দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ভ্রাম্যমাণ কবিতা উৎসব, সাক্ষী রইল দিল্লি-কলকাতা

১৯৪৭। দেশভাগ। ট্র্যাজেডি ও মেরুকরণের সূত্রে এলোমেলো হয়ে গেল ভারতবর্ষের বেশ-কয়েকটি জাতির আংশিক ভবিষ্যৎ। ভিটে ছেড়ে আসা ও চেয়েও ফিরতে না-পারার বেদনায় আছন্ন দিনকাল। ৭৫ বছর পর, সেই ঘটনা কি জাতির জীবনে আদৌ প্রাসঙ্গিক? সারা বিশ্বে যত বাস্তুহারা মানুষ, সবার বেদনার ইতিহাস কি একই?

মৌলিক এই প্রশ্নগুলোর ওপরেই তখন আলো ফেলছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব, বর্তমানে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট লেখক ও আলোচক আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্ধমান-জাতক আলাপনের কলকাতায় অবস্থিতি ও ভিটে-বিচ্যুতির উদাহরণ টেনে বুঝিয়ে দিচ্ছেন উদ্বাস্তুর সঙ্গে সে-ঘটনার ফারাকটুকু। ‘অথচ আমি আজ চাইলেই বর্ধমানে গিয়ে নিজের ভিটে দেখে আসতে পারি। আমার সে-সুযোগ রয়েছে। যে মানুষ চিরতরে বাড়িঘর ছেড়ে এলেন দেশভাগের সময়, রাষ্ট্র ও রাজনীতি যাঁর প্রত্যাবর্তনে বাধা হয়ে দাঁড়াল, আমরা বর্তমানে দাঁড়িয়ে আদৌ সে-ব্যথা ছুঁতে পারি কি?’

আলাপনের সূত্র ধরেই অভীক চন্দ তখন বলে চলেছেন ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি। পাকিস্তানের যে-সমস্ত মানুষ দেশভাগ চাননি, তাঁদের চেতনাও কি দেশভাগ-চর্চার অন্যতম উপকরণ নয়? শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃজনীর অধ্যাপক লিনা ফেরেরা ক্যাবেজা ভেনেগাস এবং ফরাসি ভাষার অধ্যাপক অ্যালিসন জেমসের কথায় উঠে আসে হলোকাস্ট-প্রসঙ্গ, কলোম্বিয়ার গৃহযুদ্ধ ও অন্যান্য বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন ট্র্যাজেডির আলোকে বাংলাভাগ ফিরে দেখা— নতুন কিছু প্রশ্ন উসকে দিল ‘ক্যান্টো’র মঞ্চ।

তেমনটাই তো চেয়েছিলেন এই উৎসবের আয়োজকরা! ‘ক্যান্টো’ কবিতা উৎসবের ডিরেক্টর ও বিশিষ্ট লেখক অভীক চন্দ জানান, “শুধুমাত্র কবিতাকে কেন্দ্র করে এই বহুভাষিক, বহুসাংস্কৃতিক, ভ্রাম্যমাণ উৎসব। ভারত তো বটেই, এ-ধরনের ভ্রাম্যমাণ আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবের আয়োজন এশিয়াতেও এই প্রথম। ভাষা, সংস্কৃতি, বর্ণ ও লিঙ্গ-যৌনতার পরিধি ভেঙে কবিতাচর্চা ও কবিতা-সৃষ্টির অনন্য পরিবেশ গড়ে তোলাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। এই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল গত আড়াই বছর ধরেই।” সঙ্গী শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, হারপার কলিনস প্রকাশনা সংস্থা, আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়-সহ একাধিক প্রতিষ্ঠান। জুড়ে ছিলাম আমরা, প্রহর.ইন-ও। 

১৫ ও ১৬ তারিখ এই উৎসবের প্রথম পর্ব আয়োজিত হয় নয়া দিল্লির ‘ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো সেন্টার’-এ। ১৮ ও ১৯ মার্চ, ‘ক্যান্টো’-র দ্বিতীয় পর্বের সাক্ষী থাকে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বেঙ্গল ক্লাব। উৎসবের প্রথম পর্বে নয়া দিল্লিতে হাজির ছিলেন ম্যানবুকার পুরস্কারজয়ী কবি জর্জ সির্টেজ, পুলিৎজার-জয়ী বিজয় শেষাদ্রি, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্ত জিত থাইল, অনিতা নায়ার, অরুন্ধতী সুব্রামনিয়ম, দান্তে পদক-প্রাপ্ত মালয়ালি কবি কে. সচ্চিদানন্দন, অখিল কাত্যাল, অদিতি আঙ্গিরাস, বিবেক দেবরায় প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা। দ্বিতীয় অধ্যায়ে, কলকাতা সাক্ষী রইল আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, কমনওয়েলথ পুরস্কার-জয়ী কবি ও লেখক অমিত চৌধুরী, বিবেক নারায়ণন, রোহন ছেত্রী, সৌরদীপ রায়, ফরোয়ার্ড পুরস্কার-জয়ী তিশানি দোশি, সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার-প্রাপ্ত জয় গোস্বামী, রোজানা ওয়ারেন, অভীক মজুমদার, দেবাশিস লাহিড়ী, কিংবদন্তি ভারতবিদ ওয়েন্ডি ডনিগার এবং ফরোয়ার্ড পুরস্কার-জয়ী কবি দলজিৎ নাগরা সহ আরও অনেকের। 

কলকাতা-পর্বের প্রথম দিন অর্থাৎ ১৮ মার্চ ‘থেশহোল্ডস’ শীর্ষক আলোচনায়, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি ও সম্পাদক শ্রীকান্ত রেড্ডির সঙ্গে কথোপকথনে অমিত চৌধুরী তুলে আনেন কলকাতা ও ভারতের স্মৃতি, গন্ধ, কোলাহল, সুর ও যাপনের কথা। উঠে আসে কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন মিষ্টির দোকানদের আশ্চর্য কাহিনি, সে-সব দোকানের দেওয়ালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কিংবা বিদ্যাসাগরের সঙ্গে অনায়াসেই জায়গা করে নেন দোকানগুলির প্রতিষ্ঠাতারা। এই বিষয় নিয়ে লেখা তাঁর কবিতার বই ‘সুইট শপ’-এর কথাও উঠে আসে প্রসঙ্গক্রমে।

দ্বিতীয় দিন ‘আফটার ডেথ কামস ওয়াটার’ শীর্ষক অধিবেশনে জয় গোস্বামীর সঙ্গে কথোপকথনে অংশ নেন তাঁরই দুটি কবিতা সংকলনের অনুবাদক সম্পূর্ণা চট্টোপাধ্যায়। সমান্তরালভাবে চলতে থাকে জয়ের লেখা মৌলিক কবিতা এবং তার ইংরাজি অনুবাদের পাঠ। এ যেন একই নদীর দুই প্রান্তের মধ্যে সেতুবন্ধন। জয়ের কথায়, তাঁর কবিতার অনুবাদের পিছনে সম্পূর্ণার প্রায় পনেরো বছরের পরিশ্রম লুকিয়ে। বেশ কিছু কবিতাপাঠের পর আলোচনায় উঠে আসে অনুবাদের গুণগত মানের প্রসঙ্গও। অনুবাদের সময় কীভাবে অক্ষত রাখা যায় কোনো কবিতার মূল অর্থ এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট? এই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলে দর্শনে, কথনে। 

১৯ মার্চ ‘ইন্টারনাল অ্যান্ড এক্সটারনাল ক্রাইসিস অফ পোয়েট্রি’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন খ্যাতনামা বাঙালি কবি অভীক মজুমদার। সঙ্গে ছিলেন দেবাশিস লাহিড়ী এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কবি রোজানা ওয়ারেন। কবির চেতনা এবং সৃষ্টির মধ্যে চলতে থাকা ক্রমাগত দ্বন্দ্বের কথা উঠে আসে আলোচনায়। বেশ কিছু কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়েই কবিতার বহুস্তরীয় এই সংকটকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন অভীক। আলোচনা এবং পাঠ বুঝিয়ে দেয় আপাতদৃষ্টিতে এই সংকট কবিতার বিষয়, চরিত্র কিংবা কবির বেদনা, সচেতন বা অবচেতন চিন্তাধারা মনে হলেও, তা আসলে সমসাময়িক ঘটনা ও পরিস্থিতিরই প্রতিফলন। 

এই দিনের শেষ আলোচনার বিষয় ছিল মহাভারত এবং তার দর্শন। ‘আফটার দ্য ওয়ার : দ্য লাস্ট বুকস অফ মহাভারত’ শীর্ষক এই আলোচনায় বক্তার আসনে ছিলেন বিশিষ্ট ভারতবিদ এবং সাহিত্যিক ওয়েন্ডি ডনিগার। সঞ্চালকের ভূমিকায় স্বয়ং উৎসব-পরিচালক অভীক চন্দ। গঙ্গা-যমুনা-সিন্ধুর দেশে মহাভারত কীভাবে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দর্শন, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার ছবি ফুটিয়ে তুলেছে— কবিতা এবং বক্তব্যের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠা করেন ওয়েন্ডি ডনিগার। তাছাড়াও ‘কলকাতা পর্ব’-এর দ্বিতীয় দিনের অন্যান্য আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন কবি দলজিৎ নাগরা, কাজিম আলি এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি দল। 

তবে শুধুমাত্র কবিতাপাঠ কিংবা কবিতা সংক্রান্ত আলোচনাই নয়, পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কবিতাচর্চা এবং সৃজনশীলতার বীজ বপন করল ‘ক্যান্টো’। ‘ক্যান্টো’-র মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে সমান্তরালভাবে কলকাতার যাদবপুর এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত হয়েছিল সৃজনশীল সাহিত্যরচনার বিশেষ কর্মশালা। তত্ত্বাবধানে শ্রীকান্ত রেড্ডি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, খ্যাতনামা কবি ও সম্পাদক জন উইলকিনসন। একইভাবে দিল্লিতেও মিরান্ডা হাউস কলেজের অধ্যাপক ও লেখক অ্যালিসন জেমসের পরিচালনায় আয়োজিত হয়েছিল সৃজনী-কর্মশালা। 

তবে মূল সুর বোধহয় বাঁধা হয়ে গিয়েছিল দেশভাগ-বিষয়ক আলোচনাচক্রটিতেই। যেখানে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলাভাগের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল, কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা রাষ্ট্রনায়ককে প্রত্যক্ষভাবে তার জন্য দায়ী করা মুশকিল। এখানেই বিশ্বের অন্যান্য ট্র্যাজেডির সঙ্গে পৃথক বেদনা-কথন নিয়ে হাজির হয় ইতিহাসের এই অধ্যায়।’

সবমিলিয়ে দেখতে গেলে, নতুন করে কবিতা উদযাপনের এক মেহফিল গড়ে তুলেছে চারদিনের এই অনুষ্ঠান। কবিতাচর্চার বাস্তুতন্ত্রও কি নয়? কলকাতা তো বটেই, যে-কোনো কবিতাপ্রেমী ভারতবাসীর কাছেই এ এক বড়ো প্রাপ্তি। এ এক নতুন শুরুর প্রাথমিক পদক্ষেপও বটে। আগামীদিনে পৃথকভাবে প্রতিটি আলোচনা ও কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কবিতা আগ্রহীদের কাছে পৌঁছে দেবেন ‘ক্যান্টো’-র আয়োজকরা। আমাদের মননে, চিন্তনে কতটা প্রভাব রাখার পথে এগোচ্ছে এই আয়োজন, তা ডিরেক্টর অভীক চন্দের এই ঘোষণা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়।

Powered by Froala Editor