দার থেকে ছোটোপর্দাতেই, মানে ইন্টারনেটেই অনেক বেশি লোক দেখেছেন। ফলে নতুন যে সময়টা আসছেসেটা সম্পর্কে আপনার নিজের কী মনে হয়? আপনি এই বিতর্কে কোনদিকে ঝুঁকে? 

যে ছবি আমি বা আমরা করি, সেগুলো কিন্তু বড়োপর্দার জন্যই করি। সেই পরিধিটা আমি ছেড়ে দিতে চাই না। কারণ আমি জানি, আমার ছবির যে এসথেটিক্স, সেটা বড়ো পর্দার এসথেটিক্স। আমি সেই স্পেসটা ওটিটির জন্য ছেড়ে দিতে পারি না। দুই, বড়োপর্দায় ছবির মুক্তিকে কেন্দ্র করে যে লড়াইটা স্বাধীন চিত্রপরিচালকদের করতে হয়, সেটা ওটিটিতেও করতে হবে। খেয়াল করে দেখবেন, মাল্টিপ্লেক্স এসেছিল তখন বলা হয়েছিল স্বাধীন পরিচালকদের জন্য সুবিধা হবে। আজ কিন্তু পুরো ব্যাপারটা উল্টে গেছে। ওটিটিতেও একই জিনিস হচ্ছে। আমি নাম বলতে চাই না, কিন্তু সম্প্রতি একটা অসামান্য ওড়িয়া ছবিকে একটা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নামিয়ে দিয়েছে। পরিচালকের নাম বড়ো হলে কিন্তু এটা ঘটত না। তবে ওটিটির ভালো দিকও আছে। এই লকডাউনের মধ্যে প্রচুর মানুষ ভালো কিছু ছবি দেখতে পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানের ভালো কিছু ছবি পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো দেখা যাচ্ছে। ভারতেও অনেক ভালো ছবি তৈরি হচ্ছে। সেটা একদিক থেকে খুবই ভালো। গুণমানটা বজায় থাকছে।

হ্যাঁ, একটা প্রতিযোগিতাও জন্ম নিয়েছে ইতিমধ্যেই। বড়োপর্দায় খারাপ ছবি লোকে দেখতে যাবে না টাকা খরচা করে। কারণ ওটিটি-তেই ভালো কনটেন্ট তাঁরা পাচ্ছেন।

ঠিক তাই। এই প্রতিযোগিতাটা স্বাস্থ্যকর। কিন্তু ফের বলছি, বড়ো পর্দার এসথেটিক্সের দাবিটা আমি ব্যক্তিগতভাবে ছাড়ব না। আমার মাধ্যম বড়োপর্দাই।
 

নতুন কোনো ছবির পরিকল্পনা চলছেবিষয়-কাস্টিং... 

নতুন ছবির পরিকল্পনা তো ছিলই। স্ক্রিপ্টও লেখা হল। শ্যুট করারও তো কথা ছিল জুন মাস থেকে। কিন্তু এই… লকডাউন শুরু হয়ে গেল। এখনকার সময়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েই ছবিটা ভেবেছি। এখন দেখা যাক… এর বেশি কিছু এখনই বলতে পারছি না (হাসি)। 

Powered by Froala Editor