গতবছর কেরালা বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন অনন্যা কুমারী অ্যালেক্স। তবে নির্বাচন শেষ হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। রূপান্তরকামী প্রার্থী অনন্যা কুমারীর মৃত্যুকে প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা বলেও অভিযোগ তুলেছিলেন অনেকে। এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, একুশ শতকের তৃতীয় দশকেও রূপান্তরকামী মানুষদের সম্পর্কে সমাজ ঠিক কেমন ধারণা পোষন করে। তবে ভাবতে আশ্চর্য লাগে, ২৪ বছর আগেই ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে সাফল্য ছিনিয়ে এনেছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের এক মানুষ। শুধু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নয়, ৫ বছর বিধায়কের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি। এমনকি তাঁর অনুপ্রেরণায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের একটি রাজনৈতিক দলও গড়ে উঠেছিল। তিনি শবনম মাওসি বানো (Shabnam Mausi)।
মধ্যপ্রদেশের একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম শবনম মাওসির। তাঁর জন্মের পরেই বোঝা গিয়েছিল, তিনি পুরুষ বা মহিলা নন। তিনি একজন ইন্টারসেক্স। অর্থাৎ যাঁর শরীরে পুরুষ এবং নারী উভয় লিঙ্গের বৈশিষ্ট্যই উপস্থিত। অবশ্য শবনমের পরিবার প্রথমে এই কথা বুঝতে পারেননি। তাঁরা তাঁকে পুত্র সন্তান বলেই গ্রহণ করেছিলেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই পরিবারের রীতি মেনে নবজাতককে আশীর্বাদ করতে ডাকা হয় ‘হিজড়া’ অর্থাৎ রূপান্তরকামী মানুষদের। তাঁরাই সেই শিশুর পরিচয় বুঝতে পারেন এবং তাঁর পরিবারকে জানান।
পরিবারের সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করতে সঙ্গে সঙ্গে নবজাতককে ত্যাগ করেন তাঁর পরিবার। সেই থেকে রূপান্তরকামীদের মধ্যেই বেড়ে ওঠা শবনমের। তাঁর নামকরণও করেছিলেন তাঁরাই। কিছুদিন একটি সরকারি স্কুলেও ভর্তি হয়েছিলেন শবনম। তবে বছর দুয়েকের মধ্যেই স্কুল ছেড়ে দেন। অবশ্য রূপান্তরকামী শিকড়হীন মানুষদের সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে অন্তত ১২টি ভাষা রপ্ত করে ফেলেছিলেন তিনি। আর ছোটো থেকেই ভাবতেন, অন্যান্য নাগরিকদের মতোই তাঁদেরও সমান অধিকারের দাবি আছে। এবং সেই দাবি ছিনিয়ে নিতে হবে।
১৯৯৪ সালে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ভোটাধিকারের আইন পাশ হয়। একইসঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকারও পান তাঁরা। তবে সেই অধিকার বাস্তবায়িত হতে লেগে যায় আরও ৪ বছর। ১৯৯৮ সালে মধ্যপ্রদেশের সোহাগপুর বিধানসভা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন শবনম বানো। গ্রামেগঞ্জে অবশ্য তিনি শবনম মাওসি নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তার কাছে অন্য কোনো প্রার্থীই দাঁড়াতে পারেননি। তথাকথিত কোনো বড়ো রাজনৈতিক দলের ব্যানার ছাড়াই বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হলেন শবনম মাওসি।
আরও পড়ুন
এই প্রথম, রাজ্যের লিগাল সার্ভিস অথোরিটির প্যানেলে তৃতীয় লিঙ্গের আইনজীবী
২০০৩ সাল পর্যন্ত বিধায়কের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন শবনম। নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকেই তিনি তাঁর কর্মসূচিতে জুড়ে নিয়েছিলেন এইডস সচেতনতা এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকারের বিষয়গুলিও। প্রশাসনিকভাবে হয়তো এই বিষয়ে তেমন সাফল্য পাননি শবনম। কিন্তু সামাজিকভাবে তাঁর সাফল্য প্রমাণিত হয় ২০০৩ সালেই। সেই বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগেই আত্মপ্রকাশ করে নতুন রাজনৈতিক দল ‘জিতি জিতাই পলিটিক্স’। অর্থাৎ রাজনীতিতে প্রবেশের ভিতর দিয়েই তাঁরা রাজনীতিকে জয় করেছেন। সত্যিই তাই। কারণ সম্পূর্ণ দলটি তৈরি হয়েছিল তৃতীয় লিঙ্গের, বিশেষত রূপান্তরকামী মানুষদের নিয়ে। সামাজিকভাবে তো বটেই, প্রশাসনিকভাবেও যাঁদের তখনও ‘হিজড়া’ বলে ডাকা হত।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের এই পোশাক কারখানা চালাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাই
শবনম মওসিকে নিয়ে বলিউডে একটি সিনেমাও তৈরি হয়েছে। তাঁর জীবনের উপর নির্মিত তথ্যচিত্র নেদারল্যান্ডের ট্রান্সজেন্ডার ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়েছে। অবশ্য সংসদীয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে তাঁকেও। বরং এখন সামাজিকভাবে রূপান্তরকামী মানুষদের লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন শবনম। ভাবতে অবাক লাগে, তারপর ২৪ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। সংসদীয় রাজনীতিতে তবুও নিজেদের অধিকার পেলেন না তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা।
আরও পড়ুন
ভিক্ষুক-জীবন থেকে চিত্র-সাংবাদিকতা – রূপকথার উত্থান তৃতীয় লিঙ্গের যোয়ার
Powered by Froala Editor