লকডাউন উঠলেও থেকে যাবে মানসিক বদ্ধতা, জানাচ্ছেন অম্বরীশ দাসগুপ্ত

লকডাউন-পরবর্তী পৃথিবীর ছবিটা ঠিক কেমন হবে? ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলি কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এই সংকট থেকে? করোনার ফলে ভারতের অর্থনীতি কতটা ক্ষতির সম্মুখীন হল? জানালেন ইনটুয়েরি কনসাল্টিং এলএলপি-র সিনিয়র পার্টনার অম্বরীশ দাসগুপ্ত। শুনল প্রহর।

কোভিড-১৯-এর জেরে প্রায় গোটা পৃথিবীব্যাপী লকডাউন চলছে। ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে কবে এই লকডাউন শেষ হবে বলে মনে আপনার মনে হয়? লকডাউন শেষ হলেও আদৌ তা সত্যি শেষ হবে কি?

অম্বরীশ দাসগুপ্ত: লকডাউন সম্পর্কে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার পক্ষে কিছু বলা মুস্কিল।  দেখুন, পৃথিবীতে নানা দেশ নানা ভাবে লকডাউন করছে। ভারত গোটা দেশ লকডাউন করেছে দুই দফায় এবং তুলছে খেপে খেপে। আমেরিকায় কিছু রাজ্যে লকডাউন। রাশিয়া একেবারেই লকডাউন করেনি, সিঙ্গাপুর এক মাসের জন্য করেছে, আবার অনেক রাষ্ট্র লকডাউনের মেয়াদ বাড়াচ্ছে। লকডাউন করা বা শেষ করার ক্ষেত্রে সরকারকে অনেক কটা বিষয় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এটা প্রশাসনিক জটিল বিষয়, কাজেই এ বিষয়ে বলাটা কঠিন। তবে লকডাউনের মধ্যেও একদল মানুষ প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে পথে বেরিয়েছেন, বেড়াচ্ছেন, আবার একদল বেরোননি। যাঁরা বেরোননি, অর্থাৎ ওই অধিক সচেতন জনসংখ্যার মধ্যেও কিন্তু একটা মানসিক লকডাউন কিন্তু থাকবে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও তাঁরা পথে বেরোতে ভয় পাবেন। এছাড়া, লকডাউন আমাদের দেশে উঠলেও অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের যেসব কাজকর্ম হয় তাতে প্রভাব পড়বে। বৈদেশিক সম্পর্কে পরিবর্তন আসবে। লকডাউন উঠলেও বিদেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে, হয়তো ধাপে ধাপে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লকডাউন তোলা হবে। এই লকডাউনের ব্যাপ্তি অত্যন্ত বৃহত্তর। লকডাউন সহজ অর্থে বা ব্যক্তিবিশেষের কাছে হয়তো শুধু গৃহবন্দি অবস্থা, কিন্তু গৃহের সংজ্ঞাটা যদি একটু বাড়িয়ে ভাবি এবং ব্যক্তি ছাপিয়ে ব্যবসায় যাই, তাহলে এই লকডাউন উঠলেও সত্যি অর্থে উঠল না। বড় বাণিজ্য তো দেশ, বিশ্বব্যাপী। মানুষ হয়তো ঘরের বাইরে এল, কিন্তু তার ব্যবসা, পণ্য বা সেবা, রাজ্য বা দেশের বাইরে যেতে পারল না, সে-ও তো এক ধরণের লকডাউনই হল। ব্যক্তির না হলেও বাণিজ্যের লকডাউন। এই অচলাবস্থা কাটতে সময় লাগবে, কারণ এটা শুধু আইনি শিথিলতার প্রশ্ন নয়, জনগণের মানসিক ভরসা ফিরে আসার উপরেও নির্ভরশীল।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কবে এই অতিমারী শেষ হবে, কিছু প্রতিষেধক আসবে, জনস্বাস্থ্য কবে আবার নিরাপদ হবে। কারণ এই বিষয়গুলিই আইনি বা মানসিক লকডাউন প্রত্যাহারের ব্যাপারে প্রধান নির্ণায়ক।

ভারতের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল অসংগঠিত ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রে লকডাউনের প্রভাব কীরকম?

অম্বরীশ দাসগুপ্ত: এই বিষয়টা তো পরিমাপযোগ্য নয়। তবে গুণগত প্রভাব, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুইই সুবিশাল। আমাদের অসংগঠিত ক্ষেত্র দুরকম: একদল স্বনিযুক্ত বা দিন আনি দিন খাই ধরণের কাজে নিযুক্ত, যেমন ঘর-গৃহস্থালির কাজে যারা সাহায্য করেন। আয়া, সবজি বিক্রেতা, গাড়ি চালক, মুটে, কুলি, মালবাহক ইত্যাদি আরও নানা রকম। আরেকদল হয়তো কুটির, ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্পে নিযুক্ত। প্রথম দলকে তো বাড়ি থেকে বের হতেই হবে, তাঁরা অনেকে লকডাউনের মধ্যেও বেরিয়েছেন কারণ তাঁদের কিছু করার নেই। তবে তাঁরা মূলত যাঁদেরকে সেবা দেন তাঁরা হয়তো অপেক্ষাকৃত বেশি সচেতন শ্রেণী। হতে পারে মানসিক লকডাউনের কারণে তাঁরা বাইরের লোকের কাছে ওই সেবা নিতে অস্বীকার করলেন, হতে পারে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অনেক কাজ নিজেরাই করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেক্ষেত্রে ওই প্রথম দল প্রবল অসুবিধার সম্মুখীন হবে। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বলি, এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলি বড় শিল্পের উপর নির্ভরশীল। যদি বড়ো শিল্পে সেভাবে কাজ না হয়, এগুলিও অসুবিধায় পড়বে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলির এখন বাজার পেতে হবে, যেটা চাহিদা না থাকলে তারা পাবে না। বাজার না পেলে এই শিল্পগুলির বাঁচতে, অন্তত কিছুদিন বাঁচতে আর্থিক স্বচ্ছলতা চাই, যেটাকে আমরা বলি লিকুইডিটি অর্থাৎ হাতে টাকার সংস্থান। শিল্পগুলির প্রাপ্য যা টাকা বাজারে পড়ে আছে তা অনাদায়ে এই সময়ে এই লিকুইডিটির অভাব হতে পারে। ব্যাঙ্কের সাহায্য আসছে, আরবিএই প্রদত্ত ঋণ পরিশোধের শিথিলতা হয়তো কিছুটা আর্থিক চাপ কমাবে, কিন্তু তা স্বল্প সময়ের জন্যই। এছাড়া এই সব শিথিলতা কত দ্রুত কার্যকরী হবে বা ক্ষুদ্র শিল্পপতিদের জন্য যথোপযুক্ত হবে কি না সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।  আরবিএই এর ঋণ শোধের নিয়ম শৈথিল্যের সুপ্রভাব এই সব ক্ষুদ্র শিল্পে পৌঁছতে পৌঁছতেও অনেকটা দেরি হয়ে যায়। আর ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করে একটা আপৎকালীন ব্যবস্থা যদি বা করল, চাহিদা তৈরি না হলে দীর্ঘস্থায়ী সুরাহা হবে না।

আমাদের রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাহলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলি খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

অম্বরীশ দাসগুপ্ত: আমাদের রাজ্যের বিচারে বলতে পারি হয়তো অতটা খারাপ তেমন কিছু হবে না। আমাদের বড় শিল্পের অভাব আছে, তাই এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলির উপরেই প্রচুর মানুষ নির্ভরশীল, এগুলির ক্ষতি হলে আমাদের রাজ্যে দারিদ্র্য অনেক বেড়ে যাবে। তাই সরকার থেকে বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে এই ক্ষেত্রটির ভিত মজবুত করা হয়েছে এবং তা সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত ভাবে বাস্তব রূপায়ণ করা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। তাই আমার মনে হয় আমাদের রাজ্যে এই ক্ষেত্রগুলি তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তবে বর্তমান অবস্থায় সরকার হয়তো কিছুদিনের জন্য অর্থ সাহায্য করতে পারে, কিন্তু যদি চাহিদার ঘাটতি হয়, বিশেষত অত্যাবশ্যকীয় পণ্য না হলে, সেক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধার সম্মুখীন তো হতে হবেই।

সরকার হয়তো সেক্ষেত্রে SIDBI এবং অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পে ঋণদানকারী দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করবে যে কীভাবে এই রাজ্যে ক্ষুদ্র শিল্পে বেশি ঋণ আনা যায়। সরকার হয়তো জামিনদার হতে পারে, তাদের হয়ে কোল্যাটেরাল দিতে পারে, দেখতে পারে WBIIDC, WBIFDC জাতীয় সরকারের নিজের আর্থিক সংস্থান করার সংস্থাগুলি কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারে কি না। সেল্ফ হেল্প গ্রুপ সংক্রান্ত সাহায্য যে সমস্ত বিভিন্ন দফতর দিয়ে থাকে, তারা আরও সুচারু ভাবে কী সাহায্য করতে পারে, তা দেখতে হবে। শুধু আর্থিক সাহায্যই নয়, হয়তো বড়ো বেসরকারি ক্ষেত্রগুলিকেও ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পকে আরও প্রশিক্ষণ দিতে সরকারের সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে হাত লাগাতে হবে।  ওই শিল্পগুলিকে জানাতে হবে যে ওদের বাজার কোথায় কোথায় আছে, কিভাবে ওরা কম খরচে সেখানে পণ্য বা সেবা পৌঁছে দিতে পারে। প্রযুক্তি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারে কিনা, যেমন আমাজন, ফ্লিপকার্ট জাতীয় সংস্থার সাথে কোনো ব্যবসায়িক চুক্তি করে ই-বাজারের সুবিধা নেওয়া যায় কিনা দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ, অর্থ সংস্থান তো বটেই, তা ছাড়াও প্রশিক্ষণ, তথ্যপ্রদান, অংশীদারি ইত্যাদি বহুবিধ বহুমুখী সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে এই MSME ক্ষেত্রের প্রতি। তবে এটাও দেখতে হবে এই বিপুল সাহায্যের কেউ অপব্যবহার করছে কিনা, সেক্ষেত্রে সেই সংস্থাকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করতে হবে। অপাত্রে দান করে যাওয়ার বিলাসিতা আমরা এখন দেখাতে পারব না। এর জন্য MSME গুলির মূল্যায়নের সঠিক ব্যবস্থা দরকার।

এই  অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে কী করে বেরিয়ে আসা যেতে পারে? 

অম্বরীশ দাসগুপ্ত: এটা বিশাল প্রশ্ন। সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতে ভাবলে এটার সমাধান হয়তো খানিকটা দেশকেন্দ্রিক হবে। ধরা যাক, GCC দেশগুলির কথা। সেগুলি যদি তৈলনির্ভর হয়, তাহলে এখন বিবিধ কারণে তেলের ব্যবহার ও দাম খুব কমে যাওয়ায় তাদের ওই নির্ভরতা ছাড়াও  অন্য কিছু ভাবতে হবে। তাই বিশ্বব্যাপী সমস্যাটার কথা না ভেবে প্রতিটি রাজ্যের প্রেক্ষিতে উত্তরটা ভাবতে হবে। এই পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসা খুব মুশকিল। তবে আমাদের অন্যান্য জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে, অন্যান্য বাজার দেখতে হবে, দেখতে হবে খুব তাড়াতাড়ি কীভাবে রাজ্যের মধ্যে ক্রয়ের পরিমাণ বাড়ানো যায়, দেখতে হবে বাইরে থেকে যা কিনতাম সেটা আমরা বানাতে পারি কিনা। বড় কোম্পানিগুলিকে বোঝাতে চেষ্টা করতে হবে যদি তারাও তাদের প্রয়োজনীয় উপাদানের কিছু অংশ রাজ্য থেকেই নিতে পারে। অন্য বাজার খুঁজতে হবে, অর্থের যোগান তো আগেই বলেছি, চাহিদা বাড়াতে হলে ভোগ বাড়াতে হবে, মানুষের হাতে টাকা দিতে হবে। প্রত্যক্ষ লাভ হস্তান্তর, নগদ হস্তান্তর, ১০০ দিনের কাজ, MGNREGA এই সব প্রকল্প থেকে প্রাপ্য টাকা সঠিক ভাবে মানুষের হাতে পৌঁছচ্ছে কিনা দেখতে হবে। সরকারকে আরো বেশি রাজস্ব সংক্রান্ত নিয়মানুবর্তিতা দেখাতে হবে। অপ্রয়োজনীয় খরচ বন্ধ করে যেখানে আশু প্রয়োজন সেখানে অর্থ পাঠাতে হবে।

বহু পরিযায়ী শ্রমিক যারা এখন রাজ্যে ফিরে এসেছেন তারা হয়তো আবার বাইরের রাজ্যে কাজ করতে যেতে চাইবেন না। এঁরা সকলেই কিছুতে না কিছুতে কিন্তু পারদর্শী, সেই পারদর্শিতা ব্যবহার করে আমরা কিছু করতে পারি কিনা দেখতে হবে। নতুন দ্রব্য আবিষ্কার করতে হবে। আর্থিক ক্ষেত্র, বেসরকারি ক্ষেত্রকে কাজে লাগাতে হবে। আমার মনে হয় এটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে মূল্যায়ন করার সঠিক সময়। এই সংগঠনগুলিকে ব্যবহার করলে সেগুলি এখন একটি বড়ো ভূমিকা নিতে পারে।

এই করোনা অতিমারী কি আমাদের সবার জীবন একটু বদলে দিল?

 অম্বরীশ দাসগুপ্ত:  সে তো খানিকটা পালটাবেই, যদি পৃথিবীর ইতিহাস দেখা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হোক বা দ্বিতীয়, সমস্ত পৃথিবী খানিকটা পাল্টে গিয়েছে, মানুষের চিন্তাধারার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। সেই সূত্রে এরপর ও আমাদের তো খানিকটা বদলে যেতে হবেই, আমরা অনেক বেশি ভার্চুয়াল বিশ্বের দিকে এগিয়ে যাব। মানুষের সংস্পর্শ এড়াতে চেষ্টা করব। শিক্ষা, প্রয়োজনীয় খাদ্য, দ্রব্য ইত্যাদির অনলাইন যোগান চাইব। অফিসকে হোম অফিসে নিয়ে আসব। সেমিনারগুলি ওয়েবিনার হয়ে উঠবে, বিদেশ যাওয়া কমতে পারে, হয়তো অনেক ব্যবসায়িক বিদেশযাত্রা ভার্চুয়ালি অনলাইনে সারব। এছাড়া নিজস্ব বিনোদন চাইব, টেলিমেডিসিন উঠে আসতে পারে যাতে ক্লিনিক বা ডাক্তারের কাছে যাওয়া কমাতে হয়। আরো বেশি ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং-এর ব্যবহার করব, কারখানাগুলিতে যান্ত্রিকতা ব্যবহার করে শ্রম নির্ভরশীলতা কমাব।

তবে এটাও ঠিক যে বেশ কিছু পরিবর্তন তাৎক্ষণিক হবে, তার পাশাপাশি পুরনো পদ্ধতিও চলবে। মানুষ খানিকটা অভ্যাসের দাস, অত সহজে পুরনো অভ্যাস একদম ছাড়তে না-ও পারে। আর পরিবর্তন হয়তো অনেক বেশি দেখা যাবে অধিকতর আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল শ্রেণীর মধ্যে। আর্থিক ও অন্যান্য ভাবে বঞ্চিত ও অনগ্রসর মানুষেরা হয়তো যা ছিল তাই থাকতে বাধ্য হবে কারণ ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল বিশ্বে বিচরণ করার জন্য যে অর্থ, শিক্ষা বা সামাজিক পরিমণ্ডল দরকার সেটা হয়তো তাদের নেই।