বন্দিদের মুক্তি দিয়ে, সাম্যপ্রতিষ্ঠার আনন্দেই শুরু হয়েছিল ঈদ-উল-ফিতর

আজ ঈদ-উল-ফিতর। পরম আনন্দের উৎসব। ‘ঈদ’ কথাটির অর্থই হল আনন্দ। ‘ফিতর’ কথাটি এসেছে ‘ফিতরা’ থেকে। দুঃস্থ এবং দরিদ্রদের কাছে সাধ্যমতো সাহায্য পৌঁছে দেওয়াই হল এই ফিতরা। ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকে এই আনন্দের অংশীদার করে তোলাই আসল উদ্দেশ্য ঈদের। 

কিন্তু এই আনন্দোৎসব ঈদের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে যুদ্ধের কাহিনী। বদরের যুদ্ধ। তবে ঈদের ব্যাপারে প্রচলিত অনেকগুলি কথার মধ্যে এটি একটা। রয়েছে ভিন্নমত-ও। মুসলমান ইতিহাসে এর আগে বেশ কিছু খণ্ডযুদ্ধের কথা উল্লেখিত থাকলেও প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ ছিল এটি। ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরি সালের নবম মাস রমজানে, মদিনার কাছেই বদরে এই যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে প্রফেট মহম্মদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম ধর্মালম্বীদের প্রতিপক্ষ ছিল কুরাইশরা। 

যুদ্ধের কারণ ছিল ইসলামের প্রসারে কুরাইশদের হিংসা। সেই সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল বাণিজ্যিক প্রভাববিস্তার এবং ইসলামী রাজ্যগুলির উপর কাফেরদের শক্তিপ্রতিষ্ঠা করা। বদরের যুদ্ধে আক্রমণকারী অসম শক্তির বিশাল কুরাইশ বাহিনীর বিরুদ্ধে জয় অর্জন করে মুসলমানরা। তবে নিষ্ঠাবান এবং সৎ থাকার জন্যই ঈশ্বর তাঁদের এই অসম যুদ্ধ বিজয়ের শক্তি যুগিয়েছিলেন, এমনটাই বর্ণিত রয়েছে কথায়। এই বিজয় দিবসের উদযাপনেই দ্বিতীয় হিজরি সাল থেকে শুরু হয় পবিত্র ঈদ উৎসব। যুদ্ধের ঠিক ১৩ দিন পর হিজরি বর্ষের দশম মাস শাওয়ালের প্রথম দিন পালিত হয়েছিল ঈদ উৎসব। 

কিন্তু যে-কোনো বিজয় উৎসবই, একটি নির্দিষ্ট দিন মাত্র। সেক্ষেত্রে ঈদের দিকে দেখতে গেলে এই উৎসব প্রতিবছরই এগিয়ে আসে ১০ কিংবা ১১ দিন। গত বছর যেখানে ঈদ পালিত হয়েছিল ৪ জুন, সেখানেই এই বছর ঈদের দিন ২৫ মে। অর্থাৎ দশদিনের তফাৎ। ঈদ কোনো বিজয় উৎসব হলে সেক্ষেত্রে এই নির্দিষ্ট তারিখ না থাকার ঘটনা, সেই গল্পকথার দিকে আঙুল তুলবে, তা তো স্বাভাবিক। তবে এর পিছনে লুকিয়ে আছে অন্য এক বিজ্ঞান, হিসেব এবং যুক্তিবাদ। 

সূচনাকালে আরবেই সীমাবদ্ধ ছিল ঈদ উৎসব। আর আরবে এক সন্ধে থেকে পরবর্তী সন্ধে পর্যন্ত সময়কেই দিন হিসাবে গণ্য করা হয়। সেই সঙ্গে আরবি হিজরি সালের গণনা হয় চাঁদের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। তাই চাঁদ দেখতে পাওয়ার উপরেই নির্ভর করে মাসের দিন সংখ্যা, বছরের দিন সংখ্যা। এই বছর কখনো হয় ৩৫৪ দিনে, কখনো বা ৩৫৫ দিনে। যা প্রচলিত সৌরবছরের থেকে ১০ দিন কম। এই হিজরি বর্ষ মেনেই ঈদ উদযাপিত হয় বলে উৎসবের দিন হিজরি ক্যালেন্ডারে নির্দিষ্ট থাকলেও, সৌরবছরের নিরিখে ১০ কিংবা ১১ দিন এগিয়ে আসে ঈদের তারিখ। 

চন্দ্রপঞ্জিকা মেনে এই উৎসব পালিত হয় বলে, চাঁদের সঙ্গে জুড়ে আছে ঈদ। চাঁদ দেখতে পাওয়া গেলেই রমজান মাসের শেষ হয়। শুরু হয় পরবর্তী শাওয়াল মাসের প্রথম দিন। সেই সঙ্গেই শেষ হয় একমাসের দীর্ঘ উপবাস। এই উপবাসের মাধ্যমে ঈশ্বর অর্থাৎ আল্লাহ’র কাছ থেকে অর্জন করা যায় সহনশীলতা, মানসিক শক্তি। এমনটাই বিশ্বাস করেন ইসলাম ধর্মের অনুগামীরা।

তবে বদরের যুদ্ধক্ষেত্রে দুই প্রতিপক্ষেরই বেশ কিছু সৈনিক প্রাণ হারালেও, যুদ্ধবন্দিদের বিনা আঘাতে মুক্তি দিয়েছিলেন প্রফেট মহম্মদ। শর্ত ছিল সাম্য প্রতিষ্ঠা, সম্প্রীতি, ভালবাসার প্রসার এবং শিক্ষা গ্রহণে উদার হয়ে ওঠা। ঠিক এই কথা মাথায় রেখেই ধনী-দরিদ্র, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া সকলের মধ্যে। ফিতরার প্রচলন-ও হয়তো তাই-ই। এভাবেই যুদ্ধের স্মৃতির মোড়কে থেকেও ঈদ সকলের কাছেই আনন্দের উৎসব। উৎসব সাম্যের, ঐক্যের এবং সম্প্রীতির। তবে ভিন্ন ভিন্ন কথায় ঈদের ইতিহাসের ছবিও পাল্টে যায়।

Powered by Froala Editor