সে অনেকদিন আগের কথা। এক পরিবারে দুটি বউ ছিল৷ ছোট বউ ছিল খুব লোভী৷ বাড়ির মাছ বা অন্যান্য ভালো খাবার রান্না হলেই সে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে নিত আর শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করত ‘সব কালো বেড়ালে খেয়ে নিয়েছে ’৷ বেড়াল মা ষষ্ঠীর বাহন৷ তাই বেড়াল, মা ষষ্ঠীর কাছে অভিযোগ জানাল৷ মা ষষ্ঠী রেগে গেলেন৷ যার জেরে ছোটো বউ-এর একটি করে সন্তান হয় আর মা ষষ্ঠী তার প্রাণ হরণ করেন৷ এইভাবে ছোটো বউয়ের সাত পুত্র ও এক কন্যাকে মা ষষ্ঠী ফিরিয়ে নেন৷ ফলে স্বামী, শাশুড়ি ও অন্যান্যরা মিলে তাকে ‘অলক্ষণা’ বলে গালিগালাজ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়৷ অথচ বড় বউ পুত্রকন্যাদের নিয়ে সুখে ঘর করতে থাকে ৷
ছোট বউ মনের দুঃখে বনে চলে যায় ও একাকী কাঁদতে থাকে৷ শেষে মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার ছদ্মবেশে তাঁর কাছে এসে কান্নার কারণ জানতে চান৷ সে তার দুঃখের কথা বলে৷ তখন মা ষষ্ঠী তার পূর্বের অন্যায় আচরণের কথা বললে সে মাফ চায় ৷ ষষ্ঠী তাকে ক্ষমা করেন| এরপর বলেন — ভক্তিভরে ষষ্ঠীর পুজো করলে সাতপুত্র ও এক কন্যার জীবন ফিরে পাবে৷ তখন ছোট বউ সংসারে ফিরে এসে ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করে ও ক্রমে ক্রমে তার পুত্র কন্যাদের ফিরে পায় ৷ এর থেকে দিকে দিকে ষষ্ঠী পুজোর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে৷
এদিকে বৌয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি তাঁকে বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তাঁর মা-বাবা দিনের পর দিন মেয়ের মুখ দেখতে পান না। শেষে মেয়েকে দেখতে উন্মুখ মা-বাবা একবার ষষ্ঠীপূজার দিন শ্বশুরবাড়িতে আসার জন্য জামাইকে সাদরে নিমন্ত্রণ জানান। এ নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করার সাধ্যি জামাইয়ের ছিল না। ষষ্ঠী পূজার দিন শ্বশুরবাড়িতে জামাই সস্ত্রীক উপস্থিত হলে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
ষষ্ঠীপূজা রূপান্তরিত হয় জামাইষষ্ঠীতে।
আরও পড়ুন
‘দু-চারটে ভালো খিস্তি দিও তো আমায়’, জামাইষষ্ঠীতে দাবি শ্বশুরমশাই-এর
আসল ঘটনা একটু অন্যরকম। ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একসময় সংস্কার ছিল কন্যা যতদিন না পুত্রবতী হয় ততদিন কন্যার পিতা বা মাতা কন্যাগৃহে পদার্পণ করবেন না৷ এই ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিল —সন্তানধারণে সমস্যা হলে বা সন্তান মৃত্যুর (শিশুমৃত্যু তখন প্রচুর হত) ফলে কন্যার পিতামাতাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত কন্যার বাড়ি যাওয়ার জন্য ৷ সেক্ষেত্রে বিবাহিত কন্যার মুখদর্শন কীভাবে ঘটে? তাই সমাজের বিধানদাতা জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীকে বেছে নিলেন জামাই ষষ্ঠী হিসাবে৷ যেখানে মেয়ে জামাইকে নিমন্ত্রণ করে সমাদর করা হবে ও কন্যার মুখ দর্শন করা যাবে৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই নিয়ম একটু এদিক ওদিক করে এখনও চলছে একইভাবে...
আরও পড়ুন
শ্বশুরমশাইয়ের চোয়াল নাকি ‘ঘোড়ার মতো দীর্ঘ’, হিসেব কষে ষষ্ঠীতে যেত জামাই
মিষ্টির সঙ্গে জামাইদের বহুকালের সম্পর্ক। দ্বারকানাথ বিদ্যারত্ন তাঁর কবিতাকুসুমাঞ্জলি বইয়ের প্রথম খণ্ডে লিখেছেন বিয়েতে কে কী চায়? তাতে বলা হচ্ছে, কন্যা চায় বরের রূপ, মাতা চান জামাইয়ের ধন, পিতা চান পাত্রের জ্ঞান, বান্ধবরা দেখেন পাত্রের কুল আর জনগণ মিষ্টি পেয়েই খুশি, মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ।
আরও পড়ুন
বাংলার জামাই তিনি, ভোজনরসিক ও নেশায় ব্যোম - ‘ভুঁড়িওয়ালা’ শিবকে এভাবেই আপন করেছি আমরা
সূর্য মোদকের জলভরা সন্দেশের গল্প সবাই জানেন। তবু একবার বলেই দিই। তখন ১৮১৮ সাল। বাংলায় তখন ইংরেজ শাসন চালু হলেও আনাচেকানাচে দু-চারটে জমিদারি তখনও টিকে আছে বহাল তবিয়তে। আয় যেমনই হোক, আদবকায়দায়, ঠাটেবাটে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা পুরোপুরি বর্তমান। এমনই এক জমিদার ছিলেন ভদ্রেশ্বরের তেলিনীপাড়ার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। বাড়ির মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পরে মেয়ে এসেছে বাপের বাড়ি জামাই নিয়ে জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে। তখন আবার জামাইঠকানো বা বউঠকানো বহু প্রথা চালু ছিল। এখন সেগুলো বোকা বোকা মনে হলেও তখন এইসব প্রথা রমরম করে চলত। সে যাই হোক, জামাইকে ঠকাতে হবে। কী করা যায়? ঠকানোও হল আবার জামাই বাবাজীবন রাগও করতে পারলেন না, এমন কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।
অনেক ভেবে তেলিনীপাড়ার জমিদারবাড়িতে তলব হল এলাকার নামকরা ময়রা সূর্যকুমার মোদকের। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হল এমন একটা মিষ্টি বানাতে হবে যা দিয়ে জামাই ঠকানো যাবে অথচ তাঁর মানসম্মান যেন কোনওভাবেই ক্ষুণ্ণ না হয়। বহু ভাবনাচিন্তা করার পর মোদক মহাশয় একটা বিশাল আকারের মিষ্টি বানালেন, যার ভেতরে জল ভরা থাকে, অথচ বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোনো উপায়ই নেই। সেই মিষ্টি দেওয়া হল জামাইয়ের পাতে। মিষ্টিতে মাতোয়ারা জামাই সেই মিষ্টি হাতে নিয়ে দিলেন বিশাল এক কামড়। আর যেই না কামড়ানো, মিষ্টির ভেতরের লুকোনো জল বেরিয়ে এসে ভিজিয়ে দিল জামাইয়ের সাধের গরদের পাঞ্জাবি। জামাই অপ্রস্তুত। হো হো করে হেসে উঠলেন শালা-শালিদের দল। ঘোমটার আড়ালে হাসিতে ভরে উঠল শাশুড়িদের মুখ আর জমিদারবাবু গোঁফে দিলেন তা। জন্ম হল জলভরার।
ধর্মচর্চার পীঠস্থান হওয়ার জন্য গুপ্তিপাড়াকে 'গুপ্ত বৃন্দাবন' বলা হত। ক্রমে 'গুপ্ত বৃন্দাবন পল্লী', তার থেকে 'গুপ্ত পল্লী' এবং পরিশেষে গুপ্তিপাড়া নাম হয়। কথিত আছে যে গুপ্তিপাড়াতেই সন্দেশের জন্ম। এখানেই প্রথম তৈরি হয় সন্দেশের মিশ্রণ, যা মাখা সন্দেশ নামে পরিচিত। পরে সেই মাখা সন্দেশকেই আকার দিয়ে তৈরি হয় গুপো সন্দেশ। এই সন্দেশ জনপ্রিয় হলে তা 'গুপ্তিপাড়ার সন্দেশ' বা সংক্ষেপে 'গুপো সন্দেশ' বলে পরিচিতি লাভ করে। অপর মতে অবশ্য সন্দেশটি খাওয়ার সময় গোঁফে লেগে যায় বলে তার নাম হয়েছে গুঁফো সন্দেশ।
এখানে এর একটা অন্য গল্প বলি বরং... ভিতরে ভিতরে একটা চাপা লড়াই চলছিল অনেকদিন থেকেই। বোম্বের ইম্পেরিয়াল মুভিটোন আর কলকাতার ম্যাডানের মধ্যে।
ম্যাডান তখন ভারতে সিনেমার সবচেয়ে বড়ো নাম। আগে অন্য বিলেতি সিনেমা দেখালেও অবশেষে নিজেই সিনেমা বানাচ্ছেন।গড়ের মাঠে তাঁবু খাটিয়ে সিনেমা দেখান না আর। বরং কিনে নিয়েছেন প্রাসাদপম এলফিনস্টোন থিয়েটার। একের পর এক হিট ছবি বানাচ্ছেন তাঁরা। এদিকে হলিউডে সেই ১৯২৮ এই টকি ছবি তৈরি হয়ে গেছে। ভারতেও তাই লড়াই শুরু হল ইতিহাস সৃষ্টির। একদিকে আর্দশির ইরাণী অন্যদিকে ম্যাডান স্টুডিওর অমর চৌধুরী। ইরাণী বেছে নিলেন রাজা রানি নিয়ে এক পৌরাণিক গল্প আর অমর বাবু নিজেই লিখলেন এক স্ল্যাপস্টিক কমেডি-অনেকটা তাঁর পূর্বসূরী ডিজির ধাঁচে। অভিনয়ে নায়ক কুবেরের ভূমিকায় তিনি নিজে, তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় মিস গোলাপ আর শাশুড়ি রাণীসুন্দরী দেবী। গান লিখলেন আর সুর দিলেন ক্ষিরোদগোপাল মুখুজ্জে। কিন্তু একটা মুসকিল হল। ম্যাডান একসাথে পাঁচটি হিন্দি বাংলা টকি রিলিজ করতে চাইলেন, যার মধ্যে বিগ বাজেট হিন্দি সিনেমা শিরিন ফারহাদ ছিল। ফলে ক্রু মেম্বারদের অমরবাবুর সেট থেকে সরিয়ে নেওয়া হত প্রায়ই। ম্যাডানের পরিকল্পনা ছিল শিরিন দিয়েই শুরু হবে ভারতের প্রথম টকি যাত্রা।
এদিনে মুভিটোন ১৯৩১ এর মার্চে সাততাড়াতাড়ি রিলিজ করে দিলেন পৃথ্বীরাজ কাপুর, জুবেদা আর মাস্টার বিঠঠল অভিনীত "আলম আরা"। ভারতের প্রথম টকি। শিরিন ফারহাদ তখনও মাঝপথে। বাজারে টিকে থাকতে মাত্র দুই হপ্তায় অমরবাবুর সিনেমা শেষ করে এপ্রিলেই রিলিজ করে দেওয়া হল। ইতিহাস সৃষ্টি হল। প্রথম বাংলা টকি আলোর মুখ দেখল।
ছবির নাম? ওই, আজকে যে দিন! ‘জামাইষষ্ঠী’...
ছবি – বিল্টু দে
Powered by Froala Editor