‘শর্মিলার সঙ্গে ইয়ার্কির পরিকল্পনা ভেস্তে দিলেন মানিকদা’ – আলাপচারিতায় বরুণ চন্দ

জীবনের প্রথম সিনেমাতেই তিনি সত্যজিৎ রায়ের নায়ক। বরুণ চন্দ। অভিনয়ের সূত্রে কাছ দেখে দেখেছেন সত্যজিৎ রায়-কে। ‘সীমাবদ্ধ’-র পর, ২০ বছরের স্বেচ্ছা-নির্বাসন। আবার ফিরলেন ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে। এর মধ্যিখানে লুকিয়ে ‘মানিকদা’-কে নিয়ে অসংখ্য স্মৃতি। প্রহরের সঙ্গে আলাপচারিতায় অকপট বরুণ চন্দ।

আপনি তো বিজ্ঞাপন জগতের মানুষ ছিলেন। সত্যজিৎ রায়ও তাই। তাঁর ছবিতে সুযোগ পাওয়াও কি সেই সূত্রে?

বরুণ চন্দ - হ্যাঁ, বিজ্ঞাপন জগতের মানুষ আমি। আমি যে বিজ্ঞাপন সংস্থাতে কাজ করতাম সত্যজিৎ রায় সেখানকার অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন। কিন্তু তিনি নিয়মিত অফিসে আসতেন না। এমনকি, বোর্ড মিটিং-এও থাকতেন না তিনি। তাই ওঁর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বিশেষ হয়নি তখনও।

সেই আমলে ‘জুনিয়র স্টেটসম্যান’ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা ছিল। তাঁর সম্পাদকের সূত্রেই আমি একদিন সত্যজিৎ রায়ের ইন্টারভিউ নিতে যাই। সেই সূত্রেই ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। তারপর ওঁর হয়তো মনে হয়েছিল আমাকে দিয়ে কাজ হবে। উনি নিজেই যোগাযোগ রাখেন, আসতে বলেন। রবিবার সকালে ওঁর বাড়িতে এক বিরাট আড্ডা হত, দারুণ মজা হত সেখানে। উনি বলতেন 'কিছু কাজ না থাকলে মাঝেসাঝে চলে এসো।' হয়তো কোনো চরিত্রের জন্য আমি প্রস্তুত কিনা বা উপযোগী কিনা, দেখে নিতেন। আমার ধারণা, অডিশনের জন্য যখন আমায় প্রথম ডাকেন, তখনই উনি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন, সেই চরিত্রের জন্য আমি উপযুক্ত।

আরও পড়ুন
‘পথের পাঁচালী’র সেটে আলাপ, সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বললেন সৌমেন্দু রায়

সত্যজিতের ছবিতে প্রথম অভিনয়, তাও একেবারে নায়কের ভূমিকায়, এই অনুভূতিটা কেমন ছিল?

বরুণ চন্দ - দারুণ। প্রথমত সত্যজিতের সিনেমাতে অভিনয় করতে পারা ওই কম বয়েসে একটা বিরাট ব্যাপার মনে হত। ওই হাতে চাঁদ পেয়ে যাওয়া গোছের। তারপর নায়কের চরিত্র! চাঁদ ও সূর্য দুটোই একসঙ্গে পাওয়া।

একজন নবাগত চলচ্চিত্র-অভিনেতা, যিনি প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁকে উনি কীভাবে সামলাতেন বা, পরামর্শ দিতেন?

বরুণ চন্দ - পরামর্শ উনি একেবারেই দেননি। যখন একটি প্রধান চরিত্রে জন্য একজনকে বেছে নিতেন সত্যজিৎ, ভীষণভাবে নিশ্চিত থাকতেন যে তাকে দিয়েই হবে। উনি কিন্তু ছবি শুরুর আগে বলে দিয়েছিলেন, 'বরুণ তোমাকে যখন আমি এই ছবিটার জন্য নিচ্ছি, ধরেই নিচ্ছি তুমি শ্যামলেন্দু চ্যাটার্জি-র চরিত্রটা বোঝো ও করতে পারবে। কিন্তু কখনও যদি মনে হয় তুমি যেটা করছ সেটা আমার গল্পের বা বক্তব্যের পরিপন্থী, তখন কিন্তু আমার কথামতো কাজ করতে হবে'। উনি কখনও 'এমন ভাবে করো', 'এমন ভাবে বলো', 'এরকম ভাবে চলাফেরা করবে' এরকম কিচ্ছু বলেননি। আমার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হওয়ার পরও একবছর কেটে গেছে, তারপর ছবির কাজ শুরু। সবরকম ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এক বছরেরও বেশি সময় ধরে।

ছবিতে শ্যামলেন্দু চরিত্রটির মধ্যে তখনও কিছুটা মফস্বলী ভাব রয়ে গিয়েছিল, অথচ ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্খার জন্য সে অনবরত চেষ্টা করে যায়। বলতে গেলে, বেশ কঠিন একটা চরিত্র। তার জন্য আপনার যে নিজেকে তৈরি করা, সেসবের পিছনে সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকা নিয়ে কিছু বলুন।

‌বরুণ চন্দ – উনি এই চরিত্রটার জন্য এমন কাউকে চাইছিলেন, যার কর্পোরেট জগতের সঙ্গে ব্যক্তিগত  অভিজ্ঞতা আছে। আমায় দেখে ওঁর মনে হয়েছিল যে, আমাকে দিয়ে সেই ব্যাপারটা হবে। মানিকদার পাশাপাশি আমারও আমারও মনে হয়েছিল কতকগুলো জিনিস বদলানো উচিৎ। সেইমতোই সিনেমায় কিছু খুঁটিনাটি বদল এনেছিলাম আমরা।

আরও পড়ুন
সর্বজয়ার কান্নায় রবিশঙ্করের সুর, মুগ্ধ সত্যজিৎ বদল এনেছিলেন যে দৃশ্যে

আপনি রেসকোর্সের মাঠে ছবি তুলেছিলেন বলে আপনার জরিমানা হয়েছিল, শোনা যায়। শুটিং-এর সময়কার এমন কিছু মজার গল্প যদি বলেন...

‌বরুণ চন্দ - (হাসি) আসলে সহকারী পরিচালক, সহকারী ক্যামেরাম্যান সব্বাই একবার করে লুক থ্রু করছিলেন ক্যামেরা দিয়ে। আমিও ভাবলাম, দেখিই না কী দেখা যায়! তো ক্যামেরাটা ওভাবেই দাঁড় করানো ছিল, ফিক্সড করা ছিল। শুটিং তখনও শুরু হয়নি। আমি যেই ক্যামেরাটা দিয়ে লুক থ্রু করেছি, তখনই ইউনিটের সবাই হা হা করে এসে ধরল। বললো এই তো পাওয়া গেছে! ১০০ টাকা জরিমানা করে বসল। সেটা দিতেও হয়েছিল।

‌আরেকটা মজার কথা বলি। ‌শর্মিলা ঠাকুর তো আমায় চিনতেন না। আমার ধারণা উনি আমার ছবিও দেখেননি আগে। ওঁনর যেদিন প্রথম শুটিং ছিল, হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনালে, সেদিন আমার শুটিং ছিল না। অফিসের কাজে আমার যেতে দেরি হয়েছিল। ভেবেছিলাম, শেষের দিকে চুপিসারে একবার যাব শুটিং-এ। কোথায় শুটিং হবে আমি জানতাম। সেখানে কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও মানিকদা নিশ্চয়ই তখন স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করবেন, সৌম্যেন্দুদা(ক্যামেরাম্যান সৌম্যেন্দু রায়)-র সঙ্গে নানাবিধ আলোচনা হবে - ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাবলাম একটা ইয়ার্কি করা যাক। চুপিসারে শর্মিলার কাছে একটা অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে হাজির হব, বলব যে আমি আপনার একজন বিরাট ফ্যান, দয়া করে যদি একটা অটোগ্রাফ দেন। গিয়ে দেখলাম সত্যিই বিরাট হইহল্লা, ভিড়। মানিকদা ভীষণ ব্যস্ত। স্ক্রিপ্ট নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। ওইদিকে বোধহয় শর্মিলার তখন মেক আপের ফিনিশিং টাচ হচ্ছিল। আমি ভাবলাম লুকিয়ে চুপিসারে শর্মিলার দিকে এগিয়ে যাই। অদ্ভুত ব্যাপার, স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করতে করতে মানিকদা সোজা আমার দিকে তাকালেন। 'এইতো বরুণ এসে গেছে, চলো রিঙ্কুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।' আমার অত সুন্দর প্ল্যান ভেস্তে গেল।

আরও পড়ুন
প্রচ্ছদ থেকে পোস্টার – সবেতেই তুখোড় সত্যজিৎ; বানিয়েছেন চারটি ইংরাজি ফন্টও

সত্যজিতের ক্যালকাটা ট্রিলজির বাকি দুটি ছবি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং ‘জন অরণ্য’ থেকে সীমাবদ্ধ অনেকটাই আলাদা, অনেক সমালোচকের মত এমনটাই। আপনিও কি তেমনই মনে করেন?

বরুণ চন্দ - যতটা আলাদা মনে হয়, ততটা কিন্তু নয়। এই যে ‘ক্যালকাটা ট্রিলজি’ বলা হয়। সেটা একটু মিসনোমা, কারণ কলকাতার ওপর ‘মহানগর’ হয়ে গিয়েছিল আগেই। সেটাও কিন্তু বক্তব্য এক - চাকরি। যদি এই তিনটে ছবির যারা নায়ক, তারা কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের। এবং এদের দুজনের মধ্যে কিন্তু চাকরি পাওয়া নিয়ে একটা সংশয় ছিল। 'জন অরণ্য’-তে প্রদীপ যে চরিত্রটি করেছিলেন, সেটাতে চাকরি নিয়ে একটা গন্ডগোল ছিল। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে ধৃতিমানেরও চাকরি পাওয়া নিয়ে একটা জটিলতা ছিল। 'সীমাবদ্ধ’  দেখলে কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এটা আলাদা। আলাদা কিন্তু নয়।

'সীমাবদ্ধ' ছবির শুরুটা হচ্ছে এমপ্লয়েমেন্ট এক্সচেঞ্জ বিল্ডিংটা থেকে। আমার ভয়েসওভার বলছে, পশ্চিমবঙ্গে এত লক্ষ যুবক অফিসিয়ালি চাকরিহীন, আনঅফিসিয়ালি আরও কত যে আছে তার সীমা নেই। আমি কিন্তু এদের দলভুক্ত নই। সমস্যাটাকে প্রথমে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে যে, I am the lucky exception.

এরপরে ১৯৬৯-১৯৭১, তখন নকশাল আন্দোলন চরমে। 'জন অরণ্য' তে নকশাল আন্দোলন নিয়ে সেভাবে কিছু আসেনি, কিন্তু 'প্রতিদ্বন্দ্বী'-তে ভীষণভাবে সেটা ছিল। 'সীমাবদ্ধ'তেও গোটা সিনেমা জুড়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা কনটেক্সট রয়েছে। অতএব তিনটে আলাদা রূপ নয়, বরং কলকাতার তৎকালীন বাঙালি সমাজের তিনটে আলাদা দিক বলা যেতে পারে। কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের চাকরি পাওয়া নিয়ে গল্প।

আরও পড়ুন
দৃষ্টিহীন বিনোদবিহারীকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানালেন সত্যজিৎ, ক্যামেরার পিছনে সৌমেন্দু রায়

এই প্রশ্নটি সম্পূর্ণ আপনাকে নিয়ে। শ্যামলেন্দুর যে চরিত্রটি, যে পুরোপুরি মানতেও পারেনি কর্পোরেটের চাকচিক্য, কূটনীতিকে, আবার নিজেও সেই পিঠ বাঁচাতে গিয়ে কারচুপিরই আশ্রয় নিল, তারপর তুতুল ও নিজের চোখে ছোটো হয়ে গেল – এই চরিত্রটার প্রতি আপনার নিজের কি মায়া হয়েছে?

‌‌বরুণ চন্দ - হ্যাঁ, এটা তো নিশ্চয়ই ট্রাজেডি। অ্যাম্বিশন থেকে জন্ম নেওয়া ট্রাজেডি। মানুষ বেশি অ্যাম্বিশাস হলে কত কিছু করতে পারে। এটাতে কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের অন্য একটা দিক ফুটে ওঠে। ও যেটা করেছে সেটা কিন্তু কিছু দোষের নয়। ও ফ্যাক্টরিতে একটা অসুবিধের সৃষ্টি করেছিল, তাই ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেওয়া হল। তার ফলে যে পেনাল্টিটা দিতে হত, সেটা আর দিতে হল না। বলতে পারেন একরকম চাতুর্য। চাতুরির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা কখনওই বেআইনি নয়। গন্ডগোলটা হল যখন গেটে বোমা ফাটানো হল। গেটে যে হাজির ছিল, সে একজন ডায়বেটিক রুগি। মূল গল্পে উনি মারা যান। 'সীমাবদ্ধ' ছবিতে কিন্তু তা করা হয়নি। তিনি গুরুতর আহত হন। এবং ছবির নায়ক শ্যামলেন্দু জোর করেই হাসপাতালে যায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে চরিত্রের একটা সচেতনতার দিক উঠে এসেছে। বিবেকের একটা দংশনের ব্যাপারও তো রয়েইছে!

পাশাপাশি তার শ্যালিকা সুদর্শনা বা তুতুল, সেও কিন্তু এখানে একটা প্রতীক হিসেবে এসেছে। 'Symbol of his conscience'। এটা নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা হয়েছে। সবসময় একটা এথিকস ফুটে উঠেছে শ্যামলেন্দুর মনে - এটা ভালো না খারাপ। এই যে প্রশ্নটা, এই মূল্যায়ন – উচিৎ কি অনুচিত, সেটা তার শ্যালিকার থেকে আসছে।

আরও পড়ুন
গুপীর চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন সৌমিত্র, রাজি হননি সত্যজিৎ

সত্যজিতের ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করলেন। সেক্ষেত্রে স্বভাবতই এই প্রশ্ন জাগে যে, ওঁর অন্য কোনো ছবিতে আপনাকে দেখা গেল না কেন? এবং তারপর বহু বছর আপনাকে ছবি করতে দেখা যায়নি, এই বিষয়েও জানতে চাইব।

‌বরুণ চন্দ - অনেকটা স্বেচ্ছা-নির্বাসিত বলা চলে। সীমাবদ্ধ করার পর সাত-আটটা চরিত্রের অফার পেয়েছিলাম, কোনোটাই অ্যাক্সেপ্ট করিনি। কারণ আমার মনে হয়েছিল সেই চরিত্রগুলো কোথাও একটা শুধু অভিনয় করার জন্য অভিনয় করা হবে। আমি সেটা কিন্তু চাইনি। আমি কখনওই চাইনি একজন ফিল্মস্টার হয়ে থেকে যেতে। বরাবর একজন অভিনেতা হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তপন সিনহা, ঋত্বিক ঘটক, মৃণালদা - যাঁরা সে-সময়ের বাংলা সিনেমার অগ্রদূত তাঁরা কেউই আমায় ডাকেননি। বেশিরভাগ ছবিই দীপঙ্কর করেছিল। সেখান থেকেই কিন্তু দীপঙ্কর দে-র উত্থান। কিন্তু আমি যে চরিত্রগুলো ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তার নব্বই শতাংশই দীপঙ্কর করল।।

সেসব নিয়ে আমার মনে কিন্তু কোনো দুঃখ নেই। কেননা ভালো ছবি না হলে শুধু অভিনয় করার জন্য আমি নায়ক হব - সেরকম আমার আকর্ষণ ছিল না। আরেকটা বিষয় ছিল, তখনকার দিনে বছরে খুব বেশি হলে দশ বারোটা বাংলা ছবি হত। তার মধ্যে ২-৩টে উত্তমবাবুর ছবি, কিছু সৌমিত্রবাবুর, অন্যান্যদের আরও কয়েকটা। এর মধ্যে আমি একটা রোল পেলাম কি পেলাম না, সেটা তো বিরাট একটা চান্স নেওয়া। সে-সময় অভিনয়ের জন্য চাকরি ছেড়ে দেওয়া আমার কাছে ঠিক বলে মনে হয়নি। আমি তখন বিবাহিত, সংসার আছে, একটা দায়িত্ব আছে। আমার মা, ভাই এর প্রতি একটা দায়িত্ব  ছিল। আমার উত্তমকুমার হওয়ার কোনো বাসনা ছিল না৷ অভিনেতা হওয়ার বাসনা ছিল। সেটা এখন হচ্ছে। ছোটো চরিত্র হলেও চেষ্টা করি দাগ কাটার।

আরও পড়ুন
কান চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি হওয়ার আমন্ত্রণ, ‘না’ সত্যজিতের

সীমাবদ্ধ’-র প্রায় ২০ বছর পর ফিরলেন সিনেমায়, আরেক খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার, ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে...

‌বরুণ চন্দ - হ্যাঁ, ঋতুপর্ণের ‘হীরের আংটি’ দিয়েই আমার কামব্যাক। কিন্তু তারও আগে একটা পুলিশ ডিটেকটিভ সিরিজে কাজ করেছিলাম। সেটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল। নাম – ‘১০০’। দূরদর্শনে দেখানো হয়েছিল ১৯৮৮-৮৯ নাগাদ। তখনকার দিনে এটা কিন্তু বিরাট এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আমি সেই সিরিয়ালে কাজ করে কিন্তু খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। তারপর ঋতুপর্ণের ছবিতে অফার আসে।

‘সীমাবদ্ধ’-র পরে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আর যোগাযোগ ছিল?

বরুণ চন্দ - ভীষণ ভাবেই যোগাযোগ ছিল। বাবু মানে সন্দীপের সঙ্গে খুবই বন্ধুতা ছিল। তারপর যা হয় আরকি, যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। অতটা যোগাযোগ থাকে না। মানিকদার ‘ঘরে বাইরে’ ছবির পর থেকে ও-বাড়িতে আমার যাওয়া-আসা খানিক কমে আসে। কারণ যে মানিকদা কে আমি জানতাম, এক বিশালাকার চেহারাই নয় এক বিরাট মাপের ব্যক্তিত্ব – তাঁকে যেন আর খুঁজে পেতাম না। ওঁর হার্ট অ্যাটাকের পর থেকে যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, আমি গিয়ে খুব কষ্ট পেতাম। পরের দিকে উনি আমার থেকে বেঁটে হয়ে গিয়েছিলেন। সেটা আমি সহ্য করতে পারিনি। যখন ‘সীমাবদ্ধ’ করি, তখন আমি ৬'২" উনি ৬'৪"। তারপর আমি যখন ওঁর বাড়ি যেতাম দেখতাম কীরকম ছোটো হয়ে যাচ্ছেন। মানিকদার সেই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যেটা কেমন ফিকে হয়ে আসছিল। সেই যে একটা জ্বলজ্বলে ব্যাপার, সেটা আর ছিল না। আমার খারাপ লাগত। আমার যিনি নায়ক, তিনি আর নেই কোথাও যেন! সেই নায়ককে আর দেখতে পেতাম না। খুব কষ্ট হত। তাই শেষের দিকে আর ওঁর বাড়িতে যাইনি। উনি মনের দিক থেকেও অনেকটা ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছিলেন।  সেই প্রতিভার ছটা, একটা অসাধারণ ব্যতিক্রমী ব্যাপার, সেটা আর খুঁজে পেতাম না। মনের দুঃখে যেতাম না।

আরও পড়ুন
বাড়িতেই লুকিয়ে ছিল অসংখ্য চিঠি-ছবি, সামনে এল সত্যজিতের ‘গুপ্তধন’

শেষ প্রশ্ন, বহু পরিচালকের সঙ্গে পরবর্তীকালে কাজ করেছেন। আপনার চোখে সত্যজিৎ রায় কোথায় আলাদা?

কোনো তুলনাই হয় না। যদি তুলনা করতে হয়, উনি সবদিক দিয়েই আলাদা। ওই তুলনামূলক বিচারে না যাওয়াই ভালো। আমি এটুকু বলব, ‘সীমাবদ্ধ’ করার বহুদিন পর একটা ছবি করে কিন্তু আমি খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। সেটি একটি হিন্দি ছবি, বাংলা নয়। নাম, ‘লুটেরা’। ‘সীমাবদ্ধ’ যদি আমার বেস্ট হয়, সেকেন্ড বেস্ট হিসেবে রাখব ‘লুটেরা’কেই।

Powered by Froala Editor