দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শুরু হওয়ার মুখে। ভারতের নানা জায়গায় ঘাঁটি গাড়তে শুরু করেছে ইংরেজ সেনাদল। তেমনই একটা ছাউনি তৈরি হয়েছিল উলুবেড়িয়ার (Uluberia) হাসপাতাল মাঠে। যুদ্ধ তখনও শুরু হয়নি, তাই সেনা অফিসাররা বেশ আরামেই ছিলেন। বিকাল হলেই শুরু হত তাঁদের ব্যাডমিন্টন (Badminton) খেলা। সেই খেলা দেখেই নতুন ফন্দি মাথায় এসে গেল স্থানীয় ব্যবসায়ী জ্ঞান বসুর। সাহেবদের জন্য তিনি তৈরি করলেন শাটল কক (Shuttle Cock)। বোতলের ছিপির কক এবং স্থানীয় হাঁসের পালক জুড়েই তৈরি করেছিলেন শাটল কক। আর সেই কক পছন্দ হয়ে গেল সাহেবদেরও। সেই থেকেই ব্যবসার শুরু। আজও সেই ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে উলুবেড়িয়ার শাটল কক শিল্প। সারা দেশে একমাত্র এখানেই হাতে তৈরি শাটল কক তৈরি হয়।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায় মন্দা এসেছে। বিশেষত গত বছরে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছেন হস্তশিল্পীরা। মেশিনে তৈরি শাটল কক দামে সস্তা। গুণমানে একটু পিছিয়ে থাকলেও তার যোগান অনেক বেশি। বিশেষ করে চিনের তৈরি সিন্থেটিক শাটল ককের জন্য তো পাখির পালকের উপরেও নির্ভর করতে হয় না। অন্যদিকে উলুবেড়িয়ার কারখানাগুলির কাঁচামালের একমাত্র উৎস স্থানীয় পুকুরের হাঁস। হাঁসের দল গা ঝাড়ার সঙ্গে পালক খসিয়ে ফেললে তবে সেই পালক সংগ্রহ করে আনা হয়, আর তাই দিয়ে তৈরি হয় শাটল কক। এই প্রতিযোগিতার বাজারেও অলিম্পিকে পিভি সিন্ধুর রুপোজয় আশার আলো দেখাচ্ছে ব্যবসায়ীদের। অনেকেই মনে করছেন, এবার হয়তো সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্পোর্টস ক্লাবগুলি ব্যাডমিন্টনের চর্চায় উৎসাহ দেবে। আর সেইসঙ্গে বাড়বে শাটল ককের চাহিদাও। তখন আবার হারানো বাজার ফিরে পাবেন তাঁরা।
সেই সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, প্রকাশ পাড়ুকন যখন খ্যাতির মধ্যগগনে, তখন পাড়ুকন স্পোর্টসের জন্য শাটল কক যেত একমাত্র উলুবেড়িয়া অঞ্চল থেকেই। দেখতে দেখতে একের পর এক কারখানা গড়ে উঠেছিল বাণীবন, যদুরবেড়িয়া, বাণীতবলা এলাকায়। বছর কুড়ি আগেও অন্তত ২৫০টি কারখানা ছিল এই চত্ত্বরে। সেখানে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। আজ কারখানার সংখ্যা কমতে কমতে ১০-১৫-তে এসে দাঁড়িয়েছে। এর বেশিরভাগটাই যদুরবেড়িয়া গ্রামকে ঘিরে। আর কারখানায় মোট শ্রমিকের সংখ্যাও ৫০০ জনের বেশি নয়। তাঁরাও অনেকে বেশি পারিশ্রমিকের আশায় ভিন্ন জীবিকায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। কেউ আশেপাশের ভারী শিল্পের কারখানায় শ্রমিকের দলে নাম লিখিয়েছেন। তবে অনেকেই এখনও শাটল কক তৈরিকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চান। পাখির পালক সংগ্রহ করা, তাকে পরিষ্কার করে শুকানো, এরপর গুণমান যাচাই করা, ককের গায়ে সেই পালক জুড়ে দেওয়া – গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাঁদের নাড়ির টান। ছোটো থেকেই এই কাজ করে আসছেন।
একমাত্র সরকারি উদ্যোগই এই ক্ষয়িষ্ণু শিল্পকে বাঁচাতে পারে, এমনটাই মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। বছর দশেক আগে রাজ্যের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিভাগের উদ্যোগে শিল্পীদের নিয়ে একটি ক্লাস্টার তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তবে এই ১০ বছরে সেই কাজও একটুও এগোয়নি। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে ক্লাস্টার তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জমি এবং লগ্নির অর্থ পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই কথা মানতে রাজি নন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মতে, জমির অভাব নেই গ্রামে। শাটল কক শিল্পকে বাঁচাতে তাঁরা নিজেদের জমি দিতেও প্রস্তুত। আর যেটুকু অর্থের প্রয়োজন, সেটাও সরকার চাইলেই ব্যবস্থা করতে পারে। এই সময় আবারও আশার আলো হয়ে উঠছেন সেই সিন্ধুই। অলিম্পিকে ভারতের রুপোজয়ের পরেও কি ব্যাডমিন্টনের দিকে নজর দেবে না ক্রীড়া বিভাগ? আর তাহলে তো শাটল ককের প্রয়োজন পড়বেই। এবার হয়তো এতদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার কথা ভাববে সরকার। এখনও এমনটাই আশা করছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন
বৌবাজার, জ্যাভলিন ও এক ধূসর দোকানের গল্প
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
পড়াশোনার সুযোগ পাননি নিজে, পাটুলিতে স্ট্রিট লাইব্রেরি গড়ে ‘স্বপ্নপূরণ’ দোকানির