চেন্নাই শহরের বেড়ে ওঠা, অত্যাধুনিকতায় উত্তরণ সবই যেন দেখেছে এই সুদীর্ঘ সড়কপথটি। সে এক চলন্ত ইতিহাসের দুর্নিবার গতিময়তার ধারক ও বাহক। তার একটি পোশাকি নামও আছে। আন্না সালাই। ব্রিটিশ সময়ে নাম ছিল মাউন্ট রোড। নানা প্রশাসনিক ভবন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, সাবেক স্থাপত্য ইত্যাদি বহু কিছুর ঠিকানাই তাকে ঘিরে। আন্না সালাইয়ের এক প্রান্তে গড়ে উঠেছিল তৎকালীন মাদ্রাজের সুবৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্র ‘ব্রডওয়ে’। কালের নিয়মে জায়গার বাহ্যিক পরিবর্তন এলেও নাম বদলায়নি। এই ব্রডওয়ের কাছেই একদা একটি বইয়ের ব্যবসা খুলেছিল মিশনারি প্রতিষ্ঠান ওয়েসলিয়ান মেথডিস্ট মিশন। নাম দিয়েছিলেন ‘ওয়েসলিয়ান বুক ডিপোজিটারি’।
সময়টা উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ। যে তিন প্রেসিডেন্সিকে ঘিরে নির্মিত হচ্ছে আধুনিক ভারতের রূপরেখা, তার অন্যতম তখন মাদ্রাজ। সেইসময়েই ঘটনাচক্রে এই শহরে এসে পড়েন এক একুশ বছর বয়সী এক ইংরেজ জাহাজকর্মী। এসে পড়ার ঘটনাটিও বেশ অদ্ভুত। ইংরেজ হলেও সাহেবের জন্ম হয়েছিল কেরালায়। তাঁর বাবা জন ছিলেন ব্রিটিশ আর্মি অফিসার। শৈশবে মাকে হারানোর পর স্কটিশ মিশনারিরাই তাঁকে মানুষ করেন। স্কুল পাশ করার পর জাহাজে কাজ নিয়েছিলেন। কিন্তু সমুদ্রের কঠিন, অনিশ্চিত জীবন খুব বেশি টানেনি তাঁকে। মাদ্রাজ বন্দরে নেমে পালানোর চেষ্টা করলে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। সেই তাঁর প্রথম এই শহরে পা দেওয়া। তবে তাঁর সম্পর্কে যে গল্পটি লোকেমুখে বেশি ঘোরে, তা হল, তিনি বিনা টিকিটে জাহাজে ওঠায় ক্যাপ্টেনের হুকুমে তাঁকে মাদ্রাজে নামিয়ে দেওয়া হয়। যাই হোক, যেভাবেই তিনি এসে থাকুন, এই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগসূত্র গড়ে উঠবে, তা বোধহয় তিনি নিজেও কখনও ভাবতে পারেননি। ওয়েসলিয়ান বুক ডিপোজিটারিতে স্টোর ম্যানেজার হিসাবে নিযুক্ত হয়ে যান। এখানেই বইয়ের প্রতি অসম্ভব ভালবাসা জন্মায় তাঁর। কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন, বই সম্পর্কে ক্রেতাকে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল করে তোলার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে তাঁর। সেনাকর্মীদের কাছে বাইবেল বিতরণ করতেন। এহেন আগন্তুকটির নাম আবেল যোশুয়া হিগিনবোথাম।
তবে তখনও অবধি তাঁর এই আকস্মিক আগমনের নাটকীয় ভবিষ্যতের কথা হয়ত আবেল নিজেও ভাবেননি। এ শহরে তাঁর পা পড়েছিল ১৮৪০ সালে। আর চার বছরের মধ্যেই ব্যবসায়িক ক্ষতির ফলে ওয়েসলিয়ান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। মিশনারিদের কাছ থেকে পুরো ব্যবসাটি কিনে নিলেন আবেল। নাম দিলেন ‘হিগিনবোথাম’স’। জমকালো চিত্রনাট্যের সঠিক বাস্তবায়নে যেভাবে বার বার জন্ম নেয় ইতিহাস, এক্ষেত্রেও তার কোনো অন্যথা হয়নি।
বইকে কীভাবে ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করতে হয়, সে বিষয়ে রীতিমতো তুখোড় ছিলেন আবেল। সঙ্গে ছিল সুনিপুণভাবে ক্রেতাকে বই সম্পর্কে বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। অচিরেই ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করল তাঁর দোকান। তবে ব্যবসার চেয়েও আবেল বরাবর গুরুত্ব দিতেন বইয়ের গুণগত মানের উপর। জন মারে তাঁর ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত ‘গাইডবুক টু দ্য প্রেসিডেন্সিস অফ ম্যাড্রাস অ্যান্ড বম্বে’ বইতে হিগিনবোথামকে উল্লেখ করেছেন ‘প্রিমিয়ার বুকশপ অফ ম্যাড্রাস’ অর্থাৎ মাদ্রাজ শহরের প্রধান বই বিপণি হিসেবে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ থমাস ব্যাবিংটন ম্যাকালেকে (লর্ড ম্যাকালে) তৎকালীন মাদ্রাজের গভর্নর লর্ড ট্রেভেলিয়ানের লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়, বিশ্বের তাবড় সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের বইয়ের ঠিকানা ছিল এই হিগিনবোথাম’স। প্রাচীন যুগের প্লেটো-সক্রেটিস-ইউরিপিদিস-হোরাশে-পেত্রার্ক থেকে শুরু করে আধুনিক হুগো-শ্যিলার-গ্যেটে প্রমুখ দিকপালদের বইয়ে ভরে থাকত দোকানের তাকগুলো। চিঠির শেষে ট্রেভেলিয়ান উল্লেখ করেছিলেন-‘Altogether, a delightful place for a casual browser and a serious book lover.’
প্রথম দিকে কর্মীর অভাবে নিজেই তাক থেকে বই নামিয়ে ক্রেতাকে দেখাতেন আবেল সাহেব। হুগো, শ্যিলার, গ্যেটের বইয়ের সাম্প্রতিকতম সংস্করণ আনাতেন বিলেত থেকে। ১৮৫৯ সালে সুয়েজ খাল খননের ফলে বিলেত থেকে ভারতে আসা আরও সহজতর হল। তিন মাসের সমুদ্র-সফরে কমে দাঁড়াল তিন সপ্তাহে। ভারতের বিভিন্ন বন্দরে তখন বিপুল পরিমাণে নামানো হত বিলাতি জিনিসের বড় বড় বাক্স। মাদ্রাজ বন্দরে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে আরও যে জিনিসটি নামত, সেটি হল বই। রাশি রাশি বইয়ের ক্রেট আসত শুধুমাত্র হিগিনবোথাম’সের জন্য।
সুয়েজ খাল উদ্বোধনের একবছর আগেই ভারতের শাসনভার চলে গেছে ব্রিটিশ সংসদের হাতে। মহারানি ভিক্টোরিয়ার এই ঘোষণাটি ইংরাজি ও তামিল ভাষায় প্রকাশ করে সমগ্র মাদ্রাজ অঞ্চলে বিতরণ করেছিল আবেল সাহেবের কর্মীরা। দোকানের ইতিহাসে সবচেয়ে মোড় ঘোরানো ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮৭৫ সালে। সেসময় ভারত-সফরে এসেছিলেন ভিক্টোরিয়া-পুত্র এডওয়ার্ড, যিনি তখন ওয়েলসের রাজকুমার (পরবর্তীকালে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড)। রাজকুমারের ছিল বই পড়ার শখ। তাঁকে উপযুক্ত বই সরবরাহের ভার দেওয়া হয়েছিল হিগিনবোথাম’সকে। তখন অবশ্য ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়ে দোকানের নাম ‘হিগিনবোথাম অ্যান্ড কোং’। দোকানের জনপ্রিয়তা তো বাড়ছিলই, আবেল সাহেবের উপর প্রশাসনের নেকনজরও এসে পড়েছিল। ১৮৮৮ ও ’৮৯ সালে মাদ্রাজের শেরিফ ছিলেন তিনি।
তাঁর সাধের বিপণি অবশ্য ততদিনে শুধুমাত্র বইয়ের দোকানই নয়, তৈরি হয়েছে তাদের নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা। দোকানে বইয়ের পাশাপাশি ঘর সাজানোর শো-পিসও কিনতে পাওয়া যাচ্ছে ষাটের দশক থেকেই। তাদের প্রকাশনার প্রথম বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ সালে। বইটি ছিল কর্নেল আর্থার রবার্ট কেনি-হার্বার্টের লেখা ‘সুইট ডিশেস: আ লিটল ট্রিটাইজ অন কনফেকশনারি’। কর্নেল অবশ্য বইটি লিখেছিলেন উইভার্ন ছদ্মনামে। মহাবিদ্রোহের পরপরই ১৮৫৯ সালে এদেশে পা রেখেছিলেন কর্নেল। ভারতীয় রান্নার প্রতি তাঁর ভালবাসা জন্মায়, এবং ঠান্ডার দেশের স্বজাতিরা কীভাবে এখানে এসে এখানকার খাবার খেয়ে দিব্যি বেঁচে আছেন, সেই বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখলেন, বহু খাবারই দুই সংস্কৃতির বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে মিশ্র, অনন্য। সেই ভাবনা থেকেই পরবর্তীকালে বহু রান্নার বই লিখেছিলেন।
১৮৯১ সালে মারা যান আবেল। অর্ধশতাব্দীকাল ধরে এই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আবেলের পর দোকানের দায়িত্ব নেন তাঁর ছেলে চার্লস হুবার্ট হিগিনবোথাম। ১৮৯০ থেকে ১৯২০ অবধি মাদ্রাজের কোনেমারা পাবলিক লাইব্রেরিকে এককভাবে বই সরবরাহ করেছে তাঁদের দোকান। এমনকি, খোদ ব্রিটিশ সরকারের জন্যও বই যেত দোকান থেকে। হীরক জয়ন্তী বর্ষে মাউন্ট রোডের বর্তমান ঠিকানায় উঠে আসে হিগিনবোথাম অ্যান্ড কোং। নতুন ভবনটি বিশেষভাবে বইয়ের সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। সুউচ্চ সিলিংয়ের ফলে ভাল হাওয়া চলাচল করবে, ফলে বই সহজে পুরনো হবে না। রাস্তার ধুলোবালি আটকাতে জানলার সংখ্যাও রাখা হয়েছিল বেশ কম। সালটা ১৯০৪। আর তার পরের বছরেই ব্যাঙ্গালোর শহরে খোলা হল হিগিনবোথাম অ্যান্ড কোং-এর প্রথম শাখা। মহাত্মা গান্ধী রোডে অবস্থিত বেঙ্গালুরুর সবচেয়ে পুরনো বইয়ের দোকান এই শাখা-বিপণীটিই।
১৯১২ সালে হিগিনবোথাম অ্যান্ড কোং-এর সঙ্গে গড়ে ওঠে অ্যাসোসিয়েটেড প্রিন্টার্স। ১৯২৪-২৫ সাল নাগাদ জনপ্রিয় মণিহারি দোকান স্পেন্সার্সের মালিক জন ওকশট একসঙ্গে ম্যাড্রাস মেল, হিগিনবোথাম অ্যান্ড কোং ও অ্যাসোসিয়েটেড প্রিন্টার্স কিনে নেন। নাম দেন অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশার্স। একটা সময় প্রায় চারশো কর্মীর অন্নসংস্থান হত এই সংস্থা থেকে। ১৯৩০ সালে প্রয়াত হন চার্লস। স্বাধীনতার পর ১৯৪৯ সালে সমস্ত মালিকানা চলে আসে শিল্পপতি শিবশইলম অনন্তরামকৃষ্ণনের অ্যামালগামেশন্স ইন্ডাস্ট্রিজের হাতে।
আন্না সালাইয়ের একপাশে এলআইসি ভবন। তার ঠিক অপর পাশে প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতশুভ্র বাড়িটি। আকৃতিতে ঠিক যেন কোনো তীর্থস্থান। কালো প্লেটের উপর বড় বড় ব্লকের সাহায্যে লেখা আছে হিগিনবোথাম’স। তার ঠিক নীচেই ‘সিন্স ১৮৪৪’। দু’পাশের দেওয়াল জুড়ে পাবলিশার্স অ্যান্ড প্রিন্টার্স, বুকসেলার্স অ্যান্ড স্টেশনারিজ। কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই যেন শোনা যায় বিশালত্বের দীর্ঘশ্বাস। উঁচু সিলিং, তা থেকে ঝুলে থাকা লম্বা পাখাগুলো, রঙিন কাচের জানলা, ছককাটা মেঝে, কাঠের সিঁড়ি, সমস্তই সেই আগের মতো রয়ে গেছে। এই দোকানের একসময় নিয়মিত খদ্দের ছিলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি, ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, মাদ্রাজ ক্রিশ্চান কলেজের কিংবদন্তি স্কটিশ শিক্ষাবিদ ও মিশনারি রেভারেন্ড ডঃ উইলিয়াম মিলার। কুড়ির দশকে লেবার পার্টি সাংসদ ক্লেমেন্ট অ্যাটলি (পরবর্তীকালে যাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বে ভারত স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করে) ছিলেন হিগিনবোথাম’সের নিয়মিত খরিদ্দার। ষাটের দশকে এই দোকানে পা পড়েছিল রবার্ট পেরির। তিনি তখন ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান। ‘পেরি’জ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হ্যান্ডবুক’ আজও যে-কোনো কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের কাছেই বাইবেল-স্বরূপ। ১৯৩৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল রবার্টের বাবা জনের সম্পাদনায়। পরবর্তী ছ’টি সংস্করণ রবার্টের সম্পাদনায় বেরিয়েছিল। প্রাচ্যের এক প্রাচীন দোকানে নিজের বই দেখে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন মার্কিন সাহেবটি। বইটা হাতে তুলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। সেসব ইতিহাস-ফ্রেস্কো যেন এখনও ধরা আছে দেওয়ালের প্রতিটি কোণায়।
প্রকাশনা আর নেই, বইয়ের সংগ্রহও আর তেমন ঈর্ষণীয় নয়। তবে যেসব বই বহু মানুষের কাজে লাগে, তেমন বই বিক্রির দিকেই বরাবর নজর দিয়েছে এই দোকান। তাই হয়ত বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলেই এখনও ভিড় জমান দোকানে। নিয়মিত আসেন শহরের বিদেশিরাও। এই ইন্টারনেটের যুগেও হিগিনবোথাম’সে ভিড় লেগেই আছে সর্বক্ষণ। বর্তমানের ব্যস্ততার মাঝেও প্রাচীন গরিমাকে ধরে রাখার চেষ্টাটুকু অন্তত অক্ষুণ্ণ রেখে দিয়েছে ভারতের প্রাচীনতম বই বিপণীটি।