৩৪ জন প্রকাশক নিয়ে বইমেলার শুরু, মেলা চত্বরেই মারা যান আনন্দবাজারের সম্পাদক

কথায় বলে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। কিন্তু এর বাইরেও যে আরেকটি পার্বণ রয়েছে— বই পার্বণ! আর জানুয়ারি মাস এলেই বাঙালি মেতে ওঠে এই পার্বণের আসল অনুষ্ঠানে। হ্যাঁ, বইমেলা। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বইপোকাদের মিলনস্থল হয়ে রয়েছে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। এই বছরের মেলাও শুরু হয়ে গেছে সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কে। জাঁকজমকের মাঝে, কোথাও এখনও উঁকি মারে পুরনো ইতিহাস। যা ফেলে ফেলে, ক্রমশ এগিয়ে গেছে এই বইমেলা।

সালটা ১৯৭৪। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে আড্ডায় বসেছে একদল তরুণ সাহিত্যপ্রেমী, প্রকাশক। কথা চলছিল বাংলা বইয়ের বিক্রি নিয়ে, প্রকাশনা জগত নিয়ে। আরও কী করে বাংলা বইকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, সেই আলোচনাই চলছিল। কথায় কথায় উঠে এল ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার প্রসঙ্গ। কফি হাউসে বসেই ঠিক হল, কলকাতাতেও এরকম একটি বইমেলার আয়োজন করা হবে।

তখন থেকেই পথ চলা শুরু। ১৯৭৫-এ তৈরি হল ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড’। প্রথম সভাপতি হলেন সুশীল মুখোপাধ্যায়। শুরুর দিকে এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যেমন ছিলেন অনেকে, তেমনই বিরোধিতার লোকেরও কভার ছিল না। কিন্তু থামেনি এই উদ্যোগ। অবশেষে, ১৯৭৬ সালে শুরু হয় প্রথম কলকাতা বইমেলা। ৫ মার্চ থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত চলেছিল এই মেলা। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের উল্টোদিকে, আজ যেখানে মোহরকুঞ্জ অবস্থিত, সেখানেই বসেছিল এই আসর।

প্রথম বছর থেকেই ঘটনাবহুল ছিল কলকাতা বইমেলা। মেলার প্রথম সভাপতি ছিলেন শ্রীশকুমার পণ্ডা। সেইবার বৃষ্টিতে বইমেলার কিছু জায়গায় জল জমল। জল যাতে বেরিয়ে যায়, সেটা নিয়ে চেষ্টা-চরিত্র চলছে। এর মধ্যেই সেই কাজে হাত লাগালেন স্বয়ং সভাপতি শ্রীশবাবু। জামা টামা খুলে, স্রেফ একটি গেঞ্জি গায়ে মাঠে নেমে পড়লেন তিনি। কঞ্চি দিয়ে জল বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করছেন। মাঝে মাঝে বাইরেও বেরিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে ঢুকতে গেলে আটকে দিচ্ছে নিরাপত্তাকর্মীরা। গেঞ্জি পড়ে বইমেলায় এসেছে, নির্ঘাত টিকিট নেই! তাদের বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল এটা বুঝতে যে, ওই গেঞ্জি পরা, জল-কাদা মাখা লোকটিই আসলে মেলার সভাপতি!

প্রথম মেলায় ৩৪ জন প্রকাশক ও ৫৪টি স্টল ছিল। অনেকেই অংশ নেননি এতে। কিন্তু পরের বছর থেকেই বইমেলার ভোল বদলে যায়। প্রকাশক ও স্টলের সংখ্যাও যেমন বাড়তে থাকে, তেমনই বাড়তে থাকে পাঠকদের ভিড়ও। বই বিক্রিও বাড়তে থাকে সমান ভাবে।

১৯৮৩ সালে বইমেলায় উপস্থিত হয়েছিলেন আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল। মেলা দেখে মুগ্ধ হন তিনি। সেই বছরই কলকাতা বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হয় ‘আন্তর্জাতিক’ তকমা। গোটা পৃথিবীর বইমেলার ক্যালেন্ডারে যুক্ত হয় আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার নাম।

সে-বছরই মেলায় ‘যাযাবরের অমনিবাস’ বইটি উদ্বোধন করতে এসেছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক অশোককুমার সরকার। মঞ্চে উঠেছেন, এমন সময়ই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন তিনি। হার্ট অ্যাটাক! সঙ্গে সঙ্গে পি জি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। মেলার মঞ্চেই মারা গিয়েছিলেন অশোকবাবু।

যত সময় যেতে থাকে, মেলার পরিধি ততই বাড়তে থাকে। ফলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বইমেলা সরতে থাকে। ১৯৮৮ সালে পার্ক স্ট্রিটের কাছে ময়দানে চলে আসে বইমেলা। তারপর থেকে ময়দান আর বইমেলা যেন সমার্থক হয়ে যায়। এখনও বহু মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে ময়দানের বইমেলার কথা।

বইমেলার অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে থাকে ‘ফোকাল থিম’। এই ব্যাপারটি শুরু থেকে ছিল না। ১৯৯১ সালে প্রথম ফোকাল থিম দেখে কলকাতা বইমেলা। প্রথমবার থিম হিসেবে ছিল আসাম। ১৯৯৪ সালে প্রথমবার অন্য একটি দেশ ফোকাল থিম হিসেবে উঠে আসে। সেবার উঠে এসেছিল জিম্বাবোয়ে। পশ্চিমবঙ্গও একবারের জন্য ফোকাল থিম হয়েছিল, ১৯৯৫ সালে।

এরপর, ১৯৯৭ সাল। যে সাল বইমেলা কখনই ভুলতে পারবে না। সেই বছর বইমেলার ফোকাল কান্ট্রি ছিল ফ্রান্স। উদ্বোধনে এসেছিলেন জাক দেরিদা। দিব্যি চলছিল মেলা। কিন্তু ষষ্ঠ দিনে, মেলায় ঘটে যায় অগ্নিকাণ্ড। এক লাখেরও বেশি বই এক লহমায় পুড়ে ছাই! বহু প্রকাশনার স্টলও পুড়ে গিয়েছিল। ঘটনাস্থলেই হৃদরোগে মারা যান একজন। তিনদিনের মধ্যে আবার স্টল তৈরি করে মেলা শুরু হয়েছিল। যিনি মারা গিয়েছিলেন, সেই যতীন শীলের স্মরণে আজও মেলায় নীরবতা পালন করা হয়। সেই অগ্নিকাণ্ডের পর পেরিয়ে গেছে আরও অনেকগুলো বছর। কিন্তু সেই ক্ষত থেকে গেছে আজও। আর তার পরের বছরই, প্রবল বৃষ্টিতে আবারও ক্ষতির মুখে পড়েছিল বইমেলা।

এরই মধ্যে সামনে উঠে আসে পরিবেশ সংক্রান্ত বিবাদ। ময়দানে কোনোরকম মেলা করা যাবে না বলে ঘোষণা করে কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু মেলার গুরুত্ব ও তার আন্তর্জাতিক প্রভাবের কথা চিন্তা করে প্রাথমিকভাবে ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু ২০০৭ সালে পরিবেশপ্রেমীদের আন্দোলনের জেরে ময়দানের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছেদ ঘটে বইমেলার। এরপরই বইমেলা চলে আসে পার্ক সার্কাস ময়দানে। কিন্তু সেখানেও উঠে আসে পরিবেশ সংক্রান্ত প্রশ্ন। ফলে, সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যায় সেই বছরের মেলা। যুবভারতী স্টেডিয়ামে বিকল্প একটি মেলার আয়োজন করা হয় বটে, কিন্তু সেটা সাফল্য পায় না।

২০০৯ সাল থেকে বইমেলার ঠিকানা হয় সায়েন্স সিটির উল্টোদিকের মিলনমেলা প্রাঙ্গণে। ২০১৮ সাল থেকে এই মেলা চলে আসে সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কে। প্রতি বছর প্রচুর প্রকাশকদের সমাবেশ ঘটে এই মেলায়। জমজমাট থাকে লিটল ম্যাগাজিনও। চার দশক ধরে কত ঘটনার সাক্ষী থেকেছে, কত কবি-সাহিত্যিকের জন্ম দেখেছে এই মেলা। আবার হারিয়েওছে অনেককে। সবাইকে নিয়ে আজও বেড়ে চলেছে এই প্রাণের মেলা।

তথ্যসূত্র-
১) The Statesman, Kolkata Book Fair: A look at over 4-decade history of Boi Mela
২) উইকিপিডিয়া
৩) কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর, সবিতেন্দ্রনাথ রায়
৪) খবর অনলাইন, কফি হাউজের আড্ডা থেকে বিশ্বের দরবারে