সারা দেশ যেন পরিণত হয়েছে শ্মশানে। আগুন নেভার বালাই নেই। একের পর এক মৃত্যুসংবাদ ভেসে আসছে দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকেই। সেইসঙ্গে চূড়ান্ত স্বাস্থ্য সংকট। যেন চিকিৎসাক্ষেত্রে চলছে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা। কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গ কার্যত ওলোট-পালোট করে দিয়েছে ভারতকে। গত মঙ্গলবারই দৈনিক সংক্রমণের নিরিখে আমেরিকার রেকর্ড পেরিয়ে গিয়েছে ভারত। তারপরেও ক্রমশ বেড়ে চলেছে দৈনিক সংক্রমণের ঊর্ধ্বসীমা। কিন্তু এই হঠাৎ ‘প্লাবন’-এর কারণ কী? এবার সেই উত্তর খুঁজলেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
জেফ্রি জেটলম্যান। ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকার দক্ষিণ এশিয়ার বিউরো-চিফ সম্প্রতি ভারতের কোভিড পরিস্থিতির এই হঠাৎ অবনমনের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায়। মহামারীর একদম শুরু থেকে নয়া দিল্লিতে থেকেই গোটা অবস্থাটির পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। আর তার প্রেক্ষিতেই ভারতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিশ্লেষণ তাঁর।
গতকাল নিয়ে টানা চারদিন দৈনিক সংক্রমণের মাত্রা ছাড়িয়েছে ৩ লক্ষের গণ্ডি। তবে এই ‘স্পাইক’ কোনো তাৎক্ষণিক ঘটনা নয়। বরং এর সূত্রপাত হয়েছিল মাস দুয়েক আগেই। এমনটাই জানাচ্ছেন জেটলম্যান। আর স্বাভাবিকভাবেই এই পরিস্থিতির জন্য তিনি বিঁধেছেন ভারতীয় প্রশাসনকেই। ভারত সরকার বরাবরই উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছে বলে দাবি তাঁর। আর এই পিছনে দায়ী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের কিছু ভ্রান্ত ধারণা, আত্মবিশ্বাস এবং কুসংস্কার।
উদাহরণ স্বরূপ ২০২০-র ফেব্রুয়ারি-মার্চের কথা তুলে আনেন জেটলম্যান। ইতালি, ফ্রান্স-সহ পশ্চিমি দেশগুলিতে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়লেও বেশ নিশ্চিন্তেই ছিল ভারত। দেশের মানুষের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে, এমনই এক ভ্রান্ত ধারণার ওপর ভর করেই সিধান্ত নিতে অনেক দেরি করা প্রশাসন। তাই, কড়া লকডাউনের পথে হাঁটলেও শেষ পর্যন্ত দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে সংক্রমণ।
আরও পড়ুন
তাঁদের সুরেই অভিষেক কুমার শানুর, করোনায় ছিন্ন নাদিম-শ্রাবণ জুটি
এমনকি তাঁর দাবি, পূর্ব-পরিকল্পনাতেও যথেষ্ট ঘাটতি ছিল সরকারের। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য জেটলম্যান দুষেছেন পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরাকেই। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এত বড়ো গণ-পরিযায়ন ভারত আর কখনো হয়নি, সেই তথ্যই তুলে আনেন তিনি। পরিযায়ী শ্রমিকদের হাত ধরেই দেশের বড়ো বড়ো শহর তথা হটস্পটগুলি থেকেই প্রান্তিক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল ভাইরাস। প্রশস্ত করেছিল গণ-সংক্রমণের পথ। ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই এই স্পাইক রুখতে পারত সরকার, জানাচ্ছেন জেটলম্যান। তদুপরি, মাস কয়েক কড়া লকডাউন থাকলেও অর্থনীতির হাল ফেরাতে তুলে নেওয়া হয় বিধি-নিষেধ। সাময়িকভাবে সে সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা কমলেও, তার প্রভাব দায়ী দ্বিতীয় তরঙ্গের জন্য।
আরও পড়ুন
করোনাকালে গৃহহীন ইংল্যান্ডের ৭ লক্ষ পরিবার!
আইনি শিথিলতার কারণে অধিকাংশ অঞ্চলেই মাস্কের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল ভারতীয় নাগরিকরা। সেইসঙ্গে মহামারীকে তুচ্ছ করেই সরকার ছাড়পত্র দেয় বৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ এবং নির্বাচনী প্রচারে। এই সিদ্ধান্তই শেষ পেরেক পুঁতে দেয় ভারতের কফিনে। যা ত্বরান্বিত করে অতিসংক্রামক ডবল মিউট্যান্ট ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়াকে।
আরও পড়ুন
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় না মস্তিষ্ক, প্রমাণ দিলেন গবেষকরা
পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অভাবকেও কাঠ গড়ায় দাঁড় করিয়েছেন জেটলম্যান। কারণ, হাসপাতালে শয্যা, অক্সিজেন-ভেন্টিলেশনের অভাবের পাশাপাশি ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করতেও ব্যর্থ ভারত। এখনও পর্যন্ত ভ্যাকসিনের ন্যূনতম একটি ডোজ পেয়েছেন মাত্র ৯ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে পর্যাপ্ত টেস্টের অভাবের কারণে, আরও দু-তিন সপ্তাহ টানা বৃদ্ধি পাবে আক্রান্তের সংখ্যা, এমনটাই দাবি তাঁর। তবে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরিসংখ্যান মডেল বিশ্লেষণ করিয়ে তিনি পূর্বাভাস দিচ্ছেন, কয়েক সপ্তাহ পরে হঠাৎই প্রকোপ কমে আসবে কোভিডের। কিন্তু ততদিন দ্বিতীয় তরঙ্গের এই ধাক্কাকে কি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে ভারত? এই প্রশ্নই ঘুরে-ফিরে আসছে বার বার।
তবে বাড়ির বাইরে মাস্কের সঠিক ব্যবহার এই পরিস্থিতিকে দ্রুত আয়ত্তে আনতে পারে বলেই ধারণা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের। ভার্জিনিয়া টেকের গবেষক ডঃ লিনসি মার জানাচ্ছেন, ভাইরাসের কণা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে হাওয়ায়। ফলে দূরত্ব বিধি ও মাস্কের ব্যবহার করলেই পথচলতি মানুষের থেকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায় অনেকটাই। এই হার আরও কমানো যেতে পারে ভ্যাকসিনেশনের মাধ্যমে। তবে সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি বাড়ির মধ্যেই। কারণ, সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যমে সামনের জন আক্রান্ত হন ভাইরাসে। আর সেই কারণেই বাড়ির মধ্যেও দূরত্ববিধি ও মাস্ক ব্যবহারের জন্য জোর দিতে বলছেন তাঁরা। মারণ ভাইরাসকে আটকানোর জন্য প্রতি নাগরিকদেরই যে সচেতন হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে প্রতি পদে, তা আর নতুন করে বলার নয়। একমাত্র সেই সচেতনতাই হারাতে পারে মহামারীকে…
Powered by Froala Editor