চোখে অদম্য খিদে। সম্বল হার না মানার মানসিকতা। মুহূর্তের মধ্যেই প্রতিপক্ষের পরিচলনকে প্রতিহত করে, ছুঁড়ে দেওয়া পাল্টা চ্যালেঞ্জ। ম্যাচের পর ম্যাচ এভাবেই প্রতিপক্ষের কাছে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। বাংলা তথা ভারতকে গর্বিত করেছিলেন পরিমল। পরিমল সিংহ। ক্রিকেটপ্রেমী আমজনতার কাছে খুব এক পরিচিত নন তিনি। তবে ভারতীয় ক্রীড়া পরিসংখ্যান ঘাঁটলেই উজ্জ্বল হয়ে এই নামটা।
প্রতিপক্ষের কাছে, প্রতিবন্ধকতার কাছে কোনোদিন নতজানু না হলেও শেষ অবধি হার মানলেন বেকারত্বের কাছে। হ্যাঁ, অর্থাভাব এমনভাবেই চেপে ধরেছিল তাঁকে। অর্থাভাব থেকে মুক্তির পথ হিসাবে শেষমেশ স্বেচ্ছামৃত্যুকেই তাই বেছে নিলেন শিলিগুড়ির এই তরুণ, ভারতের অন্যতম প্রতিভাবান আন্তর্জাতিক জুডো এবং ক্যারাটে খেলোয়াড়। বয়স হয়েছিল মাত্র ২৪ বছর।
জন্মগত বধির পরিমল। তবুও জুডো বা ক্যারাটেতে অন্যদের থেকে এতটুকুও কম ছিলেন না তিনি। অপ্রতিরোধ্য মনোভাবই তাঁকে জেলা, রাজ্যস্তর থেকে পৌঁছে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মঞ্চে। বাংলাদেশ, নেপাল এবং মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন পরিমল। তিনবারই ফিরেছিলেন মাথা উঁচু করে, চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় পরে।
ছোটবেলাতেই বাবার অকাল মৃত্যু একপ্রকার তাড়া করেই বেড়াত পরিমল সিংহকে। খেলার পাশাপাশিই তাই কাজের সন্ধান করছিলেন তিনি দীর্ঘদিন ধরেই। চব্বিশের কোঠা পার করে যাওয়ায় বাড়ছিল সাংসারিক দায়িত্বও। অর্থের টানাপোড়েন ছিলই, তা-ই যেন আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল এই লকডাউনে। গত কয়েক মাসে নিজেও মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন চাকরির অভাবে। তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল বেকারত্ব। বেশ কয়েক জায়গায় ঘুরেও সংস্থান হয়নি কিছু।
শেষ অবধি অনটনের সঙ্গে এই লড়াইটারই ফাইনাল হুইসল বাজল গত ১৮ সেপ্টেম্বর। মুখ নামিয়ে নিজেই যেন রিং থেকে সরে এলেন লড়াকু যোদ্ধা। তাঁর ঘরের দরজা খুলেই উদ্ধার করা হয় ঝুলন্ত দেহ। শনিবার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে ময়নাতদন্তের পর শিলিগুড়িতেই আত্মীয়-পরিজনরা চোখের জলে বিদায় জানান সোনার ছেলেকে। সমবেদনা জানিয়েছেন শিলিগুড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকরাও।
ভারতে বেকারত্ব মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে। চাকরি, অর্থাভাব রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার যুবক-যুবতীর। তাঁরা হয়তো কেউ কেউ পরিমলের মতোই বেছে নিচ্ছেন লড়াই থেকে সরে আসার পথ। এই ক্ষেত্রেও যেমন সরকারের ভূমিকা প্রশ্নের সামনে, তেমনই প্রশ্ন উঠছে আন্তর্জাতিক একজন খেলোয়াড়ের প্রতি সরকারের দায়িত্ব নিয়েও। এর আগেও বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়কে দেখা গেছে অর্থাভাবের শিকার হতে। কেউ হয়তো অলিম্পিকের মঞ্চ থেকে ফেরার পরও বেছে নিয়েছেন পরিচারিকার কাজ। কারোর হয়তো দিন কাটে স্রেফ কায়িক শ্রমেই। দেশকে বিশ্বের মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করে তোলা প্রতিভারা কি এভাবেই উপেক্ষিত হবেন? এভাবেই কি অর্থের অভাবে ‘ফুরিয়ে’ যাবে প্রতিভারা? জানা নেই এর শেষ কোথায়...
আরও পড়ুন
যুদ্ধের সমাপ্তি, প্রয়াত ভারতীয় সংস্কৃতির ‘রণনেত্রী’ কপিলা বাৎসায়ন
Powered by Froala Editor