তপ্ত রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মাঠে কোদাল চালাচ্ছেন এক যুবক। কখনও আবার চারা লাগাচ্ছেন ধানের। তাঁর পেটানো চেহারা, পেশির গড়ন যেন প্রতি মুহূর্তে ইঙ্গিত দিচ্ছে তিনি একজন খেলোয়াড়। হ্যাঁ, সাধারণ কোনো খেলোয়াড় নন। তিনি আন্তর্জাতিক একাধিক প্রতিযোগিতায় ভারতের প্রতিনিধিও বটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, জীবিকা উপার্জনের জন্য লাঙল ধরতে হচ্ছে তাঁকে।
অবাক লাগলেও এমনটাই কঠিন বাস্তব। শ্রীকৃষ্ণ মাহাতো (Shrikrishna Mahato)। নামটা চেনা ঠেকছে না নিশ্চয়ই? আসলে ক্রিকেট, ফুটবল ছাড়া সার্বিকভাবে আর কোন খেলারই বা খবর রাখে বাঙালি! ক্রীড়াজগতের খুঁটিনাটি খবরাখবর মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়ও অনেক সময় এড়িয়ে যায় সংবাদমাধ্যমও। ঠিক সেভাবেই উপেক্ষিত হয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ। অথচ, মেদিনীপুরের (Midnapore) গোয়ালতোড়ের এই অ্যাথলিটের (Athlete) পদক সংগ্রহ দেখলে চমকে উঠবেন আপনিও।
২০০৭ সাল থেকে বাংলার হয়ে জাতীয় গেমসে খেলে আসছেন শ্রীকৃষ্ণ। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াজগতে অভিষেক ২০১২ সালে। ওয়ার্ল্ড ডেফ অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম ভারতের হয়ে মাঠে নামা। ২০১৭ সালে ডেফ অলিম্পিক গেমসে রিলে রেসে ভারতের হয়ে সপ্তম স্থান দখল করেছিলেন তিনি। ঝুলিতে রয়েছে রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতার ৮৩টি স্বর্ণপদক, ১৬টি রৌপ্য পদক। জাতীয় স্তরের ৩১টি স্বর্ণপদক। দৌড় এবং সাঁতার— উভয়ক্ষেত্রেই বাংলা ও ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। অথচ, তারপরেও খোলেনি ভাগ্য।
আরও পড়ুন
হাত দিয়ে হেঁটে গিনেস রেকর্ড মার্কিন অ্যাথলিটের
ছোটোবেলা থেকেই দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই চলে আসছে পশ্চিম মেদিনীপুরের এই তরুণের। না, আদর্শ খেলোয়াড় হয়ে ওঠার মতো কোনো সুবিধাই পাননি তিনি। পাননি উপযোগী ডায়েটও। ভাতের মাড় খেয়ে দিনের পর দিন তাঁকে ঘাম ঝরাতে হয়েছে মাঠে। সেইসঙ্গে শুনতে বা কথা বলতে না পারার মতো প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই ফুল ফুটিয়েছেন অ্যাথলেটিক্সের মাঠে। আর দেশ এবং রাজ্যকে এত এত পদক এনে দেওয়ার প্রতিদান?
আরও পড়ুন
হাসপাতাল থেকে ফিরেই জোড়া স্বর্ণপদক মার্কিন অ্যাথলিটের
না, প্রশাসনের থেকে কোনোরকম আর্থিক সুবিধাই পাননি শ্রীকৃষ্ণ। এখনও পদক কিংবা ট্রফি ঘরে আনলেই নিয়ম করে সংবর্ধনা পান তিনি। পুষ্পস্তবক দিয়ে বরণ করেন প্রশাসনিক প্রধানরা। কিন্তু তাতে কি পেট চলে? বিগত কয়েক বছর ধরেই একাধিকবার রাজ্য ও কেন্দ্রের কাছে চাকরির জন্য দ্বারস্থ হয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি কোনো। এমনকি খালি হাতে ফিরতে হয়েছে ‘সাই’, অর্থাৎ স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার দপ্তর থেকে। স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে মূক ও বধিরদের জন্য কোনোরকম প্রকল্পই নেই তাদের দপ্তরে!
আরও পড়ুন
১৮ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা হয়েও অলিম্পিকের মনোনয়ন পর্বে আমেরিকার অ্যাথলিট
শেষ সম্বল বলতে, এখন টিকে রয়েছে দেড় বিঘা জমি। আর একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। নিজের অনুশীলন, কৃষিকাজ সামলে অবসর সময় মিললে সেই দোকানেই হাজির হন শ্রীকৃষ্ণ। সাহায্য করেন মাকে। খেলার জন্য বাইরে থেকে অনুশীলনও অধিকাংশ সময়ে সম্ভব হয়ে ওঠে না অর্থের অভাবে। গ্রামের মানুষরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও, তা সামান্যই। এভাবে আর কতদিন? এই প্রশ্নই যেন বার বার ঘুরে ফিরে আসে শ্রীকৃষ্ণের কাছে।
প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং পরিস্থিতির শিকার হয়ে ক্রমশ যেন অনিশ্চয়তা এবং হতাশার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছেন বাংলার প্রতিভাবান এই খেলোয়াড়। সম্প্রতি, বাধ্য হয়েই সাহায্যের জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে বেছে নিয়েছেন তিনি। এখন দেখার তাঁর এই কাতর আর্তি প্রশাসনের কানে আদৌ পৌঁছায় কিনা…
Powered by Froala Editor