ভারতের একমাত্র কলসপত্রী উদ্ভিদ, ঠিকানা মেঘালয়ের পাহাড়

‘সেপ্টোপাসের খিদে’। সত্যজিৎ রায়ের লেখা এই গল্পটির সঙ্গে কম-বেশি পরিচিত সকলেই। ছোটো পাখি, বন্যপ্রাণী থেকে শুরু করে আস্ত মানুষ— কোনো কিছুকেই উদরস্থ করতে বাদ রাখত না এই বিশেষ মাংসাশী উদ্ভিদ। হ্যাঁ, এমন উদ্ভিদের অস্তিত্ব আছে বাস্তবেও। মূলত কীটপতঙ্গই শিকার করে তারা। তবে ভারতের বুকেই রয়েছে এমন এক বিশেষ গোত্রের মাংসাশী উদ্ভিদ, যা গিলে খায় আস্ত ইঁদুর থেকে পাখি। 

‘নেপেনথেস খাসিয়ানা’। বিজ্ঞানসম্মত নাম থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় এই গাছ আসলে মেঘালয়ের (Meghalaya) বাসিন্দা। খাসি পাহাড়েই তাদের আদি বাস। তাছাড়াও স্থানীয় গারো ও জয়ন্তী ভাষায় যথাক্রমে ‘টিউ-রাকোট’ (রাক্ষুসে গাছ) এবং ‘মেমাং কোকসি’ (শয়তানের ঝুড়ি) নামে পরিচিত এই গাছ। অবশ্য শুধু মেঘালয়ই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে আসামের একাধিক জায়গাতেও সন্ধান মিলেছে এই বিশেষ উদ্ভিদটির।

সাধারণত শিকার ধরার পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে বেশ কয়েক ভাগে ভাগ করা হয় মাংসাশী উদ্ভিদদের। কোনো কোনো প্রজাতি শিকার করে কাঁটাযুক্ত আঠালো পাতার মাধ্যমে, আবার কোনো কোনো প্রজাতির ক্ষেত্রে দেখা যায় দীর্ঘ নলের মতো আকারের ধারণ করে তাদের পাতা। এই দ্বিতীয় গোত্রের মাংসাশী উদ্ভিদরা বাংলা ভাষায় পরিচিত কলসপত্রী (Pitcher Plant) নামে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয় পিচার প্ল্যান্ট। মেঘালয়ের রাক্ষুসে গাছ আসলে এই গোত্রেরই উদ্ভিদ। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে গোটা ভারতের একমাত্র কলসপত্রী উদ্ভিদের প্রজাতি এটিই।

আজ থেকে শ’-দুয়েক বছর আগে পর্যন্তও অনেকে মনে করতেন লাল বর্ণের দীর্ঘ নলাকার এই অংশটি উদ্ভিদ ব্যবহার করে জল সংরক্ষণের জন্য। পরবর্তীতে প্রকাশ্যে আসে এই কলসের আসল রহস্য। সাধারণত এক বিশেষ ধরনের গন্ধ উৎপন্ন করে এই কলস। সেই গন্ধের আকর্ষণেই এই ফাঁদে পা রাখে পোকামাকড়েরা। কখনও কখনও সেখানে হাজির হয় ছোটো পাখি কিংবা ইঁদুরও। একবার এই পিচ্ছিল, আঠালো ‘টিউব’-এর মধ্যে ঢুকে পড়লে আর বেরোনোর সুযোগ পায় না তারা। কলসের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন উৎসেচক ধীরে ধীরে গলিয়ে ফেলে শিকারের রক্ত-মাংসের দেহ। কলসের রন্ধ্রের মাধ্যমে সেই পুষ্টি শোষণ করে গাছ।

প্রাচীন কাল থেকে মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থানীয় উপজাতি গোষ্ঠী এই উদ্ভিদটিকে ব্যবহার করে ঔষধি হিসাবে। চোখের ছানি, রাতকানা রোগ, ডায়াবেটিস, পাকস্থলি ও ত্বকের সমস্যা-সহ বহু রোগের সমাধান হিসাবেই ব্যবহৃত হয় এই উদ্ভিদের নির্যাস। তবে চিকিৎসাক্ষেত্রে বাড়তে থাকা ব্যবহারের কারণে ক্রমাগত অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে ভারতের একমাত্র কলসপত্রী প্রজাতি। বর্তমানে বিপন্নপ্রায় উদ্ভিদ প্রজাতি হিসাবে এই গাছ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসার্ভেশন অফ নেচার-এর ‘রেড লিস্ট’-এর অন্তর্ভুক্ত। ২০২২ সালে বাঘমারা রিজার্ভ ফরেস্টের একটি বিশেষ এলাকাকে কলসপত্রী অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা করেছে মেঘালয় সরকারও। বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিটিকে সংরক্ষণের চেষ্টা চালাচ্ছে শিলং-এর নর্থ ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটির গবেষকরাও। কিন্তু তারপরেও এখনও পর্যন্ত ঠেকানো সম্ভব হয়নি চোরাপাচার। মানুষের এই আগ্রাসনকে পেরিয়ে আদৌ কতদিন টিকে থাকতে পারবে এই প্রজাতি, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

Powered by Froala Editor