একটি স্টার্ট আপ। আর তার সূত্রেই বদল আসতে চলেছে সাইকোমেট্রিকসের চিরাচরিত পদ্ধতিতে। আরও বেশি করে নিজেকে চিনতে সাহায্য করবে এই উদ্যোগ। বলা ভালো, ধরিয়ে দেবে আপনারই না-জানা দিকগুলি। ‘নুভা’ এমনই এক ম্যাজিক-মস্তিস্কের নাম। কর্ণধার অভীক চন্দের সঙ্গে কথোপকথনে অনিতেশ চক্রবর্তী...
অভীকদা, আপনাকে ইংরেজি নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। প্রহরের পাঠক ও দর্শকদের দীর্ঘদিনের সঙ্গী আপনি। প্রথমে ‘ক্যান্ডিট টক’ সিরিজ, এবং সাম্প্রতিক সময় ‘শিকাগো ডায়লগস’-এ সঞ্চালকের ভূমিকায় আপনাকে দেখেছে সবাই। আর ২০২১-র শুরুতেই আরও এক নতুন ভূমিকায় আপনাকে দেখতে চলেছি আমরা। স্টার্টআপ সংস্থা ‘নুভা’-র প্রতিষ্ঠাতা আপনি। কী করে এই নতুন পথ চলা শুরু হল?
অনিতেশ, তোমাকে এবং প্রহরের পুরো টিম, দর্শক-পাঠকদের জানাই ইংরেজি নববর্ষের অনেক শুভেচ্ছা। ‘নুভা’-র কথা বলতে গেলে আমাকে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। ২০১৫ সালে, আমি এবং আমার এক বন্ধু মিলে একটি বই লিখতে শুরু করেছিলাম। হারপারকলিন্সের পক্ষ থেকে প্রকাশিত বইটির নাম ছিল “ফ্রম কমান্ড টু এমপ্যাথি : ইউজিং ইকিউ ইন দ্য এজ অফ ডিজরাপশন”। সেখানেই, প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে আমরা কয়েকটি প্রশ্ন রেখেছিলাম পাঠকদের জন্য; যাতে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের যাচাই করে নিতে পারেন। এবং এই কাজটি করতে গিয়েই সাইকোমেট্রিকস বিষয়টা নিয়ে উৎসাহিত হই। এরপর চার বছর ধরে এটি নিয়ে, শিল্পের ওপর সাইকোমেট্রিকসের প্রয়োগ নিয়ে পড়াশোনা করি। তারপর ২০২০-তে এসে, আমাদের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সঞ্জয় চ্যাটার্জির সঙ্গে আলোচনা করতে করতেই এই ভাবনা মাথায় এল। কেমন হয়, যদি সবার জন্য এরকমই একটি প্রোডাক্ট বের করা যায়, যার মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনও থাকবে, আর ব্যবহার করাও সুবিধেজনক হবে…
সেইসূত্রেই আমরা এমন একটি নাম খুঁজছিলাম, যেখানে কেবল ভারতীয় নয়, আন্তর্জাতিক ছাপ থাকবে। সেইসঙ্গে নামের মধ্যে থাকবে একটা নতুনত্ব। তখনই সঞ্জয়ের মাথায় এল— ‘নুভা’।
কিন্তু বিশ্বের বাজারে তো আরও অনেক সাইকোমেট্রিক অ্যাপ্লিকেশন আছে। আইকিউ, ইকিউয়ের মতো প্ল্যাটফর্মও আছে, যেখানে বিনামূল্যে এই কাজটি করা হয়। তাহলে ‘নুভা’ এদের থেকে আলাদা কোথায়?
ঠিকই। তবে ‘নুভা’-র ভাবনা, কাজের ধরণ— সবই এদের থেকে আলাদা। ট্র্যাডিশনাল সাইকোমেট্রিক বরাবরই একটি বিশেষ মডেল অনুসরণ করে। এই মডেলের লক্ষ্যই হল, এক একজন মানুষের দুর্বলতা বা খামতির জায়গাগুলোকে খোঁজা এবং বিভিন্ন উপায়ে সেগুলোকে যতটা সম্ভব মেরামত করা। কিন্তু এই পদ্ধতিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে হয়। যেমন, তোমার মতে কোন কোন কাজে তুমি অন্যদের থেকে একটু ভালো? সহজভাবে বললে, তোমার ট্যালেন্ট বা প্রতিভা কী? কাজের জায়গায় হোক বা তার বাইরে সেই প্রতিভাকে কেমন করে ব্যবহার করছ? কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত রাখো, নিজের প্রতিভায় শান দাও? এরকম আরও অনেক প্রশ্ন আছে, যেগুলো একটা মানুষের পজিটিভ দিকগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। এবং এটাই ‘নুভা’-র মূল মন্ত্র। অবশ্যই আমরা মানুষের আসল ইস্যুগুলোকে তুলে আনব। কিন্তু সেইসঙ্গে ওই মানুষটির আসল ক্ষমতা, প্রতিভা সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ও পজিটিভ ধারণা তৈরি করাও আমাদের অন্যতম কাজ।
প্রোডাক্টটি সম্পর্কে যদি একটু বলেন… আমরা কি এখনই এটি ব্যবহার করতে পারব?
এই ছয় মাসে প্রোডাক্টটির বেটা টেস্টিং পুরোপুরি সফল। আমরা প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু মানুষকে সঙ্গে পেয়েছি, কিছু ক্ষেত্রে কথা এগোচ্ছে। এই পুরো প্রোডাক্টটির দুটো দিক আছে; এক, ব্যক্তি নির্বিশেষে একটি সাইকোলজিকাল ধারণা তৈরি করা এবং দুই, একটা সম্পূর্ণ রিপোর্ট। যে রিপোর্টে সামগ্রিকভাবে ব্যবহারকারীর সমস্ত দিক তুলে ধরা হবে। ব্যক্তিগত রিপোর্টে তিনটে স্তর থাকবে। প্রথমত, অন্তত ২৪টি সম্ভাবনাময় জায়গা বা দিক, যেখান থেকে নিজেকে মেলে ধরতে পারবে; দ্বিতীয়ত, ব্যবহারকারীর চারিত্রিক দিক, তাঁর মাইন্ডসেট। আর এই দুটোর ওপর ভিত্তি করে বাকি সিদ্ধান্তগুলোও নেওয়া হবে। আমাদের কাছে যারা আসবেন, তাঁদের চাহিদা অনুযায়ীই সমস্ত কিছু সাজানো হবে। প্রত্যেকের চাহিদা হয়তো বিভিন্ন, সেই অনুযায়ী আমরা পুরো ব্যাপারটিকেও তৈরি করব; কিন্তু মূল প্রয়াসটা একই থাকবে।
আরও পড়ুন
‘বীরেনবাবুকে মানুষ যতদিন মনে রাখবে, ততদিন আমিও বেঁচে থাকব’ : শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
যদি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করি, তাহলে ‘নুভা’ কীভাবে সাহায্য করবে আমাদের?
এখানে একটা কথা বলি। ধরা যাক কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন। এই মুহূর্তে পৃথিবী জুড়ে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের একটা বড়ো অংশের মানুষের কাছে এখনও এই ভ্যাকসিন পৌঁছয়নি। সেটা হতে এখনও বেশ কিছু মাস দেরি। আমাদের কাজের জায়গাও আর আগের মতো নেই। কাজেই, শুধুমাত্র ভ্যাকসিন নিলেই আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব না। আমাদের মনে সেই শক্তি রাখতে হবে; পজিটিভিটি, আশা রাখতে হবে। মনটাকে উন্মুক্ত রাখতে হবে, সহনশীল হতে হবে।
এবার যদি ‘নুভা’-র সাইকোমেট্রিক বিষয়ে নজর দাও, তাহলে এর মধ্যে বেশ কিছু ব্যাপারে তুমি সেভাবে উৎরোতে পারবে না। এটা সবার ক্ষেত্রেই ঘটে। এই ইনসাইটের মাধ্যমেই সেই যাবতীয় ভালো-মন্দ সম্পর্কে জানা যাবে। এখন যারা এই সিস্টেম ব্যবহার করছেন, তাঁরা যথেষ্ট বলেছেন। তাঁরা এও বলেছেন, নিজেদের স্বভাবের এমন এমন জিনিসের সন্ধান পেয়েছেন যেগুলো এর আগে কখনও ভাবেনওনি। হয়তো সেভাবে নিজেকে জানার চেষ্টাও করা যায়নি। ‘নুভা’-র এই সাইকোমেট্রিক ইনসাইটের মাধ্যম আসলে একটি আয়না, যার মাধ্যমে একজন নিজের সম্পূর্ণটা জানতে পারবে। তাঁর কোন কোন জায়গা খারাপ, কোন কোন কাজ একটু ভালো পারে, তাঁর আসল প্রতিভা কী এই সমস্ত বিষয়ই তুলে ধরা হবে। এবং এর ফলাফল দেখেই পরবর্তী পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, একটা লক্ষ্য স্থির করা যাবে। আর সেটা শারীরিক, মানসিক সব দিক থেকেই ভালো হবে।
আরও পড়ুন
‘এই সময়ে দাঁড়িয়ে সকলের মধ্যে প্রেম বিলানো একটা বড়ো কাজ’: ইমন
‘নুভা’-র পরবর্তী পদক্ষেপগুলি কী কী? ধরা যাক, একজনের সাইকোমেট্রিক ইনসাইটে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উঠে এসেছে যেগুলো ওই ব্যক্তির নিজস্ব ক্ষমতার জায়গা। তাদের মধ্যেই অন্তত কয়েকটার ওপর এই মুহূর্তে ফোকাস করা জরুরি। এই বিষয়টা কীভাবে নির্ণয় করেন আপনারা?
এই প্রোডাক্টটিই ‘নুভা’-র সাইকোমেট্রিক বিষয়টির মূল শাঁস বলা চলে। তবে একথাও মনে রাখতে হবে যে, একটি প্রোডাক্ট কখনই স্ট্যাটিক নয়; অর্থাৎ পরিস্থিতি নির্বিশেষে এর চাহিদা ও অবস্থারও বদল হতে পারে। আজ যেভাবে ভাবা হচ্ছে, চিরকাল যে সেইভাবেই ভাবা হবে তা কিন্তু নয়। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি অনেকগুলি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। আমরা চেষ্টা করছি যাতে এই মুহূর্তে ঠিক কোন কোন জিনিসগুলি প্রয়োজন সেই অনুযায়ী পুরো ছক তৈরি করা যায়। বলে রাখা ভালো, গার্টনার, ফোর্বস, ফরেস্টার, ম্যাককিনসে’র মতো জায়গায় একটি সার্ভে করেছি। এবং সেই সার্ভে অনুযায়ী আমাদের মনে হয়েছে, তিনটি বিষয় আজকের দিনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক, তুমি কতটা গভীরভাবে ভাবতে পারছ, মানে মননশীলতা; দুই, তুমি নিজের কাজের ক্ষেত্রে কতটা সহনশীল; আর তিন, সৃষ্টিশীলতা এবং নতুনত্ব। আপাতত এই বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই কাজ চলছে। এবং আমরা আশা করছি মার্চের শেষে আমরা একটা ভালো জায়গায় যেতে পারব।
এই অতিমারির সময় নতুন একটি স্টার্টআপ বাজারে আনছেন। স্বাভাবিকভাবেই বেশ ঝুঁকির কাজ। নিশ্চয়ই বেশ কিছু প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়েছে আপনাকে। সেগুলো নিয়ে যদি একটু বলেন। সেইসঙ্গে সেই প্রতিকূলতা সামলালেন কেমন করে, সেটাও যদি বলেন…
২০২০-র জানুয়ারির শেষেই ‘নুভা’-র সমস্ত ভাবনাচিন্তা করা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল পুরো বিষয়টা মার্চের গোড়াতেই সম্পূর্ণ হয়ে যাবে, এবং এপ্রিলে বাজারে লঞ্চ করা হবে। কিন্তু তার মধ্যেই করোনা অতিমারি শুরু হয়ে গেল। এবং পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ভয়ংকর হয়ে উঠল। অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতোই আমাদেরও সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। সমস্ত কিছু বাতিল করতে হল। অনলাইন ওয়েবিনার জায়গা করে নিল। পরিস্থিতি সত্যিই প্রতিকূল ছিল; তবুও আমরা আমাদের প্রোডাক্টের বেটা টেস্টিং করেছি, এবং সফলও হয়েছি। আর এই পুরো সময়ই আমরা এমন কিছু সংস্থার খোঁজ করেছি যারা আমাদের এই কাজের সহায়ক হয়ে উঠবে। তাঁরা হবে আমাদের বিজনেস পার্টনার। আমরা তাঁদের কাছে পৌঁছেছি, আমাদের ভাবনা জানিয়েছি। এবং সবথেকে বড়ো কথা, আমরা বিভিন্ন বড়ো প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম। তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, করোনার এমন পরিস্থিতিতে, বাজার ঠিক কী চায়? ঠিক কোন কোন বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর জোর দেওয়া জরুরি? এই পুরো রিপোর্ট বেশ কিছু প্রথম শ্রেণির সংবাদ মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে। আমি নিজে পড়াশোনার কাজ থামাইনি, এবং সেই কাজ এখনও চলছে। যখন পেছন দিকে ফিরে তাকাই, তখন বেশ ভালো লাগে। কারণ, এমন একটা মাসও যায়নি যেখানে ভালো কিছু হয়নি। প্রতি মাসেই কোনো ভালো ফলাফল অপেক্ষা করেছে আমাদের জন্য। এখন নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হয়…
আরও পড়ুন
বড়োপর্দার মতো ওটিটি-তেও স্বাধীন পরিচালকদের লড়েই জায়গা করে নিতে হবে: রঞ্জন ঘোষ
যে কোনো স্টার্টআপের শুরুতেই পার্টনারশিপ করাটা একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে বেশ চ্যালেঞ্জিংও বটে। এক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা কীরকম?
অতিমারির এমন দুর্গম পরিস্থিতিতেও আমরা যে এতদূর এগিয়েছি, তার জন্য সত্যিই ভাগ্যবান মনে হয় নিজেদের। ‘ন্যাসকম ১০,০০০ স্টার্টআপস’ ভার্চুয়াল প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে আমরা মনোনীত হই; এবং এর সঙ্গেই ন্যাশনাল এইচআরডি নেটওয়ার্ক রিসোর্সেস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়াও আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। এনএইচআরডিএন, এফআইসিসিআই এবং দ্য হিউম্যান রিসোর্সেস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া-র মতো সংগঠনের সঙ্গেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করি। মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশনের মতো সংস্থাও আমাদের পাশে আছে। তাঁরাও অন্যতম অংশীদার। সাইকোমেট্রিক সলিউশন তৈরি করাই শুধু নয়, আমাদের ক্লায়েন্টদের প্রয়োজনে সাইকোলজিকাল কাউন্সেলিংয়েরও ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা। নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ক অ্যান্ড পার্টনারস, ইন্ডিস্মার্টের মতো সংস্থাও আমাদের পাশে এসেছে। আর প্রহরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করেছি। এখানে আমাদের লক্ষ্য ছিল মানুষ যাতে আরও বেশি করে মানসিকভাবে সুস্থ থাকে, লড়াই করার সাহস পায়। তবে সবথেকে ভালো খবর, আমরা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির অধ্যাপক এলেন ল্যাঙ্গারের থেকেও সাহায্য পেয়েছি। তিনিও এসে আমাদের হাত ধরেছেন। মার্টিন সেলিগম্যানের মতে, অধ্যাপক ল্যাঙ্গার এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রথম শ্রেণীর মনোবিদদের মধ্যে অন্যতম। তিনি নিজের তৈরি করা বিখ্যাত ‘ল্যাঙ্গার মাইন্ডফুল স্কেল’ ব্যবহারেরও অনুমতি দিয়েছেন। এসবই আমরা ফেব্রুয়ারির গোড়াতেই সবার সামনে নিয়ে আসব।
Powered by Froala Editor