রং-তুলি নয়, তিনি ছবি আঁকতেন ধারালো ছুরি দিয়ে। শোলার কাঠি থেকে তৈরি করতেন মুখোশ। এছাড়াও শোলা দিয়ে তৈরি করতেন নানা গয়না এবং অন্যান্য শিল্পসামগ্রীও। তবে দক্ষিণ দিনাজপুরের মুস্কিপুর গ্রামের মধুমঙ্গল মালাকার (Madhumangal Malakar) বিখ্যাত ছিলেন তাঁর তৈরি মুখোশের জন্যই। এই পেশা পূর্বপুরুষের হাত থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন তিনি। তারপর তাকেই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সারা বিশ্বের দরবারে। ইউরোপ-আমেরিকার নানা দেশে পৌঁছে দিয়েছেন বাংলার এই হস্তশিল্পকে। গতকাল সকালে শিল্পের জগৎ ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিলেন শোলাশিল্পী (Shola Artist) মধুমঙ্গল মালাকার। মাত্র ৬২ বছর বয়সে মৃত্যু হল তাঁর।
বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন মধুমঙ্গল। মাস ছয়েক আগে জানা যায় তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যানসার। কলকাতার চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসকরা অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। কিন্তু রোগ যখন ধরা পড়ে, তখনই অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। ফলে শেষ রক্ষা সম্ভব হল না। শোলাশিল্প বলতে আজও অনেকেই মনে করেন শুধু দুর্গাপুজোর ডাকের সাজ। কিন্তু বাস্তবটা যে তা নয়, সে-কথাই প্রহরকে বলছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত শোলাশিল্পী আশিস মালাকার। তাঁর কথায়, “দিনাজপুর অঞ্চলের শিল্পের ধারাটাই অনেকটা আলাদা। তাঁরা মূলত মুখোশ তৈরির কাজই করেন। আর মধুমঙ্গলের কাজের সৌন্দর্যও ছিল প্রশংসার যোগ্য।”
বাবা তরুণীকান্ত মালাকারের কাছ থেকে কাজ শেখা মধুমঙ্গলের। এরপর মাত্র ২১ বছর বয়সে জাহাঙ্গীর মুম্বাই শহরে জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারির মেলাতে হাজির হয়েছিলেন নিজের পসরা নিয়ে। সেই পথচলার শুরু। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
লন্ডন মিউজিয়াম থেকে শুরু করে ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অফ আর্ট, এডিনবরা থেকে সানফ্রান্সিসকো বা স্কটল্যান্ড থেকে বার্সিলোনাতেও সংরক্ষণ করে রাখা আছে মধুমঙ্গলের হাতের কাজ। মুখোশ তৈরির পাশাপাশি শোলা দিয়ে তাজিয়া, পীরের ঘোড়া, মনসার পট, অথাই পাথায়, দেবদেবীর বুকবন্ধ ইত্যাদি নানা ধরনের কাজই করতেন তিনি। পাশাপাশি শিল্পীদের সংঘবদ্ধ করার ব্রতও নিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গীয় পারস্পরিক সংগঠনের মুখ্য সংগঠক ছিলেন মধুমঙ্গল। এছাড়া দুঃস্থ শিল্পীদের কাছে প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার কাজও করতেন। তাঁর উদ্যোগেই ২০১৭ সাল থেকে কলকাতা প্রেস ক্লাবের প্রাঙ্গনে শুরু হয় গ্রামকৃষ্টি উৎসব। গতমাসে সেই অনুষ্ঠানের আসর থেকেই জীবনকৃতি সম্মান জানানো হয় শিল্পীকে। অবশ্য তিনি তখন গুরুতর অসুস্থ ছিলেন।
আরও পড়ুন
শেষ মুহূর্তের বায়নায় হিমশিম খাচ্ছে বর্ধমানের 'শোলা শিল্পগ্রাম'
বাংলার শিল্পকলাকে দেশবিদেশের নানা প্রান্তে জনপ্রিয় করে তুলতে চেয়েছিলেন মধুমঙ্গল। কাজ করেছেন মুম্বাই ফিল্ম ডিভিশনের সঙ্গেও। নিজের এবং অন্যান্য সহশিল্পীদের কাজকে আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য তো ছিলই। সেইসঙ্গে অন্যান্য হস্তশিল্পীদের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতেও চেয়েছিলেন মধুমঙ্গল। বিদেশের মাটিতে বাংলার শোলাশিল্প যথেষ্ট সম্মান পেলেও আজও বাংলার বুকে এই শিল্পের যথেষ্ট বাজার তৈরি হয়নি। এই আক্ষেপ ছিল সারাজীবন। সেই বাজার তৈরি করার লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন মধুমঙ্গল। তাঁর মৃত্যুতে সেই কাজ যে অনেকটাই থমকে গেল, সে-কথা বলাই বাহুল্য। প্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সেই বাজার তৈরি করতে পারলে শিল্পীর স্বপ্ন পূরণ হবে। সেইসঙ্গে হারিয়ে যাওয়ার মুখ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বাংলার হস্তশিল্পও।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কাজের বরাত সামান্যই, পুজোর মুখে ধুঁকছে বাংলার ‘শোলাশিল্প গ্রাম’ বনকাপাশি