অর্জুন গৌরিসারিয়া (১৯৬৪—) (Arjun Gourisaria) পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের উল্লেখযোগ্য উদ্যোক্তা (অন্ত্রপ্রেনর), চলচ্চিত্র নির্মাতা, সম্পাদক এবং শিক্ষক। ১৯৮৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত, তিনি ৫০০-টিরও বেশি বিজ্ঞাপনচিত্র পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন। এছাড়াও ফিকশন এবং নন-ফিকশন উভয় ক্ষেত্রেই ১০০০ ঘণ্টার বেশি টেলিভিশন প্রোগ্রামিং করেছেন অর্জুন। অর্জুন সম্পাদিত 'গুলাবি গ্যাং' (২০১৪) এবং 'শাট আপ সোনা' (২০২০) তথ্যচিত্রদুটি ফিল্ম-এডিটিং-এর ক্ষেত্রে জাতীয় পুরস্কার সহ একাধিক পুরস্কার পেয়েছে। হালে জি-৫ ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়ার পর ‘শাট-আপ-সোনা’ দেশের চলচ্চিত্র আঙিনায় আলোচনার শিরনামে উঠে এসেছে। এছাড়াও মৈনাক বিশ্বাসের সাথে যুগ্ম-পরিচালনায় তৈরি করা প্রথম ফিচারফিল্ম 'স্থানীয় সংবাদ' (২০১১) নিউইয়র্ক ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পেয়েছিল সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার । অর্জুন এবং তার বন্ধুদের হাতে গড়ে ওঠা ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক মোশান পিকচার্স’ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও বিজ্ঞাপনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। বর্তমানে কলকাতাবাসী অর্জুনকে চলচিত্র বিষয়ক অনলাইন বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখতে এবং কখনও সখনও অন্তরঙ্গ আড্ডায় ক্লাসিকাল গিটার হাতেও দেখা যায়। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে রূপক বর্ধন রায়। আজ প্রথম পর্ব।
রূপক : প্রথমেই জানতে চাই, ফিল্ম বা সিনেমায় কেন?
অর্জুন : এই উত্তরটা দেওয়া খুব একটা সহজ নয়। আমি আমার মামা-বাড়িতে বড়ো হয়েছি, আর আমাদের গোটা পরিবারটাই ফিল্ম-পাগলদের পরিবার। প্রত্যেক শুক্রবার যে হিন্দি ছবিটা রিলিজ হত, মামার কমলা হেরাল্ডে চেপে সপরিবারে সেটা দেখতে যেতাম আমরা। মামা খোশমেজাজের লোক, ইনভেরিয়েবলি দেরি করাতেন। এই নিয়ে আমার মা আর আমি খুব বিরক্ত থাকতাম; গোড়ার সিনগুলো দেখা হত না!
রূপক : এটা কোন সময়?
অর্জুন : এটা ধরো সত্তরের দশক থেকে শুরু করে আশির দশকের গোড়ার সময়ের কথা। আমার জন্ম ’৬৪ সালে আর বাবা চলে যাওয়ার পর ওই ’৭০ সাল নাগাদ মামা বাড়িতে আসি।
রূপক : কলকাতাতেই?
অর্জুন : হ্যাঁ কলকাতা। প্রথম প্রথম আমরা রাসেল স্ট্রিটে থাকতাম। কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে, আই হ্যাভ বিন আ সাউথ ক্যালকাটা পার্সন।
কাজেই, ছোটোবেলা থেকেই ছবি বা সিনেমার প্রতি একটা তীব্র ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তার পুরোটাই হিন্দি কমার্শিয়াল ছবি নির্ভর। রাজেশ খান্নার শেষের দিকের আর অমিতাভ বচ্চনের গোড়ার দিকের ছবিগুলো দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছি। এছাড়া বই পড়ার দারুণ নেশা ছিল।
আরও পড়ুন
বাংলা সিনেমায় ‘থিম সং’ এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
এই ‘লাভ ফর ন্যারেটিভ দ্যাট ক্যান ইভোক ইমোশানজ অর ইন্সপায়ার এ্যাকশানজ’ ভিতরে দানা বাধছিল। তাছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা, নাটক দেখতে যাওয়াই হোক বা সারা রাত আড্ডা দেওয়াই হোক— আমাদের বাড়িতে কোনো কিছু নিয়েই তেমন কড়াকড়ি ছিল না। আমি ছেলে বলে বলছি না, আমাদের বাড়িতে মেয়েদেরও ছিল না।
রূপক : এরপর?
অর্জুন : এরপর আসতে আসতে হলিউড ছবি দেখা শুরু হয়। ওটা ’৭০-’৮০র দশক, তখন সপ্তাহে বড়োজোর একটা হিন্দি আর একটা ইংরেজি ছবি আসত। কাজেই যে ছবিই এসেছে, তা-ই দেখার সুযোগ হয়েছে। তাছাড়া গানবাজনা শিখছি, মিউজিক স্কুলে যাচ্ছি, এভাবেই ভিজুয়াল আর্টসের উপর একটা আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।
আরও পড়ুন
বাংলা সিনেমার নবজাগরণ ও আবহমান ঋতু
এছাড়া আমি আমাদের শহরের কথা তো বলবই, কলকাতা ওয়াজ আ ভাইব্রেন্ট সিটি! ওয়াজ কথাটা আমি ইচ্ছে করেই বলছি। তখনকার কলকাতায়, কেউ একেবারে অন্ধ না হলে সমস্তটা শুষে নেবেই! একদিকে আকাডেমিতে নাটক হচ্ছে, সব ধরনের মিউজিক কনসার্টস হচ্ছে— মানে ওসিবিসা পারফর্ম করতে আসছে আবার আলি আকবর খান সাহেব, নিখীল ব্যানার্জি বাজাচ্ছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত হচ্ছে, অন্যদিকে রতন থিয়ামের নাটক দেখছি, হাবিব তনবিরের নাটক দেখছি; সব হচ্ছে। তনবির সাহেব একাধিক নাটক নিয়ে প্রত্যেক বছর কলকাতায় আসতেন— ওনার নাটক দেখার জন্য রাত্রিবেলা লাইন দিতে হত। মানে সবাই রাত ৯টা সাড়ে নটায় খবরের কাগজ পেতে লাইনে শুয়ে ঘুমতেন, তারপর টিকিট কাটতেন সকালে।
আরও পড়ুন
‘বাবু পেলে ছবি বানাব, এখন লক্ষ্য বিজেপিকে হারানো’, বলছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্জুন
কাজেই বোঝাই যাচ্ছে, আমি একটা ‘কট্টর আর্টসবাদি’ পরিবেশে বড়ো হয়েছি (হাসি)।
এরপর একটু অন্যান্য দেশের ছবি সম্বন্ধে পড়াশোনাও শুরুও করি। আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়ো দিদি তখন সিনেমা তৈরির কাজের সাথে জড়িত। অন্যদিকে আমার জ্যেঠু ওয়াজ ভেরি ক্লোজ ফ্রেন্ড উইথ সুনীলদা (দত্ত), দিলীপ কুমার, লতা মঙ্গেশকর... তো সবসময়েই একটা ফিল্ম-ফিল্ম আবহাওয়া ছিল বাড়িতে। দিদি আমায় একটা নিউ ওয়েভ বই প্রেজেন্ট করেছিল, কোনো সিনেমা না দেখেই সেটা পড়েছি তখন।
রূপক : কোয়াইট এক্সাইটিং!
অর্জুন : কিন্তু এত কিছুর পরেও কফিনে শেষ পেরেক ছিল ‘৮২ সালের কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। আমি তখন হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছি। ওই বছর গোদার-ইয়্যাঞ্চো রেট্রোস্পেকটিভ এল, তার সঙ্গে আরো অন্যান্য ছবিও এল। রাত জেগে জেগে লাইন দিয়ে, দিনে চারটে করে ছবি দেখে শেষমেশ আমার মনে হল এইটাই করতে চাই, দিস ইজ ওয়াট আই ওয়ান্ট টু ডু! তারও পরে যাদবপুরে গিয়ে বার্গম্যানের ‘সেভেন্থ সিল’ আমার মনের বাকি সংশয়টুকুও কাটিয়ে দেয়। আমার এখনও মনে আছে, সেভেন্থ সিল দেখে বেরোলাম, আমি আর আমার এক বন্ধু এফ-এস-আইতে সে-রাতে প্রিন্ট ফেরত দিতে যাওয়ার পথে দোতলা বাসের উপরের তলায় ওই ষাট কিলোর ক্যান হাতেই ছবিটা নিয়ে কথা তো বলেইছিলাম, এমনকি এরপর সারা রাত ভিক্টোরিয়ার মাঠে বসে শুধু ওই ছবিটা নিয়ে কথা বলেছি। আই থিংক সেই সকালে সূর্য ওঠার পর আমি জানতাম যে এইটাই করতে হবে।
কাজেই, হায়ার সেকেন্ডারির পর গোদার দেখে একটা ছেলে ঠিক করছে যে সে ফিল্মমেকারই হতে চায়, বোঝাই যাচ্ছে একটু পাকা টাইপের ছিলাম; (দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে হাসি) এখনও আছি বোধহয়!
রূপক : এরপর তো কলেজ?
অর্জুন : হ্যাঁ। আমি প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, সেন্ট জেভিয়ার্স তিনটেতেই চান্স পেয়েছিলাম।
রূপক : কোন বিষয়ে?
অর্জুন : ইকোনমিক্স, তিনটেতেই। কমার্সে যাইনি কারণ কমার্স করলে জেভিয়ার্স আর সেটা মর্নিং কলেজ। কাজেই আমার দিনের বেলা কাজ করতে হবে। এইটাতে আমি কিছুতেই রাজি ছিলাম না, দিনের বেলার সময়টা আমি সিনেমা দেখতে চাইতাম! (হাসি) কাজেই যাদবপুরে ঢুকলাম! আই এ্যাম ভেরি গ্ল্যাড যে আই জয়েনড যাদবপুর! কারণ ঢোকার দুই মাসের মধ্যেই আই বিকেম ওয়ান অফ দা অরগানাইজিং মেমবারস অফ দা ফিল্ম সোসাইটি। এইভাবেই ছবির জগতে প্রবেশ করা। তবে ছবির জগতে চলে আসায় আমার গানবাজনার গুরু খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। তুমি তো আমার বাজনা শুনেছ, কাজেই আমি যতটুকুই বাজাতে পারি তার বেশিরভাগটাই ওঁর থেকে পাওয়া। আমার গুরুর নাম সুজয় বসু।
যেমন বলছিলাম, আমি কিন্তু বাড়ি থেকে কোনোরকম বাধা পাইনি। মানে আমি যে কারণে এই কথাটা বলছি তা হল আমাদের সোসাইটিতে তো সিনেমা জগতে কাজ করতে যাওয়াকে বিশেষ ভালো চোখে দেখা হয় না! অভীক মুখুজ্জের(সিনেমাটোগ্রাফার) সঙ্গে একদিন আড্ডা হচ্ছিল এই বিষয়ে। অভীক বলছিল, “লোকে কী বলে? লোকে বলে যে আমার ছেলে বা আমার মেয়ে ডাক্তার হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং করছে, আর ফিল্মের জন্য কী বলে? বলে যে আমার ছেলে ফিল্মে নেমেছে!” (অট্টহাসি)
কাজেই দেয়ার ইজ এ সেন্স অফ ডিসেন্ট ইনটু সিনেমা! পরবর্তীকালে না খেয়ে মরবি, এই সেই। আমি কিন্তু তিনজনের থেকে দারুণ এ্যাডভাইস পেয়েছিলাম। মা-কে বলাতে মা বলল, “আমি তো প্রথম থেকেই জানি তুই এইটাই করবি, এত ভাবছিস কেন?”
তারপর বলল, মামাকে জানা। মামা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছিল। বলেছিল, “এটা তো ব্যবসা নয়, প্রফেশন। সিনেমা বানানোর কিছু না জেনেই এইটুকু বলতে পারি যে ভালো তখনই করবে ইফ ইউ এঞ্জয় ওয়াট ইউ ডু! …ভালোবাসা থাকলে যদি কিছু নাও হয়, ইউ উইল বি হ্যাভিং ফান!”
আর দিদি বলেছিল, “দ্যাখো, সিনেমা ভালোবাসা বা সিনেমা দেখে ফেলার সঙ্গে সিনেমা বানানোর বিস্তর পার্থক্য আছে।” এটা আমি নিজে অনেক পরে দেখেওছি। অনেকেই সিনেমা ভালোবেসে সিনেমা বানাতে এসে পরে বুঝতে পেরেছে, সে শুধুই ভালোবাসে। কিন্তু প্রমাণ করতে হবে বলে যা খুশি বানিয়েছে।
কাজেই ওই বয়সে “মাল খেয়ে রাস্তার ধারে নর্দমায় পড়ে থাকবি” না শুনে এই ধরনের বিরল এ্যাডভাইস পেয়েছি, আমি ভাগ্যবান!
রূপক : ফিল্ম ইন্সটিটিউটে জয়েন করলেন কোন সালে?
অর্জুন : ’৮৭তে। সেখানে দু বছরের ফিল্ম এডিটিং কোর্সে পড়াশোনা করলাম। সে সময়ে ওরা তিন বছরের জায়গায় ২ বছরের মডেল চালু করেছিল।
রূপক : ফিল্ম মেকিং-এর কোর্সে না ঢুকে এডিটিং নিয়েই পড়াশোনা করবেন, এটা কি একটা সচেতন সিদ্ধান্ত? মানে আমি একজন লে-ম্যানের তরফে দুটো দিকের পার্থক্যগুলো থেকে বুঝতে চাইছি। একজন নতুন ছাত্র দুটোর মধ্যে কোনো একটাকে আলাদা করে শিখবে কেন?
অর্জুন : দেখো ফিল্ম একটা কালেকটিভ আর্ট! আজকাল যদিও অনেকেই একা হাতে সবটা করছেন, কিন্তু আসলে দে আর ওয়েরিং ফোর অর ফাইভ হ্যাটস এ্যাট ডিফারেন্ট টাইমজ। আমি যখন পুনের ইন্সটিটিউটে ঢুকেছি, আমি শুধু জানতাম যে আমি ছবি বানাতে চাই। কাজেই কোনো একদিকে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা কেম বাই আ প্রসেস অফ এলিমিনেশান। সিনেমাটোগ্রাফি বা সাউন্ডে অ্যাপ্লাই করা সম্ভব ছিল না কারণ তার জন্য তোমায় সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট হতে হবে।
রূপক : এটা বেশ বোকাবোকা মনে হয় না?
অর্জুন : অবশ্যই! কারণ এই ফিল্ম স্কুলগুলো খোলার আগে নামিদামি সিনেমাটোগ্রাফার বা সাউন্ডের মানুষেরা কি সবাই ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি পড়ে এসেছিলেন? তা তো নয়! তবে হ্যাঁ, অন্তত সেলুলয়েডের দিন অবধি একদম বেসিক কেমিস্ট্রির কিছু জ্ঞান থাকা জরুরি ছিল, কিন্তু তা এতই বেসিক যে তার জন্য পি-সি-এম থাকার দরকার পড়ে না। যাই হোক নিয়মের মধ্যে থেকে ওই দুটোয় যাওয়া হল না। সুযোগ থাকলে হয়তো সাউন্ডে যেতে পারতাম, কারণ আমার কাছে শব্দ ভীষণ জরুরি।
পড়ে থাকে পরিচালনা এবং এডিটিং। এইবার ব্যাপার হল, বিগত কিছু বছরে ইয়াঞ্ছো, গোদার থেকে শুরু করে যাবতীয় সমস্ত আঁতেল ছবি আর সিনেমা বিষয়ক বই বেছে-বেছে বার বার করে দেখে এবং পড়ে আমার ধারণা হয় ফিল্ম স্কুল গিয়ে বেসিকিয়ালি ছবি বানানো শেখা হবে না(হাসি)! মানে এই লেভেলের আঁতেল, হ্যাঁ? (আবার হাসি) মালটা ফিল্ম স্কুলে যাওয়ার আগে থেকে জানে, ধোর্, ফিল্ম স্কুলে গিয়ে কিছু হবে না! যেতে হয় বলে যাচ্ছি।
তবে আমি খুশি যে এই আঁতলামোটা ছিল! মানে লোককে চুতিয়া বানানো বলে না, ডিরেকশন কোর্সটা তাই! তুমি একজনকে ব্যাকরণ শেখাতে পারো কিন্তু শেকসপিয়ার হওয়া তো শেখাতে পারবে না!
রূপক : হ্যাঁ, মানে ছবি আকার পদ্ধতি শেখাতে পারেন কিন্তু কী ছবি সে আঁকবে, তা তো শেখানো যাবে না!
অর্জুন : এগজ্যাক্টলি!
ততদ্দিনে স্তানিস্লভসকি থেকে শুরু করে যাবতীয় আঁতেল বই পড়ে এটুকু বোঝা গেছে যে ডিরেকশানের গ্রামার বলতে তেমন কিছু নেই; ইট ইজ আ গ্রামার দ্যাট কন্টিনিউয়াসলি ইভলভস! কারণ আমি সেই মানুষদের মধ্যে পড়ি, যারা বিশ্বাস করে যে ব্যাকরণের বিবর্তন বন্ধ হলে সেই আর্ট ফর্মেরও মৃত্যু হয়!
রূপক : সেটা তো মানুষ থেকে মানুষ, কনশাসনেস থেকে কনশাসনেসে পাল্টাতে থাকবে?
অর্জুন : সেটাই তো! দেশ বা ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গেও বদলে যেতে পারে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ধর আমি সমতলে থাকি আর একজন পাহাড়ে থাকে। যে পাহাড়ে থাকে তার ছবির ভাষা কি আমার মতো হবে? কখনও এক হতে পারে? অসম্ভব! কারণ আমি যখন পাহাড়ে শ্যুট করতে যাব, (আমি সিনেমাটোগ্রাফি ছেড়ে দিয়ে বলছি) আমি যেভাবে পাহাড়কে উপলব্ধি করছি গ্রামারের গতি তো তার সঙ্গেই ইভলভ করবে, তাই না?
রূপক : মানে আপনি কি এইটা বলতে চাইছেন যে, ক্যামেরাকে যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করলেও চোখ বা দৃষ্টিটা তো আমারই?
অর্জুন : কারেক্ট! সেটা একনম্বর। আর দু-নম্বর, আমাদের ভাষায় লেখার ক্ষেত্রে আমরা বাঁদিক থেকে লেখা শুরু করে ডানদিকে যাই, তাই তো? কাজেই আমাদের ‘সাইকে’ ওটা বসে গেছে। নাটকের স্টেজেও এই ওরিয়েন্টেশানটা দেখতে পাবি। আর আমি যদি ডান দিক থেকে বাঁদিকে কিছু করার চেষ্টা করি ইট উইল লিড টু আ ডিজওরিয়েন্টেশান ইন মাই মাইন্ড!
আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গগুলো এতটাই গভীর। এডিটিং-এর নানান বইয়ে দেখবি নিয়ম-টিয়ম লেখা থাকে… ম্যান এন্টার্স ফ্রম লেফট অফ ফ্রেম লিভস ফ্রম দা রাইট। পরের শটেও তাই। তবেই কনটিনুইটি থাকবে। ইংরেজি বইয়ে খুব রেয়ারলি এর উলটোটা লেখা থাকে; কাজেই এই গোটা ব্যাপারটা পুরোপুরি ব্যাক্তিগত!
কাজেই যা বলছিলাম, সুতরাং পড়ে রইল এডিটিং! আর এছাড়াও বার বার ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন দেখাটাও আমায় শিখিয়েছে যে শেষমেশ এডিটিংটাই ছবি তৈরি করে। ওই ছবিটাই আমায় বুঝিয়েছিল যে সিনেমার ভাষা বলে যদি কিছু থেকে থাকে তা হল এডিটিং।
রূপক : আপনি যে ওরিয়েন্টেশানের কথাটা বললেন সেই কন্টেক্সটে মাজিদ মাজিদি বা কিয়ারোস্তামির ছবির ফর্ম কি আলাদা?
অর্জুন : ‘টেস্ট অফ চেরি’র কথা ভাবতে গেলে প্রথমেই তোর কোন দৃশ্যটা মাথায় আসে? জিপটা কোন দিকে পয়েন্ট করছে? বাঁদিকে তো?
রূপক : রাইট!
অর্জুন : একজন ইউরোপিয়ান পরিচালক ছবি বানালে কি দৃশ্যটা একই রকম হত? আই নো দিস সাউন্ডজ সিলি! আর তাছাড়া এটা কখনই একটা সচেতন সিদ্ধান্ত হতে পারে না, তাও ঠিক! এটা শুনে অনেকেই বলতে পারে যে এতো ফালতু আঁতলামো করছে; কিন্তু আমার মনে হয় যে আমাদের লেখার ধরণ আমাদের প্রাইমারি ভিজুয়াল এক্সপেরিয়েন্সের একটা অংশ।
রূপক : এর কোনো এফেক্ট তো শব্দ বা সাউন্ডে থাকার কথা নয়?
অর্জুন : কে বলতে পারে? এই ওরিয়েন্টেশান ব্যাপারটা এতটাই ব্যক্তিগত আর মৌলিক যে, মনের কোথায় কীভাবে এর প্রভাব পড়ছে তা বলা বেশ শক্ত।
অর্জুন গৌরিসারিয়ার ছবি - ময়ূরাক্ষী ব্যানার্জি
Powered by Froala Editor