সাল ১৮৮৮। সুদূর বিলেতে বসে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল। ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’-এর নাম তখন কিংবদন্তিসম; গোটা বিশ্বের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নিজের কাজের জায়গায় বসেই ফ্লোরেন্স শুনলেন এক ভারতীয় বাঙালি তরুণীর কাণ্ডকারখানার কথা। শুনে রীতিমতো তাজ্জব হয়ে গেলেন! ভারত সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ নন তিনি; জানেন সেখানকার মেয়েদের কীভাবে জীবন কাটাতে হয়। তাই অবাক হয়ে গেলেন শুনে যে, এই মেয়ে বিয়ে করে, সন্তান ধারণ করেও ডাক্তারি পড়া চালিয়ে যাচ্ছে! শুধু তাই নয়, একটা লেকচারও মিস করেনি! আজ বাদে কাল এই মেয়েটি ডাক্তারি লাইসেন্সও পেয়ে যাবে! তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল। এক ভারতীয় বন্ধুকে সঙ্গে সঙ্গে চিঠি পাঠিয়ে এর সম্পর্কে জানতে চান। ভারতের তো বটেই, বাংলার ইতিহাসেও এই চিঠিটি একটি দলিল হয়ে থাকবে চিরকাল। আর এর পেছনের মানুষটি? তিনি আর কেউ নন, ডাঃ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়…
তাঁর পরিচয় অনেক ভাবে দেওয়া যায়। যে সালে জন্মেছিলেন, তখন আরও অনেক কৃতী মানুষ জন্মেছিলেন। ১৮৬১ সালকে মানুষ মনে রেখেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকারের জন্মসাল হিসেবে। সেই একই বছরেই জন্মেছিলেন কাদম্বিনী। ডাক্তার হিসেবে একের পর এক শিখর অতিক্রম তো করেছেনই। নারীশিক্ষা ও নারী অগ্রগতির অন্যতম পুরোধা ছিলেন তিনি। বিপদ কি ছিল না তাঁর? তবে একটা কথা আছে না, সমস্ত সফল পুরুষের পেছনে একজন নারী আছে। এখানে ব্যাপারটা একটু ঘুরে গেছে। কাদম্বিনীর এমন দুর্দম সাহসের পেছনে মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনজন পুরুষ। বাড়ি এবং সমাজে পরিস্থিতি যতই ঘোরালো থাক; পাশে থেকেছেন বাবা এবং পিসতুতো দাদা। আর পরবর্তীতে শিক্ষক তথা স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় তো ছিলেন সহযোদ্ধা। সমাজের বহু তিরস্কার, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অত্যাচার সহ্য করেছেন; কিন্তু দিনের শেষে জয়ী হয়েছেন তাঁরাই। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের দরজাটা মেয়েদের জন্য খুলে দিয়েছিলেন তিনি। শুধু মেডিক্যাল কলেজ কেন; দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রেই এটা একটা বড়ো পদক্ষেপ।
ডাক্তারির আগেও একটা বড়ো মুহূর্ত ঘটে গিয়েছিল। ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’-তে পড়াশোনা শুরু হয় কাদম্বিনীর। তিন বছর পর অবশ্য বিদ্যালয়ের নাম বদলে হয়ে যায় ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’। তারও বছর দুয়েক পর বেথুন স্কুলের সঙ্গে এটি জুড়ে যায়। এই স্কুল থেকেই কাদম্বিনী এন্ট্রান্স পাশ করেছিলেন। তাঁর এমন কৃতিত্বের খবর পৌঁছে গিয়েছিল খোদ লর্ড লিটনের কাছে। লেডি লিটনের কাছ থেকে পুরস্কারও নেন তিনি। অন্যদিকে এন্ট্রান্সে সফল হয়ে বসেছিলেন চন্দ্রমুখী বসুও। মূলত এই দুজনের জন্যই বেথুন স্কুল পরিবর্তিত হল বেথুন কলেজে। এর আগে এমন ঘটনা বাংলায় ঘটেনি। সমাজে শোরগোল পড়ে যায়। ১৮৮৩ সালে যখন চন্দ্রমুখী পলিটিকাল ইকোনমিক আর কাদম্বিনী অঙ্কে স্নাতক পাশ করলেন; বাংলা তো বটেই গোটা দেশে আলোড়ন পড়ে গেল। ভারতের প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েট বলে কথা! কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কাদম্বিনী-চন্দ্রমুখীকে নিয়ে লিখে ফেললেন আস্ত একটি কবিতাও। সেদিন বেথুন কলেজের ক্যাম্পাস চত্বরে তাঁদের দেখতে এত ভিড় হয়েছিল যে পুলিশকে লাঠিপেটা করতে হয়েছিল!
যেমন মনোযোগী ছিলেন পড়াশোনায়, তেমনই নিষ্ঠা ছিল চিকিৎসায়। সেরকম ছিল পেশাদারিত্ব। বাড়িতে আট সন্তান, এখনও মা’কে চিনতেও শেখেনি ছোটোটি। তারই মধ্যে একা একাই বিলেতে রওয়ানা হয়ে গেলেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। সঙ্গী বলতে ছিলেন এক সাহেবিনী। মোট তিন মাসে তিনটে ডাক্তারি ডিপ্লোমা অর্জন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। তারপর ফিরে আসেন দেশে। অদ্ভুত ব্যাপার, ফেরার পর নিজের ছোটো ছেলে চিনতেই পারেনি তাঁকে। দুঃখ হয়েছিল কাদম্বিনীর; কিন্তু পরক্ষণে সেই দুঃখ ভুলে কাজে নেমে পড়েছিলেন। জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণা খুবই স্পষ্ট ছিল তাঁর।
কাদম্বিনী যে কি অসামান্য ও দক্ষ চিকিৎসক ছিলেন, সেই সময়ের বেশ কিছু বর্ণনায় তাঁর প্রমাণ মেলে। যে হাতে তিনি নিখুঁত অপারেশন করছেন, সেই হাতেই একের পর এক লেস বুনে চলেছেন। হ্যাঁ, এটাও তাঁর অন্যতম একটা শখের জায়গা ছিল বটে। রোগীর বাড়ি যাওয়ার সময় ফাঁক পেলেই ডুবে যেতেন দুই কাঠি আর উলের মাঝখানে। তারপর কখন যে মনটা আবার চলে আসত ঠিক জায়গায়! আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করা দরকার। ২৭ জুন, ১৮৯৮। স্বামী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় মারা গেছেন সকালে। বিকেলে একটি জমিদার বাড়িতে প্রসব করাতে গেছেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। সবাই তো অবাক! কোথায় শোক করবে, তা না! এমনই ছিল পেশাদারিত্ব। কংগ্রেসের অধিবেশন হোক, ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনা হোক, রোগীর চিকিৎসা হোক বা সন্তানদের মানুষ করা হোক— সব কিছুতে নিয়ম আর স্নেহের বাঁধন আলগা হতে দেননি কখনও। এমনকি মৃত্যুর দিনও নিয়ম করে রোগী দেখে এসেছেন…
তথ্যসূত্র-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা- ‘টাট্টু ঘোড়ার গাড়িতে চেপে ‘কল’-এ যেতেন’
২) গুরুচণ্ডালী- ‘একজন প্রবল ব্যতিক্রমী নারী- ডক্টর কাদম্বিনী গাঙ্গুলি’
আরও পড়ুন
মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধে প্রথম স্থানে দিল্লি, জানাচ্ছে এনসিআরবি-র রিপোর্ট
Powered by Froala Editor